প্রেমময় প্রদীপ

প্রেমময় প্রদীপ !! Part- 02

বাড়িতে ফিরেছে সাফা সেই কবে! কিন্তু তার মায়ের বকুনি এখনো শেষ হলো না । সেই কবে থেকেই একনাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছেন সামিনা রশিদ—-
বাবা মেয়ে আমার কথার কোনো গুরুত্বই দেয়না । ঘটলো তো অঘটন! ঠিক নাফাখুমেই খুনটা হয়েছে । এতবার, এতবার নিষেধ করলাম । কে শুনে কার কথা! না আমি তো তার শত্রু । শত্রুর কথা শুনবে কেনো সে!
.
নাহ আর সহ্য করা যাচ্ছেনা ৷ একই কথা বারবার শুনতে কারই বা ভালো লাগে!
সোফা ছেড়ে উঠে সাফা বলল-
আমার ঘুম পাচ্ছে ।
.
হনহনিয়ে সে নিজের রুমে চলে গেলেও থামলেন না সামিনা রশিদ ।
চেঁচিয়ে তিনি পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছেন ।
এদিকে নিজের রুমে এসে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পড়েছে সাফা । এই সময় তার মাকে শান্ত করতো পারতো তার বাবা । অথচ তিনি বাসায় নেই । অফিসে গিয়েছেন । অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে । এতক্ষণ যাবৎ এসব সহ্য করতে হবে তাকে! উফফ….
.
এরইমাঝে সামিনা রশিদ দরজায় কড়া নেড়ে বললেন-
বাসায় এসে কিছু তো খাসনি । আয় কিছু খেয়ে নিবি ।
-কে বলেছে কিছু খাইনি আমি! বকুনি খেয়েই পেট ভরে গিয়েছে আমার ।
-দরজা খুলে খেতে আয় ।
-প্লিজ আম্মু যাও এখন । আমার ঘুম পাচ্ছে ।
.
কথা বাড়ালেন না সামিনা রশিদ । মেয়ের জেদ সম্পর্কে অজানা নয় তার । সরে গেলেন তিনি। এদিকে চোখ জোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো সাফা ।
.
.
একটা ফুলের বাগানে বসে আছে সাফা । চারদিকে তাকিয়ে সে বাগানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছে । হঠাৎ টুংটাং শব্দ শুনতে পেলো সে । পেছনে ফিরতেই দেখলো, সাইকেল চেপে এক ছেলে তার দিকে এগিয়ে আসছে । দূর থেকেই ছেলেটির টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ সাফার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো । এত সুন্দর ছেলেও হয়! একে না দেখলে জানতোই না সাফা ।
খুব দ্রুত সাফার কাছে এসে পৌঁছালো ছেলেটি ।
মেয়ে হয়েও ছেলেটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফা । ইচ্ছে করছে তার গালে নিজের হাতটি ছুঁয়ে দিতে ।
সাফার আরো কাছে এসে ছেলেটি বলল-
ছুঁয়ে দিতেই পারো, আমি তো তোমারি!
.
-সাফা? এই সাফা?
.
মায়ের ডাকে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসলো সাফা ।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, সে তার নিজের রুমেই আছে । তার মানে স্বপ্ন দেখছিল সে!
ইশ…
এত মিষ্টি একটা মুহুর্ত কেনো যে স্বপ্ন হলো!
.
-সাফা তুই কি শুনতে পারছিস না আমার কথা? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে । ভাত খাবি কখন তুই?
.
মুখে বিরক্তিভাব এনে সাফা বলল-
আসছি আমি ফ্রেশ হয়ে । তুমি যাও ।
.
.
পরেরদিন কলেজে আসলো সাফা । গতকাল সারাদিন ঘুমিয়েও যেন চোখের ঘুম কাটেনি তার ।
ক্লাসে এসেই সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব দেখলো সে । তনিমাকে জিজ্ঞাসা করলো-
সবাইকে এমন লাগছে কেনো?
-তুই যেন জানিস না কেনো?
পরশু এতবড় একটা কান্ড ঘটে গেল…
-কি কান্ড?
-এই সাফা তোর মাথা ঠিক আছে? নাফাখুমের লাশটির কথা বলছি আমি ।
-ও আচ্ছা! এটা নিয়ে এত আতঙ্কে থাকার কি হয়েছে? যে মরার সে মরেই গিয়েছে ।
-আমাদের মাঝে কারো সাথে ঘটতে পারতো এটা ।
-ঘটেনি তো ।
-তোর ভয় করেনি লাশ দেখে?
-নাহ!
-সিরিয়াসলি?
-হু । এত অবাক হবার কি আছে! অবশ্য আমার মা কি বলে জানিস? মেয়ে না হয়ে আমার ছেলে হওয়ার প্রয়োজন ছিল । আমার সাহস অনেক বেশিই কিনা..
.
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাইফ । তাদের কথপোকথন শুনে সে বিড়বিড়িয়ে বলল-
ভালোই হয়েছে তুমি ছেলে হওনি । নাহলে আমি কার প্রেমে পড়তাম?
.
তার পাশে দাঁড়ানো শফিকুল বলল-
কি বলছিস বিড়বিড়িয়ে?
-তোকে নয় ।
-নিশ্চয় সাফাকে?
-হ্যাঁ ।
-এভাবে আর কত? সাফাকে মনের কথা জানিয়ে দেয়া উচিত ।
.
শফিকুল খেয়াল করলো, জানানোর কথা শুনেই তাইফের পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে ।
উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো শফিকুল ।
তাইফ তার মুখটা চেপে ধরে বলল-
হুশ! আস্তে ।
.
তাইফের হাত সরিয়ে শফিকুল বলল-
ভালোবাসিস, জানাতে পারিস না? তোর হয়ে আমি জানাবো সাফাকে ।
-দেখ আমি আস্তেধীরে জানাবো । তোর কষ্ট করার প্রয়োজন নেই ।
-খুব আছে । আমার বন্ধু কষ্ট পাচ্ছে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব!
.
শফিকুল এগিয়ে যেতে চায়লে দেখলো, সাফা নেই ।
সাফা গেল কই?
শফিকুল খুঁজতে লাগলো তাকে । তার পিছুপিছু ছুটছে তাইফ ।
সাফাকে তারা পেলো । কিন্তু কলেজের কমনরুমে । তার সাথে দেখতে পেলো, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র তমালকে । সাফার হাতে আছে ফুলের তোড়া ।
দুজনকে এভাবে কাছাকাছি বসে কথা বলতে দেখে, তাইফ কষ্ট পেলেও কিছু বলল না । চুপচাপ সেখান থেকে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো সে । তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে শফিকুল বলল-
দেখলি তো তাইফ? পাখি উড়াল দিলো, তুই খাচার পাশেই বসে থাকলি ।
.
তাইফের কষ্ট হচ্ছে, সাথে রাগও । তমালের কোনো আচরণে মনে হয়নি সে পছন্দ করে সাফাকে । তবে আজ এসব কি দেখলো সে!
হুট করেই তাইফের মনে পড়লো, তমাল হিন্দু! মুসলিম হয়ে একটা হিন্দু ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ালো সাফা?
তাইফ বলল-
সাফা ভুল পথে যাচ্ছে । ওকে আমার বুঝানো উচিত । এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
.
-পরশু পিকনিকেই রাইমা কে প্রপোজ টা করে ফেলতাম । ভেবেছি জিন্না পাড়ায় গিয়ে করব । কিন্তু হুট করে চলে আসার কারণে আমার সব প্ল্যান চপাট হলো । এখন তুমিই আমার ভরসা সাফা । এভাবে কলেজে ওকে কিভাবে মনের কথা বলি? তাই তুমি যদি আমার হয়ে এই চিঠিটা আর ফুলের তোড়া টা রাইমাকে দিতে…
-কিচ্ছু চপাট হয়নি । আমি অবশ্যই রাইমাকে দিব এসব । আর আমার যা মনেহয়, রাইমাও তোমাকে পছন্দ করে ।
-সত্যি বলছ! রাই আমাকে পছন্দ করে?
-রাই? কি রোমান্টিক!
.
খানিকটা লজ্জা পেলো তমাল । সাফা উঠতে উঠতে বলল-
নো চিন্তা । একটু পরেই তুমি তোমার জবাব পেয়ে যাবে ।
.
.
চিঠি ও ফুলের তোড়া নিয়ে হেঁটে আসছে সাফা । তাইফ তার দিকে এগিয়ে এসে বলল-
একটু থামবে?
-কি সমস্যা?
.
কোনোমতে সাহস জুগিয়ে তাইফ বলেই ফেললো-
তোমার কাছে এটা আশা করিনি সাফা। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলেকে তুমি পাত্তা দাওনি, শেষমেশ একটা হিন্দু ছেলের সাথে…
.
থেমে গেল তাইফ । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে ।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে সাফা বলল-
আমি যার সাথেই প্রেম করিনা কেন! তোমার তাতে কি?
.
কোনো জবাব তাইফ দিতে পারলোনা । সাফা বলল-
ভালোবাসো আমাকে?
.
নীরবতা সম্মতির লক্ষণ, এমনটায় জানে সাফা । তাইফ তাকে ভালোবাসে জানে সে খুশিই হলো । ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত ছেলে হলো তাইফ । কিছুদিন ভালোই নাচানো যাবে তাকে ।
কাউকে জবাবদিহি করার মেয়ে সাফা নয় । কিন্তু তাইফকে তার সত্যটা বলতে হবে নাহলে নিজের পেছনে ঘুরাবে কি করে তাকে!
সাফা বলল-
রাইমাকে পছন্দ করে তমাল । আমি রাইমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলে আমার মাধ্যমে চিঠি পাঠাচ্ছে ।
.
কথাটি শুনে তাইফের মুখে হাসি ফুটলো ।
সাফা বলল-
ওরা দুজনি হিন্দু । এখন কোনো সমস্যা?
.
খুশিতে আত্নহারা হয়ে তাইফ বলে ফেলল-
কোনো সমস্যা নেই । মেয়েটি যে তুমি নয়!
.
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল সাফা ।
নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে তাইফ আনমনে বলল-
তার মানে সাফাও কি ভালোবাসে আমায়!
.
.
-বুঝলি রাইমা? এতদিন এই অপেক্ষায় ছিলাম আমি । কখন যে আমাকে তমাল প্রপোজ করবে! আজ দেখ আমার আশা পূরণ হলো । হিন্দু, মুসলমান কোনো ব্যাপার না বুঝলি । দুটি মনের মিলনই হলো…
.
সাফাকে থামিয়ে রাইমা বলল-
হয়েছে হয়েছে । আর বলতে হবেনা । তোর ভালো তুই বুঝিস ।
.
মুখে স্বীকার না করলেও, তমালকে রাইমা পছন্দ করে এটা বুঝতে পারতো সাফা ।
তাই ইচ্ছে করেই রাইমার কাছে এসব বলছে সে ।
রাইমাকে আরো জ্বালানোর জন্য সে বলল-
দেখ সে আমাকে লাভ লেটারও দিয়েছে । দেখ না?
-তোর লেটার আমি দেখে কি করব!
-উহু দেখ না! কত রোমান্টিক তমাল! আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা ।
.
সাফার জোরাজোরিতে চিঠিটা পড়তে লাগলো রাইমা । চিঠি পড়ে সে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে গেল । চিঠিটা তার জন্যই লিখেছে তমাল! এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার…
সাফা মৃদু হেসে বলল-
এখন কি বলবি? তমালকে পছন্দ নয় তোর?
.
লজ্জায় দৌড়ে ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল রাইমা ।
.
.
একটা ক্লাস শেষ হতেই গত পরশুর বিষয়টা নিয়ে আবার আলোচনায় বসেছে সবাই ।
সাফার সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই ।
শফিকুল এসে বলল-
তাইফ তোমাকে ভালোবাসে এটা তো তুমি জেনেছ । তোমার কথা জানালে না তো?
-সাফার ভালোবাসা পাওয়া এত সহজ নয় ।
-মানে?
-সেতো আমায় ভালোবাসে তা বলেনি ।
-তুমি যদি চাও বলবে ।
-আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কিছু করতে হবে তাইফ কে ।
-কি করবে সে?
-আমার বাসায় এসে মা বাবার সামনে আমায় জানাতে হবে, সে আমাকে ভালোবাসো ।
-এটা কি করে সম্ভব?
-ভালোবাসলে সবই সম্ভব হয় । তোমার বন্ধুকে জানিয়ে দাও । আজ সন্ধ্যার মাঝেই জানাতে হবে কিন্তু ।
.
কলেজ ছুটির পর ক্লাস থেকে বেরুনোর সময় তনিমা বলল-
প্রদীপ টা কি করেছিস রে?
.
প্রদীপটির কথা ভুলেই গিয়েছে সাফা । তনিমার কথা শুনে মনে পড়েছে তার । সে বলল-
ব্যাগ থেকে কিছু বেরই করিনি আমি এখনো ।
-ও আচ্ছা । বের করে ঘষে দেখিস, যদি জ্বীন বের হয়!
-তারপর সেই জ্বীনটা তোর কাছে পাঠিয়ে দিব আমি ।
-আমার ইচ্ছে পূরণ করতে?
-নাহ । তোকে মারতে ।
.
মুখটা ফ্যাকাশে করে ফেললো তনিমা । সাফা বলল-
এই মামুলি প্রদীপ থেকে
কোনো জ্বীন টিন বের হবেনা পাগলি ।
.
.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা নিলো সাফা ।
কিন্তু প্রদীপটা সেখানে পেলো না সে ৷ সারা ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রদীপ না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেল সাফা । নিজের হাতে প্রদীপটি ব্যাগে ঢুকিয়েছিল সে, তবে গেল কোথায় সেটি!
.
চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *