যদি তুমি জানতে

যদি তুমি জানতে !! Part- 03

সাঈদ ভাইয়া কাছে এসে ঠাসসস করে এক থাপ্পড় গালে বসিয়ে দিলেন। উনি এতো জোরে দিলেন যে আমার ডান গালের ভেতরের নরম চামড়া দাতের সাথে লেগে কেটে গিয়েছে। আমাকে এভাবে থাপ্পড় দিতে দেখে খালামনি টান মেরে আমাকে আগলে নিলেন। আর সাঈদ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
-তোর এতো সাহস কে দিলো আমার মেয়ের উপর হাত তুললি! আজ পযর্ন্ত আমি ওর উপর টোকা দিতে দেইনি সে জায়গায় তুই আমার সামনে ওকে এভাবে মারলি!
-আম্মু তোমার এই মেয়েকে বলে দিও আমার কোনো ফ্রেন্ডের সামনে সে যেন না আসে!
-ও একশো একবার আসবে।ওর বাড়ি! তোর কি! ভুলবি না আমি এ বাড়ির মালিক। আমার সামনে তুই যে ওর উপর হাত তুললি এর খেসারত তোর অবশ্যই হবে। আজ তোর কোনো খাবার দিবনা। খালি পেটে থাকবি তুই! কোনোরকম বাইরে যাবি না।আর যদি না কথা শুনিস। বাকিটা ইতিহাস তুই বুঝবি!

সাঈদ ভাইয়া পাল্টা আরেকটা কথাও বললেন না। খালামনির এমন কড়াকড়ি শাস্তি শুনে উনি পা ঘুরিয়ে সোজা রুমে চলে গেলেন। খালামনি আমাকে আর আপুকে নিয়ে নিচে ডাইনিং টেবিলে গেলেন। খালামনি আমাদের দুজনের প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেও একটা প্লেট আপুকে দিয়ে খালামনি আমাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আর আপু ব্যাপারটা বারবার আড়চোখে দেখছেন। আমার যতটুকু ধারনা আপু হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছেন। তাতে আমার কি। আমিতো আর খালামনিকে বলিনি আমাকে খাইয়ে দিতে।

বামপাশে খাবার ঠেলে কোনোরকমে পানি দিয়ে গিলে খাচ্ছি। ডানপাশে খাবার আসলেই বিপদ! এমন ভাবে খাচ্ছি যেন ব্যাথা কম লাগে আর খালামনিও না বুঝে। যদি খালামনি ব্যাপারটা খেয়াল করে তাহলে ওই সাঈদ ভাইয়ার আজকে বিরাট খবর আছে!
.
.

খাওয়া শেষ করে আপু ভার্সিটিতে চলে গেলেন। আজকে নাকি ইর্ম্পটেন্ট লেকচার আছে। ওটা এটেন্ড করতে হবে।
আমাকে খাইয়ে দিয়ে খালামনি রান্না ঘর থেকে এক বয়াম ভর্তি আমের আচার খেতে দিয়ে বললেন-
-নে ফিহা তোর জন্য আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। খেয়ে বলিস কেমন হয়েছে!! তোর মা যে কেমন মানুষ তা আমার জানা আছে। আচার করতে কষ্ট বিধায় তোকে তো মুখ পুড়ে পুড়ে খেতেও দেয়না। এজন্য আমি বানিয়ে রেখেছি। তুই আসলে দিব বলে।
-আরে খালামনি তুমি বানিয়েছো না, অবশ্যই ভালো হবে। আম্মু বলতো নানুবাসায় নাকি সবাই তোমার আচারের পাগল। আর এখন তো এক বয়াম পেয়েছি!! ইচ্ছেমতো জমিয়ে খাব।।
খালামনি আমার কথা শুনে মুচকি হেসে দিয়ে বললেন-
-যা ছাদে বসে বসে খা। ভালো লাগবে।মাদুর রাখা আছে। আর সাবধান, ওই বদমাইশের সামনে যাবিনা। আজ তোর খালু আসুক দেখ কি করি।
-খালামনি আর বলো না, আমার এখনো রাগ উঠছে!! শুধুশুধু থাপ্পড় মারলো। কিছুই করিনি তারপরও।
-তোর কি অনেক বেশি লেগেছে?
-না না ঠিক আছি খালামনি। আমি ছাদে গেলাম।

.
.

ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসলাম। মাথার উপর সূর্য। তবে সূর্যের প্রখরতা তেমন না। বাতাসের শো শো শব্দে ঠান্ডা পরিবেশ লাগছে। বয়াম খুলে একটা পিস মুখ পুড়ে নিলাম। যেই না কামড় দিলাম ওমনেই ছ্যাত করে উঠল। সাথেসাথে আমের পিস টা মুখ থেকে ফেলে দিলাম। আচারের মসলা সোজা গিয়ে ডানে পাশে লেগেছে যেপাশে সাঈদ ভাইয়া থাপ্পড় দিয়ে কেটে দিয়েছিল। আগুনের মতো জলছে। দৌড়ে নিচে নেমে গিয়ে সোজা রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে গেলাম। পানি নিয়ে কয়েকবার কুলি করতেই দেখি রক্ত পড়ছে। আরও কয়েকবার কুলি করতে লাগলাম। আস্তে আস্তে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ইশশ!আমার স্বাদের আচার। শান্তিমতো খেতেও পারছিনা।বাসায় থাকলে আম্মু খেতে দেয়না আর এখানে এক বয়াম থাকা সত্ত্বেও খেতে পারছিনা। কি এক জালা!সব ওই সাঈদ ভাইয়ের দোষ!

ছাদ থেকে বয়াম এনে, রুমে বসে একটু একটু করে খাচ্ছি। বাম পাশে রেখে। হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ আসার শব্দ হলো। উঠে টেবিল থেকে ফোন নিয়ে দেখি একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, ঠিক এরকম- “ভালো হয়ে যাও। সময় আছে এখনো। বাসায় ফিরে যাও।নয়তো আবার আসবো”।।
পড়া শেষ করতেই ধুপ করে হাত থেকে ফোন পড়ে গেল। আবারও সেই অজানা ভয়। তার মানে সে আমাকে ফিরে যাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। কাল রাতে যা হলো তা এখনো খালামনিকে জানানো হয়নি। আশ্চর্যজনক হলো, এখানে আসার পরও এমন হচ্ছে। কেউ একজন আমার উপর ভীষণ নজর রাখছে। এমন একজন করছে যে কিনা আমাকে ভালোভাবে চিনে। ধ্যাত!
সেসব কথা বাদ আগে খালামনিকে জানাতে হবে কাল রাতের ঘটনা!!

.
.

খালামনির রুমে যাবো ওমনেই দেখি সাঈদ ভাইয়ের রুম থেকে ফাহিম নামের ছেলেটি বের হচ্ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে সে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি পিছু পিছু সিড়ি দিয়ে নেমে খালামনির রুমে ঢুকতেই খালামনি বলে উঠলেন-
-ফিহা একটু মেইন দরজাটা লাগিয়ে দিসতো। ফাহিম চলে যাচ্ছে।

খালামনির কথানুযায়ী আমি গেট আটকাতে যাই। গেট আটকে দিয়ে আসতে নিলে কেউ দরজায় টোকা দিল। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি কেউ নেই। আবার আটকে দিয়ে আসতে নিলে আবারও কেউ দরজায় জোরে টোকা দিল। আমি এবার বেরিয়ে ভালোভাবে চেক করতে থাকি, কেউ আশেপাশে আছে কিনা। কিন্তু না, কেউ নেই। এই সময় কে এমন ফাজলামি করবে!! আজব কারবার। চলে আসতে নিলে চোখ পড়ল এক বিড়ালের দিকে। সাদা বিড়াল। খুব সুন্দর। নীল নীল চোখ। বিড়ালের গলায় কি যেন বাধা। আমি একটু সামনে এগিয়ে বিড়ালটাকে ধরলাম। বিড়ালটা কোনো ভয় পেলনা। বরং আমার হাতে তার নরম গা ঘষতে লাগল।
বলে রাখি আমার বিড়ার, কুকুর খুব পছন্দ। ওরা বোবা প্রাণি কিন্তু পোষ মানলে ওরা নিজের জান বিলিয়ে তাদের মনিবকে রক্ষা করতে দ্বিধাবোধ করবেনা।
নরম তুলতুলে ওমন কিউট বিড়ালের গলায় একটা রশি দিয়ে ছোট একটা কাগজ বাধা। আমি তার গলা থেকে রশি খুলে কাগজটা নিয়ে তাকে নিচে রাখলাম। নিচে রাখতেই বিড়ালটা দৌড়ে পালাল। যেন কেউ ওকে ধাওয়া করেছে। তাকে উপেক্ষা করে কাগজের ভাজ খুললাম।
তাতে কিছু লিখা ছিল – “সময় থাকতে ভালো হও। নাহলে আমি আসবো। শেষ করবো তোমাকে। যেখানেই থাকো “।

তারমানে চিরকুটটা ওই একই ব্যাক্তি পাঠিয়েছে। কিন্তু, কি সে করে এতো ভালোভাবে নজর রাখছে? একটু আগে ফাহিম ছেলেটা বেরিয়েছে। তাহলে কি ওই এই কাজ করছে? করতেও পারে। কারন, সকাল ছেলেটা ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। গায়ে লাগতে এসেছে। হতে পারে ওই সেই ব্যক্তি !!

.
.

খালামনিকে কালরাতের ব্যাপারে কিছু জানালাম না। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলছি, রুমে যাব বলে। মাথায় একটা চিন্তা- কেনো করছে, কি জন্য করবে, কারন কী এসব করার।। সিড়িতে আরেক পা রাখব ওমনেই সাঈদ ভাইয়ার ছয়ফুট তালগাছ টাইপের বডির সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনো কারনে মনে হলো আমি নিচে পড়ে যাইনি। চোখ খুলে দেখি সাঈদ ভাইয়া আমার ডান হাত ধরে রেখেছেন। উনি হাত ছেড়ে দিলে এমন পড়া পড়ব যে একমাস বেডে শুয়ে থাকতে হবে। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আকুতি করে বললাম-

-সাঈদ ভাইয়া হাত দিও না প্লিজ। আমি পড়ে যাব। এমনেই তুমি যেই থাপ্পড় দিছো এখনো চরম ব্যাথা হয়ে আছে। হাত ছেড়ে দিও না ভাই প্লিজ প্লিজ।।।
-তোর জন্য মা আমাকে এখনো খেতে দেয়নি। আর তুই এক্সপেক্ট করছিস আমি তোকে ছাড়বনা। নো ওয়ে। ছেড়ে দিচ্ছি।

সাঈদ ভাইয়ার কথা শুনে অনেক খারাপ লাগছে। ভাইয়া সবসময় আমার সাথে এমন করেন। শুধু শুধু আমাকে কষ্ট দেন। আমি কি খালামনিকে ইচ্ছে করে বলছি নাকি সাঈদ ভাইয়াকে খাবার দিও না!.. নাকি আমি কোনো ভুল করছি! উনি সবার সাথে ভালো হলেও আমার সাথে সবসময় দ্বিগুন রাগ দেখান।

-ভাইয়া ছেড়ে দাও। যদি আমাকে ব্যাথা দিয়ে তুমি খুশি হও তাহলে ছেড়ে দাও ভাইয়া ।

কথা মতো ভাইয়া হাত ছেড়ে দিলে আমি চোখ বন্ধ করি।সত্যি ভাইয়া হাত ছেড়ে দিয়েছেন।শেষ আমি। কিছুই করার নেই। আমার কপালে হয়তো সাঈদ ভাইয়ার ভালো ব্যবহার জুটবে না, না জুটবে তার হাস্যজ্জ্বল চেহারা। কিন্তু এবারও মনে হচ্ছে আমি পড়ে যাইনি। চোখ খুলে দেখি সাঈদ ভাইয়া হাত ধরে ফেলেছেন। আর আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছেন। হঠাৎ হাসতে হাসতে সাঈদ ভাইয়া টান দিয়ে সোজা উনার সাথে মিশিয়ে নিলেন। উনি এখনো হেসেই যাচ্ছেন। তাকিয়ে আছি উনার মুখখানার দিকে। এই প্রথম সাঈদ ভাই আমার সামনে হাসছেন। ছোট থেকে বড় হলাম আজ পযর্ন্ত উনার হাসি দেখিনি। সবসময় নাকের ডগায় যেন রাগ রেখে চলতেন। সাঈদ ভাইয়ের হাসি খুব সুন্দর। কিন্তু কেন যে হাসেন না জানিনা। উনি চাইলেই তো পারেন হাসিখুশি থাকতে। ওভাবে রাগচটা স্বভাবের না হলেও তো পারতেন। আমার ড্যাবড্যাবে চাহনিতে ভাইয়া হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-কি হয়েছে? ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
-ভাইয়া তোমার হাসি না অনেক সুন্দর।
-আমার হাসি বুঝি দেখিসনি তুই!
– নাহ্। কারন, তুমি কখনো হাসো নি। সবসময় রাগী মুখে থাক , এজন্য।
-আমি এতো রাগী?
-হুম। দেখলে না সকালে কী জোরে থাপ্পড় দিলে।এত জোরে দিছো যে আমার গালের ভেতরের অংশে কেটে গিয়েছে।
সাঈদ ভাইয়া আমার কথা শুনে সাথে সাথে ছেড়ে দিয়ে আমাকে সোজা করে দাড় করালেন। উনি কিছু না বলেই নিচে চলে যান। যেন নিচে জরুরী কিছু ভুলে রেখে এসেছেন।।

আমি ওখান থেকে রুমে এসে জানালার পাশে বসি। মনটা খুব খুশি। কারনটা জানা নেই। তবে আজ প্রথম সাঈদ ভাই আমার সাথে একটু বেশি কথা বললেন। ভালো লাগছে একহিসেবে।

.
একটুপর সাঈদ ভাই হুরমুড় করে রুমে ঢুকে আমার হাত টেনে বিছানায় বসালেন। আমি একদম অবাক! সাঈদ ভাই এভাবে কখনো রুমে আসেননি। আজ উনি একের পর এক নতুন রুপ দেখিয়ে যাচ্ছেন। ভাইয়ার হাতে একটা কাপড় এবং বরফভর্তি বোল। উনি কয়েকটা বরফ টুকরা নিয়ে কাপড়ে মুড়ে আমার ডান গালে চেপে ধরে বললেন-
-তোর কি খুব ব্যাথা করছে?
-না, হালকা।
-মাফ করে দিস। আমি বুঝতে পারিনি।
-সমস্যা নেই ভাই। মাফ করে দিলাম।
সাঈদ ভাই তার ভুলের জন্য মাফ চাচ্ছেন। এতো বড় কপাল কীভাবে হলো আমার!! আপুর কাছ থেকে শুনেছি, উনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে নাকি ব্রেকআপটা শুধুমাত্র একটা “মাফ” চাওয়া নিয়ে হয়েছে। সাঈদ ভাইয়া নাকি একটার পর একটা ভুল করতেন কিন্তু কোনো মাফ চাইতেননা। একসময় উনার গার্লফ্রেন্ড বিরক্ত হয়ে আরেকজনের সাথে চলে যায়। উনাকে ধোকা দিয়ে।

-নাবিলা প্লিজ আম্মুকে তোর এই ব্যাথার ব্যাপারে বলিস না। আম্মু শুনলে আব্বুকে জানাবে। আর আব্বু জানলে যে আমাকে শেষ করবে এটা তুই ভালোভাবে জানিস। প্লিজ কাউকে বলিস না।
ভাইয়ার কথা শুনে মনেমনে যা ভেবেছিলাম সেসব চিন্তাভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো। ভাইয়া স্বার্থপরের মতো নিজের জন্য মাফ চাচ্ছেন। আমি যে এতো ব্যাথার মধ্যে আছি সেটা উনি দেখলেন না। সাঈদ ভাইয়া একটা স্বার্থান্বেষী মানুষ।আসলে উনি আমাকে নিয়ে ভাববেন কেন? আমি তো কেউই নাহ্। আমার তো কোনো অধিকার নেই।
আমার গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিলাম। লাগবেনা উনার সেলফিস টাইপের কেয়ার। সাঈদ ভাইয়াকে বললাম-
-সাঈদ ভাইয়া তোমার এমন সো অফ কেয়ার আমার লাগবেনা। তুমি চলে যাও।
-রাগ করলি নাকি? আরে আমি তো এভাবেই বললাম।
-চলে যাও ভাই। সামনে আসবে না।

-চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *