সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 19

৮.
দীঘিকে নিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছে আবদ্ধ। এই সাতসকালে টিভি দেখতে মোটেও ইচ্ছে করছে না দীঘির। আর সেটা যদি খবরের চ্যালেন হয় তাহলে তো আরও না। তার বয়স এখন কার্টুন, সিনেমা এগুলো দেখার। তা না দেখিয়ে কেন যে আবদ্ধ তাকে এত সকাল সকাল খবর দেখাচ্ছে তা বিন্দু মাত্র বুঝতে পারছে না দীঘি! প্রচুর বিরক্তি লাগছে তার। কেন যে পরীক্ষার জন্য স্কুল বন্ধ দিলো, না দিলেই বরং ভালো হতো। খবর দেখতে হতো না তার। কিসব দেখাচ্ছে খবরে। আগামাথা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। তবে আবদ্ধ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে খবর। টিভির দিকে নজর রেখেই দীঘির মুখে খাবার বাড়িয়ে বলে উঠে….
— “হা! কর।”
দীঘি “হা” করতেই খাবার মুখে পুরে দিলো আবদ্ধ। নিজেও খাচ্ছে আর দীঘিকেও খাওয়াচ্ছে। কিছুক্ষন খবরের দিকে মনোযোগ দিয়ে আবদ্ধ হুট করে বলে উঠে….
— “তোর মাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসলে কেমন হয় পিচ্চি?”
অবাক হলো দীঘি। হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করল আবদ্ধ? তাছাড়া এটা তো সম্ভব না। সে চাইলেও আর না চাইলেও! তার বাবা কি কখনো তার মাকে এখানে আসতে দিবে? মোটেও না! বরং মাকে মারধোর করবে। যা চায় না দীঘি। আবদ্ধের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে দীঘি বলে উঠে…
— “ভালো হবে না। আগে তো আম্মার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলো না। আর এখন এখানে আসতে চাইলেও আব্বা আসতে দিবে না আম্মাকে।”
— “তোর আব্বা থাকলেই না!”
কথাটা আবদ্ধ বিড়বিড় করে বললেও দীঘি সেটা শুনতে পায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে…
— “মানে?”
— “মানে তোর বাপ তোর মার সাথে থাকে না।”
— “তাহলে কোথায় থাকে? আপনি কি আব্বার সাথে কিছু করেছেন আবদ্ধ? আব্বা কি আম্মাকে রেখে কোথাও চলে গেছে?”
আবদ্ধের সোজা-সাপ্টা জবাব…
— “হুম!”
— “কি করেছেন আপনি আব্বার সাথে?”
— “জেলে পাঠিয়েছি।”
— “কখন?”

— “হয়েছে এক-দু’দিন। তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আজকে বিকেলে তোর মা মানে আমার শ্বাশুড়ি মাকে আনতে যাবো। এখন থেকে উনি আমাদের সাথেই থাকবেন।”
খুশি হলো দীঘি। তার মা তার সাথে থাকবে, ভাবতেই খুশিতে নেচে উঠতে ইচ্ছে করছে তার। পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল দীঘির। এভাবে আবদ্ধের সাথে থাকা তার মোটেও উচিত না। তারওপর যদি তার মাও এ বাড়িতে থাকতে আসে তাহলে ব্যপারটা নিত্যান্তই বাজে দেখায়। তাছাড়া দীঘি তো আবদ্ধের বউ না। সে কেন থাকবে আবদ্ধের সাথে? এখন যেহেতু ওর বাবাও চলে গেছে তাহলে ও আর ওর মা শান্তিতে ওদের বাসায় থাকতে পারবে। আবদ্ধের সাথে এখানে থাকতে হবে না। ভেবেই আবদ্ধকে দীঘি বলে উঠল…
— “আম্মাকে এখানে আনা লাগবে না আপনার। আমি আর আপনার সাথে থাকবো না। আম্মা আর আমি আমাদের বাসায় থাকবো। আমাকে বিকেলে আম্মার কাছে দিয়ে আসবেন।”
মুহুর্তেই আবদ্ধ রেগে গেল। কপালের রগ স্পষ্ট তার। তবে এখন রাগ দেখাতে চাচ্ছে না আবদ্ধ। কয়েকটা বড় বড় দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল সে। দীঘির দিকে একটু ঝুঁকে দাঁতে দাঁত চেপে আবদ্ধ বলে উঠল…
— “যা বলেছিস, তা আবার ফেরত নেয়।তোর এই আশা জীবনেও পূরণ হবে না। আমি বলেছি তোর মা এখানে থাকবে মানে এখানেই থাকবে। এর উপরে কথা বলার সাহস করিস না। ভালো হবে না।”
— “আপনি এমন কেন আবদ্ধ? বুঝার চেষ্টা করছেন না কেন? সমাজ এটাকে ভালো চোখে দেখবে না। তাছাড়া আমার কেন যেন মনে হয় আমি আপনার জন্য একটা বোঝা।”
সোজা হয়ে বসল আবদ্ধ। টিভির দিকে নজর দিয়ে চলমান খবরটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল…
— “জানিস পিচ্চি! টিভিতে এই খবরগুলো দেখে আমার যত না বিরক্তি লাগে তার চেয়ে দ্বিগুণ বিরক্তি লাগে তোর এই অযুক্তিকর কথা শুনে।”
থামলো আবদ্ধ। দীঘির দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠল…
— “যদি আমি বিজ্ঞানি হতাম, আই সোয়ের! তোর মাথা থেকে এসব আজগুবি চিন্তা সরিয়ে ফেলতাম। তোর মস্তিষ্কে শুধু থাকতো আমার অস্তিত্ব আর পড়ালেখা। এর বাইরে কোনো কিছুর চিন্তাই তোর মাথামোটা মস্তিষ্কে আসতো না। উফফ! যদি এমন করতে পারতাম, তাহলে আমার জীবনটাই ধন্য হয়ে যেত রে পিচ্চি।”
মুখ বাকালো দীঘি। এমন কিছু যদি করতেই ইচ্ছে করে তাহলে করুক না। কে মানা করেছে? কিন্তু তাও এ পড়ালেখাটা মস্তিষ্কে থাকতে হবে কেন? এটা মাথা থেকে ফেলে দেওয়া যায় না। পড়ালেখা যে দীঘির জীবনের শত্রু৷ একবার যদি জানতে পারতো কে পড়ালেখা আর এসব পরীক্ষা বানিয়েছে তাহলে সে তাকে মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ফেলতো। এতে যদি দীঘি শান্ত হয়!

সকালে ঘুম ভাঙ্গে মামীর ডাকে। মামী আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর আমাকে ঘুম থেকে উঠাচ্ছেন। আচ্ছা! এভাবে আদর করলে, মাথায় হাত বুলালে কেউ কি আদও ঘুম থেকে উঠতে চাইবে? আমার মতে তো না। এসবের মাধ্যমে যেন আমার ঘুমানোর ইচ্ছে আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। চোখ বন্ধ থেকেই মামীকে জিজ্ঞেস করলাম…
— “ক’টা বাজে মা?”
— “৮টা! আর কত ঘুমাবি মিরা?বেলা হয়েছে অনেক।উঠে পড়। সেই কখন থেকে রেয়ান নিচে বসে আছে। ফ্রেস হয়ে দেখা করে আয় ওর সাথে।”
এমন কথায় বিরক্তি যেন মাথায় চেপে বসল আমার। চোখে-মুখে বিরক্ত নিয়ে মামীকে বলে উঠলাম…
— “তোমার মনে হয় না মা তুমি ডক্টর-টাকে একটু বেশিই পছন্দ করো? এত কিসের দেখা করব আমি উনার সাথে?উনি কে আমার যে উনার জন্য সাত-সকালে ফ্রেস হয়ে দেখা করতে যেতে হবে? আসছে ভালো করেছে।তুমি গিয়ে উনার সাথে গল্প করো, নাস্তা খাওয়াও! এখানে আমার তো কোনো কাজ নেই। এখন যাও, আমি আরেকটু ঘুমাবো। ডিস্টার্ব করো না আমায়।”
— “কিন্তু মিরা…”
— “কিন্তু কি মা? আমি জানি তুমি কি চাচ্ছো। তবে যা চাচ্ছো তা কখনও হবে না।”
— “একবার চেষ্টা তো করে দেখ। ছেলেটাকে অনেক ভালো লাগে আমার। নম্র,ভদ্র,ভালো ডাক্তার, তার চেয়ে বড় কথা তোকে ভালো রাখবে।”
— “কিভাবে বুঝলে তুমি উনি আমাকে ভালো রাখবেন? আচ্ছা মানলাম উনি আমাকে ভালো রাখবেন, কিন্তু আমাদের বিয়ে হওয়ার পর কখনও যদি উনার কিছু হয় তখন? সত্যি বলতে মা উনি আসলেই অনেক ভালো মানুষ। উনাকে দেখলে মনে এক অজানা বিশ্বাস তৈরি হয়। পাশাপাশি একটা ভয়ও কাজ করে। হাড়ানোর ভয়। ছোট বেলা থেকেই আমার যা পছন্দ ছিল সব এক এক করে হারিয়ে গেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ মা-বাবার মৃত্যু। জানো তোমাদের নিয়েও আমার ভয় হয়। এ-ই বুঝি কিছু হয়ে যায় তোমাদের। প্রতিনিয়ত আতংকে থাকি আমি। চাই না অন্য কাউকে এ-ই জীবনের সাথে জড়াতে। বারবার কোনো ভয়ংকর ধাক্কা সামলাতে পারবো না। আমি যেমন আছি তেমনই বেশ আছি। অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সাহসটুকু নেই আমার।”
— “তাহলে তুই কি চাচ্ছিস? সারা জীবন কি এভাবে একা থাকবি?”
— “যদি ভাগ্যে এমন কিছুই লিখা থাকে তাহলে এটাই শ্রেও।এখন কথা আর বাড়িও না। মাথা ব্যথা করছে আমার। ঘুমাবো আমি।”
কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না মামী। আমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে চলে গেলেন রুম থেকে। আমিও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না আমার। মস্তিষ্কে শুধু একটা কথাই ঘুড়ছে…”এখন ৮টা বাজে। ১০টায় ভার্সিটি। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটি যেতে হবে আমার।”
৯.
বিকেলের দিকে আবদ্ধ দীঘিকে নিয়ে চলে যায় দীঘির বাসায়। উদ্দেশ্য দীঘির মাকে আনতে যাওয়া। এতে আমি কিংবা মামী কেউ-ই দ্বিমত করি নি। এদিকে আমারও ভার্সিটি থেকে আসতে বিকেল হয়ে যায়। এসেই একটা গভীর ঘুম দিয়ে একেবারে রাত ৮টার দিকে ঘুম থেকে উঠি আমি। রাতের বেলা বারান্দায় দাড়ানো যেন আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আজও ঘুম থেকে উঠে প্রথমে চলে যাই বারান্দায়। কালকের মতোই মনরোম পরিবেশ বিরাজ করেছে চারপাশে। বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব৷ দূর থেকে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ আসছে কানে। চোখ বন্ধ করতেই রেয়ানের চেহারা ভেসে উঠে সামনে। আজ একবারও মানুষটার সাথে দেখা হয় নি আমার। কেন যেন মন বলছে এখন বৃষ্টি হবে সাথে রেয়ানও আসবেন আমার সাথে দেখা করতে।তবে মস্তিষ্ক বলছে এর বিপরীতটা! বৃষ্টিতে আসবে না, আর না আসবেন রেয়ান। কিন্তু মস্তিষ্কের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে হঠাৎ-ই বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। বৃষ্টির এক এক ফোটা বারংবার আমার মুখটা আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চট করে চোখ খুললাম আমি। বৃষ্টি তো হচ্ছে, তাহলে কি রেয়ান এসেছেন? তাড়াতাড়ি নিচে তাকালাম আমি। সত্যিই রেয়ান এসেছেন। নিজের কালো গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে হাত দু’টো বুকে ভাঁজ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

আমাকে তার দিকে তাকাতে দেখে ইশারা করে বলে উঠেন- “নিচে আসো”। সাথে সাথে রুমে চলে আসি আমি। যাবো কি যাবো না ভাবছি মাত্র। তবে রেয়ানের সাথে বোঝাপড়া করা প্রয়োজন। উনাকে আমার জীবনের সাথে জড়াতে চাইনা আমি। চাই না আমার জীবনের সাথে উনার একটু অস্তিত্বও জড়িয়ে থাকুক। ভেবেই একটা ছাতা নিয়ে ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম নিচের দিকে।
বাড়ির বাইরের আসতেই দেখলাম রেয়ান বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন৷ ভিজে নাজেহাল অবস্থা তার। তবে মুখে ফুটে আছে অফুরন্ত হাসি। আমার কাছে এগিয়ে এসে ছাতার নিচে ঢুকে পড়লেন উনি। উনার থেকে আমার দূরত্ব প্রায় কয়েক ইঞ্চি। তবে কেউ কাউকে স্পর্শ করছি না। কিন্তু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস গুলো ঠিকই স্পর্শ করছে একে অপরকে। আমাদের মুখে কথা নেই, তবুও মনে হচ্ছে নিরবতার মাঝে হাজারতা কথা বলছি দু’জন।হঠাৎ রেয়ান আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে কি যেন করেন। হাত উঠিয়ে দেখতে চাইলে বাধা দিলেন উনি। বললেন…
— “উহু! এখন দেখো না।আমি যাওয়ার পর দেখো।”
রেয়ানের দিকে একবার তাকালাম আমি। সাথে সাথে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কি করতে এসেছি আর কি হচ্ছে। মাথার সব চিন্তা ভাবনা যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।এর মধ্যে রেয়ান বেশ অভিমানি কণ্ঠে বলে উঠেন…
— “জানো মরুভূমি আমি তোমাকে ভালোবাসি না।একটুও না! ভালোবাসি আমার প্রেয়সীকে। তাকে বলো, বৃষ্টির সময় তার হাতে-হাত রেখে এক ছাতা নিচে দু’জন দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাস করতে আমার ভালো লাগে।তাকে বলো, তার এক একটা নিশ্বাস প্রতিনিয়ত গুণে গুণে রাখি আমি। কিভাবে জানো? কারন তার নিশ্বাসেই যে আমার নিশ্বাস উঠানামা করে। আমার নিজের নিশ্বাস গুণলেই তো তার নিশ্বাস গুণা হয়ে যাবে তাই না?”
হাসলেন রেয়ান। এ মুহুর্তে তার হাসি আমার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর হাসি মনে হচ্ছে। আমার চোখে চোখ রেখে রেয়ান আবার বলে উঠলেন…
— “ভালো থেকো প্রেয়সী।খোদা হাফেস!”
বলেই চলে যেতে লাগলেন উনি। তাকেও “খোদা হাফেস” বলতে ইচ্ছে করলো আমার। তবে পারলাম না বলতে। উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম মাত্র। রেয়ান যেতেই ডান হাতটা উঠিয়ে দেখলাম আমি। কিঞ্চিত অবাক হলাম! ডান হাতের অনামিকা আঙুলে একটা সাদা পাথরের আংটি। তাহলে কি তখন উনি এটা পড়িয়ে ছিলেন আমার হাতে?
.
.
#চলবে🍁