প্রেমময় প্রদীপ

প্রেমময় প্রদীপ !! Part- 05

-আজ আমার এমনিতেই ক্লাস করার মুড ছিল না । মিথ্যে বললেও তোর সাথে রাগ করিনি সাফা । এখানে এসে ভালোই লাগছে ।
.
তনিমার কথা শুনে রাইমা অভিমানী সুরে বলল-
তোদের মুড না থাকতেই পারে । আমার ছিল ।
-ওহ তাই! কেনো আমরা বুঝিনা?
-কেনো?
তোর মন প্রেমিকের জন্য ছটফট করছে বল । ক্লাস করতে আসিস না, আসিস তো প্রেম করতে ।
.
অনেকক্ষণ ধরে তনিমা ও রাইমা আড্ডায় মজে থাকলেও সাফা চুপচাপ বসে আছে ।
তার দৃষ্টি ওয়ারড্রবের উপরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা, প্রেমের দিকে ।
সাফার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে সে ।
এতক্ষণে এতটুকু সাফা নিশ্চিত, তার বান্ধবীরা দেখতে পাচ্ছেনা প্রেমকে ৷ জলজ্যান্ত একটা ছেলেকে দেখতে পেয়েও, না দেখার ভান নিশ্চয় করতো না ।
আরো কিছুক্ষণ পর দরজায় নক করে সামিনা রশিদ বললেন-
ওদের নিয়ে খেতে আয় সাফা ।
.
বান্ধবীদের নিয়ে ডাইনিং রুমে এলো সাফা ৷
টেবিলে দুপুরের খাবারের আয়োজন দেখে তনিমা বলল-
আন্টি আপনি এসব করতে গেলেন কেন কষ্ট করে? এত তাড়াতাড়ি ভাত খাইনা আমরা ।
-তেমন কিছু করিনি । দুপুর তো হয়েই আসলো ৷ একদিন তাড়াতাড়ি খেলে কিছু হবেনা । তোমরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছ । বাসায় ঠিক সময়ে যেতে হবে তোমাদের । তাই তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেললাম । দেখি বসো এখন, খেয়ে নাও ।
.
ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই খেতে শুরু করলে, প্রেমের আগমন ঘটলো ।
সাফার পাশের চেয়ারটি খালি ছিল । সে এখানে এসে বসে পড়লে, সাফা হকচকিয়ে উঠলো ।
তার মা বলল-
কি হয়েছে?
.
সাফা এক মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল, প্রেমকে সে ছাড়া আর কেউ দেখতে পারবেনা । কথাটি মনে পড়তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল সে-
কই নাতো! কিছুনা ।
.
প্রেম বলল-
একা একা খাবেন? আমাকে দিবেন না?
.
সাফা আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-
নিজের প্রদীপের মাঝে ঢুকে খেয়ে আসুন । এখানে খাবার জুটবেনা ।
.
-কিছু বলেছিস সাফা?
.
তনিমার করা প্রশ্নে সাফা জবাব দিলো-
নাতো!
.
দুপুরে খাওয়ার একটু পরেই তনিমা ও রাইমা চলে গেলে, নিজের রুমে আসলো সাফা ।
বিছানার উপরে প্রেমকে বসে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল-
আপনি কে? সত্যি করে বলুন তো?
-ম্যাডাম আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন প্লিজ ।
-বয়সে দেখতে তো আমার চেয়ে বড় মনেহয় ।
-তা বড়ই কিন্তু আপনি আমার ম্যাডাম ।
.
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ভ্রু জোড়া কুচকে সাফা বলল-
আপনার উদ্দেশ্য কি?
-আপনার তিনটে ইচ্ছে পূরণ করা ।
.
প্রেমকে কিছু না বলে রুমের মাঝে পায়চারি করতে লাগলো সাফা ।
প্রেম শান্ত স্বরে বলল-
ম্যাডাম আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন । এদিকে এসে বসুন প্লিজ ।
.
সাফা বিছানার এক কোণে বসে তাকালো প্রেমের দিকে ।
আজ সাদা রঙের একটি হাত কাটা টি-শার্ট, কালো জিন্স ও কালো কেডস পরেছে প্রেম ।
তাকে দেখতে কোনো হিরোর চেয়েও কম সুন্দর লাগছেনা ।
চোখ সরিয়ে সাফা বলল-
ছোট থেকে আলাদীনের চেরাগে থাকা জ্বীনির কথা অনেক শুনেছি । জ্বীনি আপনার মতো হ্যান্ডসাম ছিল না ৷ সে ছিল একটা দৈত্য । আবার এটাও জানতাম, এসব কাল্পনিক । সো আমার জন্য এসব বিশ্বাস করা কঠিন নয় কি?
-তা অবশ্য ঠিক । বিশ্বাস অবিশ্বাস আপনার উপরে । তবে এটাই সত্যি ৷ আপনি একটা প্রদীপ পেয়েছেন । যার মাঝে থাকা এই প্রেম, আপনার তিনটে ইচ্ছে পূরণ করবে ।
-এতটুকু প্রদীপের মাঝে থাকেন কি করে আপনি?
-ওখানেই রয়েছে আমার রাজ্য । সেই রাজ্য থেকে বের হয়ে মানুষের ইচ্ছে পূরণ করাই আমার কাজ ।
যে এই প্রদীপটি ঘষে আমায় বের করবে, তার তিনটে ইচ্ছে পূরণ করেই প্রদীপ সহ গায়েব হয়ে যাব আমি ।
-কোথায়?
-অন্য কোথাও, অন্য কারো ইচ্ছে পূরণ করতে ।
.
এখনো যেন এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সাফার ।
প্রেম বলল-
আমি কিন্তু অনেক কিছুই করতে পারি ৷ ইচ্ছেগুলো বললে আপনারই লাভ ম্যাডাম । আর যদি না চান, আমাকে মুক্তি দিন ৷ অন্য কারো ইচ্ছে পূরণ করে আনন্দ দিতে চাই ।
-মুক্তি?
-হ্যাঁ । আপনি আপনার দাবি ছেড়ে দিলেই আমার মুক্তি হয়ে যাবে । এবার আপনিই বলুন, ইচ্ছে পূরণ করবেন নাকি দাবি ছেড়ে দিবেন?
.
বিছানার উপরে রাখা প্রদীপটি নিয়ে ঘষলো সাফা ।
নিমিষেই প্রেম প্রদীপের মাঝে ঢুকে গেল ।
বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো সে ।
সে কি মুক্ত করে দিবে প্রেমকে?
.
আচমকা শোয়া থেকে উঠে পড়লো সাফা । প্রদীপ ঘষে প্রেমকে বের করে জিজ্ঞাসা করলো-
আমার যেকোনো ইচ্ছে কি আপনি পূরণ করতে পারবেন?
-জি ম্যাডাম ।
-সিরিয়াসলি?
-হ্যাঁ ।
-ওকে আপনি প্রদীপের মাঝেই থাকুন এখন ।
.
প্রেমকে আবারো প্রদীপের মাঝে ঢুকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো সাফা । তার যেকোনো তিনটি ইচ্ছে পূরণ হবে । ভাবা যায়!
চটপট খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লো সে ।
কি কি ইচ্ছে আছে তার খাতায় লিখে রাখা প্রয়োজন ।
—————————-
১. মা বাবাসহ আমি যেন সারাজীবন বেঁচে থাকি ।
২. খেতে ইচ্ছে করলেই যেন পছন্দের সব খাবার আমার সামনে চলে আসে ।
৩. সবসময় ছেলেদের যেন নিজের পেছনে ঘুরাতে পারি ।
৪. মোবাইলের চার্জ যেন কখনো শেষ নাহয় ।
৫. যখন তখন যেন ফ্রিতে শপিং করতে পারি ।
৬. পরীক্ষা খারাপ হলেও যেন রেজাল্ট ভালো হয় ।
৭. কখনো যেন বুড়ি না হই ।
৮. আমাদের বাড়িটা রাজপ্রাসাদের মতো বড় যেন হয়ে যায় ।
৯. সুন্দর লাল রঙের একটি কার চাই ।
১০. নায়ক রানবীর কাপুরও যেনো আমাকে দেখে ফিদা হয়ে যায় ৷
.
এভাবে প্রায় ৫০টি ইচ্ছের কথা খাতায় লিখেছে সাফা ।
প্রেম তার লিস্ট দেখে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি করতে লাগলে, সাফা গম্ভীর স্বরে বলল-
কি হয়েছে?
.
মেঝের উপরে বসে প্রেম বলল-
ম্যাডাম আমি আপনার তিনটে ইচ্ছেই পূরণ করতে পারব । পঞ্চাশটি নয় ৷ এটা আগেই বলেছিলাম ।
-আপনার কাছে ইচ্ছে পূরণ করার শক্তি আছে, তবে তিনটিই কেনো?
-এটা আমাদের রাজ্যের নিয়ম । নিয়ম ভঙ্গ করতে পারিনা আমরা । আপনাকে এসবের মাঝে যেকোনো তিনটি ইচ্ছে বেছে নিতে হবে । আর বেঁচে থাকা, বুড়ি না হওয়া এসব ইচ্ছে পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । এসবের মালিক আল্লাহ!
.
নিশ্চুপ সাফাকে দেখে প্রেম বলল-
সময় নিয়ে ভাবুন । কোন তিনটি ইচ্ছে পূরণ করতে চান ।
.
.
রাতের খাবার খেয়ে এসে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়লো সাফা । ইচ্ছে তো তার অনেক । তার মাঝে কোন তিনটি ইচ্ছে পূরণ করতে বলবে সে?
এ যেন মহা মুশকিলে পড়লো!
.
রাত অনেক হয়ে গেল ৷ চোখে ঘুম নেই সাফার ।
ভাবতে ভাবতেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে ।
ফেবুতে ঢুকে নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে একটা ছবি চোখে পড়লো তার ।
তার ফ্রেন্ডলিস্টের এক বড় আপু হাসবেন্ডের সাথে ঘুরতে গিয়েছে বরিশাল সাতলা গ্রাম, শাপলা বিলে ।
ছবি দেখে ও বিবরণ পড়ে সাফারও ইচ্ছে হলো, সেখানে যেতে ।
ছবিতেই কত ভালো লাগছে দেখতে, বাস্তবে কত সুন্দর হতে পারে!
ইশ…
যদি একবার সেও যেতে পারতো! তখনি তার মনে পড়লো প্রদীপটির কথা । প্রেম নিশ্চয় তাকে নিয়ে যেতে পারবে?
.
প্রদীপ ঘষে প্রেমকে বের করে সাফা বলল-
আমি আমার প্রথম ইচ্ছে পূরণ করতে চাই ।
-বলুন ম্যাডাম?
-বরিশাল শাপলা বিলে যেতে চাই আমি এখুনি । এটা কি সম্ভব?
-অবশ্যই ।
-বরিশাল এখান থেকে অনেক দূরে হবে নিশ্চয়?
-হ্যাঁ তা হবে । তবে আমি আপনাকে চোখের পলকে নিয়ে যেতে পারি ।
-সত্যি?
-হ্যাঁ ।
-চলুন তবে ।
-আমার হাতটি ধরে চোখ বন্ধ করুন ম্যাডাম ।
.
প্রেম তার দিকে নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিলো, সাফা তার হাতের উপরে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো ।
কয়েকসেকেন্ড পরেই প্রেম বলল-
চোখ খুলুন ম্যাডাম ।
.
চোখ খুলেই সাফা বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেল ৷
সত্যিই সে চলে এসেছে শাপলা বিলে!
তবে অন্ধকার হওয়ার কারণে ভালোভাবে কিছুই সে দেখতে পারছেনা । আকাশ মেঘলা হবার কারণে চাঁদের আলোও নেই আজ ।
সাফার অবস্থা বুঝতে পেরে প্রেম তার অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলো ।
হাজার হাজার মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল চারপাশ ।
এ যেন শাপলার এক রাজ্য!
বিলের পানিতে থাকা শত সহস্র লাল শাপলা দেখে সাফা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ।
যতদূর চোখ যায়, শুধু শাপলা আর শাপলায় দেখতে পাচ্ছে সাফা ।
এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল সে ৷
.
প্রেম বলল-
লাফালেই হবে? শাপলার রাজ্যে প্রবেশ করবেন না?
-মানে?
.
একটি ডিঙ্গি নৌকা দেখিয়ে প্রেম বলল-
চলুন হারিয়ে যাই শাপলার রাজ্যে ।
.
প্রেমের সাথে নৌকায় বসলো সাফা । এই প্রথম সে নৌকায় বসেছে । এসব যেন স্বপ্ন মনেহচ্ছে তার কাছে!
ডিঙ্গি নৌকাটি আপনা আপনি সামনের দিকে এগুতে লাগলো ।
প্রেমকে শক্ত করে ধরে জড়সড় হয়ে বসে আছে সাফা ।
প্রেম মৃদু হেসে বলল-
ভয় মেই ম্যাডাম । আমি থাকতে আপনার কিছুই হবেনা । নির্ভয়ে সৌন্দর্য্য উপভোগ করুন আপনি ।
.
একটু দূরে সরে বসলো সাফা । খোলে চুলে, ধবধবে সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ আজ তাকে কোনো অপসরীর চেয়ে কম সুন্দর লাগছে না । তার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রেম ।
এদিকে আগাছা আর বিলের লতাপাতায় ঘেরা হাজারো শাপলা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে সাফার ।
তিন ধরনের শাপলা দেখতে পেয়েছে সে । লাল, সাদা, ও বেগুনী । তবে লাল শাপলাই চোখে বেশি পড়ছে তার ।
বিলের যত ভেতরে যাচ্ছে, ততই বাড়তে থাকছে লালের আধিক্য!
প্রকৃতির বুকে আঁকা এ যেন এক নকশি কাঁথা । প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ডালা সাজিয়ে আছে এই শাপলা বিল । নয়নাভিরাম এমন দৃশ্য দেখে সাফা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে ।
প্রেমে বিল থেকে কয়েকটি শাপলা নিয়ে সাফার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
আপনার জন্য ম্যাডাম ।
-ধন্যবাদ ।
.
নিজের দিকে প্রেমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফা বলল-
অনেক বেশিই সুন্দর তাইনা জায়গাটি? আমি ভীষণ উপভোগ করছি ।
-আমিও ।
.
আপনমনে প্রেম বলল-
আপনি উপভোগ করছেন শাপলা বিলের সৌন্দর্য্য আর আমি উপভোগ করছি আপনার । পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্যই যেন হার মানবে আপনার কাছে ।
.
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *