সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 40

৫৫.
ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অস্থির হয়ে হাঁটছেন রেয়ান। নিজের বাবার প্রতি আকাশ সমান রাগ হচ্ছে তার। এভাবে কেউ নিজের ছেলেকে শাস্তি দেয়? তার জানা মতে তো না! পৃথিবীর সবচেয়ে জেদি আর একরোখা বাবা হয়তো রাহুল আহমেদ-ই। এজন্যই হয়তো রেয়ান এমন হয়েছেন। রেয়ান ভেবে পান না, তার বাবা যুবক থাকাকালিন ঠিক কেমনটা ছিলেন? এর চেয়েও অধিক জেদি? নাকি অধিক থেকেও দ্বিগুণ অধিক? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেয়ান। যদি পারতেন তাহলে রাহুল আহমেদকে সিন্দুকে বন্দি করে কোথাও রেখে দিয়ে আসতেন। তাহলে যদি তার শান্তি!
ভাবনার মাঝে ডুবে থেকেই বাড়ির বাইরে চলে আসলেন রেয়ান। নিজ রুমের সামনে দাঁড়িয়ে জানালা আর বারান্দা দু’টোই পরখ করে নিলেন একবার। কখনও যদি চুরি করে বাসাত ঢুকেছেন রেয়ান, তখন উনি জানালা দিয়েই নিজ রুমে ঢুকতেন। বারান্দা দিয়ে তো মোটেও না! কেননা বারান্দা দিয়ে রুমে ঢুকতে হলে তার পাইপ বেয়ে বেয়ে উঠতে হতো। অপরদিকে একটা মই দিয়েই অনায়াসে জানালা দিয়ে রুমে প্রবেশ করতে পারেন উনি। তাই এবারও জানালা দিয়েই রুমে ঢুকবেন ভাবছেন। যেই ভাবা সেই কাজ! তাড়াতাড়ি একটা মই নিয়ে এসে জানালা বরাবর রেখে “বিসমিল্লাহ” বলে লেগে গেলেন উপরে উঠতে।
এদিকে আমি ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি প্রায় অনেক্ষন। ঘুম আসছে না কিছুতেই। পাশেই রেয়ানের মা নীলা রাহমান ঘুমিয়ে আছেন। উনার থেকে রেয়ান আর রাহুল আহমেদের ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে গেছি ইতিমধ্যে। যার মূল প্রসঙ্গ ছিল রেয়ান আর রাহুল আহমেদের শত্রুতার কারন। তার সাথে এটাও জেনে গেছি কেন নীলা রাহমান আজকে আমার সাথে থাকবেন। কেমন যেন খারাপ লাগা কাজ করছে রেয়ানের জন্য। যখন রাহুল আহমেদ নীলা রাহমানকে আমার সাথে ঘুমাতে বলে রেয়ানকে ছাদে ঘুমাতে বলেন, তখন তার মুখ দেখার মতো ছিল। মনে হচ্ছিল সব’কটাকে এখনই খেয়ে ফেলবেন উনি। ভাবতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল রেয়ানের সেই অসহায় আর রাগ মিশ্রিত মুখটা। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল আমার। পরক্ষনেই চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় লেগে গেলাম আমি। মিনিট পাঁচ-এক পর হঠাৎই কারো ফিসফসিয়ে কথা বলার শব্দ কানে বেজে উঠল আমার। আদো আদো চোখে রেয়ানকে নিজের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখতেই তড়িৎ গতিতে উঠে বসলাম আমি। চমকালাম অনেকটাই। জোড়ে কথা বলতে গিয়েও বললাম না। মৃদু সরে বলে উঠলাম…
— “আপনি এখানে কিভাবে আসলেন? বারান্দা দিয়ে?”

— “না। জানালা।”
— “ভালো করেছেন। এখন যান এখান থেকে। কেউ দেখলে কি বলবে? আপনার বাবা রেগে যাবে। যান এখান থেকে।”
— “আমি আমার বউকে নিতে এসেছি। কেউ দেখলে কার কি? আর রইল তোমার শ্বশুড়ের কথা! তাকে ভয় পাই না আমি। সে কে আমার বউকে আমার কাছ থেকে আলাদা রাখার?”
— “আপনার বাবা। এখন প্লিজ যান। মা উঠে গেলে সমস্যা হবে। সকালে দেখা করব আমি। এখন যান। ”
— “শুনো মরুভূমি! আমি যদি এখন অবিবাহিত হতাম কিংবা তুমি যদি আমার বউ না হতে তাহলে একা একা রাত কাটিয়ে দিতাম অনায়াসে। কিন্তু তোমার আফসোস! আমি এখন বিবাহিত। সো একা ঘুমানোর প্রশ্নই আসে না। এখন চলো আমার সাথে। এত সাফাই গাইতে মোটেও ভালো লাগছে না আমার।”
বলেই হাতটা টেনে ধরলেন উনি। আমি বাঁধা দিয়ে বলে উঠলাম…
— “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
— “গেলেই বুঝবে।”
— “আমার বোঝা লাগবে না। আপনি বুঝুন। মা পাশেই ঘুমিয়ে আছেন। ঘুম ভেঙ্গে যদি আমাকে তার পাশে না দেখতে পান তাহলে…”
আমার কথা শেষ না হতেই রেয়ান ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠেন…
— “তাহলে কি?”
— “বাবাকে বলে দিবেন। ফলে উনি রেগে যাবেন। আপনার প্রতি, আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। পরে হয়তো আরও বড় শাস্তি দিবেন আমাদের!”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই আশাভরা দৃষ্টিতে রেয়ানের দিকে তাকালাম আমি। উনি ভ্রুঁ আরও কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হাত টেনে ধরে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠেন…
— “কিচ্ছু হবে না চলো।”
অতপর জোড় করে টেনে নিয়ে গেলেন রুমের বাইরে। আল্লাহ’র কাছে দোয়া করছি এতটুকু সময়ে যেন নীলা রাহমানের ঘুম না ভাঙ্গে। অথচ নীলা রাহমান জেগে আছেন প্রথম থেকেই। ঘুমের ভান ধরে ছিলেন উনি। আমাদের প্রত্যেকটা কথা শুনেছেন। এমন কি রেয়ানের সাথে আমাকে যেতে দেখেছেন। তবে বাঁধা দেন নি উনি। আদরের ছেলের জন্য এতটুকু করতেই পারেন নীলা রাহমান। তাছাড়া তারও মনে হয়, রাহুল আহমেদ একটু বেশিই অন্যায় করছেন রেয়ানের সাথে।

________________
পা টিপে টিপে বাড়ির একদম শেষপ্রান্তে এসে গেছি আমি আর রেয়ান। গেটের কাছে আসতেই দেখলাম দারোয়ান চাচা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তা দেখে বাঁকা হাসলেন রেয়ান। তার হাসির মানে বুঝলাম না আমি। তার দিকে চেয়ে রইলাম মাত্র। উনি দারোয়ান চাচার বুকের পকেট থেকে গেটের চাবি নিতে গেলেই হাত ধরে ফেললাম তার। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম…
— “কি করছেন কি? উনি জেগে যাবেন তো!”
রেয়ান স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে উঠলেন…
— “উনার গায়ে এখন এক জগ পানি ঢাললেও উঠবেন না উনি।”
— “মানে?”
রেয়ান বাঁকা হেসে চাবি নিতে নিতে বলে উঠলেন…
— “ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি আমি।”
আমি হতবাক। এ মানুষটা কি বলছে এগুলো? পাগল হয়ে গেছে নাকি? চোখ বড় বড় করে রেয়ানের দিকে তাকাতেই উনি মুখে দুষ্টু হাসির রেখা ফুঠিয়ে বলে উঠলেন…
— “এভাবে তাকিও না তো। ইচ্ছে করে একদম…. উম! বাকিটা বুঝে নিও।”
আবারও বাঁকা হাসলেন রেয়ান। গেট খুলে হাত টেনে নিয়ে গেলেন গাড়ির কাছে। তারপর দ্রুত গতিতে গাড়ি স্টার্ট করে গেট পেরিয়ে বেড়িয়ে গেলেন নিজ গন্তব্যে। তাকে কতবার বলেছি “কথায় যাচ্ছেন? বলুন না!” তার একবাক্যের উত্তর- “গেলে দেখবে।” কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। বারবার জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি তাকে। শেষে কস্টেপ দিয়ে মুখ আটকে দেন আমার। হাত দিয়ে কস্টেপ খুলতে গেলেই গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে হাত বেঁধে দেন। ফল স্বরুপ মুখ গোমড়া করে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি আমি।তার দিকে না তাকালেও বুঝতে পারছি উনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কিছুক্ষন পরপর। কিন্তু আমি তার দিকে তাকায় নি একবারও। ক্ষাণিকবাদ রেয়ান গাড়ি থামিয়ে আমার হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দেন। আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন গাড়ি থেকে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে বলে উঠেন…
— “তো জায়গাটা কেমন?”
— “বাজে!”
কথাটা বলেই আশেপাশে তাকালাম আমি। সাথে সাথে নিজের কথায় নিজেরই রাগ উঠে গেল। কেননা জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর। সরু রাস্তার দুই পার্শ্বে এক সারি গাছপালা। চাঁদের আলো সরাসরি পড়ছে রাস্তার ওপর। দমকা হাওয়া বইছে চারদিকে। সবমিলিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ এক হাত প্যান্টে রেখে অন্য হাত দিয়ে আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলেন রেয়ান। আকাশের পানে চেয়ে শান্ত সরে বলে উঠলেন…
— “আজ রাত দু’জন পাশাপাশি হাঁটবো মরুভূমি। সারাটা রাত! তোমার সমস্যা হবে কি?”
প্রতিউত্তরে কিছু বলতে পারলাম না তাকে। রেয়ানের হাতটা ধরে ফেললাম শক্ত করে। মুহুর্তেই এক কঠিন অনুভূতি এসে হানা দিলো মনে। যা শিহরণ বইয়ে দিলো সারা শরীরে!

৫৬.
টেবিলে খাবার বাড়ছেন মামী। হঠাৎ কি মনে করে “মীরা” বলে জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলেন উনি। পরক্ষনেই মনে পড়লো মীরার তো বিয়ে হয়ে গেছে। সে তো এখন তার শ্বশুড় বাড়িতে। এখানে তো নেই সে। তার নাম ধরে ডাকলেই কি তার সারা পাওয়া যাবে? সে কি আসবে তার মামীর কাছে? মোটেও না! দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মামীর। সাথে চোখ থেকে কিছু পানির কণা। আঁচল দিয়ে মুছে ফেলেন সেগুলো। আবদ্ধ আর দীঘি বসে আছে সামনেই। মামীকে কাঁদতে দেখে তাদেরও চোখে পানি চলে আসে। আবদ্ধ দীঘির হাত শক্ত করে ফেলে। দীঘিও তাই!
________________
চট জলদি রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় দিহান। ভার্সিটির কাছে পৌঁছাতেই রিকশা থেকে নেমে পড়ে সে। ভাড়া মিটিয়ে কাঁধের ব্যাগটা আরেকটু উঠিয়ে নিয়ে পা বাড়ায় ভার্সিটির ভেতরে। হঠাৎ দেখা হয়ে যায় জেনির বাবার সাথে। দিহান যেহেতু তাকে চিনে না, তাই না দেখার ভান করেই চলে যাচ্ছিল সে। তবে জেনি তার বাবাকে দিহানের ছবি দেখিয়ে ছিল। তাই তার কোনো অসুবিধে হয় নি দিহানকে চিনতে। মুখে হাসি ফুটিয়ে দিহানের সামনে দাঁড়ান তিনি। দিহান ভ্রুঁ কুঁচকায়। বলে উঠে…
— “আমি কি আপনাকে চিনি স্যার?”
— “না। আমার মেয়েকে চিনো।”
— “মানে?”
— “জেনির বাবা আমি।”
চেহারা স্বাভাবিক করে ফেলে দিহান। মৃদু হেসে বলে উঠে…
— “আসসালামু আলাইকুম আংকেল। কেমন আছেন?”
— “ভালো। তা আমার মেয়েকে তোমার কেমন লাগে?”
— “জ্বী?”
— “দেখো ঘুড়িয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি না আমি। সোজাসোজি বলছি। আমার মেয়েকে ভালোবাসতে কত টাকা নিবে তুমি। জাস্ট এমাউন্ট বলো। এক ঘন্টায় টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
দিহান আবারও ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে ফেলে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে জেনির বাবাকে পর্যবেক্ষন করে নেয় সে। কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না সে। তবে তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিচ্ছে-” কিছু একটা অতি খারাপ হবে কিংবা হচ্ছে।”
.
.
চলবে…