বদনাম—– পর্বঃ- ৮
শারমিন আক্তার
-কেঁটে যায় পাঁচ পাঁচটি বছর—-
তুলিঃ আদ্র দাড়াও! একদম ছুটবে না। চুপচাপ দাড়াও ওখানে!
আদ্রঃ না মা। পারলে আমায় ধরো!
আয়াত আর তুলির ছেলে আদ্র এর বয়স প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। সবাই আদ্রকে ভিষন ভালোবাসে। আদ্রতো তুলির জীবন। পাঁচ বছরে তুলির পরিবারের স্মৃতি থেকে তনয়া নামটা ধূসর হয়ে গেলোও তুলি মাঝে মাঝে খুব আফসুস করে মনে করে তনয়াকে।
আয়াত তনয়াকে অনেক খুঁজেছে শুধুমাত্র একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য, কিন্তু পায়নি। পাঁচ বছরে তনয়ার বাবা-মা কয়েকবার তুলিদের বাড়ি এসেছিলো তনয়ার খোঁজ করার জন্য। কিন্তু আফসুস তনয়ার কোন খোঁজ পায়নি। পাঁচ বছর পর তুলিদের দড়জার কড়া নাড়লো অভি—-
তুলি দড়জা খুলে দিলো। কিন্তু এত বছর পর অভিকে দেখায় তুলি অভিকে চিনতে কিছুটা সময় লাগলো। আর তাছাড়া অভিও অনেকটা বদলে গেছে। চেহারায় বিষন্নতায় ছাওয়া, প্রাশ্চিত্যের আগুনে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে অভি। অভির প্রতি তুলির রাগ থাকলেও সেই ক্ষোপটা এখন কাজ করছে না। কথায় আছে না সময়ের স্রোতে শত রাগ ভেসে যায়! সময় সব ঘা সারিয়ে তোলে। ওটা আলাদা বিষয় যে ঘা শত শুকালেও অনেক সময় দাঁগটা থেকে যায়।
তুলিঃ আপনি এখানে? কি চাই?
অভিঃ আপনাদের বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা প্রার্থী। আমি তনয়ার বিষয়ে কিছু জানতে চাই!
তুলিঃ দেখুন আপনাদের সেদিন করা নাটকের পর তনয়া সেদিন রাতেই অামাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে? কিভাবে আছে? তা জানি না আমরা! অনেক খুঁজেও পাইনি!
অভিঃ ওহ! আমি আসলে ওর বাবা মায়ের কাছেও গিয়েছিলাম তারাও কিছু বলতে পারেনি ভাবলাম হয়তো আপনারা জানেন। আমাকে পারলে মাফ করে দিবেন আপনারা। তনয়াকে যে কষ্ট দিয়েছি তার ফল প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ভোগ করেছি, হয়তো ভবিষ্যতেও করবো। আসছি!
তুলিঃ (মনেমনে ভাবছে এই কথাগুলো পাঁচ বছর আগে যদি আপনি বলতেন তাহলে থাপরাই দাঁত ফেলে দিতাম। কিন্তু এখন আপনার চেহারা দেখে শুধু করুনা হচ্ছে। ) বুঝলেন তাহলে একটা ভুল কিভাবে মানুষের সাজানো জীবনটাকে তছনছ করে দেয়? যাক সেসব পুড়ানো কথা আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারছেন এটাই অনেক। বসুন তনয়া আপনার জন্য কিছু রেখে গেছে। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সেটা আমি সামলে রাখছি। বসুন নিয়ে আসছি।
অভি বসে ঘরের চারদিকটা দেখছিলো। এর মধ্যে ছোট্ট একটা বাচ্চা মানে (আদ্র) এসে বললো
আদ্রঃ হেই হু আর ইউ?
অভি আদ্রর দিকে তাকাতেই বুকটা কেমন মোচর দিয়ে উঠলো। কারন হয়তো তনয়ারও এমন একটা বেবি আছে, যার শরীরে অভির রক্ত বইছে! অভি ভাবছে আমি কি নিজের সন্তানকে কি একবারও দেখতে পাবো ? হঠাৎ অাদ্রর কথায় ধ্যান ভাঙলো অভির।
আদ্রঃ আই সে হু আর ইউ?
অভিঃ আই এ্যাম অভি! এন্ড ইউ?
আদ্রঃ আই এ্যাম আদ্র
অভিঃ নাইস নেইম। নাইস টু মিট ইউ বেবি!
আদ্রঃ ডোন্ট কলমি বেবি! আই এ্যাম ফাইব ইয়ার বিগ বয়।
অভিঃ হেসে ওকে বিগ বয়।
এর মধ্যে তুলি আর আয়াত চলে আসলো। তুলি অভির হাতে তনয়ার চিঠিটা দিলো। অভি আরেকবার ওদের সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে চিঠিটা নিয়ে চলে গেলো।
আয়াতঃ তুলি আজ তুমি অভিকে কিছু বললে না যে?
তুলিঃ মরার উপর খাঁড়ার ঘা দেয়ার কি দরকার? ওনিতো নিজেই রোজ নিজের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। চোখ দেখছো ওনার অনুতাপে ভরা।
আয়াতঃ হুমম দেখলাম, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় তনয়ার সাথে আমাদের কখনো দেখা হবে আর?
তুলিঃ হুমম হবে কারন তনয়া বলেছে ও অমাদের সাথে একদিন না একদিন দেখা করতে আসবে।
আয়াতঃ আমিও সেদিনের অপেক্ষায়। (কিছু কথা যেটা জানার জন্য পাঁচ বছর ধরে বসে আছি মনে মনে)
অভি চিঠিটা নিয়ে রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চে বসলো। অনেক বছর হয়ে যাওয়ায় চিঠিটার ভাঁজে ভাঁজে কিছু জায়গা হালকা ছিঁড়ে গেছে। অভি সাবধানে চিঠিটাকে মেলে পড়া শুরু করলো।
অভি—-
প্রথম যেদিন তোমার বৌ হয়ে তোমার ঘরে গিয়েছিলাম সেদিন নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার সংসারটাকে জীবনের মত আগলে রাখবো। আর তোমার প্রতি ভালোবাসায় কোন ত্রুটি রাখবো না। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে জাদুর মত মনে হতো। তোমার ভালোবাসায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। ভাবতাম সারা জীবন তোমাকে এভাবেই ভালোবাসবো।
কিন্তু তুমি সব নষ্ট করে দিলে? আচ্ছা অভি তোমার বুকটা কি একবারও কাঁপেনি ওমন যঘন্য কাজ করতে? সে যাই হোক তুমি যা করেছো তার শাস্তি উপওয়ালা তোমাকে দিবে। আমি তোমাকে শত কষ্টের পরও মাফ করে দিতাম যদি তুমি সেদিন আয়াতকে জড়িয়ে আমার নামে #বদনাম না করতে। তবে শুনে রাখো একদিন তোমার মুখোমুখি হবো সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবো? তখন কি জবাব দিবে সেটা ভেবে রেখো। তুমি ভালো থাকো সেই দোয়াই করবো সবসময়। আল্লাহ্ হাফেজ।
**তনয়া_____
চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চিঠিটা সুন্দর ভাবে ভাঁজ করে পকেটে নিয়ে চলে যায় নিজের শহরে। বাসে বসে অভি ভাবছে অভির কাছে এখন কেউ নাই সম্পূর্ন একা একজন মানুষ। সব আত্মীয় স্বজন সে ঘটনার পর ওর থেকে দূরে সরে গেছে। তনয়ার মাথা থেকে #বদনাম কমে গেলোও সে #বদনাম গিয়ে অভির মাথায় লাগছে চিরস্থায়ী ভাবে। অভি এত বছর জেলে ছিলো। কারন ওর অফিসের সেই বস অভির নামে যে মিথ্যা অপবাদ গুলো দিয়েছিলো সেগুলো দিয়ে কেস করে অভিকে জেলে ভরে দেয়। অভির বাবা মা পড়ে অভির কেস লড়তে চায় কিন্তু অভি নিষেধ করে অভি বলেছিলো যেমন কর্ম তেমন ফল। পাঁপ যখন করেছি সাঁজাতো পেতেই হবে?
একটি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যেমন তনয়ার #বদনাম করেছিলো ঠিক তেমনি উপরওয়ালা আরেকটি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অভিকে শাস্তি দিয়েছে। গতকালই অভি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে সেখান থেকে সরাসরি তনয়ার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। বাসের জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে অভি নিজের উপর ঘৃনা জনক হাসি দিয়ে বলছে যে যেমন করে তার সাথে কোননা কোন ভাবে তেমনই হয়। প্রকৃতি কখনো কারো ধার বাকি রাখে না। কোন না কোন ভাবে শোধ করে দেয়। যেমন আয়াতের অফিসের সে বস তার মেয়ের খারাপ ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হবার ফলে তার মেয়ে সুইসাইড করে। তখন অভির বস বুঝতে পারছিলো তার পাঁপের ফল তার মেয়ে ভোগ করছে। কিছুদিন আগে তিনিই অভির উপর সব অভিযোগ তুলে নেয়। নয়তো অভির দশ বছরের শাস্তি ছিলো। কিন্তু যেদিন অভিযোগ তুলে নেয় সেদিন রাতে তিনি স্টোক করে মারা যায়। হয়তো বুকের উপর পাঁপের বোঝাটা বড্ড ভারী হয়ে গেছিলো, যেটা সহ্য ক্ষমতা তার ছিলো না । অভি জেল থেকে বের হয়ে তার কবরে দু মুঠো মাটি দিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে পাঁপ বাপকেও ছাড়ে না স্যার। না আমাকে ছাড়ছে না আপনাকে!
অভি নিজের শহরের আসার পর রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিলো তখন ওর সেই বন্ধু (সাদেক) যে, ওকে বলেছিলো বসের কথা মেনে নিতে। সে অভিকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললো কবে ছাড়া পেলি?
অভিঃ গত কাল! কিছু বলবি?
সাদেকঃ মাফ করে দে দোস্ত। তোর বিপদে তোর পাশে দাড়াতে পারিনি?
অভিঃ কেন রে তুই না আমায় বুদ্ধি দিলি বসের কথা মেনে নিতে। আজকালকার যুগে এমন সুবুদ্ধি কেউ দেয় রে?
সাদিকঃ ভাই আর লজ্জা দিস না। সেদিন পাঁপ করেছিলাম দোস্ত! তার শাস্তিও পেয়েছি!
অভিঃ কি শাস্তি?
সাদিকঃ দু বছর আগে আমার স্ত্রী আমার ছোট ভাইয়ের সাথে পালিয়ে গেছে। মান ইজ্জ্ব বলতে কিছু নাই আমার।
অভিঃ হাসতে হাসতে বললো পাঁপ বাপকেও ছাড়ে না! তারপর হাসতে হাসতে চলে গেলো। সাদের বোকার মত অভির দিকে তাকিয়ে ছিলো।
আজ আদ্রর পাঁচ বছর পূর্ন হয়েছে। আজ ওর জন্মদিন। আয়াতের বাবা এমন অনুষ্ঠান পছন্দ করে না কিন্তু আদ্রর জেদের সামনে তাদের হার মানতে হলো। আজ দুপুরে মোটামুটি একটা দোয়া দুরুদের আয়োজন করছে কিছু অনাথ বাচ্চাকে খাওয়াবে আর কিছু আত্মীয় স্বজন একসাথে বসে খাবে। আজ সকালে তুলির সাথে দেখা করতে তিন জন অতীথি আসে। তাদের দেখে তুলি হা হয়ে থাকে। কারন অতিথী আর কেউ নয় তনয়া আর তনয়ার ছেলে (রায়ান) আর এমদাদ। তুলি তনয়াকে দেখে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কান্না করে দেয়। সাথে জিগেস করতে থাকে কত কত প্রশ্ন?
তুমি কেমন আছো? কোথায় ছিলে? এতদিন কোথায় হারিয়ে গেছিলে? এতদিন কেন এলেনা? আরো কত প্রশ্ন। তনয়া কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। তুলির চোখ গেলো তনয়ার ছেলে রায়ান আর এমদাদের এর উপর তারপর জিগেস করলো ওনারা কারা?
তনয়াঃ এটা আমার ছোট ভাই এমদাদ। সত্যি বলতে ওর কারনেই বেঁচে আছি আজও। আর ও আমার ছেলে রায়ান!
তুলিঃ কি? তোমার ছেলে! আল্লাহ্ ! কি সুন্দর দেখতে হয়েছে ছেলেটা একেবারে প্রিন্সএর মত। তুলি ছেলেটাকে কাছে নিয়ে বলে বাবু জানো আমি তোমার কি হই?
রায়ানঃ হ্যা মিষ্টি খালামনি।
তুলিঃ আল্লাহ্ তুমি আমাকে চেনো?
রায়ানঃ হ্যা। মা সবসময় আপনার ছবি দেখিয়ে বলতো আপনি আমার মিষ্টি খালা।
তুলিঃ তাই বুঝি। তুলি রায়ানকে কোলে নিয়ে গালে কয়েকটা চুমো দিয়ে বললো ঠিক বলছে তোমার মা।
এর মধ্যে আদ্র ওখানে আসলো। আদ্রও তনয়াকে আগে থেকে চিনতো! আদ্র ভিষন চালাক ছেলে। তনয়াকে আদ্রকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। দূর থেকে বিষয়টা দেখে আয়াতের খুব খারাপ লাগছিলো। তারপর আদ্র আর রায়ান দুজন খেলতে চলে গেলো। তারা দুজন অল্পতেই মিশে গেলো।
তনয়ার আসাতে সবাই ভিষন খুশি। কিন্তু আয়াতের মনে ছেয়ে গেলো চিন্তার হাজারো মেঘ। কিছু একটা জিনিস নিয়ে আয়াত প্রচন্ড টেনসন আর ভয়ে আছে। একটা সত্যি যেটা পাল্টে দিতে পারে কতগুলো জীবন। আয়াতের মাথায় কাজ করছে না। পাঁচ বছর পর তনয়া এভাবে আজকের দিনেই কেন এলো? তাহলে কি?——-
চলবে——–