প্রেমময় প্রদীপ

প্রেমময় প্রদীপ !! Part- 06

ভোর হতে না হতেই ঘুমটা ভাঙলো সাফার ।
চোখ জোড়া কচলিয়ে সে উঠে বসলো ।
শাপলা বিলের মাঝে, ডিঙ্গির উপরে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে । সামনে বসা প্রেমকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো চমকে উঠল ।
প্রেম কিছু বলতে যাবে তখনি সাফা বলল-
আমি সত্যিই স্বপ্ন দেখছি না!
.
মৃদু হেসে প্রেম বলল-
না তো!
.
আশেপাশে তাকিয়ে সাফা বলল-
কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পাইনি আমি । আপনি কি সারারাত জেগে ছিলেন?
-হ্যাঁ ।
-কষ্ট হয়নি?
-মানুষের ইচ্ছে পূরণ করে আনন্দ দিতে পারলে নিজেও আনন্দ পাই ।
-আপনার ঘুম না হওয়ার ইচ্ছে আমি পোষণ করিনি ।
-আপনি যেটির করেছেন, এটি সেটির অংশ বলতে পারেন । এখানে আপনাকে এনেছি, আপনার খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব । চলুন এবার যাওয়া যাক ।
-আটটার আগে আমাকে কেউ ঘুম থেকে ডাকতে আসবেনা । আরেকটু থাকতেই পারি ।
.
সাফা খেয়াল করলো, ইতিমধ্যেই আশেপাশে কিছু মানুষের আগমন ঘটেছে ।
প্রেম বলল-
এটি একটি দর্শনীয় বিল । তাই সকালে মানুষের আনাগোনা বেশি দেখা যাবে এখানে ।
-সকালে কেনো?
-কারণ বেলা গড়ানোর সাথে সাথে ফুল বুজে ছোট হয়ে যায় ।
ফুল বুজে গেলে সৌন্দর্য্য কিভাবে উপভোগ করা যাবে?
-ওহ!
.
সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা । স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে সাফা । রাতের ও ভোরের শাপলা বিল দেখে আলাদা দুটি সৌন্দর্য্য অনুভব করলো সে ।
বিলের পানিতে ফোটা শত সহস্র শাপলা, সূর্যের লাল আভাকেও হার মানাচ্ছে ।কিছুক্ষন পর নৌকা পাড়ে ভিড়ে। ডাংগায় উঠে পরে দুজনেই।
.
.
.
.
প্রেমের সাথে শাপলা বিলের একপাশ ধরে হাঁটছে সাফা । এ যেন এক গাঢ় সবুজের পটভূমি!

হঠাৎ ক্ষিদেয় তার পেট চো-চো করতে লাগলো ।
প্রেমকে বলতে গিয়েও বললো না সে । যদি আরেকটি ইচ্ছে শেষ হয়ে যায়?
.
প্রেম তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সাফার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে ।
সে জিজ্ঞাসা করলো-
কোনো সমস্যা?
.
সত্যিটা চেপে গিয়ে সাফা বলল-
নাহ কিছুনা ।
-আমাকে বলতে পারেন!
.
সাফা বিড়বিড় করে বলল-
হ্যাঁ! আপনাকে বলি তারপর খাবার দিয়ে বলবেন, তোমার দ্বিতীয় ইচ্ছেও পূরণ করা হয়েছে ।
.
সাফাকে বিড়বিড় করতে দেখে প্রেম বলল-
কিছু বললেন?
-চারপাশটা অনেক সুন্দর বললাম ।
.

এত সুন্দর জায়গাটি থেকে এখুনি সাফার যেতে ইচ্ছে করছেনা আবার খাবারের কথাও বলতে পারছেনা সে ।
কাল রাতে কম খাওয়ার ফল এটা ।
এখন কি করতে পারে সে?
ভাবতে ভাবতে এক মহিলার ডাকে পেছনে ঘুরে তাকালো সাফা ।
সাফা তাকাতেই মধ্যবয়সী নারীটি বললেন-
একা একা এখানে কি করছো মা?
-একা নাতো!
.
কথাটি বলেই জ্বীভে কামড় বসালো সাফা ।
প্রেমকে সে ছাড়া কেউ দেখবেনা । এটা কেনো যে ভুলে যায় সে!
.
-কার সাথে এসেছ?
-না মানে একাই এসেছিলাম । এখন আপনি সাথে আছেন তাই বলেছি ।
-তাই বুঝি!
-জি ।
-বাড়ি কোথায় তোমার?
-নরসিংদী ।
-সে কি! সে তো অনেক দূরে । ওখান থেকে একাই এলে?
-হ্যাঁ । আসলে জায়গাটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ।
-কখন এলে?
-কাক ডাকা ভোরে ।
-নিশ্চয় কিছু খাওনি?
-না ।
-আমার সাথে চলো, কিছু খাবে । আমার বাড়ি পাশেই ।
.
ছোট থেকেই সাফার মা সবসময় বলতেন, অপরিচিত কারো সাথে কোথাও না যেতে । এই মহিলা নিজ বাড়িতে যেতে বলছে তাকে । সে কি যাবে?
প্রেমের দিকে চোখ পড়তেই সাফা সিদ্ধান্ত নিলো, সে যাবে । কারণ প্রেম থাকতে তার কোনো ক্ষতি হতেই পারেনা ।
তাই সাফা সম্মতি জানিয়ে বলল-
চলুন ।
.
.
বেশ কিছুক্ষণ হলো মহিলাটির বাড়িতে এসেছে সাফা । মাঝারি সাইজের টিনের চালা দেয়া একটি বাড়ি ।
বাড়িতে সে, তার স্বামী ও দুটো ছোটছোট বাচ্চা রয়েছে ।
বাড়ির পাশেই লাগানো ছোট একটি রান্নাঘর । যেখানে সাফার জন্য পিঠে বানাতে ব্যস্ত মহিলাটি ।
পিড়ি পেতে বসে তার পিঠে বানানো দেখছে সাফা ।
উঠোনে বাচ্চা দুটি খেলা করছে ।
মহিলাটি জানতে চাইলেন-
কেমন লেগেছে আমাদের গ্রাম?
-অনেক ভালো!
-শাপলা নিয়ে যাবে বাড়ি? আমার স্বামী শাপলা চাষ করে
-অন্য কোনো দিন নিব ।
.
মহিলাটির সাথে খুব সহজে মিশে গেল সাফা । হাসিমুখে কত সুন্দর করে কথা বলছে সে তার সাথে!
বাচ্চা দুটিও তার কাছে এসে কোলে উঠে বসে আছে ।
সাফাকে যত দেখছে অবাক হচ্ছে প্রেম ।
কত প্রাণবন্ত একটি মেয়ে!! …
.
.
সকাল আটটা বাজার আগেই নিজের বাড়িতে এসে পড়লো সাফা ।
কাল রাত থেকে যা ঘটে গিয়েছে, সবটাই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার কাছে ।
ঘোর যেন কাটছেই না।
প্রেম তাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
আপনার প্রথম ইচ্ছে পূরণ হয়েছে ম্যাডাম ।
.
সাফার ইচ্ছে করছে প্রেমকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাতে । কিন্তু এমনটা সে করলোনা । নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে বলল-
ঠিক আছে ।
-এবার আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছে বলুন ।
-এখুনি বলতে হবে?
-ভাবতে হবে?
-হু ।
-বেশ! তবে ভাবুন ।
.
তখনি দরজায় কড়া নেড়ে সামিনা রশিদ বললেন-
সাফা উঠেছিস? নাস্তা করতে আয় ।
.
.
.
.

-জানিস বিলের লাল শাপলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছে । কোটি কোটি শাপলা সত্যিই সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ।
গ্রামটির মানুষ অনেক অতিথিপরায়ণ । এক মহিলা তার বাসায় নিয়ে গিয়েছে আমাকে । অথচ আমাকে চেনেই না । পিঠে বানিয়ে খাওয়ালো ৷ থাকতেও বলল । তার কাছেও অনেক কিছু জানতে পারলাম । তিনি বলেছেন, তাদের জন্মের পর থেকেই এভাবে শাপলা ফুটতে দেখেছে তারা । এর উৎপত্তি কিভাবে জানা নেই ৷ তাছাড়া শাপলার বিল শুধু সৌন্দর্য্য নয়, বিল থেকে শাপলা তুলে স্থানীর বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে । ওই আন্টি আমায় শাপলাও দিতে চেয়েছেন ৷

.
সেই কখন থেকে সাফার বকবকানি শুনে যাচ্ছে তনিমা ও রাইমা । রাতে ঘটে যাওয়া সব কিছুই তাদের বলেছে সাফা । কিন্তু কিছুই বিশ্বাস করেনি তারা ।
এত তাড়াতাড়ি বরিশাল গিয়ে ফিরেও আসা সম্ভব নাকি!
আর এসব প্রদীপের কথা একেবারেই অবিশ্বাস্য । তবুও কেন তাদের মিথ্যে বলে যাচ্ছে সাফা, মাথায় আসছেনা।
সাফার কথা শুনতে শুনতে রাইমা বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লো ।
মিথ্যে কথা আর কতোই না শোনা যায়!
রাইমা চলে গেলে সাফা তনিমার দিকে তাকিয়ে বলল-
ও আমায় বিশ্বাস করলো না ।
-আমিও ।
-তোদের কেনো মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি?
-মানলাম তুই মিথ্যে বলছিস না । সত্যিই ওই প্রদীপ থেকে প্রেম নামক কেউ এসেছে, যে তোর ইচ্ছে পূরণ করতে চায় । তবে তুই এমন একটি ইচ্ছে পূরণ করলি কেনো? যদি তুই আমাদের হীরা, মুক্তা দেখাতিস তাহলে আমরা বিশ্বাস করতাম আসলেই তুই সত্যি বলছিস ।
-আমি কাল যে আনন্দটা পেয়েছি তা হীরা, মুক্তা পেলেও পেতাম না । এই এক অন্যরকম অনুভূতি । বিশ্বাস তোদের জোর করে করাতে পারব না । তবে হ্যাঁ, এই বিষয়ে তোদের আর কিছু বলে বিরক্ত করব না আমি ।
.
.
ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরতেই সাফার মা আতঙ্কিত স্বরে বললেন-
আজও একইভাবে একটি মেয়ে খুন হয়েছে সাফা । এবারের খুনটা হয়েছে সিলেটে ।
কয়েকদিন পর পর এসব কি যে হচ্ছে! আমি তো বেশ চিন্তায় থাকি তোকে নিয়ে ।
-আমি অবাক হচ্ছি মা একটা কথা ভেবে । এত খুন হচ্ছে কিন্তু খুনীকে শনাক্ত করতে পারছেনা পুলিশ । এটা কোনো দক্ষ সিরিয়াল কিলারের কাজ হতে পারে ।
-সিরিয়াল কিলার!
-হু ৷ দেখো তুমি । সব খুনই একইভাবে হচ্ছে ।
-কাল থেকে তোর কলেজ যেতে হবেনা আর ।
.
নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সাফা বলল-
ক্লাস করতে গিয়ে মরেছে এমন কেউ তো নেই মা! এত টেনশন করোনা ।
.
.
সাফা ফ্রেশ হয়ে প্রদীপ ঘষতেই প্রেম বের হয়ে এসে বলল-
ভেবে ফেলেছেন? বলুন শুনি দ্বিতীয় ইচ্ছে আপনার ।
-যাওয়ার খুব তাড়া দেখছি আপনার ।
.
মুচকি হাসলো প্রেম ।
সাফা বলল-
লিস্টে আরো কত কিছুই আছে । ভাবার জন্য সময় তো লাগবে নাকি?
-তা ঠিক ।
-আপাতত একটা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।
-কি?
-এত খুন করছেটা কে! আজও একটা খুন হলো ।

.
খুনের কথা শুনে প্রেম কিছু বললো না । চুপচাপ তাকিয়ে রইলো সে সাফার দিকে ।
সাফা বলল-
এই বিষয়ে কি আপনি আমায় জানাতে পারেন?
-এটা কি আপনার দ্বিতীয় ইচ্ছে?
-যদি বলি হ্যাঁ?
-ভেবে বলুন ।
.
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *