1. নতুন গল্পঃ2. ছোট গল্প গুলোঃলেখাঃ মুশফিকা রহমান মৈথি

তারা দুজন !! লেখাঃ মুশফিকা রহমান মৈথি

তারা দুজন

একদম আমায় ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না, খবরদার বলে দিলাম। নয়তো এই ছুরি ( ছুরিটা বালিশের নিচ থেকে বের করে হাতে নিয়ে), এই ছুরি আপনার বুকে মেরে দিতে দুই মিনিট ভাববো না।
বাসর রাতে নববধূর মুখে এরুপ কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে যাবার যোগাড় অর্কের। হা করে তাকিয়ে আছে আর সদ্য বিবাহিত বউ এর দিকে। একটু খুতে দেখলে অর্ক খেয়াল করে মেয়েটির চোখ রক্তিম আভা নিয়েছে, মুখের চোয়াল শক্ত। তবে এসির মধ্যে ও মেয়েটা ঘামছে, নাক আর ঠোঁটের মাঝে ঘামের বিন্দু সুস্পষ্ট। হাত ও কাঁপছে, মেয়েটা যে খুব ভয়ে আছে এটা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি অর্কের। এমন তো হবার কথা ছিলো না। আজ অর্কের বিয়ে হয়েছে সামনের ছুরি হাতে রক্তিম চক্ষুধারী মেয়েটির সাথে, যার নাম আফসারা। অনেকটা বাড়ির সবার জোরজবরদস্তিতে বিয়েটা হয়েছে, বিয়েটা ভেস্তে দেবার চেষ্টা যে অর্ক করে নি তা নয়। তবে বড়মার ব্লাকমেইলের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে। কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতে এই রকম জান হারানোর হুমকি পেতে হবে এটা যেন কল্পনার বাইরে। আর কারণটা হলো, সে বিয়ের প্রথম রাতে তার বিবাহিত বউ এর পাশে এসে বসেছে কেবল। নিজেকে শান্ত করে খুব ধীর গলায় বলতে লাগলো অর্ক,
– আচ্ছা, আচ্ছা তুমি আগে ছুরিটা নামাও। আমরা শান্তভাবে কথা বলি। এটা লেগে যাবে, নামাও।
– আগে আপনি সোফায় যেয়ে বসেন, তারপর আমি এটা রাখবো।
– আচ্ছা, আচ্ছা আমি সোফায় যাচ্ছি।
একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে অর্ক সোফাতে যেয়ে বসলো। অর্কের ঠান্ডা মেজাজের মানুষ খুব দ্রুত মেজাজ খারাপ হওয়ার রেকর্ড তার নেই। খুব বাজে পরিস্থিতি ঠান্ডা ভাবে কিভাবে সামলাতে হয়, ভালো করেই জানা আছে অর্কের। তাই মেজাজ গরম না করে শান্ত ভাবেই কথা বলে সে আফসারার সাথে,
– কি হয়েছে? এভাবে বিহেভ কেনো করছো?
– আমার খুব ঘুম পেয়েছে, আমি ঘুমাবো। কালকে কথা বলি?
– তুমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরো।
– আপনি?
– ডোন্ট ওয়ারি, আমি তোমাকে ছুঁবো না। ইউ ক্যান রিল্যাক্স। আর ছুরিটা এদিকে দাও।
অর্কের কথায় অনেকটা শান্ত হলো আফসারা। ছুরিটা সাইড ড্রয়ারে রেখে, নিজের ব্যাগের থেকে একটা টিশার্ট আর প্লাজো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। অর্কের মাথা ফেটে যাচ্ছে, এতো ইস্যু ছিলো যখন বিয়েটা না করলেই পারতো। শুধু পাশে এসে বসার জন্য যে মেয়ে ছুরি বুকে মেরে দেবার হুমকি দিতে পারে না জানি এই মেয়ের সাথে থাকতে গেলে ভবিষ্যতে কি কি দেখতে হবে। দু হাত দিয়ে মাথা চেপে কিছুক্ষন বসেছিলো অর্ক। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই ওদিকে নজর যায়। ভারী শাড়ি, গয়না আর মেকাপের আড়ালে আসল চেহারাটাই বুঝা যাচ্ছিলো না আফসারার। মেয়েটা দেখতে অপ্সরা না, তবে একেবারে খারাপ ও না। গোলগাল মুখ, হলদেটে ফর্সা, গোল গোল চোখ তার উপর চশমা। বেগুনি টিশার্ট আর কালো প্লাজোতে বেশ মানিয়েছে। চুল ঘাড় অবধি, হাফ পাঞ্চ করে রাখা, চোখের সামনে কিছু চুল এসে পড়ছে যা বেশ মানাচ্ছে। এতোক্ষন লেন্স পড়ে থাকায় বোঝা যাচ্ছিলো না, কিন্তু মেয়েটির দূরের নজর খুব দূর্বল, চশমার গ্লাস একটু বেশিই মোটা। অর্ককে এভাবে একনজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে আফসারা একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। হালকা কাশি দিয়ে বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
– এভাবে কি দেখছেন?
– কিছু না, দেখছি খাল কেটে কেমন কুমিরকে ঘরে তুললাম। ঘুমিয়ে পরো, কাল সকালে কথা বলবো।
– আপনি কি এখানেই ঘুমাবেন??
– আমি আজ সোফায় ঘুমাচ্ছি, ইউ ক্যান স্লিপ ইন বেড। কালকে আমায় আমায় খুলে বলবে কি ইস্যু। গোট ইট?
– হুম
অর্ক আর কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় চলে এলো। এই বিয়ে নিয়ে কোনো আশা, এক্সপেকটেশানস ছিলো না, কিন্তু এভাবে একটা ড্রামা করবে মেয়েটা কল্পনাতেই ছিলো না। মোবাইলটা বের করে, কিছু ফাইল, ছবি ডিলেট করতে করতে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেছে। মায়াবী হাসিটা যেন আজও কলিজাতে লাগে। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে ছবিটা ডিলিট করে দিলো। সিগারেট ধরিয়ে বাহিরের দিকে নজর দিলো সে। রাতের আকাশ, নিস্তব্ধতার আড়ালেও যেন অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। দুই একজন সিকিউরিটি গার্ড ব্যাতীত কিছুই নজরে পড়ছে না। সিগারেটটা শেষ হলে ফিল্টারটা ফেলে ঘরের দিকে পা বাড়ায় অর্ক। ঘড়িতে চোখ গেলে দেখে প্রায় দেড়টার কাছাকাছি বাজে। বিছানায় ছোট বিড়ালের বাচ্চার মতো কুঁকড়ে ঘুমাচ্ছে আফসারা, মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এসিটা বন্ধ করে একটা কাঁথা দিয়ে মুড়ে দিলো ওকে অর্ক। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এখন না শুতে পারলে কালকে আবার বউভাতের ফাংশনে ঘুমে টুলতে থাকবে বর, ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না। তাই কোনো মতে ফ্রেশ হয়েই সোফায় শুয়ে ঘুমের শহরে পা বাড়ালো অর্ক।
সকালে পানির ঝাপটায় ঘুম উড়ে গেলো অর্কের। প্রথমে ভেবেছে কেউ হয়তো পানি ছিটা দিচ্ছে। চোখ পিটপিট করে খুললে এক মূহুর্তের জন্য চোখ আটকে গেলো অর্কের৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে লেমন কালারের ড্রেস পড়া এক নারী নিপুনভাবে তার চুল ঝেড়ে যাচ্ছে। চুল থেকে টপটপ করে শিশিরবিন্দুর মতো পানি পড়ে জামার কাধের কিছুটা অংশ ভিজিয়ে দিয়েছে। চোখে মুখে পানির বিন্দুগুলি মুক্তার দানার মতো লাগছে। সকালের স্নিগ্ধতা যেনো আফসারার মায়াবী মুখে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অর্ক যেনো নিজের মধ্যে ছিলো না, ঠিক কতো সময় আফসারার দিকে তাকিয়ে ছিলো তার খেয়াল নেই। দরজা ধাম ধাম আওয়াজে হুশ ফিরে ওর। গায়ে ওড়নাটা জরিয়ে দরজার দিকে এগুতে নিলেই আফসারাকে বাঁধা দেয় অর্ক। আফসারা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সোফার দিকে ইশারা করে অর্ক। নিচু গলায় বলে,
– আমি চাই না এই ঘরে যা হয়েছে তা বাইরের বাসিন্দার কানে যাক।
– জ্বী।
তাড়াতাড়ি সোফা থেকে বালিশ, কাঁথা সরিয়ে দরজা খুলতে যায় অর্ক। দরজাটা খুললেই পঙ্গপালের দল রুমে ঢুকে পড়ে। এভাবে হুড়মুড় করে ঢুকতে দেখে অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আফসারা। পঙ্গপালের দল আর কেউ না, অর্কের বোনদের দল। এর মধ্যে সব কয়টা বয়সে অর্কের ছোট। মামাতো, চাচাতো মিলে মোট চার জন। আফসারাকে এভাবে ঘিরে ধরলে, আফসারা শুধু অর্কের মুখের দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকে। এর মধ্যেই মৃধা, অর্কের ছোট মামার মেয়ে বলে উঠে,
– ভাবী, এখন তুমি আমাদের টিম মেম্বার। দাদাভাই এর তাকালে হবে না। তুমি যেহেতু উঠেই গেছো তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আমাদের সাথে চলো।
– আমিতো রেডি।
কথাটা বলতে দেরি হয়নি অরনী, যে কিনা অর্কের একমাত্র ছোট বোন সে বলতে লাগলো,
– সেকি শাড়ি পড়বে না? বড়মা পুরানো আমলের মানুষ। শাড়ি না পড়লে খবর আছে তোমার। আমার বড়মা মোকেম্বো টাইপ মানুষ। চিন্তা করো, দাদাভাই এর মানুষও তাকে মেপে চলে।
– এই অরু, আম্মা এতোও রাগী না।
অরনীর কথা শেষ না হতেই অভিযোগের সুরে কথাটা বলে দিশা, অর্কের বড় চাচাতো বোন। দিশার কথায় টিপ্পনী কেটে শেলী, অর্কের ছোট চাচার মেয়ে বলে উঠে,
– না না বেশি রাগী না, হালকা পাতলা ঘষেটি বেগম আর কি।
আফসারার এমনেই এতোগুলো ননদ দেখে মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম উপরে, বড়মার কথা শুনে ভয়ে বড় সড় ঢোল গিলতে লাগলো। অর্কের খুব হাসি পাচ্ছে, আফসারার চাপে পড়ে খারাপ অবস্থা দেখে। এর মাঝে সকাল সকাল অর্কের ঘরে জটলা দেখে অর্কের ভাবী মানে চাচাতো ভাইয়ের বউ প্রাপ্তি অর্কের ঘরে ঢুকে। প্রাপ্তি হাক ছেড়ে বলতে লাগে,
– কি রে, সকাল সকাল এখানে কিসের গোল মিটিং করিস রে?
– কিছুনা বউমনি, নতুন ভাবীকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম যে এই বাড়িতে একজন মোকাম্বো আছেন। যাতে একটু সামলে চলে। হিহি (অরনী)
– আম্মার কানে গেলে, তোর মুখে সেলাই করে দিবে। তখন বুঝিস মোকাম্বো কি জিনিস। চলো, খাবার টেবিলে আসলেন বলে। তোমার এই চ্যাটর চ্যাটর কথা আমি আম্মার কানে দিচ্ছি।
– বউমনি, বউমনি এমন করো না। আমি তো মজা করছিলাম আর কি, হিহি(অরনী)
– এখনই নিচে চল সব কয়টা, নয়তো আম্মাকে তো চিনিস। সব কয়টাকে মুরগী বানিয়ে কান ধরে উঠবস করাবে, চল।
আর একমিনিট ও এদিক ওদিক না দেখে সব কয়টা বের হয়ে গেছে। এ বাড়ির কর্তী হলেন অর্কের বড়মা মানে অর্কের বড় চাচী, রাশেদা বেগম। অর্ক, অরন্য খুব ছোট থাকতে একটি এক্সিডেন্টে তাদের বাবা মা যান। তখন থেকেই তারা রাশেদা বেগমের সাথেই থাকে। মা-বাবার কমতি রাখেন নি তাদের রাশেদা বেগম। তাই কারোর কথা না মানলেও রাশেদা বেগমের কথা মানতে বাধ্য অর্ক। নিজের মায়ের মতো সম্মান করে রাশেদা বেগমকে। বাড়িতে গুড়া থেকে বুড়ো সবাই রাশেদা বেগমকে জমের মতো ভয় পায়। প্রাপ্তি মুচকি হেসে বলে,
– তোমরা আধা ঘন্টার মধ্যে নিচে আসো। আম্মা ঠিক নয়টায় সকালের খাবার খান। অকে?
– জ্বী..
– সবাই আমাকে বউমনি ডাকে, চাইলে তুমিও ঢাকতে পারো।
– আচ্ছা বউমনি। একটা কথা ছিলো
– বলো
– আমি শাড়ি পড়তে পারি না, যদি একটু হেল্প করতে
– চলো আমার সাথে, আর অর্ক তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেও। কাল ঘুম ঠিকঠাক হয়েছে তো
– বউমনিইইই
হাসতে হাসতে প্রাপ্তি চলে গেলো, সাথে আফসারাকেও নিয়ে গেলো। মিনিট বিশেক পর আফসারা রুমে আসলে দেখে, অর্ক আয়নার সামনে হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে। পরনে কালো ট্রাউজার বাদে কিছুই নাই, ফর্সা বুকে লোম গুলো লেপ্টে আছে। ছয় ফিট উচ্চতা উপরে জিম করা সুঠাম দেহ যে কারোর নজর কাড়তে সক্ষম। পেশায় ডাক্তার না হলে কোনো সিনেমার হিরো অথবা মডেল হিসেবে বেশ মানাতো অর্ককে। আফসারা হালকা কাশি দিলে অর্ক পেছনে ফিরে। ও বুঝতে পারে নি আফসারা যে ঘরে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে। তাড়াহুড়ো করে টিশার্টটা গায়ে দিতে দিতেই বলে,
– তুমি রেডি? চলো। বড়মা টাইমের খুব পাক্কা।
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।
– খেয়ে এসে বলি?
– না, বেশি সময় লাগবে না। পাঁচ মিনিট লাগবে।
– আচ্ছা বলো।
– আমার বয়ফ্রেন্ড আছে, আমি এই বিয়েটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
চলবে…..

বিঃ দ্রঃ নিচে ভালো করে লক্ষ্য করুন পরবর্তী পর্বে দেওয়া আছে..

বিঃ দ্রঃ “ লেখাঃ মুশফিকা রহমান মৈথি ” লেখকের লেখা অন্য গল্প গুলো পড়তে এখানে ক্লিক করুন !!

👉আমাদের ফেসবুক পেজ

তারা দুজন তারা দুজন তারা দুজন তারা দুজন তারা দুজন