প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ ( সিজন-2 ) Part- 07

রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে!! ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
– এবার যদি আর একটা কথা বলিস,তবে ভূত – পেত্নী না আমি তোর মাথা ভেঙে ফেলবো!!
সারাদিন জার্নি করে এসে একটু ঘুমাবো.. তার উপায় নেই!
খুশবু আর কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে সবাই বাগানে ঘুরতে বের হলাম। পলাশ মামা আমাদেরকে সব ঘুরিয়ে দেখালেন।
চা গাছগুলো দেখে মনে হয় যেন সবুজ মখমলের চাদর পেতে রেখেছে কেউ!
উফফ… এতো সুন্দর কেন?
এই সুন্দর যদি গিলে নেয়া যেতো..! গপাগপ গিলে নিতাম।
যদি খোপায় গোঁজা যেতো…
গুঁজে নিতাম!
চা পাতায় হালকা শিশির শীতের আগমন জানান দিচ্ছে।
সবাই ঘুরাঘুরি করছি,ছবি তুলছি। কিভাবে চা পাতা তুলতে হয় বাগানে যারা কাজ করে তাদের কাছ থেকে শিখলাম। কি সুন্দর করে মাথায় ঝুড়ি আটকিয়ে তারা দু’হাতে পাতা তুলে নিচ্ছে। আমরাও ঝুড়ি মাথায় নিয়ে চেষ্টা করলাম।।
দেখতে যতটা সোজা মনে হয়, ততটা সহজ না। ঝুড়ির ব্যালেন্স রেখে পাতা তুলে নেয়া অনেক কষ্টের!
ঘুরাঘুরি করে লাঞ্চের আগে সবাই বাংলোয় ফিরে আসলাম।
শুনেছি এখানে অনেক পুরানো একটা জমিদার বাড়ি আছে। আগের দিনে জমিদারের প্রাচুর্যের নিদর্শন এই বাড়ি, কিন্তু এখন অযত্নে অবহেলায় বাগানের একপাশে কোথাও পড়ে আছে।
লাঞ্চের পরে সবাই রেস্ট নিচ্ছে। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি।
ঘুম থেকে উঠে দেখি তাহসিন আনিষা হাওয়া। মানে ওরা ঘুরতে বেরিয়েছে।খুশবু, রিফাত, দিয়া,অনি ওরা ও বাংলোর সামনে ঘুরাঘুরি করছে।
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসলাম ওদের সাথে বের হবো।
এসে দেখি ওরা নেই।
ফোন করলাম
– অনি, তোরা কোথায় ? একটু আগে দেখলাম সামনে এখন তোদের পাচ্ছি না!
– আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছি।
– রেহান কই?
– ও তো রুমে ঘুমাচ্ছে।
– ঠিক আছে। যা তোরা।
রেহানের রুমে গিয়ে দেখি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
– রেহান… রেহান! এই রেহান… উঠ তাড়াতাড়ি।
ডেকেই যাচ্ছি কিন্তু রেহানের খবর নেই!
শেষ পর্যন্ত ধাক্কা দিলাম
– এই রেহান.. অই.. ধুর!
রেহান… উঠ না! রেহান… রেহান…
– কি হয়েছে?
– উঠ.. সবাই বেরিয়ে গেছে। আমি কার সাথে যাবো?
– বের হতে হবে না। ঘুমা।
রেহানের ঘুমঘুম ভয়েস শুনে ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।
এই ঘুমঘুম ভয়েস…. ঘোর লাগানোর মতো কিছু একটা।
– অই উঠ!
আরেকটু জোরের ধাক্কা দিলাম।
রেহান খপ করে হাত টেনে পাশ ফিরে শুয়েছে।
হুট করে হাতে টান খেয়ে তাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে রেহানের উপরে পড়ে গেলাম।।
রেহান উঠার চেষ্টা করতেই ওর ওপাশে গিয়ে পড়লাম।
আমি বা রেহান কেউই প্রস্তুত ছিলাম না এমন একটা ঘটনার জন্য।
রেহান আমার বন্ধু, কোনো কিছুর জন্য সংকোচ করিনি কখনো। কিন্তু আজ…. রেহান এভাবে হাত ধরবে আর এভাবে পড়ে যাবো….
না পারছি আমি উঠতে, না পারছে রেহান উঠতে। দুজনেই চেষ্টা করছি কিন্তু কেউ সোজা হয়ে বসতেও পারছিনা।
রেহানের বুকের কাছে আমার মাথা, ওর শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি।
এতে আমার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেছে।
আমাকে বিব্রত হতে দেখে রেহান বললো
– হাত পা আর ছোড়াছুড়ি করিস না। আমার নাক ফাঁটিয়ে দিয়েছিস।চুপ করে থাক,উঠতে দে আমাকে।
আমি বারবার উঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আমার হাত রেহানের নাকে বেশ জোরেই লেগেছে।
কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম। রেহান এবার উঠে গিয়ে বিছানার নিচে চলে গেছে। পরিবেশ আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য রেহান বললো
– তোর কি সমস্যা হে? আমার নাক,পিঠ ভেঙে দিয়েছিস! ওহহ..
রেহান হাত দিয়ে নিজের হাতে পিঠে মালিশ করছে। আবার নাকেও হাত দিচ্ছে।
আমিও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
– আমার সমস্যা? গাধার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছিস,ডাকতে এলাম আর তুই ই তো ফেলে দিলি!
– আমি কি জানতাম নাকি তুই ডেকেছিস! আর আমি ফেলেছি? তুই ইচ্ছে করে পড়েছিস।হাতি একটা!
– উহহ!
আমার কি ঠেকা পড়ছে তোর উপরে ইচ্ছে করে পড়ার? আসছে আমার শাহরুখ!!
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে,সবাই বেরিয়ে গেছে, আমি একা যেতে পারছিনা।
– আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি।
রেহানের সাথে অন্যদিন হলে অনেক বড় ঝগড়া বেঁধে যেতো। কিন্তু আজ অস্বস্তি হচ্ছে, তাই আর কথা বাড়াইনি।
আমি আর রেহান একসঙ্গে বের হলাম। সেখানে তাহসিন আনিষার সাথে দেখা হয়ে গেছে। চারজন এক সাথে ঘুরছি,তখন অনির ফোন আসলো।
– কইরে তোরা?
– বাগানেই, তোদের তো দেখতে পাচ্ছি না।
– আমরা ফ্যাক্টরির কাছে।এখানে চলে আয়।
পুরনো জমিদার বাড়িতে যাবো।মামা একজন গাইড দিয়েছেন আমাদের সাথে।
– ভেরি গুড! ওয়েট কর।আমরা আসছি।
রেহান জিজ্ঞেস করলো
– কি বলেছে অনি?
– ওরা অপেক্ষা করছে,একজন গাইড আমাদের জমিদার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি চল।
আমরা দ্রুত ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে গেলাম।
বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে।
গাইড আমাদের তাড়া দিচ্ছে দ্রুত হাঁটতে। এমন সময় সেখানে যেতে ইচ্ছুক না উনি,তবুও অনির জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে রাজি হলেও বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
জমিদার বাড়ি কাছাকাছি যাবার পরে দেখলাম একটা লোক, অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
আমি সবার পিছনে পড়ে গেছি। কোথাও ঘুরতে গেলে চারিদিকে ভালো করে দেখতে দেখতে যাই,তাই সবার পিছনে পড়ি।এটাই আমার অভ্যাস।
রেহান আমার সামনে। একটু পরপর ও তাড়া দেয়, তখন দৌড়ে ওদের সাথে যাই।
লোকটার অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকা আমার ভালো লাগেনি।
আমি রেহানের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরি।রেহান নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো আমার হাত।
– দেখ, লোকটা কিভাবে তাকিয়ে আছে!
রেহান লোকটার দিকে তাকায়।
– লোকটা এমন অদ্ভুত! পাগল টাগল হবে হয়তো।।
ওদিকে দেখতে হবে না তাড়াতাড়ি চল।
জমিদার বাড়ি যখন পৌছালাম, তখন শেষ বিকেল।
বাড়িটাই শুধু আছে। চারপাশে অনেক বড় বড় গাছপালা।
তবে ঝোপঝাড় কিছুটা কম,মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে কিছু ঝোপঝাড় কাটা হয়েছে।
দেয়ালে শেওলা পড়তে পড়তে আর কিছু দেখা যায় না।
দুতলা বাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
খুশবু দিয়ার হাত ছাড়ছেই না।এমনিতেই ভীতুর ডিম,তার উপর এমন নীরব, অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরনো জমিদার বাড়িতে এসে খুশবুর ঘাম ছুটে গেছে।
আমার মনে হয় ও কোনো কিছুই দেখেনি।শুধু দিয়ার হাত ঠিকঠাক ধরে আছে কিনা আর গাইড কোন দিকে যাচ্ছে সেটাই দেখছে।
গাইড তাড়া দেয়ায় সবাই নিচে নেমে যাচ্ছে । আমি সবার পিছনে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন এপাশ থেকে ওপাশে গেছে।
কাউকে দেখতে পাইছি,তবে একটা ছায়ার মতো মনে হলো।
চমকে তাকাতেই দেখি বাদুড় উড়ে গেছে।
সত্যি বলতে প্রথমে ভয় পেয়ে ছিলাম। বাদুড় দেখে স্বস্তি হলো। এই শতবর্ষী পুরনো ভাঙা বাড়িতে বাদুড়, পোকামাকড়, সাপ এগুলো থাকাই স্বাভাবিক।
এদিকে দিনের আলো ফিকে হয় অন্ধকার ভাব চলে এসেছে।
দ্রুত ফেরা দরকার। আর আমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
রেহান আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার উপরে এসে জিজ্ঞেস করলো
– দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যাবি না?
– চল।
– কি দেখছিস?
– কিছু না, একটা বাদুড় উড়ে গেলো।
– ভয় পেয়েছিস?
– না। দেখলাম কি উড়ে গেলো!
আমি যদি বলি কোনো ছায়া দেখেছি, তবে রেহান এটা নিয়ে আমাকে সব সময় পচাবে।
সেই ভয়ে আর কিছু বললাম না।
রিফাত আর অনি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলো । ওদের ব্যাগে টর্চ আছে। গাইডের কাছেও ছিলো একটা লাইট।।
এই তিন টর্চ লাইট দিয়ে আমরা বাংলোয় ফিরে এলাম।।
রাতের খাবার পরে সবাই বারান্দায় এসে বসলাম। এতো সুন্দর পূর্নিমার আলো! সবকিছু যেন ভেসে যাচ্ছে রূপালী আলোয়।
এমন উপচে পড়া জোছনায় বসে আমরা আড্ডা দিচ্ছি সাথে চা বাগানের স্পেশাল চা।।
রেহান গিটারে টংটাং করছে।
পলাশ মামা বললেন
– কি টুংটাং করছো! একটা গান শোনাও তো।
– ঠিক বলেছেন মামা।
সবাই মামাকে সাপোর্ট দিলো।
দিয়া মাঝখানে বলে উঠে
– এভাবে না। অপেক্ষা করো আমি আসছি।
দিয়া দৌড়ে ভেতরে যায়। কিছু সময় পরে কিছু কাগজের টুকরো নিয়ে ফিরে আসে।
– এসে গেছি.. এসে গেছি…
এভাবে কোনো মজা নেই। প্রথমে একজন একটা কাগজ তুলবে, সেখানে যা লেখা থাকবে তাকে সেটাই করতে হবে।
– ইয়েস! এইবার জমেছে। এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে।
পলাশ মামা খুব খুশি হলেন। উনি অনেক মিশুক আর আমুদে লোক।
প্রথমে অনির পালা অনি মূকাভিনয় করে দেখালো;যদিও আমরা কিছুই বুঝিনি।
অনি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো।
তারপর খুশবু… আবৃত্তি করলো । ভীষণ ভালো আবৃত্তি করে খুশবু।
এভাবে প্রত্যেকের কাছে যাচ্ছে কাগজের টুকরো। পলাশ মামা পাগলের অভিনয় করলো।দিয়া নাচলো। বাকি শুধু আমি আর রেহান।
পাজি দিয়া আর কি কি লিখেছে জানি না। আমার কাছে এলো প্রপোজ করার কাগজ! ভালোবাসার মানুষকে কিভাবে প্রপোজ করবো!! জীবনেও কাউকে প্রপোজ করিনি, কিভাবে করবো এত্তগুলা মানুষের সামনে! অনেক ভেবে ফিল্মি স্টাইলে একটু ডিফারেন্ট ভাবে প্রপোজের অভিনয় করে ফেললাম।
সবাই আমার প্রপোজ স্টাইল দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি!
সব শেষে এলো রেহানের পালা। ওর রাজ কপাল! ঘুরেফিরে গানই পড়লো।
রেহান একটু ভেবে গান ধরলো –
* ………….. …………….*
এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!
আমি ভাবতে পারিনি, তুমি বুকের ভেতর ফাটছো,
আমার শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি, তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!
তোমার গানের সুর
আমার পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে রেখে দিলাম
তোমার ব্যাগ-এর নীলে |
জানি তর্কে বহুদূর
তাও আমায় তুমি আঁকড়ে ধরো,
আমার ভেতর বাড়ছো তিলে তিলে!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!
আমি ভাবতে পারিনি, তুমি বুকের ভেতর ফাটছো,
আমার…
এখন অনেক রাত…. তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস….।।
………………
রেহান কেন এই গান গাইছে জানি না,কিন্তু গানটা শুনে আমার বিকালের কথা মনে পড়ে গেলো।
রেহানের শরীরের ঘ্রাণ আমি পেয়েছিলাম। ওর বুকে- কাঁধে আমার নিঃশ্বাস পড়েছিলো! ওর নিঃশ্বাস আমার চুল ছুঁয়ে গেছে!
আমি এসব কেন ভাবছি?
ভেতরে একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে।
রেহান আমার বন্ধু।ছেলেবেলার বন্ধু। বন্ধুর বাইরে কোনো দিন ওকে নিয়ে কিচ্ছু ভাবিনি। কখনো মনে হয়নি,ও একটা ছেলে, আমি একটা মেয়ে!
কেবল জানতাম আমি ওর বন্ধু,ও আমার বন্ধু।
সবচেয়ে ভালো বন্ধু, যাকে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে।
কিন্তু আজ কেন জানি সব এলোমেলো লাগছে!
চলবে…….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *