সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 45

৬৩.
— “সে কি জানে, তার কাজল রাঙ্গা চোখে বারংবার হারিয়ে যাই আমি। সে কি বুঝে, তার প্রেমেতে তৃষ্ণাদগ্ধ আমি। তার একেকটা নিশ্বাসে আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। তার গোলাপি গালগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে প্রতিবার। তাকে বলো, আমাকেও একটু ভালোবাসতে। তাকে বলো, নিজের স্নিগ্ধতায় যেন আমাকেও একটু ভাগীদার করে। বেশি না! সারাজীবন আমার হাতটা ধরে পাশে থাকলেই চলবে। বুড়োকালে ” ভালোবাসি” শব্দটা উচ্চারণ করে বুকের বা’পাশে মাথা রেখে ঘুমালেই চলবে। সে কি থাকবে এভাবেই আমার পাশে?”
থামলেন রেয়ান। নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলেন আমার কোলে। হাতে হাত রেখে চুমু খেতে শুরু করেন অনবরত! আমি চুপ করে আছি। মুহুর্তটাকে অনুভব করছি প্রবলভাবে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির টপটপ শব্দ কানে বেজে ওঠার সাথে সাথেই মনে এক আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। রেয়ান চোখ বন্ধ করে ফেললেন এবার। আমার এক হাত নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরলেন শক্ত করে। মাথাটা আরেকটু ভালোভাবে কোলে রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন,
— “মাথায় হাত বুলিয়ে দাও মরুভূমি।”
________________
এরপর কেটে গেল তিনদিন। এ তিনদিন মামীর কাছে অনেকটাই আনন্দে কেটেছে আমাদের। রেয়ানকে যেন চেনাই যায় নি। এ পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষই যেন তার পূর্ব পরিচিত। তার আপনজন! রেয়ানের মামী, আবদ্ধ আর দীঘির প্রতি করা যত্ন, হাসি-ঠাট্টা,ভালোবাসা সবই প্রকটভাবে মুগ্ধ করেছে আমাকে। উনি যখন সবার সাথে আনন্দ করতেন তখন তার মুখ-খানায় চেয়ে থাকতাম আমি। উনি হাসতেন। চোখটিপ মেরে ফিসফিসিয়ে বলতেন,
— “ভালোবাসি প্রিয়!”
তার হাসিতে তাল মিলিয়ে আমিও হাসতাম। তবে কখনও বলা হয়ে উঠেনি- “আমিও ভালোবাসি প্রিয়।”
আজকে সকাল থেকেই মনটা বেশ খারাপ আমার। তিন-তিনটা দিন এখানে থেকেছি। এখন চলে যেতে হবে আবার। সত্যি বলতে আমি যেতে চাই নি। তবে যেতে হচ্ছে রাহুল আহমেদের কারনে। উনি ভীষণ রেগে আছেন আমাদের প্রতি। এই তিনটা দিন একবারের জন্যও ফোন করেন নি আমাদের। তারওপর রেয়ানের হোসপিটালেও যেতে হবে। এতদিন ছুটি কাটানোর দরুণ অনেক কাজ জমা হয়ে আছে তার। ভাবতেই মনটা আরেকটু বিষন্ন হয়ে উঠল। রেয়ান কোত্থেকে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। কাঁধে থুতনি রেখে বললেন,
— “মন খারাপ।”
জবাব দিলাম না আমি। উনি আবারও একই প্রশ্ন করতেই বললাম,
— “আমার যেতে ইচ্ছে করছে না রেয়ান।”
— “আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। কেননা এতে আমারই লাভ। বাসায় যেয়ে বাবাকে আর বোঝাতে হবে না। হাসপাতালের কাজ তো আমি এখান থেকেও করতে পারবো।”
— “উহু! যাবো আমি।”
— “এইমাত্র না বললে যাবে না?”
— “সিদ্ধান্ত পাল্টে গেছে। এখন যাবো।”
— “এখন তো যাবাই। নিজের হাসবেন্ডকে জ্বালাতে তো তোমার অনেক ভালো লাগে। বলতে গেলে অনেক। আমি তো জানি ওখানে গেলে আমাকে তুমি ভুলেই যাবে। সারা দিন তুমি আর তোমার শ্বশুড় মুখ ফুলিয়ে রাখবে আমাকে দেখে। আমার কাছে আসতে চাইবে না। দূরে দূরে থাকবে। কিছু বললেই বলবে কাজ ছিল।”
আমি হেসে বললাম,
— “আপনাকে কে বলল এসব?”
— “রাতে স্বপ্ন দেখেছি আমি।”
এবার শব্দ করে হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে উনি মুখ ফুলিয়ে ফেললেন দ্রুত। আমি তার নাক টেনে ধরে বললাম,
— “এত কিউট কেন আপনি?”
— “উহু, আমি কিউট না।”
— “তাহলে?”
রেয়ান আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
— “তোমার প্রেমেতে পাগল আমি। তোমার সৌন্দর্যে সজ্জিত আমি।”

________________
তিনদিন হয়ে গেছে দিহান আর জেনির বিয়ের। এখন অনেকটা স্বাভাবিক দিহান। আগের মতো অতো চিন্তা করে না। তবে একেবারে চিন্তাও যে করে না সেরকমটা মোটেও না। তার মস্তিষ্কে একটা প্রশ্ন গেঁথে গেছে, কিভাবে সে সমাজের সামনে, জেনির বাবার সামনে নিজেকে জেনির যোগ্য করে তুলবে! কেননা সে তো বেকার! মাস শেষে নিজেরই খাবার খাওয়ার সংকট দেখা যায়। সেদিকে জেনিকে কিভাবে রাখবে সে? তাছাড়া জেনি এসবে অভ্যস্ত ছিলো না কখনও। তাহলে দিহানের জন্য কেন সে এসবের মধ্য দিয়ে যাবে? ভাবনাগুলো যেন কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইছে না দিহানের। বৃষ্টির পানিতে চিকচিক করা সবুজ ঘাসের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো দিহান। জেনির দিকে তাকালো এবার। সাথে সাথে ভেসে উঠল জেনির হাস্যজ্জল চেহারা। মৃদু হাসলো সে। মুহুর্তেই একটা নিষিদ্ধ জিনিস করতে মনটা উতলা হয়ে উঠল তার। সেটা দমিয়ে রাখতে পারলো না কিছুতেই। আশেপাশে তাকিয়ে নিলো একবার। সবার অগোচড়ে চুমু খেয়ে নিলো জেনির গালে। জেনি চমকে উঠল। সাথে কেঁপে উঠল কিছুটা। বিস্ময় নিয়ে নির্বাক তাকিয়ে রইল দিহানের দিকে। দিহান গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। মোটেও তাকাচ্ছে না তার দিকে। জেনি এবার অবাক সরে বলল,
— “এটা কি করলেন?”
— “কি করলাম?”
জেনি ভ্রুঁ কুঞ্চিত করে বলল,
— “আপনি জানেন না আপনি কি করেছেন?”
জেনির দিকে না তাকিয়ে দিহান স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
—” না। ”
—” মিথ্যা বলবেন না মোটেও। আমার গালে এখনও আপনার ছোঁয়া লেগে আছে। বলুন কেন করেছেন এমন? ”
দিহান জেনির দিকে তাকালো এবার। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
—” এমনটা কি আমি করতে পারি না জেনি? ”
সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না জেনি। কথার উল্টো পিঠে বলে উঠল,
— “বাবাকে আমাদের বিয়ের কথা কখন বলব দিহান?”
— “এত তাড়া কিসের? বললাম তো আমি একটু সেটেল হয়ে নি। আমার একটু সময় চাই প্লিজ! সবে তো মাত্র বিয়ের তিনদিন হলো।”
জেনি আর একটা কথাও মুখ থেকে বের করল না। মনটা হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেছে তার। আস্তে করে দিহানের কাঁধে মাথা রাখলো সে। দিহান কিছু বলল না। আলতো করে এক হাত দিয়ে জেনিকে আবদ্ধ করে নিলো নিজের মাঝে। এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। কিন্তু সে অস্থিরতা কি? সেটা জানে না সে!

৬৪.
আহমেদ ভিলা, মানে রেয়ানদের বাসায় এসেই আগে ফ্রেশ হয়ে নিলাম আমি আর রেয়ান। প্রথমে রেয়ান ফ্রেশ হতেই আমি চলে গেলাম ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি জনাব ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিকাল পাঁচটায় ঘুমানো? মোটেও না। কোনোমতে টেনে টুনে বিছানায় বসালাম তাকে। উনি চট করে আমাকে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
— “ঘুমাতে দাও না প্লিজ!”
— “উহু! উঠুন। আব্বু বাসায় আছে এখন। উনার সাথে কথা বলবেন।”
— “মাত্রই না এলাম। রাতে বলব প্লিজ।”
— “না! এক্ষুণি যাবেন আপনি। না গেলে কিন্তু আমি আম্মুর সাথে ঘুমাবো। আর আপনি ছাদে।”
রেয়ান গাল ফুলিয়ে ফেললেন। বাচ্চাদের মতো করে বললেন,
— “ইউ আর সো ব্যাড মরুভূমি! এভ্রি টাইম ইউ ব্লেকমেইল মি!”
তার বাচ্চাদের মতো করা মুখে ক্ষাণিকটা সময় তাকিয়ে রইলাম আমি। বুকে পাথর রেখে ঠেলেটুলে পাঠিয়ে দিলাম রাহুল আহমেদের কাছে।
রাহুল আহমেদ সোফায় বসে বসে গম্ভীরভাবে খবরের পত্রিকা পড়ছিলেন। রেয়ান তার সামনে দাঁড়াতেই উনি না দেখার ভান করে নিজের কাজেই মনোযোগ দিয়ে রইলেন। রেয়ান ধীর কণ্ঠে ডাকলেন তাকে,
— ” বাবা! ”

জবাব দিলেন না রাহুল আহমেদ। আগের নেয়ই পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিলেন। রেয়ান কি করবে, কি করবে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রাহুল আহমেদকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেলেন গভীরভাবে। পরক্ষনেই জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
— “আব্বা আমারে মাফ কইরা দাও। আমি সত্যি বলছি আমি এতদিন তোমার সাথে যা যা করেছি তার জন্য আমি অন্নেকগুলো সরি। মাফ করইরা দাও আব্বা। তোমার এই মুখ ফুলিয়ে রাখা কালা চান্দ আর দেখতে মন চায় না। একটু বোঝার চেষ্টা করো! ডাক্তারের কাজ এত সোজা না। ডাক্তারির পাশাপাশি আমি বিজনেসটা সামলাতে পারবো না। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আব্বা। মাফ কইরা দাও প্লিজ!”
রাহুল আহমেদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন রেয়ানের দিকে। কি হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে তিনিও জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে ওঠেন,
— “নীলা! তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। পাবনায় ফোন দাও তাড়াতাড়ি।”
.
.
চলবে…