প্রেমময় প্রদীপ

প্রেমময় প্রদীপ !! Part- 03

সাফার চেঁচামেচির শব্দ শুনে সামিনা রশিদ দ্রুত তার রুমে এসে জানতে চায়লেন-
কি হয়েছে? এসে মাত্রই বাড়ি মাথায় তুললি কেন?
-আমার ব্যাগের মাঝে একটি প্রদীপ ছিল । ওটা কি তুমি নিয়েছ?
-শুধু প্রদীপ! অনেক কিছুই পেয়েছি ।
-প্রদীপটা কোথায়?
-একটু আশেপাশে ঘুরে তাকাবি তো নাকি! ওয়ারড্রবের উপরেই রেখেছি ।
.
প্রদীপটি দেখে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো সাফা । এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে, এর মাঝে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে যার কারণে গায়েব হয়েছে । তনিমার কথা শুনে উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় এসে ভর করছে তার ।
সামিনা রশিদ বললেন-
হ্যাঁ রে সাফা? এত সুন্দর পিতলের প্রদীপটি কোথায় পেয়েছিস তুই?
-নাফাখুমে কুড়িয়ে পেয়েছি ।
-কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস রাখা ভালো কথা নয় ।
-তাহলে কি বিক্রি করে শমপাপড়ি খাব?
-আনলিই কেনো তুই!
-আমার ইচ্ছে করেছে তাই।
-তোর সাথে তর্কে যাওয়া যাবেনা, খেয়ে আয় ।
-তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি ।
-এখন আসবি তুই । পিকনিক থেকে আসার পর খাওয়া দাওয়া ভালো করে করিস নি । আজ তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি ।
-ঠিক আছে চলো ।
.
.
সন্ধ্যায় মা বাবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডায় মজে আছে সাফা ।
তার বাবা জানতে চায়লেন-
লাশটি দেখে ভয় করেনি তোর?
-নাতো! তবে আমাদের ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা ভয় পেয়েছে ৷ তানিশার কথা তো অনেক বলেছি তোমাদের ৷ সে কি করেছে জানো? বমি করে নিজের শরীর ভাসিয়ে দিয়েছে । ফেরার সময় সারা পথে কান্না করেছে । অথচ কলেজে এমন ভাব করে চলে, তার মতো সুন্দরী ও সাহসী মেয়ে একটিও নেই ।
.
ফারুক রশিদ হাসলেও সামিনা রশিদ মুখটা বাকিয়ে বললেন-
এত সাহস ভালো না । একটা লাশ দেখে তোর মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়নি!
.
সাফা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনি কলিংবেলের শব্দ শুনতে পেলো তারা ।
সাফা বলল-
আমি দেখছি ।
.
দরজা খুলে শফিকুল ও তাইফকে দেখে সাফা চোখ জোড়া বড় বড় করে বলল-
তোমরা এখানে?
.
শফিকুল বলল-
তুমিই তো বলেছিলে, তোমার মা বাবার সামনেই তাইফকে তার মনের কথা জানাতে হবে ।
.
তাইফের পা কাঁপাকাঁপি দেখে মুচকি হাসলো সাফা । সে জানে, শফিকুলের জোরাজোরিতে তাইফ এখানে আসলেও কিছুই করতে পারবে না ।
কিন্তু তার ভাবনা ভুল করে শফিকুল বলল-
আজ কিন্তু মা বাবার সামনেই তোমাকে মনের কথা জানাবে তাইফ ।
.
এই বলে ভেতরে ঢুকতে লাগলো তারা । ভেতরে এসে মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো সাফা ।
শফিকুল বলল-
আসলে আজ কলেজে সাফার শরীরটা ভালো ছিলনা বলেছে, তাই দেখতে চলে এলাম ।
.
সামিনা রশিদ মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন-
তুই তো বলিস নি তোর শরীর খারাপ!
-ওদের সাথে ফাযলামো করেছিলাম । সিরিয়াস ভাবলো ।
ওসব ছাড়ো । তোমরা গল্প করো, আমি চা বানিয়ে আনি ।
.
রান্নাঘরে এসে পায়চারি করতে থাকলো সাফা ।
প্রচন্ড সাহস দেখিয়ে ফেলেছে এই ছেলে দুটি । বাসায় চলে এসেছে তারা! মা বাবার সামনে মনের কথা জানালে সে হেরে যাবে । তাছাড়া তার মা বাবাই কি মনে করবে!
নাহ, এদের কাছে সহজে হার মানা যাবেনা ।
সাফার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো । চুলোয় চা বসালো না সে ।
ফ্রিজ থেকে পানি বের করে দুটো মগে ঢাললো । তাতে চিনি, দুধ ও গুড়ো মরিচ মিশিয়ে দিলো । একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট নিলো ।
একটু পরে ট্রেতে সেসব সাজিয়ে বের হয়ে এলো সে ।
শফিকুল ও তাইফের হাতে মগ দুটি এগিয়ে দিলে বলল-
চা খাও । আমার হাতের চা, একবার খেলে সারাজীবন মনে থাকবে ।
.
মেয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ফারুক রশিদ বললেন-
হ্যাঁ এই একটা কাজই আমার মেয়ে ভালো পারে ।
.
হাসিমুখে মগগুলো হাতে নিলেও, চায়ের রঙ দেখে তাদের বুঝতে বাকি রইলো না সাফা চায়ের বদলে অন্য কিছু এনেছে । কিন্তু কি বুঝতে পারলো না তারা । একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকলো ।
সাফা বলল-
খাও খাও । খেয়ে বলো কেমন হয়েছে!
.
দুজনেই চুমুক দিয়ে মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেললো ।
সাফা নিজেরমনে বলল-
জানাও এবার মনের কথা!
.
তাদের দিকে তাকিয়ে সাফা বলল-
পুরোটা শেষ করতে হবে কিন্তু ।
.
শফিকুল শেষ করতে না পারলেও তাইফ করলো । শেষ করার পরেই মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটলো তার ।
শফিকুল ফিসফিসিয়ে জানতে চায়লো-
এটা চা, কফি নাকি শরবত কিছুই বুঝলাম না । কি মিশিয়েছে ফাযিল মেয়েটা!
-ভালোবাসা ।
.
আর কিছু বললো না শফিকুল । তাইফকে পরে দেখে নেবে সে । তার জন্যই সাফার দুষ্টুমি সহ্য করতে হচ্ছে তার ।
এখন যেটা করতে এসেছে সেটা করা উচিত ।
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো শফিকুল । তারপর সাফার দিকে তাকিয়ে বলল-
তাইফ তোমাকে কিছু বলতে চায় ।
.
কথাটি শুনে ঘাবড়ে গেলো সাফা । এইরে!
সত্যি সত্যিই মা বাবার সামনে এসব বলবে নাকি? তার বাবা তো রেগে যাবে এমন কিছু করলে ।
সাথে সাথেই তাইফের ফোনটা বেজে উঠলো ।
রিংটোনে বেজে চলেছে এই গানটি–
ভালোবাসি বড় ভালোবাসি,
এর বেশি ভালোবাসা যায়না,,
ও আমার প্রাণ পাখি ময়না…
.
ফারুক রশিদ ভ্রু কুচকে তাইফের দিকে তাকিয়ে রইলেন । তাড়াহুড়ো করে তাইফ ফোনটা কেটে দিয়ে বলল-
বন্ধুর ফোন এসেছে । ওর কাছে যাওয়ার কথা ছিল । আজ তাহলেআসি আঙ্কেল । সাফা সুস্থ আছে জেনে ভালো লাগলো ।
.
দুজনে উঠে দাঁড়ালে সাফা বলল-
আমি ওদের এগিয়ে দিয়ে আসছি বাবা ।
.
তারা এগিয়ে যেতেই ফারুক রশিদ বললেন-
আজকালকার ছেলে মেয়েদের কি অবস্থা! কিসব গান রিংটোন হিসেবে ইউজ করছে দেখো ।
.
সামিনা রশিদ বললেন-
বাদ দাও তো । ছেলেমানুষ তারা ।
.
এদিকে দরজার পাশে আসতেই সাফা বলল-
এই হিরো? পারলে না তো জানাতে?
.
শফিকুল বলল-
কই পারলো না? এর সুন্দর গান শুনিয়ে জানিয়ে দিলো সে ।
-রিংটোন শুনিয়ে?
-হ্যাঁ! তুমি তো বলোনি মুখে বলতে হবে । বলবে নাকি?
.
নিশ্চুপ সাফাকে দেখে শফিকুল বলল-
এখন তুমি আমার বন্ধুর প্রস্তাবে রাজি আছো কিনা জানিয়ে দিও ।
.
দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে তাইফকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শফিকুল ।
নিজেকে এই প্রথম বোকা মনে হচ্ছে সাফার । তার বাসায় এসে তাকে হারিয়ে চলে গেলো এই ছেলে দুটি! মানা যায়না এটা…
.
.
রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে এলো সাফা । দরজাটা আটকিয়ে সে বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো ৷ ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করলো তনিমার নাম্বারে ।
সে রিসিভ করতেই আজ শফিকুল ও তাইফ কি কি করেছে তা জানালো ।
তনিমা হাসতে থাকলে সাফা রেগে বলল-
আমার হারে তুই হাসতে পারছিস?
-এতে হারের কি আছে সাফা? তোর জন্য একটা বোকাসোকা ছেলে কত সাহস দেখিয়েছে বুঝতে পারছিস? তাইফ তোকে আসলেই ভালোবাসে রে ।
-সবিটায় শফিকুলের আইডিয়া । ছাড় তো এসব । এখন রাখছি । কাল দেখা হবে ।
-এই শুন?
-কি?
-প্রদীপটা ঘষে দেখেছিস?
-আমার কাছে যে একটা প্রদীপ আছে, এটা আমার মনেই থাকেনা ।
.
দুষ্টুমির স্বরে তনিমা বলল-
ঘষে দেখ ঘষে দেখ, যদি সত্যিই আলাদীনের মতো একটা জ্বীনি পেয়ে যাস!
-তুই ফোন রাখলেই তো ঘষতে পারব নাকি?
-হু রাখছি।
.
তনিমার সাথে কথা বলা শেষে ওয়ারড্রবের উপর থেকে প্রদীপটি নিয়ে আবার বিছানায় ফিরে আসলো সাফা ।
আলাদীনের চেরাগ সম্পর্কে অনেক শুনেছে সে । ছোট বেলায় কার্টুন দেখেছে, বইও পড়েছে । একসময় সেও ভাবতো তারও যদি এমন একটি চেরাগ থাকতো, তবে কত কিছুই না চেয়ে বসতো সে!
সত্যি সত্যি আলাদীনের মতো প্রদীপ সে পেয়েছে । কিন্তু আফসোস, এটা কেবলই একটি পিতলের প্রদীপ ।
আর কিছু না ভেবে একবার প্রদীপটায় ঘষলো সাফা ।
কিছুক্ষণ প্রদীপটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো । পিতলের হলেও কারুকার্যের সংমিশ্রণে অসাধারণ দেখতে এটি । কি যেন মনে করে আরো দুবার ঘষলো সে ।
এরপরেই বালিশের একপাশে প্রদীপটি রেখে মোবাইল হাতে নিয়ে, গেইমস খেলতে লাগলো ।
খেলায় একটু মনোযোগ দিতেই খেয়াল করলো, তার পুরো রুমটা ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে ।
ধোঁয়া কোথা থেকে আসছে তা জানার জন্য উঠে দাঁড়ালো সে । কিছু নড়ার শব্দ কানে আসতেই বালিশের পাশে চোখ পড়লো তার । প্রদীপটি নড়ছে! প্রদীপটি থেকে কিছু বেরিয়ে আসছে দেখে ভয়ে সে খাটের নিচে ঢুকে গেল ।
তার গলা থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা । নিজেরমনে বলে যাচ্ছে সে-
এটা কি বের হচ্ছিল? কি হচ্ছে টা কি এখানে!
.
একটু সময় পরেই চারদিকে পরিষ্কার হয়ে গেল । সাফা মাথা বের করে দেখার চেষ্টা করলো, বাইরে কি ঘটেছে । ঠিক তখনি তার কাধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব হতেই বলল-
উফফ… ছাড়ো তো । দেখার চেষ্টা করছি…
.
এতটুকু বলেই থেমে গেল সাফা । সে ছাড়া রুমে কেউ ছিলনা । তাহলে তার কাঁধে হাত দিলো কে!
পাশে ফিরে তাকাতেই একটি ছেলে দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে চায়লো সাফা । ছেলেটি তার মুখ চেপে ধরে বলল-
চিৎকার করবেন না ম্যাডাম । কেউ এসে পড়বে । আমি প্রদীপ থেকে বের হয়েছি।
.
সাফা ইশারা করলো তার হাত সরাতে ।
ছেলেটি হাত সরাতেই সে দ্রুত খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে, দরজার দিকে এগিয়ে গেল ।
ছেলেটিও বের হয়ে বলল-
আপনি প্রদীপ ঘষে আমাকে বের করেছেন । তাই আপনি এখন থেকে আমার ম্যাডাম । আপনার তিনটে ইচ্ছে পূরণ করব আমি । আর ততদিন পর্যন্ত আপনি আমার ম্যাডামই থাকবেন ।
.
কথাটি শুনে থেমে গেল সাফা । এই প্রথম এতটা ভয় সে পেয়েছে । মুহুর্তেই সারা শরীর ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে তার । তবুও সাহস করে পেছনে ফিরে তাকালো সে ।
আশ্চর্য! আলাদীনের চেরাগে থাকা দৈত্যটির মতো কেউ নয় ।
হাত কাটা হালকা গোলাপি রঙের একটি টিশার্ট, সাদা জিন্স ও সাদা কেডস পরে সুদর্শন একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে ।
ছেলেটিকে কোথায় যেন দেখেছে সে । বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছে!
ধীরপায়ে ছেলেটির আরেকটু কাছে আসলো সাফা । আরে এইতো তার স্বপ্নে আসা সেই ছেলেটি!
.
সাফা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
কে তুমি?
.
মৃদু হেসে ছেলেটি বলল-
প্রেম!
.
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *