বধুবরন

বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 08

এই শুভা আমি গেলাম।রাবু, সামি,রাতুল কে দেখে রাখিস।পারলে ভাতটা রেঁধে রাখিস তো?
শুভা শর্মির সাথে মুড়ি মাখা খাচ্ছিল আর গল্প করছিল। তখনই দেখলো বড় মা নতুন শাড়ি পড়ে পরিপাটি করে ব্যাগ হাতে কোথায় যেন যাওয়ার জন্য বেরুচ্ছে।
“- কই যাও বড় মা!
“-আছে কাজ আছে।তোকে যা বলেছি করে রাখিস।তোর শরীরে এখনও জ্বর আছে।পারলে শরীর মাথা একটু ধুয়ে মুছে নিস মা।
“- ও বড় মা! বলো না।এই শাড়ি তো তুমি দাওয়াতে ছাড়া পড়ো না।কেউ কি দাওয়াত দিয়েছে?
“- আরে না! কে দাওয়াত দেবে।যাচ্ছি একটা কাজে এসে বলবো।এই শর্মি চল
“- শর্মি কই যাবে?
“-ঐ তো আমাকে নিতে আসছে।
“- কি রে শর্মি? ব্যাঙ্গের মতো সব কথা পেটে রেখে এতোক্ষন ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করছিলি আমার সাথে? মাকে কই নিচ্ছিস?
“- ওওওও আসলে ভুলেই গেছি তোকে বলতে।শুভা শর্মির দিকে কপাল কুচকে তাকাতেই শর্মি বোকা বোকা হেসে বলে,
“- সত্যি বলছি! ভুলে গেছিলাম।আন্টিকে মা ডাকছে।শাড়ির কাজ দেবে তো তাই।
“-সেই জন্য মা সেজেগুজে যাচ্ছে? ও বড় মা।সত্যি বলো?
“- আরে মহা জ্বালায় পড়লাম তো।যা যাবো না।
“- আমি কি তাই বলেছি? তুমি সত্যি করে বললে কি হয়?
“- আমি মিথ্যা কই বললাম।চুপ করে ঘরে থাকিস।সন্ধ্যা হয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে দিস।আমি আশিককে বলবো আজ যেন তাড়াতাড়ি ফেরে।আসি।শর্মি চল।
শুভা অসহায়ের মতো ছলছল চোখে চেয়ে রইল।শর্মির উপর খুব রাগ হচ্ছে। একটু আগে হুদাই চুমাটা দিছে।এখন মন চাচ্ছে চুমা ফেরত নিয়ে কামড় বসিয়ে দিতে।শর্মি যেতে যেতে পেছন তাকাতেই শুভা কামড়ের ভঙ্গিতে ঝাড়ি মারে।শর্মি তা দেখে ভয়ে আর তাকায় না।শর্মি জানে ও যা করছে শুভার ভালোর জন্যই করছে।শুভাকে সুন্দর সুখী জীবন দেওয়ার জন্যই করছে।
নীল মেহেরুন খাতুনের ঘরের বিছানায় বসে মোবাইলে গেমস খেলছে এক মনোযোগে।মেহেরুন খাতুন অনেক ক্ষন বসে বসে নীলের ভাব বোঝার চেষ্টা করছে।কিন্তু বুঝতে পারছে না।
“- দাদুভাই! এসব কি শুনছি আমি?
“- কোনসব কি শুনছ?
“- তুই নাকি বিয়ে করছিস?
“- ওহ হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ।কাল ফজর ওয়াক্তের পরই বিয়ে।মসজিদেই হবে।কোনো জাঁকজমক ছাড়াই।দাওয়াত তো দিয়েছি পাও নাই।কথাগুলো নীল গেমস খেলতে খেলতেই বললো।
“- কি বাচ্চাদের মতো মোবাইল নিয়ে পড়ে আছিস? আমার দিকে তাকা?
“- হ্যাঁ বলো?
“- তুই এমন কেন করছিস? মিরার কথা ভুলে গেছিস?
“- না ভুলি নাই।তবে কাল বিয়ের কবুল বলার সাথে সাথে ওর নাম নিশানা ভুলে যাব।
“- পাগলামো করছিস কেন? বিয়ে ছেলে খেলা না।যে জিদের বসে করলি আবার ছাড়লি।
“- ছাড়ছে কে?অনেক তো বড় খেলা খেললাম কিন্তু মজা পেলাম না।এখন ছেলে খেলায় খেলবো দেখি যদি লাইফে কোনো পান্স পাই।
“- পান্স পাওয়ার জন্য মানুষ বিয়ে করে? বাপের জনমে এমন কথা শুনিনাই তো?
“- বাপের জনমে শোনো নাই তাই বলে কি নাতির জনমেও শুনবা না।বাহ!পিঠা টা তো দারুন হয়েছে? মম! মম!
নীলের ডাক শুনে নাহিদা খান দৌড়ে আসে শ্বাশুড়ির ঘরে।শ্বাশুড়ির মুখে রাগের ছাপ দেখে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে ছেলেকে আস্তে করে জবাব দেয়,
“- বল বাবা!বড় বউয়ের মুখে বাবা ডাক শুনে মেহেরুন খাতুনের চাপা রাগ দাউ দাউ জ্বলে ওঠে।এতোক্ষন নীলের কারনে যে রাগ চাপা ছিল তা উগলে দিল বউয়ের উপরে।
“-সারাদিন কি করো বড় বউ!আমার জুতা জোড়া ময়লা দেখো না।যতোসব আক্কাইমা জুটছে।
“- মা! আমি এক্ষনি ধুয়ে দিচ্ছি দিন?
“- থাক! ছেলের সামনে আর নাটক দেখাতে হবে না।যাও দেখো কি বলে তোমার গুনধর পুত্র। একটু বুঝাও! জন্ম দিয়েই কাজ শেষ নাকি তোমার?আমাদের ছেলে পেলে তো এমন না।তোমার টা এমন হয়ছে কেন? নাহিদা সকালেই শ্বাশুড়ির ঘর বিছানা জুতাসব ঝেড়ে ধুয়ে পরিষ্কার করেছে।তবুও শ্বাশুড়ি তাকে বকবে সেটা নাহিদা জানে।এ বাড়িতে উচ্ছিষ্টের মতো দাত কামড়ে পড়ে আছে নাহিদা।মায়ের অপমানে পিঠা আর গলায় ঢোকে না নীলের। দাতে চাবাতে চাবাতে চুপ করে বসে থাকে।
নাহিদা ছেলের পাশে এসে দাঁড়ায়।
“- বল বাবা! কিছু লাগবে?
“- তোমাকে লাগবে? চলনা মা আমার সাথে।কেন এতো অপমান সহ্য করে পড়ে আছ? কি আছে এই বাড়ি?
“- নীল! আবার শুরু হয়ে গেলি? এসব কথাবার্তা আমার পছন্দ না।এ বাড়িতে বউ হয়ে ঢুকেছে লাশ হয়েই তবে বের হবো।নীল মাকে আর কিছু বলে না।বলে লাভ নেই।কোনোদিন লাভ হয় ও নি।স্বামী ভক্ত মহিলাটা কোনোদিন নিজের আত্মসম্মান বুঝলো না।নাহিদা নীলের মন খারাপ করতে দেখে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“- রাগ করিস না বাবা! জানিস ই তো এ বাড়ির লোকেরা আমার উপর কতো ভরসা করে।তাদের ভরসা উপেক্ষা করে কি করে যাই বল?
“- মা আমার কষ্ট হয় তোমাকে এভাবে দেখলে। কেন বোঝো না তুমি?
“- আরে নীল কাকে কি বলিস?তোর মা হলো মাদার নাহিদা।সবার ঠেকা নিয়ে রাখছে।মরে যাবে তবুও ঠেকার কিছু হতে দেবে না।নীলের ছোট চাচি আয়শা গ্লাসে পানি নিয়ে নীলকে দিতে দিতে বলে,
“- আহ! আয়শা কি বলছিস? মা বকবে
“- বকলে বকুক।সে তো ঐ ই পারে।হ্যাঁ রে নীল? বউ মা কে দেখাবি না?
“- উমম! এখন না।
“- কেন! কেন?
“- ওটা সারপ্রাইজ তোমাদের জন্য।এখনই বলা যাবে না।নীল কথাটা বলেই চাচীর হাত থেকে পানিটা নিয়ে খেলো
“- ইশ! এমন কেন তুই? শুধু আমাকে দেখা।আমি না তোর চাচী হই।ওয়াদা কাওকে বলবো না।
“-চাচী ইমোশনাল ব্লাকমেইল করো না তো।বিয়ের দিনই দেখবা।এর আগে না।তবে তোমাদের হবু বউ মার কিছু গুনের কথা আমি বলতে পারি।দাদীর গম্ভিরকরা ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।
“-বল! দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই।কি আট করার।
“-দারুন রান্না করতে পারে।একদম মায়ের মতো রান্নার হাত।তুমি ওর হাতের রান্না খেলে জীবনেও ভুলতে পারবা না।মা ও সব ধরনের রান্না পারে বুঝলে?তোমার এই পিঠা বানানোর নিয়ম একদিন সময় করে দেখিয়ে দিবা তো।ছেলের কথার জবাব দেওয়ার সাহস নাহিদা শ্বাশুড়ির উপস্থিতিতে পাই না।
“- সিরিয়াসলি?
“- হুম।
“- যাক! মিরার মতো বেগুনের রান্না খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। হি! হি!
“- আয়শা! মা!
“- আরে বড় ভাবি এতো ভয় পাও কেন? ঠিকই তো বলছি।মালা আপা মেয়েটাকে কিছু শিখিয়েছে সাজগোজে ছাড়া।
“- ছোট বউ মা! আমি কিন্তু সব শুনছি।তোমার পাখনা গজাচ্ছে দেখছি।
“- ওটা তো আমার জন্মের পর থেকেই গজানো আম্মা। আচ্ছা নীল যাওয়ার সময় দেখা করে যাস কথা আছে।এখানে বেশিক্ষণ থাকলে অনেকের আবার অনেক কিছু হয়ে যাবে।বড় ভাবি তুমিও চলো।ছেলের কথা তো শুনবা না তাহলে এখানে থেকে কি করবা চলো?
আয়শা নাহিদাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল ঘর থেকে।
“- দাদী আমি তাহলে চলি?
“- কই যাবি?
“- বিয়ের বহু কাজ বাকি? জাঁকজমক করে না হলেও তো বিয়ের একটা প্রস্তুতির বিষয় আছে না।প্রতিদিন তো মানুষ বিয়ে করে না তাই না?স্পেশাল মোমেন্ট বলে কথা।
“-তুই তো নাস্তিক। আল্লাহ খোদা বিশ্বাস করিস না তাহলে মসজিদে বিয়া করবি কেন?
“- হা!হা! হা!
“- হাসছিস যে? হাসির কিছু বলছি?
“- অবশ্যই বলছ? আমি নাস্তিক বলে মসজিদে বিয়ে করতে পারবো না?
“- না পারবি না।যার সাথে তোর সম্পর্ক ভালো না তার ঘরে কি করে যাস।লজ্জা করে না?
“- না করে না।তার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ কে বললো?তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে তবে সেটা তোমাদের মতো না।আর আমি নাস্তিক আমার বউ তো না।তাই ওর খুশিতেই মসজিদে বিয়ে করবো। বুঝেছ?
“- আজব কথাবার্তা তোর।কোন পাপ যে করছিলাম যার শাস্তি আল্লাহ আমারে দিচ্ছে।
“- ভেবে দেখো কোন পাপ করেছিলে।মনে না পড়লে বলো আমিই মনে করিয়ে দেই।
“- দাদুভাই না ভালো।মিরার কথা একটাবার ভাব।ও বেচারি তোর জন্য পাগল।তুই বিয়ে করছিস শুনে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিছে।চলে আসবে নাকি। ওরে কষ্ট দিস না নীল।
“- দাদী আমি আসি!
“- এই শোন! বস
“- দাদী তোমার এসব আলাপ শোনার ইচ্ছা আমার নাই।অন্য কথা থাকলে বলো।
“- বিয়ে তাহলে তুই করেই ছাড়বি?
“- হুমম।
“-মেয়ের চৌদ্দগুষ্টির পরিচয় দে।মেয়ে দেখতে কেমন? গোলাপি ফর্সা না সাদা ফর্সা?নীল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
“- কিছুই বলবো না।কাল আসো সামনাসামনি সব দেখিয়ে দেব। আসি।ভালো থাকবা।
মেহেরুন খাতুনের দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা নাতির কথা শুনে।তার মতো পরহেজগার মহিলার নাতি এমন নিচ জাতের কেমনে হয় সেটাই তিনি ভেবে উঠতে পারেন না।তারপর বলেও গেল না কাকে বিয়ে করছে।কালো ছোটো বংশের কেউ নয়তো?মেহেরুনের বিপি হাই হয়ে গেল।চিৎকার করে উঠলো অসুস্থ ভাব নিয়ে,
“- ও বড় বউ! বলি কই গিয়ে মরলে? আমার বিপির বড়ি দিয়ে যাও।আল্লাহ রহম কর আল্লাহ। মনে মনে দুআ দুরুদ পড়তে লাগলেন বিপদ মুক্তির জন্য।
শুভা কেঁদে কেটে অস্থির। কোন রামস্বর্ণা নাকি বলেছিল যতো হাসি ততো কান্না।ঠিকই বলেছিল।শুভার অবস্থাও তেমন। কালকের হাসির দ্বিগুণ কাদছে।
“-বড় মা এমনটা করতে পারলো?হুট করে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে আমাকে না জানিয়েই।কালই বিয়ে তাও ভোর বেলা।জীবনেও শোনে নি ভোর বেলা বিয়ের কথা।
“- এই শুভা দে মেহেদী লাগিয়ে দেই।শর্মি হাসতে হাসতে কাভেরি মেহেদির টিউব নিয়ে বসে শুভার সামনে।শুভার মেজাজ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠে।শর্মির চুলের মুঠি ধরে খাটে ফেলে ওর উপর উঠে বসে।
“- বেঈমানী! এতো বড় ধোঁকা দিলি? এতোবড়! তোরে খুন করে জেলে যাবো তাহলে তো বিয়ে হবে না আমার।
“- ঐ সর! আমি কি করছি? জিগা বড় মা রে।আমি কিছুই জানি না।
“- মিথ্যাবাদি! চুপ।
“- শাকিব খানের মতো ডায়লগ হয়ে গেছে গা শুভা।হি! হি!
“- কুত্তি! মজা লস।আমার বিয়া হইলে বড় মা’দের কে দেখবো ক?
“- কেন কুত্তাওয়ালা ব্যাডা।
শুভা চোখ বড় বড় করে থম মেরে বসে পড়ে পাশে শর্মির কথা শুনে।বরফের মতো জমে গেছে শরীর।ভয়ে কলিজা ফরফর করছে।
“- ঐ শর্মি এসবের মধ্যে ঐ বদটারে আনলি কেন?
“- আমি আনতে যাবো কেন? সে আগে থেকেই আছে।দে হাত দে! আচ্ছা নাম কি লিখবো? কুত্তাওয়ালা ব্যাডা না নীল? হি! হি! হি!
শুভার মনে হলো কেউ কানের মধ্যে সিসা ঢুকিয়ে দিয়েছে।পুরো কান মাথা জ্বলছে।শর্মির গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো শুভা।
“- ফাজলামি করিস? বেয়াদ্দপ ছেরি।ও বড় মা।বড় মা।
“- কি হলো কি?
“- তুমি আমারে বিষ দাও আমি খাইয়া মরে যাই।
“- এসব কেমন কথা? কাল তোর বিয়ে আর আজ মুখে অলক্ষুণে কথা আনছিস? কি রে শর্মি গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছিস কেন? শুভার হাতে মেহেদী লাগা।
“- আন্টি!
“- ঐ চুপ কর।না হলে থাবড়ায়া তোর সব দাত ফেলে দিব।বড় মা এমন করো না বড় মা।আমি ঐ বদ লোককে বিয়ে করবো না বড় মা।তুমি জানো না ঐ লোকটা কতো খারাপ?
“- সব জানি আমি।নীল সব বলেছে।তুই আমাকে এতো বড় কথা লুকিয়ে ছিলি কোন সাহসে? বিয়ে ঐ ছেলেকেই করতে হবে।নয়তো আমার মরা মুখ দেখবি।শর্মি লাগা মেহেদী দেখি ও কি করে?
শুভা বড় মার রাগ দেখে কেঁদে কেটে শেষ।রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ে।নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহ যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়।কিন্তু কিভাবে হবে? রাত তো পোহালো বলে।শুভা মনে মনে জেদ নিয়ে আসে বিয়ে কোনোমতেই ঐ নীল কে করবে না।দুইদিন যাকে সহ্য করতে পারে নাই।যার উপস্থিতিতে বুকে ভয় ছাড়া কিছুই জাগে না তার সাথে সারাজীবন কেমনে সংসার কাটাবো? অসম্ভব। একটা নাস্তিক, চরিত্রহীন লোককে শুভা মরে গেলেও বিয়ে করবে না।হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসলো বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথাও দু’তিন দিন থেকে আসবে।তারপর সব ঠিক হয়ে গেলে চলে আসবে শুভা।কিন্তু যাবেটা কোথাই? হঠাৎ মনে পড়লো সেন্টমার্টিন মৌ আপুর বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসলে কেমন হয়?বেড়ানোও হল কাজের কাজও হলো। শুভা আস্তে আস্তে পা টিপে।ব্যাগে কাপড় টাপড় ভরে বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলো।রাতে শূন্য গলিতে কুকুর গুলো দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা ছিল।পুরো রাস্তা শুনশান।একটা দুটো কুকুর ছাড়া কেউ নাই।হাত ঘড়ি দেখে নিল শুভা।৪ টা বাজতে এখনও ৫ মিনিট।চুপচাপ ঐ দোকানের পাশে ঘাপটি মেরে বসে প্রথম বাসেই উঠে পড়বে বলে মনে মনে চিন্তা করে।৪ টা বাজতেই শুভা দেখলো কেউ একজন কালো টিশার্ট পড়ে এদিকেই আসছে।অন্ধকারে মুখটা দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো।পাগলের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হয় কিছু হারিয়ে ফেলেছে। শুভা এক কোনে চুপচাপ বসে থাকায় শুভাকে দেখা যাচ্ছে না।কিন্তু ও সব দেখছে।শুভা লোকটার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো।কখন ৫ টা বাজবে সেই আশায় বুক ধড়ফড় করছে রাতের বেলা এসব জায়গা মেয়ে মানুষের জন্য মোটেও সেফ না।তবুও ঐ নীলের হাত থেকে বাঁচার জন্য শুভা সব রিস্ক নিতে প্রস্তুত। অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা ভাবতেই মনে হলো কেউ ছায়া দিয়ে দাড়িয়ে আছে সামনে।শুভার ভয় হচ্ছে ভুতটুত না তো? আল্লাহ রক্ষা কর।
“- এত্তো সাহস তোমার? আমাকে ফাঁকি দেওয়া চিন্তা করো?
“- আআআপপনিইই,, নীলের গলা শুনে লাফ দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।আমতা আমতা করে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঠাসস করে একটা চড় শুভার গালের উপর পড়ে। শুভা গালে হাত দিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে যায়।নীল টানত টানতে গাড়িতে উঠিয়ে শুভার বাসায় নিয়ে আসে।মনিরা রাগে শুভাকে মারতে গেলে নীল বাঁধা দেয়।মনিরা শুভার উপর অনেক রেগে যায়।শর্মি নিজ হাতে শুভাকে বিয়ের কাপড় চোপড় পড়িয়ে মসজিদে নিয়ে আসে।শুভা এই সময়ের মধ্যে একটা কথাও বলে নি।রাগে ফুসেছে শুধু।মসজিদে এসে দেখে নীল কালোর উপর সাদা, গোলাপি ফুলের কাজ করা পাঞ্জাবি পড়েছে। শুভা একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।নীলের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে রাগে গা জ্বলছে শুভার।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ব্যাটা আমাকে বিয়ে করার শখ তোকে আমি হাড়ে মাংসে বুঝিয়ে দেব।নীলের কয়েকজন বন্ধু, কাজের লোক,শর্মির বাড়ির সবাই আর শুভার বাড়ির সবাই ছাড়া এই মুহুর্তে কেউ নেই মসজিদে।একটু পর ফজরের আজান হলো।সবাই নামাজ পড়লেও নীল পড়লো না।শুভা রাগে চোখ ছোট করে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল নীলের থেকে।নামাজ শেষে সবাই নীলের পাশে শুভাকে দেখে একটু চোখ কুচকালো।একজন তো বলেই ফেললো যৌতুক কতো নিচ্ছেন ভাই? শুভার রাগ কান্নায় রূপ নিল।এই কারনেই শুভা বিয়ে করতে চাই না।শুভা জানে ও কারোর উপযুক্ত না।রূপ দেখেই এসব বলছে যখন জানবে শুভার বংশ পরিচয়ও নেই তখন কি হবে? না বিয়ে যে করেই হোক আটকাতে হবে।সারাজীবন ছোট হয়ে থাকতে পারবে না শুভা।দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসা,বিশ্বাস আর পরস্পরের প্রতি অগাধ সম্মান মর্যাদা থাকতে হয়। নীলের মতো কোটিপতি,সুদর্শন ছেলে আমাকে কোনোদিন সেটা দেবে না।স্বামী হিসেবে শুধু ভোগই করবে সম্মান মর্যাদা কোনোদিনই দেবে না।আর তাকে বিশ্বাসও কোনোদিন আমি করবো না।তাহলে এমন বিয়ের মানে কি?শুভার সকল বাঁধা, অনিচ্ছা উপেক্ষা করে বিয়েটা অবশেষে হয়ে গেল।শুভার চোখের জল নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মতো বইতে লাগলো।
শুভা নীলের ঘরে চুপচাপ বসে আছে।কোনো ফুলটুল দিয়ে সাজানো নেই।সিম্পল যেমন ছিল তেমই আছে।শুভার কিছুই ভালো লাগছে না কিছুই না।শুভা ভাবতে ভাবতে সারারাত না ঘুমানোর কারনে কখন যে ঘুমিয়ে গেল টেও পেলো না।হঠাৎ অনুভব করলো কেউ গলায় মুখে অজস্র উঞ্চ পরশে ভরিয়ে তুলছে।শুভা শরীর শক্ত করে বিছানা খামচে শুয়ে আছে।টিপটিপ করে চোখ মেলার আগেই উঞ্চ পরশটা ঠোঁট আকড়ে ধরলো।শুভা চোখ খুলেই নীলের চোখের নেশা দেখলো।এই নেশার ঘোর থেকে চেষ্টা করেও নিজেকে বাঁচাতে পারলো না শুভা।
সকালে চাদরে জড়িয়ে বসে বসে কাঁদতে লাগলো খাটের এককোনে।নীল গোসল করে আয়নার সামনে চুলগুলো ঠিক করছে আর আড়চোখে শুভাকে দেখছে।
“- যাও গোসল করে রেডি হয়ে নাও।বাড়ি থেকে তোমাকে দেখতে আসবে সবাই।
শুভাকে চুপ থাকতে দেখে নীল শুভাকে আবার বিছানার সাথে চেপে ধরে।
“- কথা কানে যায় না।
“- ছাড়ুন আমার লাগছে!
“- লাগুক!কথা না শুনলে এর চেয়েও খারাপ হবে।
“-এমন কেন করলেন আমার সাথে? ছি!
“- কেমন করেছি? স্বামীর ভালোবাসাকে ছি! বলো?
“- কে স্বামী? কিসের স্বামী?
“- আমি স্বামী।তোমার সমস্ত কিছুর একমাত্র ভোগ দখল কারী ভালোবাসার স্বামী।
“- আপনি অনেক খারাপ।আমার ভাবনার চাইতেও খারাপ।দুনিয়ার সবচেয়ে বড় খারাপ।
“- উফ! এভাবে বলো না তো! তোমাকে আরও ভালোবাসতে মন চাই যে তাহলে?
“- আপনিই,,,শুভার কথা শেষ না হতেই নীল একটানে শুভার গায়ের উপর থেকে চাদরটা কেড়ে নেয়।শুভা চিৎকার করে নীলকে জড়িয়ে ধরে লজ্জায়।
“- আর কখনো মুখে মুখে তর্ক করবে?
“- না! কোনোদিন না।
“- যাও গোসল করে রেডি হয়ে নাও।শুভার গায়ে চাদর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে নীল। শুভা কাঁদতে কাঁদতে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে চলে আসে।শাওয়ার ছেড়ে খুব কাঁদে রাতের কথা মনে করে।নীলের বাসা থেকে নাহিদা আর রোদেলী ছাড়া বাকি সবাই এ বাড়িতে এসেছে বউ দেখতে।বউ দেখা তো নয় এসেছে নিজেদের সম মর্যাদার অধিকারী কি না সেটা দেখতে।মেহেরুন খাতুনের মনটা কেন যেন কু ডাকছে।নিজেকে অনেক কষ্টে স্থির রেখেছেন তিনি।পুত্রবধূ বরণের জন্য নিজের হিরের বালা দুটো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।অধীর আগ্রহ আর আশা নিয়ে বসে আছে সবাই। শুভাকে রিনা বুয়া সাজিয়ে গুজিয়া সামনে নিয়ে আসলেই পুরো বাড়ি শুদ্ধ লোকের চোখ কপালে ওঠে।আয়শা হা করে নীলের দিকে তাকাতেই নীল লাজুক মুখে মুচকি হাসি দেয়।মেহেরুন খাতুন ধপ করে সোফায় বসে পড়ে।সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।শুভা মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।সবাই ওকে দেখে মুখটা কেমন করে গেল ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। নীলের দিকে আড়চোখে তাকাতেই নীল এক চোখ টিপ দেয় বাঁকা হেসে।তাড়াতাড়ি মেহেরুন খাতুনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হল।আয়শা ছাড়া কেউ ই শুভার সাথে কথা বললো না।আয়শা শুভাকে আশির্বাদ স্বরুপ নিজের গলার চেনটা খুলে পড়িয়ে দিয়ে গেল।শুভা স্পষ্ট বুঝেছে নীলের বাড়ির কেউ ওকে পছন্দ করে নি।শুভা অপমান লজ্জায় রুমে এসে কাদতে লাগলো।
“- সে যখন জানেই তার পরিবার কোনোদিন আমাকে মানবে না তাহলে বিয়ে করার অর্থ কি?
“- শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তোমাকে এবং আমার বাড়ির লোককে।দরজায় হেলান দিয়ে হেসে বলে নীল।
শুভা চমকে ওঠে নীলের কথা শুনে।রাগে ফুলতে থাকে নীলের দিকে তাকিয়ে।
“- রাতের শাস্তি এতো তাড়াতাড়িই ভুলে গেলে রাধূনী? চোখ নামাও। নীলের ধমকে ভয়ে কেঁপে ওঠে শুভা।চোখ নামিয়ে হাত মুচড়াতে থাকে নাক টানতে টানতে।
“- এভাবে বসে থাকার জন্য তো আনি নি তোমাকে? যাও সকালের জন্য ইটালিয়ান ইউনিক কিছু ডিশ তৈরি করে আনো।গো!নীল সোজা হয়ে দাড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে। শুভার কলিজা পর্যন্ত নড়ে ওঠে নীলের হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া রূপটা দেখে।

চলবে,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *