বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 09
শুভা কোমরে আঁচল গুজে নাকের জল চোখের জল এক করে রান্না করতে লাগলো।কিসের ইটালিয়ান ফিটালিয়ান রান্না করবে।নীলের ধমকের আর রূপ বদলের চিন্তায় কখন যে আটা গুলিয়ে রুটি আলু ভাজি করে ফেলেছে খেয়ালই নাই।মন একদিকে হাত অন্যদিকে।দুটোর মধ্যে মান অভিমানের ব্যবধানের ফল রুটি আলুভাজি।রিনা বুয়া চুপচাপ শুধু দেখে যাচ্ছে বসার ঘর থেকে। নীলের কড়া নিষেধ শুভার ধারে কাছেও যাওয়া যাবে না এখন।মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়া নীল ঘরে ঢুকলো মোবাইলে কথা বলতে বলতে।বুয়াকে রান্নাঘরের দিকে বিমর্ষ তাকাতে দেখে এগিয়ে গেল পাঞ্জাবির হাতা ভাঁজ করতে করতে।
“- বুয়া! এমন ভাবে দাড়িয়ে আছ কেন?
আচমকা নীলের আওয়াজ পেয়ে রিনা বুয়া চমকে ওঠে।আমতা আমতা করে বলে,
“- কককই কিছু না তো।
“- গুড! তাহলে একটু পর জ্যাককে রেডি করিয়ে নিয়ে আসো ওকে গোসল করাবো।
“- জ্বী!
“- ওহ হ্যাঁ! তার আগে একটা কাজ করো তো।গাড়িতে দুটো পার্সেল আছে নিয়ে আমার রুমে রেখে আসো।যাও
বুয়া মুখটা কালো করে নীলের সামনে থেকে বাইরে চলে গেল।নীল কোমরে হাত দিয়ে ঘার বেকিয়ে রান্নাঘরে ব্যস্ত শুভাকে দেখে নিল।মুখে অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠলো নীলের।নীল ঘুরে দাড়িয়ে চুল গুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতে শুভার পাশে গিয়ে দাড়াল।শুভা তখনও ভাবনার জোয়ারে ভাসছে।নীলের শুভাকে দেখলেই রাগাতে ইচ্ছা হয়।আর রেগে গেলে ভয় দেখাতে।পানসে জীবনে একফালি চঞ্চলতাময় রঙিন জীবন তো শুভার কারনে পেয়েছে নীল।এই জীবন যে বহু কাঙ্খিত ছিল নীলের।কেউ আপন হবে খুব আপন।তার সাথে মনের রাগ অভিমান নির্দিধায় শেয়ার করা যাবে।ইচ্ছা মতো যাকে মনখুলে ভালোবাসা যাবে।যাকে দেখলে ঠোঁটের কোনে হাসি মনের কোনে দুষ্টুমি ভালোবাসা জেগে উঠবে।সেই মানুষটাকে নীল পেয়েছে! হ্যাঁ পেয়েছে নীল।যে আপন তাকে চিনতে সময় লাগে না।শত সহস্র বছর পর এলেও তাকে চিনে নেয় মন।শুভাকে নীল নয় নীলের মন চিনেছে।চিনিয়েছে নীলকেও।নীল শুভার উন্মুক্ত মসৃণ তামাটে ঘাড়ে তাকিয়ে থাকে।ধীর পায়ে এগিয়ে পেছন থেকে শুভাকে জড়িয়ে ধরে শুভার ঘাড়ে পিঠে উষ্ণতায় ভরিয়ে তোলে।শুভা ক্ষনিকের জন্য জমে যায়।নীলের ভালোবাসার ছোঁয়ায় জমে আইসবার্গ হয়ে যায়।নীলের মন ভরার আগেই শুভা আড়মোড়া ভেঙ্গে নীলকে সরিয়ে দেয়।নীল আবার শুভার মুখটা খপ করে ধরে একদম কাছে নিয়ে আসে।দুজোড়া ঠোঁটের মাঝে সামান্য দূরত্ব। শুভা নাক কুঁচকে নীলের বুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
“- ছি! আপনার মুখে সিগারেটের গন্ধ। ওয়াক! শুভা বমির ভাব করে বেসিনে ঝুকে পড়ে।
নীল কপাল চাপড়ায় এমন অসাবধানতার জন্য। মনে মনে ভাবে সেন্টারফ্রুটস কিংবা অন্য সুগন্ধি কিছু খেয়ে আসা উচিত ছিল।
“-আর ইউ ওকে!
“- আরে কিয়ের ওকে? আপনি লোকটা সম্পূর্ণ খারাপ।আল্লাহ এমন লোকই কেন আমার কপালে রাখলো উফ!
“-আচ্ছা নেক্সট টাইম সিগারেট খেয়ে মুখ ফ্রেশ করে আসবো।এখন উপরে চলো।শুভার হাত ধরে টানতে গেলে শুভা দেয়াল ধরে দাড়িয়ে থাকে।
“- কি হলো? দেয়াল ছাড়ো।
“- না! আমি যাবো না উপরে।
“- কেন? নীল চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করে
“- আপনার মতলব খুবই খারাপ।আমার শরীর ভালো না।আমি যাবো না উপরে।
“- তুমি যাবা তোমার ঘারেও যাবে।চলো?
“- সত্যি বলছি অনেক খারাপ শরীর। ওষুধ খাওয়া লাগবে।শুভা মুখটা নিচু করে কাঁদো কাদো হয়ে যায়।
“- তুমি কথা মোটেও শোনো না।অসহ্য। নীল শুভাকে পাজা কোলে তুলে নেয়।
“- এই! এই! করছেন টা কি? ছাড়ুন প্লিজ।
“- চুপ থাকো।
“- আপনার টর্চারে সত্যি আমি মরে যাবো।ছাড়ুন।শুভার সকল কথা উপেক্ষা করে নীল শুভাকে ঘরের বিছানায় বসিয়ে দেয়।নীলকে পাঞ্জাবি খুলতে দেখে শুভা খাটের এককোনে ঘাপটি মেরে কেঁদে ওঠে শব্দ করে।
“-কি হলো কাঁদছ কেন?
“- আপনি খুবই খারাপ।মারাত্মক রকম বাজে লোক।যার ঈমান থাকে না তার দয়া মায়াও থাকে না আজ বুঝলাম।শুভার কথা শুনে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে কপালে হাত দিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকে।
“- তুমি কি আগে থেকেই পাবনা ভর্তি ছিলে নাকি নতুন করে ভর্তির পায়তারা করছ বলবা প্লিজ? আজাইরা কথা বন্ধ কর। এই নাও ঠিক করে রাখ এটা।শুভার মুখের উপর পাঞ্জাবি ছুড়ে মেরে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে নীল।
শুভা মুখের উপর পড়া পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে বেকুব বনে যায়।ছি! কি লজ্জার কথা।কি ভেবেছিলাম। শুভা জিহ্বা কামড়ে পাঞ্জাবিটার দিকে নাক কুঁচকে হাসি দেয়।নীল ভিজে চুলে তোয়ালে জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শুভা মুখটা গোমড়া করে আলমারির ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে থাকে নীলের দিকে একদৃষ্টিতে দেখে।
“- এভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আদর দিব?
“- ছি! পঁচা লোক।শুভা চোখ নামিয়ে নেয় ফ্লোরে।
“-কিছু জিজ্ঞেস করলেও খারাপ, না করলেও খারাপ।হায়রে ফুটা কপাল আমার।এই যে ভালো মানুষ আলমারি থেকে আমার কাপড় বের করেন তো? কুইক।শুভা ঠোঁট টা ভেংচি দিয়ে আলমারি খুলে হা হয়ে যায়।
“- আল্লাহ গো আল্লাহ! পুরো একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি।এই সব কাপড় আপনার?
“- হুমম।এতো অবাক হওয়ার কি আছে?
“-আমি তো জীবনেও শুনি নাই কারও একার এতো কাপড় থাকে তাও আবার পুরুষ মানুষের।মেয়ে মানুষ হলে না হয় একটা কথা ছিলওওও
“- আবার পকপক শুরু করছ? মেয়েমানুষ হলে মানে কি বুঝাচ্ছ?শুভার দিকে এগোতে এগোতে।
“- সত্যি আমি হাফ লেডিস বুঝাচ্ছি না।আল্লাহ একি বললাম?শুভা নিজের ঠোঁটে হাত চেপে ধরে বেফাঁস কথা বলার জন্য
“- হোয়াট! হাউ ডেয়ার টু সে,,নীল দাঁত কটমট করতে থাকে।
“- বিশ্বাস করুন!
“- আমার সামনে থেকে যাও।গেট লস্ট
“-প্লিজ সরি! দেখুন সরি। এই যে কানে ধরেছি। আপনি চাইলে উঠবস ও করবো।
“- তাহলে করো।
“- অ্যাআআআ।
“- হারি আপ!
“- সত্যি ই কানে ধরতে হবে?
“- যাও তো আমার সামনে থেকে।অসহ্য একটা
“- ধরছি কানে।ভালো করেও তো বলা যায় কথাটা।হু
শুভা কান ধরে উঠবস করছে আর নীল খাটে পা ছড়িয়ে বসে মোবাইলে গেমস খেলছে আর মুচকি হাসছে।
“-শুনছেন!
“- হুমম
“- ১০ বার উঠবস করেছি
“- মাত্র!
“- মাত্র মানে? আপনি কি আমি দিনরাত কান ধরে উঠবস করবো ?
“- সমস্যা কোথায়। স্বামীকে উল্টো পাল্টা বলার শাস্তি ঠিকঠাক পাবা না?
“-বালের স্বামী হু! (আস্তে করে বলে মুখ ভেংচে)
“- আবার কি বলছ?
“- বলছি আপনি অনেক ভালো স্বামী! আপনি শাহরুখ আমি গৌরি।
“- বাহ! দারুন বলেছ তো? এখন থেকে সবসময় এমন রোমান্টিক কথাবার্তা বলবা।যাও এজন্য মাফ।শার্ট আর প্যান্ট বের করো এখন।আর কতো আমাকে এভাবে দেখবে।অনেক তো দেখলে।
“- কি আমার শাহরুখ খান? শাহরুখ না ছাই! অমরেশ পুরি,হুমায়ুন ফরিদী, রাজিব,প্রেম চোপড়া সব তুই।আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভিলেন তুই হারামি।আর কতো দেখবে?ভাবে বাচছ না।সবাইরে কি তোর দিওয়ানি ভাবিস যে হা করে তোর বডি গিলবে?শুভার চোখ জ্বলে পুরে ছাই হয় তোরে দেখলে।হু শুভা বিরবির করতে করতে শার্ট প্যান্ট বাছাই করতে গিয়ে চোখ পিটপিট করে।
“- শুনছেন!
“- শুনছি!
“- মানে! কোনটা পড়বেন?
“- তুমি সিলেক্ট করো।
“- আমি কি করে করবো? আপনার পোষাক আপনিই না বলতে পারবেন?
“- আজ থেকে তুমি বলবা।সিলেক্ট করে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।ক্ষুধা লাগছে খুব।
“-আমি কেমনে! ধুর!
অবশেষে পুরো আলমারি ঘেটে ব্লাক টিশার্ট আর কারগো প্যান্ট এনে নীলের সামনে রাখলো।
“- ওয়াও! গুড চয়েস।ব্লাক টিশার্ট পড়ে শুভাকে নিজের বাহুডোরে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“- বলো তো ইদুরনী! আমাকে এই ড্রেসে কেমন লাগছে?
“- আপনি তো সুন্দর, যা পড়বেন তাতেই সুন্দর লাগবে।ফর্সা তো তাই কালোতে বেশি মানিয়েছে।
“- ফর্সা রঙের সাথে কালো বেশি মানায় তাইতো?
“- হ্যাঁ সবাই জানে।
“- আমার ডিশিসন তাহলে সঠিক ছিল।শুভার গালে আলতো করে ভালোবাসা দিয়ে সোফায় বসে পড়ে নীল।শুভা নীলের কথা বুঝতে পেরে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।শুভা নীলকে বুঝতেই পারছে না।এক একসময় এক এক রূপ।বিয়ের আসল মোটিভ টাই বা কি? শুভাকে ভালোবাসে? অসম্ভব! শুভা জীবনেও এ কথা মানবে না।নীলের মতো সুপার হিরো,পারফেক্ট ছেলে ওর মতো কালো মেয়েকে কেন হুট করে ভালোবাসতে যাবে? নাটক সিনেমা নাকি?
কিছুতো ঝোল আছে! হুমম
“- কি হলো? বেবির নাম কি হবে সেটা প্লান করছ?
“- ছি! কি সব বলেন? লজ্জা লাগে না
“-না! লজ্জা শরম আমার বরাবরই কম। যাও ঐ পার্সেল খুলে খাবার গুলো প্লেটে নিয়ে আসো।প্রচুর ক্ষুধা লাগছে।
“- কেন আমি তোওও
“- রুটি আলু ভাজি করছ তাই তো?স্বভাব চেঞ্জ করো।এসব এ বাড়িতে চলে না।
শুভা মুখটা ভেংচি কেটে খাবার গরম করে অর্ধেক বাড়ির কাজের লোকের জন্য বাকি অর্ধেক নীলের জন্য নিয়ে যায়।সকাল বেলা এসব শুভা খাবে না।নীল খেতে খেতে তাকিয়ে দেখে শুভা খাটে বসে আনমনে হাতের চুড়ি নিয়ে খেলা করছে। একদম বাচ্চা মেয়ের মতো।নীল ভাবে,
“- সত্যি শুভা দিনকে দিন তোমার প্রতি উইকনেস ফিল করছি।মনে হচ্ছে কোনো ভালোবাসার ফ্লু তুমি।যে আমার জীবনে এসে সমস্ত কিছু দূর্বল করে দিচ্ছে।এতো মায়া কেন তোমার মুখে? মায়া এড়িয়ে অন্য কোথাও মনই টিকছে এখন আর।নয়তো মিরাকে ভোলা সত্যি আমার জন্য কঠিন ছিল।আমি মিরা নামক মানুষটাকে ভুলতে চাই।হেল্প করো আমায়।
“-খাওয়া শেষ আপনার?
“-না!
“- তাহলে চুপ করে বসে আছেন যে।কিছু লাগবে?
“- হুমম।
“- বলেন!
“- তোমাকে!
“- ছি! আমি কি খাওয়ার জিনিস?
“- এদিকে আসো।
“- হুমম
“- খেয়েছ সকালে?
“- খেতে দিছেন নাকি?
“-আচ্ছা বসো। আমার সাথে খাও।
“-না গরু আমি খাই না।
“- কেন?
“- এলার্জি আছে।ঠান্ডা জ্বর এসে যাবে।
“- তাহলে অন্য কিছু অর্ডার করি?
“- না! আমি গরিব মানুষ। রুটি আলু খাওয়ার অভ্যাস। এসব বড়লোকি খাবার আমার হজম হবে না।তাছাড়া আজ আছি কাল ধাক্কা দিয়ে বের ও করে দিতে পারেন।আপনাদের বড়লোকি ব্যাপার স্যাপার বোঝা মুশকিল।বদ অভ্যাস করে পস্তাতে চাই না।আপনি খেয়ে নিন।আমি নিচে গেলাম।
শুভার এই জিনিসটাই নীলের মেজাজ খারাপ করে দেয়।প্রচন্ড রকম আত্মসম্মানে ভরা মেয়েটা। অভিমানীও কম নয়।নীলের ভয় হলো যদি মিরা এসে পড়ে কি হবে? শুভা কি মিরার হাতে সব সঁপে চলে যাবে? না! কোনোদিন নীল সেটা হতে দেবে না।এই হাসি খুশি জীবন নীল হারাতে চাই না।শুভাকে নীলের প্রয়োজন। নীল জানে একদিন এই প্রয়োজন আর অল্প স্বল্প ভালো লাগাই গভীর ভালোবাসাতে পরিনত হবে।
চলবে,,৷