সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 43

৬০.
কাজী অসিফ থেকে মাত্র বের হয়েছে দিহান আর জেনি। হাতে হাত ধরে ফুটপাতে হাঁটছে তারা। জেনি বেশ কয়েকবার রিকশা নিতে বলেছে তাকে। তবে কেন যেন রিকশায় চোড়তে মন সায় দিচ্ছে না তার। হঠাৎ সে কি করে ফেলল! এটা কি আদও করা উচিত হয়েছে? এত তাড়াতাড়ি! তার তো সময় প্রয়োজন ছিল। নিজেকে গড়ে তুলতে, জেনিকে ভালোবাসতে! তাহলে? ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো দিহানের। সে কেন জেনিকে বিয়ে করেছে কিংবা এ ধরণের চিন্তাই বা কেন তার মাথায় এটে গেছে তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই দিহানের কাছে। এখন কিভাবে কি করবে সে? তার না আছে ভালো চাকরি। স্টুডেন্ট সে! তিন রুমের একটা বাসায় থাকে। ব্যাচেলর হিসেবে। তবে সে একাই। তিন-চারটে টিউশনি করে যা টাকা আয় হয় তা দিয়েই কোনো মতে টেনেটুনে চলতে হয় মাস-ভর। জেনিকে কিভাবে রাখবে সে? মুহুর্তেই একটু আগের নেওয়া সিধান্তের প্রতি প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হলো দিহান। জেনিকে বিয়ে করা ঠিক হয় নি তার। কিন্তু এখন যে আর কিছুই করার নেই। মেয়েটা যে তার দিকে চেয়ে আছে একরাশ আশা নিয়ে। এক মুঠো ভালোবাসার জন্য! তাকে ঠকাতে যে পারবে না দিহান। চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলল সে। পরক্ষনেই চোখের পাতা খুলতেই দেখতে পেল জেনি তাকিয়ে আছে তার দিকে। মৃদু হাসলো দিহান। জেনির হাতটা আরেকটু শক্ত করে আকড়ে ধরে বলল,
— “চলো লেকে যাবো।”

________________
সোফায় বিরক্তি নিয়ে বসে আছেন রাহুল আহমেদ। তার পাশে নীলা আহমেদ আর সামনে বসে আছে নুহান, রেয়ান আর আমি। রেয়ান রাহুল আহমেদের মতোই বিরক্তি নিয়ে আছেন, আমি ক্ষাণিকটা ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে আছি আর নুহান তার অভ্যাসগত নীতিতে ফোন হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগি হয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে তা জানার সময় কই তার? এদিকে এমন অপ্রত্যাশিত নীরবতায় বিরক্ত হতে হচ্ছে প্রায় সবাই। তার মধ্যে রাহুল আহমেদ আর রেয়ান প্রধানই ধরা যায়। নীরবতা ভেঙ্গে রাহুল আহমেদ গলা খাকড়ে কেশে ওঠেন। সরাসরি রেয়ানের দিকে তাকিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
— “আমি মানা করা সত্ত্বেও তোমাদের মা-ছেলের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমার মতামতের আদও কি মূল্য দেবে না তোমরা?”
রেয়ান মুখ উঁচু করে একবারও তাকালেন না রাহুল আহমেদের দিকে। তবে তিনি তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছেন তা বেশ বুঝতে পারছেন রেয়ান। তার সাথে এটাও যে, রাহুল আহেদের অগোচরে উনি যে আমার সাথে দেখা করেন তা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন রাহুল আহমেদ। এতে নূণ্যতম বিচলিত হননি রেয়ান। এমন যে হওয়ার ছিল তা উনি আগে থেকেই জানতেন। তাই এমন পরিস্থিতে পড়ার পর বিচলিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। উল্টো স্বাভাবিক কণ্ঠে রেয়ান বলে উঠেন,
— “তোমার মতামতগুলো কি আসলেই মানার যোগ্য? আচ্ছা এটা বলো আমাকে বিবাহিত ছেলেকে বিয়ের পরেরদিনই কোন বাবা বউয়ের সাথে আলাদা করে রাখে? তাও মাত্র একটা শাস্তি দেওয়ার জন্য! আমি তোমাকে বলিনি আমি পারবো না তোমার বিজনেস সামলাতে? এসব ভালো লাগে না আমার। ডাক্তার হিসেবেই ঠিক আছি আমি। আর যদি বলো দু’টোই সামলাতে তাহলে বলবো একটা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি। দু’টো একসাথে সামলাতে গেলে দেখা যাবে অতি প্রেশারে তোমার ছেলে আর এ পৃথিবীতে নেই।”
উপস্থিত সবাই চমকে উঠে। রেয়ানের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমি। রাহুল আহমেদ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
— “আমি চাই তুমি আমার বিজনেস সামলাও!”
কথাটা ঠিক হজম হলো না রেয়ানের। মেজাজ বিগড়ে গেল সাথে সাথে। একটা কথা উনাকে কতবার এবং কত পদ্ধতিতে বলা লাগবে? একবার বললেই কি বুঝেন না উনি? চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে রেয়ানে বলে উঠলেন,
— “তোমার সমস্যা কি বলতো? নূণ্যতম দরদ হচ্ছে না আমার ওপর? সত্যি বলছি! এই দুই-তিন বছরে একই টপিক নিয়ে তোমার সাথে কথা কাটাকাটি করতে আমি বিরক্ত। সত্যিই বিরক্ত। আমার শান্তি চাই প্লিজ!”
কথা শেষ করেই বড় দম ফেললেন রেয়ান। রাহুল আহমেদ শুধু রইলেন রেয়ানের দিকে। ছেলেটা আসলেই বড় হয়ে গেছে। কিভাবে কৌশলে কথার মাঝে “বাবা” ডাকটা উচ্চারণ করলো না সে। এতটা অধম সে? একটা বার কি বাবা ডাকটা ডাকা যেত না? তার ছেলের কাছে এতটাই অপছন্দের পাত্র সে। আরে, একবার যদি রেয়ান বাবা বলে ডাকতো রাহুল আহমেদকে তাহলেই তো তিনি সব উজাড় করে দিতেন রেয়ানের জন্য। উঠে দাঁড়ালেন রাহুল আহমেদ। কথা বলার কিছু নেই বিধায় রেয়ানের দিকে চোখ তুলে একবার তাকালেন। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন নিজ রুমে!
তিনি যাওয়ার কিচ্ছুক্ষন পরই আমার হাত টেনে রেয়ান নিয়ে যান নিজের রুমে। সোফায় বসিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন আমায়। মৃদু মলিন কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “আমি আর পারছি না মরুভূমি। এসব আর ভালো লাগে না আমার। বিরক্ত লাগছে। সবকিছু শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।”
আমি শান্ত সরে বললাম,
— “কেন?”
— “তুমি জানো না কেন?”
তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না আমি। নিজেকে রেয়ান থেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলাম,
— “আমার শ্বশুড় আপনার কি হয়?”
রেয়ান ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠেন,
— “মানে?”
— “যা বলেছি তার উত্তর দিন।”
মুহুর্তেই রেয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “আমার বাবা।”
— “তাহলে আপনি একবারও উনাকে বাবা বলে ডাকলেন না কেন? সে তো নিজ থেকেই আপনার সাথে কথা বলেছেন তাই না? তাহলে আপনি কেন তাকে বাবা বলে সম্মোধন করলেন না। তাকে বুঝিয়ে বললেও তো সে একটু হলেও আপনার পরিস্থিতি বুঝতেন।”
— “তুমি বলতে চাইছো সব দোষ আমার?”
— “না। শুধু বুঝিয়ে বলার কথা বলছি।”
— “বলেছি আমি। ডাক্তার হওয়ার পরপরই বলেছি। কিন্তু বাবা আমার কথা শুনেন নি। উল্টো আমাকে বাসা থেকে বের হতে বলে দিয়েছেন।”
— “উনি তো বলেছেন রাগের মাথায় সে কথাটা মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে।”
রেয়ান চুপ করে রইলেন। বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলে তার হাত ধরে ফেললাম আমি। সোফায় বসিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— “বোঝার চেষ্টা করুন রেয়ান। শুধু একবার নিজের বাবার সাথে মন খুলে কথা বলুন। প্লিজ!”
— “আজকে তো আমার শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার কথা। যাবে না?”
— “কথা ঘুড়াচ্ছেন?”
রেয়ান এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। নাকে নাক ঘষে বলে উঠলেন,
— “ওখান থেকে এসে কথা বলব ঠিকাছে। এখন দাও তো আমাকে! খাবো।”
— “কি?”
— “চুমু।”
— “অসভ্য।”

________________
দিহানের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেনি। খুশি খুশি লাগছে তার। উফফ! নিজের স্বামীর বাড়িতে এসেছে সে। আর এদিকে দিহান প্রতিবারের মতো এবারও বিরক্তি নিয়ে চেয়ে আছে জেনির দিকে। মেয়েটা আসলেই বিরক্তি কর। যাকে দেখলে শুধু বিরক্তই হয় দিহান। প্রবল ভাবে বিরক্ত। কি দরকার তার দিহানের সাথে দিহানের ফ্ল্যাটে আসার। নিজ বাসা চলে গেলে কি হতো? বিয়ে হয়েছে এখন মাত্র দুই কি তিন ঘন্টা। আর এই মেয়ে, এখন থেকেই অধিকার খাটাচ্ছে তার ওপর। যা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না দিহানের। মোটেও না। কয়েক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছে- বিয়েটা করা সত্যি সঠিক হয় নি। অন্তত্য এখন না। আরও পড়ে করলে বোধহয় ভালো হতো। ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিহান। প্যান্টের পকেট থেকে ফ্ল্যাটের চাবি বের করে দরজা খুলে ফেললো চটাচট। ব্যাচেলর সে! বিল্ডিংয়ের কেউ যদি তাকে একটা মেয়ে নিয়ে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যতই সে তাদের প্রতিবেশি হোক না কেন, পরবর্তিতে গ্ণধোলাই দিতেও তারা পিছ পা হবে না। কেননা জেনির সাথে তাকে এভাবে দেখলে সেটা অনেকটাই দৃষ্টি কটু। তাছাড়া কেউ জানে না সে বিবাহিত!
হেচকা টানে জেনিকে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় দিহান। জেনি চমকিয়ে তাকায় দিহানের দিকে। দিহান জেনির কাছ থেকে সরে আসে তাড়াতাড়ি। সোফায় বসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
— “তোমার এখানে আসা মোটেও উচিত হয় নি জেনি। নিচে তো দেখেই ছিলে সবাই আমাকে তোমার সাথে দেখে কিভাবে তাকাচ্ছিলো।”
— “তো?”

— “তো মানে? বুঝতে পারছো না কিছু? এখানে আসার কি এমন দরকার ছিল জেনি? বিয়ে হয়েছে বলেই কি অধিকার খাটাতে হবে?”
জেনি দিহানের পাশে বসতে বসতে বলে উঠল,
— “অবশ্যই! বিয়ে তো মানুষ অধিকার খাটাবার জন্যই করে।তাছাড়া আমি তোমার ফ্ল্যাটের আনাচে-কানাচে সব দেখবো। উঠো, উঠো দেখাবে আমাকে।”
দিহান প্রচন্ড রেগে তাকালো জেনির দিকে। জেনি ক্ষানিকটা চুপসে গেল। তবে পুরোপুরি ভাবে দমলো না। জেদ নিয়ে টেনে ধরল দিহানকে। দিহানও নাছোড়বান্দা। সে উঠবে না কিছুতেই। কয়েকবার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে পড়ল জেনি। শেষবার নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে দিহানকে উঠানোর চেষ্টা করতেই ঘটে গেল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঘটনা ক্রমে জেনির চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের বড় হয়ে যায়। দিহানও অবাক হয়ে যায় অনেকটাই। পরক্ষনেই তার কি হলো কে জানে! নিজের ওষ্ঠজোড়া দিয়ে জেনির ওষ্ঠজোড়া চেপে ধরল প্রবল ভাবে। এতে যেন জেনির অবাক হওয়ার পালা বেড়ে যায়। এদিকে কিছু সময়বাদ নিজের করা ভুল বুঝতে পেরে জেনির কাছ থেকে ছিটকে সরে যায় দিহান। নিজের করা কাজে নিজেই অবাক সে। নিজের নিয়ন্ত্রণ কিভাবে ধরে রাখতে পারলো না সে? তার ভেতরের সত্ত্বা জেনিকে পছন্দ করে বলে? নাকি জেনি তার জন্য হালাল তাই? চোখটা কুঁচকে বন্ধ করে ফেললো দিহান। না! আর এক মুহুর্তও জেনিকে এখানে রাখা যাবে না। নিজের প্রতি যে নিজেরই বিশ্বাস উঠে গেছে দিহানের। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বলে উঠল,
— “চল তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি।”
.
.
চলবে…