সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 44

৬১.
অনেকদিন পর নিজের বাসায় এসে বুকটা “হু,হু” করে ওঠে আমার। ড্রইংরুমে যেতেই দেখলাম সেখানে আবদ্ধ,দীঘি আর মামী বসে বসে গল্প করছেন। কান্না আর বাঁধ মানলো না আমার। ছুঁটে গেলাম মামীর কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। মামী,আবদ্ধ আর দীঘি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেননা তারা জানে না আমরা আসবো এখানে। এক রকম সারপ্রাইজ দেওয়া হয়েছে তাদের! অবাকের রেশ কাটাতে রেয়ান লাগেজটা সোফার একটু পাশে রেখে সোফায় আয়েশ করে বসে বলে উঠলেন,
— “সারপ্রাইজ কেমন লাগলো সবার? মনে হয় ভালো লাগেনি। কেউ কাঁদছো না তো প্রিয় মানুষটাকে দেখে। তোমাদের তো কাঁদার কথা।”
রেয়ানের কথায় সবাই কাঁদার বদলে এবার হেসে দিলো। তবে মামীর চোখ ভরে এলো জলে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানিটা মুছে নিলেন উনি। রেয়ান আর আমাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে চলে যান রান্নাঘরে। মামী যেতেই আমরা লেগে গেলাম আড্ডা করতে। আমি দীঘির সাথে আর রেয়ান আবদ্ধের সাথে। আবদ্ধ মুচকি হেসে দুষ্টুমি করে রেয়ানকে বলে উঠল,
— “তো ভাইয়া, নিউ নিউ ম্যারেড লাইফ কেমন লাগছে?”
— “স্বপ্নের মতো! তোমারও তো নিউ নিউ ম্যারেড লাইফ। তোমার কেমন লাগছে?”
আবদ্ধ একরাশ নিরাশা নিয়ে বলল,
— “পিচ্চিটাকে নিয়ে বহুত জ্বালায় আছি।”
কথাটা শুনতে পেলাম আমি, দীঘি দু’জনেই। ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালাম আবদ্ধের দিকে। বললাম,
— “আমার মিষ্টি বোনটা কিভাবে জ্বালায় তোকে? অপবাদ দিস কেন? ওর মতো একটা মিষ্টি মেয়ে আর একটাও আছে নাকি!”
এবার আবদ্ধ বলে উঠল,

— “আছে বৈকি! বহুত আছে। ওর থেকে হাজার গুণে ভালো আছে।”
— “এত কিছু না বলে বল তুই নামে অপবাদ দিচ্ছিস কেন? কি করেছে ও?”
— “আর বলো না। ওর নাকি এ পিচ্চি বয়সে বেবি চাই।”
আমি আর রেয়ান “খু,খু” করে কেশে উঠলাম। দীঘি লজ্জায় ডুবে গেল সাগরে। আমাদের এমন অবস্থা থেকে মাথা চুলকাচ্ছে আবদ্ধ। সে এমনটা বলতে চাই নি সবার সামনে। কিভাবে যেন কথায় কথায় মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছে। এদিকে রেয়ানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিলাম আমি। উনি বাঁকা হেসে চোখ মেরে হেসে ওঠেন নিঃশব্দে! সোজা হয়ে বসে বলে ওঠেন,
— “তোমার এ বয়সে বেবি না লাগলেও আমার কিন্তু লাগবে আবদ্ধ। কি বলো!”
এহেন কথায় আবদ্ধ রেয়ানের সাথে সমান তালে হেসে উঠল। এবার যেন আমিও লজ্জায় মিশে গেলাম। মনে মনে বকতে লাগলাম তাদের দু’জনকেই। এরা দুইজনেই এক! খাটাশ, অসভ্য, বেহায়া আর নির্লজ্জ। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কোনোমতে চলে এলাম রান্নাঘরে। আমার পিছু পিছু দীঘিও এলো। নাহয় যে উপায় নেই। নির্লজ্জগুলো যে বারবার লজ্জায় ফেলে দেয় আমাদের!
________________
রাত প্রায় ১০টা বেজে ৫৩মিনিট। রাতের খাবার খেয়ে মাত্রই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে দিহান। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো “ভোঁ ভোঁ” করে। ফোন ভাইব্রেট করে রাখার কারনে ফোনের এমন বাজে রিংটনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো দিহান। ফোন হাতে নিতেই ভেসে উঠল গোটা গোটা অক্ষরে জেনির নাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিহান। কলটা রিসিভ করতেই জেনির অস্তির হওয়া কণ্ঠ বারি খেলো কানে।
— “ফোন ধরতে এতক্ষন লাগে তোমার? কতক্ষন ধরে ফোন করছিলাম, খেয়াল আছে?”
দিহান কিঞ্চিত অবাক হলো। বিয়ে হয়েছে আজকে সকালে। এত তাড়াতাড়ি আপনি থেকে তুমি! পরক্ষনেই এসব কিছু স্বাভাবিকের তালিকায় ফেলে অবাক হওয়াটা কমিয়ে নিলো দিহান। শান্ত সরে বলল,

— “ডিনার করছিলাম। ফোন রুমে ছিল আর ভাইব্রেট করা ছিল। তাই শুনি নি।”
— “কি খেয়েছো? রান্না করেছো নাকি তুমি? নাকি বাইরে থেকে খেয়েছো?”
এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করায় বিরক্ত হলো দিহান। সে এমনিই খুব কম কথা বলে। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না মোটেও। নাহলে যে মীরার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পেতেই সে তা উপস্তিত করতো মীরার সামনে। কিন্তু আফসোস! সে সত্যিই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ব্যর্থ। কিন্তু জেনির প্রতি যেটা প্রকাশ পাচ্ছে সেটা আসলেই অচেনা তার জন্য। হুট করে সিধান্ত নেওয়ার মতো মানুষও সে না। কিন্তু জেনির বেলাই যে কেন এমন হলো! দীর্ঘশ্বাস আবারও এসে হানা দিলো বুকে। মুখ থেকে কথা বের হলো না একটিও। উত্তর না পেয়ে জেনি আবারও বলল,
— “বলো না! তুমি রান্না করেছে খাবার?”
দিহান ছোট্ট করে জবাব দিলো,
— “হ্যাঁ!”
— “তাহলে তো ভালোই হলো। কয়েকদিন পর যখন আমি তোমার সাথে থাকতে আসবো তোমার বাসায়, তখন আমার আর রান্না করতে হবে না। কি মজা!”
খিলখিল করে হেসে উঠলো জেনি। দিহান মুগ্ধ হয়ে শুনলো সে হাসি। মেয়েটা আসলেই পাগল। নাহলে এমন কথায় কেও হাসে নাকি? অন্তত্য সে হাসে না! জেনি আবারও হেসে বলল,
— “আচ্ছা দিহান তুমি আমাকে তোমার কাছে কখন নিয়ে যাবে?”
— “জানি না।”
দিহানের কথায় কষ্ট পেলো জেনি। তবে প্রকাশ করলো না সেটা। মুখে হাসির রেখা ফুটিয়েই বলল,
— “বাবাকে কখন বলল আমাদের বিয়ের কথা?”
— “এক,দুই বছর পর। আমাকে একটু সেটেল হতে দাও। তারপর।”
— “এত্তত্তত্ত দিন তোমাকে ছাড়া আমাকে থাকতে হবে? নো ওয়ে!”
— “বোঝার চেষ্টা করো জেনি! আমি সেটেল না। তোমার বাবার তো আবার বড়লোক ছেলেকে দেখলে গা চুলকায়। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি গায়ের কাটা উনার। আমি যদি সেটেলই না হই তাহলে তোমার বাবা আমাদের মেনে নিবে না। উনি তো জাস্ট তোমার মন রাখার জন্য কয়েকদিন তোমাকে ভালোবাসার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিলেন আমায়।”
কথাটা শুনে চোখে পানি এসে ভীড় করল জেনির চোখে। কষ্ট হচ্ছে খুব। তবে কথাগুলো যে সত্যি, তা জেনিও খুব ভালো করে জানে। তাই তর্ক করলো না সে। বলল,
— “আমি তোমার থেকে এতদিন দূরে থাকবো, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
দিহান ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে বলল,
— “কি শর্ত?”
— “প্রতিদিন সারারাত কথা বলতে হবে আমার সাথে।”
— “সারারাত? তাহলে ঘুমাবো কখন? সারাদিন ক্লান্তিতে কাটবে তো আমার।”
— “আচ্ছা ঠিকাছে। সারারাত কথা বলতে হবে না। রাত ২টা পর্যন্ত কথা বললেই চলবে। তবে আজকে কিন্তু সারারাতই কথা বলতে হবে।”
— ”কেন?”
— “ভুলে গেছ নাকি? আজকে আমাদের বাসর রাত না!”
দিহান মৃদু হাসলো। জেনির কথার প্রতিউত্তর কি দিবে সেটা ভাবতে ভাবতেই জেনি শুরু হয়ে গেল তার কথার ঝুলি নিয়ে।
৬২.
রাতের খাবার খেয়ে মামীর সাথে আমি আর দীঘি অগোছালো সব গুছিয়ে রাখলাম। সবার আগেই চলে এলাম রুমে। রেয়ান তখনও গল্প করছেন আবদ্ধের সাথে। রুমে এসে লাগেজ থেকে একে-একে কাপড় বের করে রেখে দিলাম আলমারিতে। কাজ শেষে চলে এলাম বারান্দায়। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। কেন যেন আনন্দ আর দুঃখ মিশ্রিত অনুভূতি হচ্ছে আমার। রাতের আকাশে বিরাজ করা চাঁদটাও যেন আমাকে দেখেই হাসছে। তার হাসি দেখে আমিও হাসলাম। চোখ বন্ধ করে আরেকবার শ্বাস নিলাম বুক ভরে। হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন রেয়ান। কাঁধে থুতনি রেখে আদুরে গলায় বললেন,
— “আমাকে রেখে আসলে কেন?”
— “আপনি তো আবদ্ধর সাথে গল্প করছিলেন।”
— “মোটেও না। আমি তো অপেক্ষা করছিলাম তোমার। কখন তুমি কাজ শেষ করে আসবে আর কখন আমি তোমার সাথে রুমে আসবো। কিন্তু তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে আগেই চলে এসেছো রুমে। কাজটা মোটেও ঠিক করো নি। ফাজিল মেয়ে একটা!”
আমি হেসে বললাম,
— “সরি।”
— “উহুম। সরি বললে হবে না। শাস্তি পেতে হবে।”
— “কি শাস্তি?”
— “প্রথমে আমার ঠোঁটে চুমু খাবে। তারপর আমার জন্য কফি নিয়ে আসবে।”
— “প্রথমটা পারবো না। শেষেরটা নিয়ে আসছি।”
— “উহু! পারতে হবে ম্যাম। নাহলে রেহাই পাবেন না আপনি।”
— “তাই নাকি?”
রেয়ান আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে বললেন,
— “হু।”

আমি আবারও হাসলাম। উনার দিকে ঘুরে দু’হাতে আবদ্ধ করে নিলাম উনার মুখ। আলতো করে গালে চুমু দিয়ে পরক্ষনেই জোড়ে একটা কামড় দিয়ে দিলাম। রেয়ান “আহহ” শব্দ করে গালে হাত বোলাতে বোলাতে দূরে সরে গেলেন। বিড়বিড় করে বললেন,
— “রাক্ষসী!”
তাকে বিরাট বড় হাসি উপহার দিয়ে আমি চলে গেলাম কফি বানাতে। এদিকে দীঘি আর আবদ্ধও চলে গেছে নিজ রুমে। রুমে ঢুকতেই আবদ্ধ দীঘিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। দীঘি আবদ্ধের কাছ থেকে সরে যেতে যেতে বলে ওঠে,
— “আপনি পঁচা! আপনার সাথে কথা নেই।”
আবদ্ধ দীঘিকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। গালে উষ্ণ ছোঁয়া দিতে দিতে বলল,
— “কেন?”
— “ভুলে গেছেন নাকি? কিভাবে রেয়ান ভাইয়ার সামনে ওমন কথা বলেছেন। আমার বুঝি লজ্জা লাগে না?”
— “তাই? কাছে আয় লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দি।”
— “কেন কাছে আসবো? আপনি তো আমাকে বেশি বেশি আদর করেন না। তারওপর আমার টিভি দেখাও বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই আপনার সাথে কাট্টি!”
বাচ্চাদের মতো করে একরাশ অভিমান নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো দীঘি। আবদ্ধ হেসে আবারও তার গালে উষ্ণ ছোঁয়া দিতে দিতে বলল,
— “আজগুবি কথা বলিস কেন? এজন্যই তো এমন করি। এখন কাছে আয় তো। কথা বেশি বলিস তুই।”
— “কাছে আসবো কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
— “কি?”
দীঘি খুশি মনে বলল,
— “আপুরা যতদিন বাসায় থাকবেন, ততদিন কোনো পড়ালেখা করব না আমি।”
আবদ্ধ কিছুক্ষন ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো দীঘির দিকে। পরক্ষনেই গলায় কাঠিন্য নিয়ে বলল,
— “যা পড়তে বয়! কিসের কাছে আসাআসি! পড়তে বসবি তুই এখন। যা টেবিলে।”
দীঘির মন খারাপ হয়ে গেল নিমিষেই। লোকটা ওমন কেন? একদম বাজে!
.
.
চলবে…