পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 25
রিমন বসে আছে রিমির ঠিক সামনে।রিমন ভয়ে কাপঁছে থরথর করে।কপাল,মুখ জুড়ে তার ঘামের ছড়াছড়ি।ডান হাতের উল্ট পিঠ দিয়ে বার বার সে নিজের চোখে মুখের ঘাম মুছচ্ছে।হোটেলের রুমটায় বসে আছে সে।রাত গভীর!হবে হয়তো ১২:১০কি ২০।এতো রাতে একজন তাগড়া যুবকের সাথে থাকলে অবশ্যই মেয়েটার ভয়ে কাঁপা উচিঁত ছিলো।কিন্তু এখানে ব্যাপারটা সম্পূর্ন্য উল্টো হচ্ছে।মেয়ের বদলে ছেলেটাই বেশি ভয় পাচ্ছে।শুধু ভয়না রিতিমত কাঁপা কাঁপি করছে।রিমি স্থির হয়ে বসে আছে।হাতে লম্বা চিকন লাঠি।এটা তার না।রিমনের এই রুমে ছিলো।লাঠিটা ক্রমাগত হাতের তালুতে ঘোঁষছে সে।রিমনের চোখেমুখে অসহায় ভাব।কাঁদো কাঁদো নয়নে তাকিয়ে আছে সে।রিমি গলা ঝারে।চোখ তুলে রিমনের চোখে চোখ রাখে।মুখ উচিঁয়ে বললো,
—-“ মাহির তোমার বিশাল লম্বা গোঁফটা কোথায় গো??”
কথাটা কানে পৌছানো মাত্র রিমন নিজের ঠোঁটের উপরে হাত রাখে।বিস্মিত হয়ে ভাবে,অরিত্রানের পিছনে যাওয়ার সময় কি সে জানতো?রিমি এত রাতে তার সাথে দেখা করতে আসবে??এখানে আসার আগেও সে জানতো না যে ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে এসেছে সে অন্য কেউ নয় রিমি!!!তাকে তো হোটেল থেকে কল করেছে আর বলেছে কেউ জরুরি ভাবে তার সাথে দেখা করতে চায়।এবং দেখা করা খুবই প্রয়োজন।তাই তো সে এসেছে।এসে যে রিমির সামনে পরবে কে জানতো?রিমন নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।রিমি তেজি গলায় বললো,
—-“ রিমন হয়ে মাহির কেনো সাজতে গেলে??”
রিমন আশ্চর্য চোখে মাথা তুলে তাকায়।রিমির ক্ষদ্ধ চোখ!রিমন সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিচে রাখে।রিমি নিচু গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—-“ এত বড় চিটার তোমরা??আমি ভাবতেই পারছি না।কিভাবে ধোঁকা দিতে পারলে তুমি??কিভাবে??বলো??প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো।তারপরেও বিশ্বাস করেছি।তার বিনিময়ে এতো বড় ধোঁকা??
রিমন অনুশোচনা ভরা চোখে তাকিয়ে বললো,
—-“ আমরা কাউকে ধোঁকা দিতে চাই নি। আসলে”
রিমি কথার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে রাগি গলায় বললো,
—-“ ধোঁকা দেওয়া তো তোমাদের উদ্দেশ্য ছিলো না নিশ্চুয়ই অন্য মতলব ছিলো।তাহলে চুপ করে না থেকে বলো কি উদ্দেশ্যে আমাদের সাথে নকল মানুষ হয়ে মিশেছো??কেনো??
কিছুসময় চুপ থেকে বললো,
—-“ ওওও বুঝেছি !! নারী পাঁচার মূল উদ্দেশ্য নয় তো??আল্লাহ্ গো শেষে এক পাঁচার কারীর সাথে আমি প্রেম করছি??আমার প্রেমিক পাঁচার কারী!!যদি বিয়ে করতাম তাহলে আমার স্বামী একজন পাঁচার কারী হতো??আল্লাহ্!!বাচ্চা হলে আমার জন্টুমন্টুর বাবা পাঁচার কারী হতো!!তখন আমি কি করতাম??”
রিমনের হাত আপনা আপনি কপালে চলে গেলো।রিমির অবস্থা করুন।সে নিজের এখনো না হওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার জোয়ারে ভাসছে।রিমন কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে বলে,
—-“ মেয়েদের বুদ্ধী আসলেই হাটুঁর নিচে থাকে ।আজ এর চাক্ষোস প্রমান মিললো।রিমনরে তোর বউ তোর চাইতেও বেশি বুঝে এক লাইন।”
রিমি নিজের চিন্তা এক পাশে রেখে ভ্রু কুঁচকে রিমনের দিকে তাকায়।সন্দেহ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
—-“ কি হলো??প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কি এতো বিড়বিড় করছো??আর তোমার ওই পার্টনার কই??সেও নিশ্চুয়ই আসল না??তার আসল পরিচয় বলো??”
রিমন কিছুক্ষন স্তব্দ হয়ে থাকে।রিমির তারত তারত কথাও সে কানে তুলে না ।ভাবে অরিত্রানের নামটা কি বলে দিবো??রিমি তাড়া দিয়ে হাকিয়ে উঠে।রিমন চমকে উঠে বলেই দিলো।শুরু থেকে সব বললো।কিন্তু অরিত্রানের অনেক কথা গোপন করে।সব শুনে রিমি বাকরূদ্ধ হয়ে বসে থাকে কিছু সময়।এরপর চোখ তুলে রিমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“ নুহাশ আসলে অরিত্রান!!”
—-“ হুম।”রিমনের চাপা গলা।
রিমি বিস্মিত!!
____________________________
ঘুমেরা বড্ড খারাপ ,মনে হচ্ছে নোড়ার কাছে।ঘন্টা খানেক বিছানার এপাশ ওপাশ করে নোড়া হাঁপিয়ে উঠেছে।চোখে মুখে তার অস্থির ভাব।বিরক্তিতে চুপসে আছে তার উজ্জ্বল বর্ণের মুখশ্রী।না পারতে ধপাস করে উঠে বসে সে।পাশের টেবিলে রাখা ফোন হাতে নিয়ে দেখে রাত ১ বাজার আর অল্প বাকি।রিমি দ্রুত আসবে বলে এখনো এলো না ।চিন্তা হচ্ছে খুব।নোড়া টেনশান চেপে বসে থাকতে পারে না।হাঁটা হাঁটি করলে তার টেনশন কম হয়।তাই উঠে দাড়িঁয়ে ছাদের দিকে হাটা দেয়।ছাদের শেষ সিঁড়িতে পা রাখতেই অজানা কারনে তার বুকটা কেঁপে উঠে।পা টা আরো বারিয়ে দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে এক ছাঁয়া মূর্তি।নোড়া কৌতুহলি হয়ে আরো এগিয়ে যায়।চোখ যায় একটু দুরে।কর্ণের দিকে কেউ একজন এক পা ভাঁজ করে বসে আছে।কে না বুঝলেও একজন ছেলে যে তা সে বুঝতে পেরেছে।এতো রাতে ছেলে!!নোড়া চমকায়।গলা উঁচিয়ে বলে,
—-“ কে? কে ওখানে??”
অরূপ মাথা তুলে তাকায়।নোড়া আর একটু এগিয়ে এসে অরূপকে দেখে ভারি অবাক হলো।তার সাথে তাল মিলিয়ে অবাক হলো অরূপও।নোড়া বিস্মিত গলায় বললো,
—-“ তুমি এখানে??”
অরূপ বিরক্ত হচ্ছে খুব নোড়াকে এখানে দেখে।অতিথি ভেবে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রেখে বললো,
—-“ আমার বাড়ি,আমার ছাদ।আমি কি এখানে আসতে পারি না??”
নোড়া হাসলো।মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে অরূপের পাশ ঘেঁষে বসে।নোড়াকে পাশে বসতে দেখে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যায় অরূপ।নোড়ার মন খারাপ হয়।খুন্ন মনে নোড়া বললো,
—-“ আমি বসেছি বলে কি তোমার অসুবিধা হচ্ছে??”
অরূপ জোড় পূ্র্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,
—-“ না ! তা হবে কেনো।
—-“ তাহলে চোখে মুখে এতো বিরক্তি কেনো??”
—-“ তেমন কিছু না।আর এই অন্ধকারে তুমি আমার মুখ দেখলে কিভাবে??”
নোড়া হাসে।সে হাসি অন্ধকারেই মিলিয়ে যায়।অরূপের চোখে আর ধরা পরে না।নোড়া হাসি থামিয়ে বললো,
—-“ যারা খুব কাছের হয় !তাদের দেখতে হলে আলো লাগে না।হৃদয়ের আয়নাই যথেষ্ট।”
অরূপ নোড়ার ফিলিংস বুঝে।কিন্তু সকল ব্যক্তিই নিজের ফিলিংসকে আগে মূল্য দেয়।অরূপের বেলাও তাই।ওয়াসেনাতকে সে মন দিয়ে বসেছে।যে কোনো কিছুর বিনিময়ে সে তাকে চায়।অরূপ নিশ্চুপ।নোড়া বললো,
—-“ বিরক্ত হচ্ছো??”
—-“ না।”
—-“ কন্ঠ শুনে ,নিশ্চুপতা তো তাই বুঝাচ্ছে।”
—-“ তেমন কিছুই না।বুঝার মাঝেও ভুল হতে পারে।”
নোড়া উদাসিন গলায় বললো,
—-“ হয় তো।”
—-“ এতরাতে ছাদে কি করছো??”
—-“ তুমি কি করছো??”
—-“ আগে আমি প্রশ্ন করেছি।”
নোড়া হাসলো।পা গুটিয়ে সে বললো,
—-“ ঘুম আসছে না তাই ভাবলাম একটু ছাদে যাই।এবার তুমি বলো কেনো এসেছো??”
—-“ একুই ব্যাপার।”
নোড়ার চোখ চারপাশে ঘুরছে।অন্ধকার আকাশ।লাইট বন্ধ।তাই কিছুই দেখা যাচ্ছে না।অরূপের হাতে ফোন।নোড়া সেদিকে তাকায়।উঁচু হয়ে দেখে।একটা মেয়ের ছবি।ভালো করে দেখতে আরো এগিয়ে যায়।ধাক্কা লাগে অরূপের বাহুতে।অরূপ চোখ ঘুরিয়ে তাকায়।নোড়া ভীতু হয়ে বললো,
—-“ সরি।”
অরূপ বিরক্ত।কিন্তু কিছু বললো না।নোড়া মাথা এগিয়ে ভালো করে খেয়াল করে বুঝে মেয়েটা ওয়াসেনাত।নোড়ার বুকটা ধ্বক করে উঠে।চিনচিন ব্যথা হয়।মুখটা মলিন হয়ে আসে।খুব কান্না পাচ্ছে তার।কলিজা জ্বলছে।ওয়াসেনাতের প্রতি যে অরূপের একটা ফিলিংস আছে এটা এ কয়েক দিনে সে বুঝতে পেরেছে।নোড়া অস্পষ্ট গলায় বললো,
—-“ ভালোবাসো ওয়াসেনাতকে???”
অরূপ একবার চমকে তাকায়।কিছু সময় পিনপিনে নীরবতা বিরাজ করে।নোড়া আটকে আসা গলাই আবার বললো,
—-“ ভালোবাসো তাই না??”
অরূপ চোখ ফিরিয়ে কালো আকাশে রাখে।নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষন হাসে।তারপর বলে,
—-“ প্রথম দেখার প্রেম।কম বয়সি আবেগ।চলে যাবে বা ফুরিয়ে যাবে ভেবেছি।কিন্তু তা হলো না।মনে হচ্ছে দিন দিন এর রূপ রং গভীর হচ্ছে।ভালোবাসাটা হঠাৎ হয়ে গেলো।কিন্তু তারতো খবরই নেই।সে নিজের মতো আনন্দে আছে।কিন্তু সে কি জানে আমার আনন্দ গায়েব করেছে সে।ভালোবাসাময় জ্বালায় আমাকে পুড়িয়ে মারছে!!”
অরূপ থেমে হাসে।সেই হাসির শব্দ কানে আসে নোড়ার।মাথা ঝুঁকে নিচে তাকায়।চোখের পাপড়ি ভিঁজে চুপ চুপ হয়ে আছে।মনে মনে নোড়া আওড়ায়,তুমি ও তো ভালোবাসা নামক অগ্নি স্তুপে পুড়িয়ে ছাঁড়খাঁড় করছো আমাকে!!”মুখ ফুটে বলতে চেয়েও বলতে পারলো না।সে হতাশ হয়ে ভাবে,কতটা ভালোবাসলে এতগুলো বছর একতরফা ভাবেই ভালোবাসতে পারে!!সেও তো বাসে।তার ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাড়ানো কি উঁচিত না??অরূপ উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললো,
—-“ নিচে যাও।অনেক রাত হয়েছে।”
নোড়ার বলতে ইচ্ছে করছে,” আর একটু বসবে প্লিজ!!” কিন্তু বলা হলো না।কিছু কথা চেয়েও বলা যায় না।বলতে হলে তো অধিকার বোধ চাই।তার তো কোনো অধিকার নেই অরূপের উপর।তাহলে কিভাবে বলবে..নোড়া উঠে দাড়িয়ে সোজা হাটা দেয়।অরূপের দিকে একবারো তাকালো না।অরূপ যদি একবার তার চোখে চোখ রাখতো তখন দেখতো ভালোবাসর আগুন কতটা বেদোনা দায়ক!অরূপ ইচ্ছে করেই আর বললো না।ভালোবাসা তো দোষের না।একজনকে অনেকেই ভালোবাসতে পারে।এতে তো কারো হাত নেই।সে তো একজনকেই ভালোবাসে।চাইলেও নোড়ার ভালোবাসার মান কাখতে পারবে না সে।
___________________________
চোখে মুখে কারো চুল এলোমেলো হয়ে উড়ে আসছে অরিত্রানের।হুঁশটা চট করেই আসে তার।চোখ খুলে না দেখেই সে বুঝতে পেরেছে কারো কাঁধে তার মাথাটা আছে।অরিত্রানের গায়ে কারো উড়না।লাল উড়না।বাতাসে উড়ছে সে উড়না।উড়ছে অবাধ্য চুল।সাথে তাল মিলিয়ে অরিত্রানের হৃৎপিন্ড।মাথা তুলে সরতেই ওয়াসেনাতের মাথাটা পরে যেতে নেয়।অরিত্রান হাত বাড়িয়ে মাথাটা ধরে।যত্নের সাথে বুকের পাশটায় রাখে।ওয়াসেনাতের চুল বাতাসের তালে মৃদু দুলছে।অরিত্রান চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে।ভাতের প্লেট।পানি ভর্তি পাত্র।সেই পাত্রে একটা সাদা রুমাল।নিজের মাথায় হাত দিয়ে অরিত্রান হাসলো।মেয়েটা সারা রাত তার মাথায় রুমাল ভিজিয়ে দিয়েছে।জ্বর কমিয়েছে।কাঁধে মাথা রাখার অধিকার দিয়েছে।আর কি প্রয়োজন!এই ছন্নছাড়া জীবনে এমন একজন মানুষ হলেই তো হবে।আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে ধীরে ধীরে।সূর্য যেনো আজ নতুন রূপে উঠছে।অরিত্রানের চোখ যায় ফ্লোরে ঝড়িয়ে থাকা ওয়াসেনাতের লম্বা এলোমেলো চুলের দিকে।চমকে উঠে অরিত্রান।এতটা বিস্মিত সে আগে কখনো হয়নি।কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সে।এ যেনো নতুন করে প্রেমে পড়া।অরিত্রান ওয়াসেনাতের মুখের দিকে একবার চোখ রাখে।মুখের উপর ছড়িয়ে আছে চুল।অরিত্রান ডানপাশের ব্যান্ডেজে মুড়ানো হাতটা এগিয়ে নিয়ে দুইটি আঙ্গুল দিয়ে যত্ন করে আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দেয়।হাতের মুঠোয় হাত রাখে।কোমল হাত।এত কোমলতা কেনো এই মেয়ের মাঝে সে জানে না।হৃদয়টা খুব কোমল তানা হলে রাত জেগে তার সেবা করতো না।লাইটের আলো পরছে একদম ওয়াসেনাতের মুখ বরাবর।ওয়াসেনাতের চোখমুখ খিঁচে আছে।অরিত্রানের চোখে মুগ্ধতা।এতো মুগ্ধ সে তার জীবনে আর কখনো হয় নি।প্রতি ধাপেই যেনো প্রেমে পড়ছে সে।ঘুমন্ত ওয়াসেনাতের প্রেমে আজ বিমুগ্ধ সে।ওয়াসেনাতকে দুহাতে টেনে বুকে জিড়িয়ে নেয় অরিত্রান।ওয়াসেনাতের মুখ,ঠোঁট স্পর্শ করে অরিত্রানের বুকে।অদ্ভুত এক অনুভুতি ঘায়েল করছে তাকে।অরিত্রান আরো একবার ওয়াসেনাতে জড়িয়ে ধরতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবানদের কাতারে ফেলেছে নিজেকে।অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুভুতি অনুভব করছে সে।মন বলছে আজ এই মুহূর্ত টুকুতে থমকে যাক সময়।ক্ষতি কি তাতে।অরিত্রানের যে তাড়া নেই আর।সে বাঁধা পরেছে ।নিজেকে হারিয়েছে।বিলিন হয়ে আজ অপেক্ষায় আছে কোনো এক সময় সত্যি মুহূর্তটা থমকাবে।অরিত্রান অনেক্ষন আপলক ভাবে তাকিয়ে থাকে ওয়াসেনাতের চুলের দিকে।চুগুলো কি আদো বাস্তবিক??ব্যাপারটা যেনো তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।অরিত্রান ওয়াসেনাতের ঘুমন্ত মুখের দিকে তারিয়ে অবাধ্য মনের ইচ্ছে পুরনের জন্য একটা চুমু খায় ওয়াসেনাতের কপালের মাঝ বরাবর।ওয়াসেনাত নড়েচড়ে উঠে।দু’হাতে অরিত্রানের পিঠ জড়িয়ে আবার শান্ত হয়ে নেতিয়ে পরে।অরিত্রান হাসে।চুলের উপরে হাত বুলিয়ে দেয়।ঘুমের মাঝে ওয়াসেনাত ঠোঁট মেলে হাসে।হাসলে মেয়েটাকে মারাত্নক লাগে।অরিত্রান নিজের বুকে এক হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—-“ অরিত্রানের বিনাশ এই মেয়ের হাসিতেই!!”
রোদের প্রথম লাল কিরণ চোখেমুখে পরতেই ওয়াসেনাতের ভারী ঘুমটা মুহূর্তেই ছুটে যায়।ষষ্ট ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কেউ গভীর ভাবে তাকে জড়িয়ে আছে।নড়তে গিয়ে নিজেকে বন্ধি মনে হলো তাঁর।চোখ মেলে ভালো করে তাকিয়ে পরিবেশ বুঝতে চাচ্ছে সে।আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে আছে দু’টি শক্ত হাত।তার মাথাটা কারো শক্ত বুকে!ওয়াসেনাত চমকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে।নিজেকে অরিত্রানের বাহুডোবে আবদ্ধ দেখে ভারী আবাক হয় সে।অরিত্রান রিলিং ঘেঁষে মাথা কাত করে চোখ বন্ধ করে আছে।মুখটা সূর্যের আলোতে ভালো করে দেখেই হকচকিয়ে য়ায ওয়াসেনাত।লোকটার মুখটা এত সুন্দর!!নিজের দু’হাত অরিত্রানের পিঠে বুঝতে পেরে আরো অবাক হয় সে।অরিত্রানের চওড়া বুকের সাথে মিশে আছে নিজের শরীর কথাটা মাথায় আসতেই ,মুহূর্তে তার সম্পূর্ন্য শরীর বরফের মত ঠান্ডা হয়ে জমে গেছে।শিরশির করছে পায়ের তালু।হাতগুলোও ঠান্ডা হয়ে আসছে।হৃৎপিণ্ডের রক্ত দ্রুত গতিতে চলছে।কাঁপছে সে।একটা উড়নার মাঝে তারা দু’জন!তাদের বাসায় দুটো ছাদ ।একটা তাদের ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ি,আর বাকিটা বাহিরে সবার জন্য।বাবা যদি ছাদে আসে??কথাটা ভেবে তার হাত পা আরো কাঁপছে।নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে।সে নিঃশ্বাস পরছে অরিত্রানর বুকের পাশে।অরিত্রান ঘুমায়নি।শুধু চোখ বুজে ছিলো।পিঠে থাকা ওয়াসেনাতের হাতটা ঠান্ড হয়ে আছে।নিঃশ্বাসের তীব্র বেগে অরিত্রান চোখ খুলে তাকায়।হাত আলগা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
—-“ সমস্যা কি??এভাবে কাঁপছো কেনো??নিঃশ্বাস নিতে কি কষ্ট হচ্ছে??আর হাত ঠান্ডা হচ্ছে কেনো??”
ওযাসেনাত নিজের চুলগুলো গুটিয়ে নিয়ে চট করে বুক থেকে সরে যায়।অরিত্রান ভ্রু কুঁচকে তাকায়।ওয়াসেনাত নিজের ভুল ভেবে বললো,
—-“ সরি!!”
অরিত্রান কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে বললো,
—-“ কেনো??”
ওয়াসেনাত জবাব দিলো না।চুলগুলো দু’হাতে মুঠো বন্ধি করতে চেয়ে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে সে।
অনেক্ষন হয়ে গেলো।কিন্তু ওয়াসেনাত এখনো চুল গোঁছাতে ব্যস্ত।অরিত্রান বিরক্ত গলায় মজা করে বললো,
—-“ নকল চুলের এত যত্নের কি প্রয়োজন??”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক গলায় বললো,
—-“ এগুলো নকল নয় আসল।”
অরিত্রান অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
—-“ তাই না কি!!কই দেখি!”
একটা বাহানায় অরিত্রান ওয়াসেনাতের চুল ছুঁয়ে দেয়।দু’হাতে আলতো করে এলোমেলো চুল গুঁছিয়ে দেয়।চুলগুলো পিঠের উপর গুঁছিয়ে বললো,
—-“ ওরে আল্লাহ্ এ চুল তো বাস্তব!!”
ওয়াসেনাত দ্রুত ঘুরে বললো,
—-“ অবাস্তব কেনো হবে??আর মাশআল্লাহ্ বলুন।তানা হলে পরে দেখা যাবে আমার চুল পরছে।”
অরিত্রান হেসে দিলো।হাসতে হাসতে বললো,
—-“ মাশআল্লাহ্!!”
ওয়াসেনাত অরিত্রানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“ কে আপনি??এখনো তো বললেন না??”
অরিত্রানের মনে পরে।রাতে জ্বরের ঘোরে সে কত কি করে ফেলেছে।নিজেকে স্বাভাবিক করে সে বললো,
—-“ তা না যেনেই রাত ভর সেবা করেছো??”
ওয়াসেনাত থতমত খেয়ে বললো,
—-“ অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করা উঁচিত।আম্মু বলতো।তাই করেছি।”
অরিত্রান উঠে দাড়াঁতে দাঁড়াতে বললো,
—-“ তাকে না হয় আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ বলে দিও।”
ওয়াসেনাত চুপ করে আছে।কিছু বলছে না দেখে অরিত্রান রেলিং ঘেঁষে দাড়াঁয়।ওয়াসেনাতের চোখ প্লেটে যেতেই সে বললো,
—-“ আপনি তো অনেক ক্ষুধার্ত ছিলেন।কিন্তু খাবার খাওয়ার আগেই তো সেন্স হারিয়েছেন।এখন কি আবার খাবার নিয়ে আসবো??”
অরিত্রান মাথা উঠিয়ে একবার নিচের দিকে তাকিয়ে প্লেট দেখে বললো,
—-“ দরকার নেই।এখন আর ক্ষুধা নেই।তবে পরে কখনো আসলে এই ভাত বা তেল ,মশলা জাতীয় কিছু নিয়ে এসো না।আমি এগুলো খাই না।
ওয়াসেনাত বিস্মিত হয়ে বললো,
—-“ আপনি কি আবার আসবেন না কি??কিন্তু কেনো??আর কে আপনি ,এখনো বলছেন না কেনো??”
অরিত্রান নিজের ছিঁড়া হাত দেখতে দেখতে বললো,
—-“ মেডিসিন কি তুমি লাগিয়েছো??”
—-“ হুম!!ওয়াসেনাতের বিরক্তির সুর।”
অরিত্রান এক লাফে রেলিং পেরিয়ে রেলিংয়ের উপরে দু’হাত রাখে।ওয়াসেনাত ভীতু হয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
—-“ আপনি কি পাগল না কি??”
অরিত্রান হাসলো।দু’হাতে নিজেকে হালকা উঁচিয়ে বললো,
—-“ অবশ্যই!!তাও শুধু তোমার জন্য।”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক হলো।বললো,
—-“ আমার জন্য মানে কি??আমি কি আপনাকে পাগল হতে বলেছি ??”
—-“ না তো।একদম না।কিন্তু পাগল করেছো।ভয়ংকর রকমের পাগল।এবার দোষি যেহেতু তুমি সে হিসেবে পাগলামী সহ্য ও করতে হবে তোমাকে ।”
ওয়াসেনাতের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়।কি বলছে এই লোক!!মুখে বললো,
—-“ এই আপনি কি বহু রূপী??কিছু সময় পর পর আপনি রূপ পরিবর্তন করেন কেনো??কে আপনি??নুহাশের রূপ কেনো নিয়েছেন??আসল উদ্দেশ্য কি??”
অরিত্রান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।চোখের সামনে পরে থাকা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—-“ পরীজা এত ভেবে কাজ নেই।এখন সব উদ্দেশ্যের মূলে তো তুমি বাবু!!”
ওয়াসেনাত হতবম্ভ হয়ে বললো,
—-“ পরীজাটা কে??আর আমাকে আপনার বাবু মনে হচ্ছে কেনো??এই আপনি কি সত্যি পাগল হলেন না কি??”
—-“ তোমার নামটা অনেক বড় বাবু তাই কেটে কুটে ছোট করে ফেলেছি।ওয়াসেনাত বিনতে তৌফিক।বাপরে!!নামটা নিলেই তোমার জার্নালিষ্ট বাবার মুখ ভেসে উঠে।তাই ছোট করে ফেলেছি।ওয়াসেনাতের ওয়াসু!পরীর মতো দেখতে তাই পরী!আমার পাথরের হৃদয়ের ফুল আমার জান।সেই জানের জা!সব মিলিয়ে ওয়াসুপরীজা!!আর এত কষ্ট করে কাল রাতে যা বলেছি সেগুলো তোমার জন্য বাবু।”
ওয়াসেনাত বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ভাবছে কি বলবে সে??তার মাথা ঘুরছে।শরীর কাঁপছে।অজানা অনুভুতিতে কাঁপছে হৃৎপিণ্ড।ঝিম ধরা গলায় বললো,
—-“ কি সব বলছেন??কে আপনি??সারা রাত আপনার সেবা করেছি কেনো জানেন ??কে আপনি জানার জন্য!!বলুন তো কে আপনি??”
অরিত্রান হাসলো।গাল ভর্তি হাসি রেখে অরিত্রান বললো,
—-“ নো নো ভুল বললা,তুমি মোটেও এটা জানার জন্য আমার সেবা করনি।তুমি করেছে ভালোবাসার টানে।প্রেমে পড়েছো আমার পরীজা!!এটুকু তো তারই ফল।”
ওয়াসেনাত নাখচ করে বললো,
—-“ ম মোটেও না!!আমার মাথা কি খারাপ না কি ??আপনার মত পাগলের প্রেমে পরতে যাবো কেনো??কি সব বলছেন??”
—-“ হাসাচ্ছো কেনো??নিচে পরে যাবো তো!!”
—-“ মানে কি??”
—-“ এতো মানে জেনে কি হবে বলো তো!এর চাইতে আমি যা বলছি শুনো!!”
ওয়াসেনাত ক্ষীন স্বরে বললো,
—-“ বলনে !!”
—-“ মিষ্টার অরূপের কাছ থেকে দূরে থাকবে।এটা কিন্তু আমার ওয়ার্নিং।”
ওয়াসেনাত চোখ ছোট করে তাকায়।তীক্ত মেজাজে বলে,
—-“ আপনার কথা আমি কেনো শুনবো??কে আপনি??আগে নিজের পরিচয় দেন??তা না হলে শুনবো না।”
ওয়াসেনাত মুখ ঘরিয়ে তাকায়।কিছুক্ষন থেমে আবার বলে,
—-“ এই আপনার না গার্লফ্রেন্ড আছে??ওই মাদৌলি না টাক্কাদৌলি!!ওরে রেখে আবার আমার প্রেমে পড়তে চাচ্ছেন কেনো??মতলব কি??ব্রেকাপ হয়েছে বুঝি??জাপ্টাজাপ্টি করা শেষ??”
ওয়াসেনাত অভিমানে মুখ সরিয়ে নেয়।অরিত্রান নিশ্চুপ হয়ে ভাবে।এরপর হেসে উঠে বললো,
—-“ ওও তাহলে এই ব্যাপার??পরে এটা নিয়ে কথা বলবো।আগে চোখের উপরে পরে থাকা চুলগুলো কোমল হাতে সরিয়ে দেও তো!!”
অরিত্রান মাথা এগিয়ে নিয়ে আসে।ওয়াসেনাত বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললো,
—-“ মাথা জায়গায় আছে আপনার??আমি কেনো আপনার এটা করবো?পাগল না কি??”
অরিত্রানের নাছড়বান্দা গলা।বললো,
—-“ রাতে তো আমার অগোচরে কাজটা করেছিলে।এখন তো সয়ং নিজে বলছি।করে দেও তাড়াতাড়ি।হাত পিছলে যাচ্ছে।”
ওয়াসেনাত লজ্জায়,সংকোচে মাথা নতো করে।লাল হয়ে উঠে গালের দু’পাশ।অরিত্রান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।স্থির চোখে তাকিয়ে সে বললো,
—-“ মার্ডার হয়ে যাবো পরীজা।এতটা পাগল না করলেও পারতা।জীবনটা তো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই ছাই করছো তুমি নামক অসুখে।আমি তো মরেছি।এবার জীবিত পুড়ছি।”
ওয়াসেনাত আরো নুয়ে যায়।অরিত্রান চুল ঝাঁকিয়ে হেসে বললো,
—-“ লজ্জা পেলে তোমাকে মারাত্নক লাগে।তুমি না হয় আমার সামনে সব সময় লাজুকলতা হয়ে থেকো।এখন চুল সরিয়ে দেও।
ওয়াসেনাত হাত বাড়িয়ে চুল সরিয়ে দেয়।অরিত্রানের চোখ সরু।তীক্ষ্ন কন্ঠে সে বললো,
—-“ বিকেলে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করবো।তোমাকে দেখতে চাই।”
ওয়াসেনাত মেজাজ দেখিয়ে বললো,
—-“ আপনার সব কথা কেনো শুনবো???আমি কি আপনার কিনা সম্পত্তি না কি??যা বলবেন শুনতে হবে!!”
অরিত্রান এবার শব্দ করে হেসে উঠে।ঠোঁট কামড়ে সে হাসি থামিয়ে সে বললো,
—-“ মেয়েরা কখনো ছেলেদের সম্পত্তি হয় না পরীজা।হয় সম্পদ।সে হিসেবে তুমি আমার সম্পত্তি না ওয়াসুপরীজা!!তুমি আমার সম্পদ।মহা মূল্যবান সম্পদ।”
ওয়াসেনাত অপলক তাকিয়ে আছে।অরিত্রানের এক হাতে রক্ত জড়ছে।কালকের কাটা হাত।ওয়াসেনাত উত্তেজিত গলায় বললো,
—-“ আপনার চলে যাওয়া উঁচিত।নেমে যান!!”
অরিত্রান অবাক হওয়া গলায় বললো,
—-“ তুমি আমাকে জান বলেছো!!ও মাই গড!!!”
ওয়াসেনাত কপাল কুঁচকে বললো,
—-“ কখন বললাম??আমি তো আপনাকে যেতে বলেছি!”
—-“ আরে মনে করে দেখো মাত্র বলেছো জান!!”
—-“ মোটেও না।আমি বলেছি নেমে যান।”
—-“ এই তো আবার বললা।মেরে ফেলতে চাও না কি!!”
ওয়াসেনাত বিরক্ত হয়ে বললো,
—-“ এত ফালতু কথা না বলে কে আপনি বলেন???”
অরিত্রান নামতে নামতে বললো,
—-“ বিকেলে না হয় বলবো।বাই পরীজা!!”
ওয়াসেনাত হা করে ভাবে পাগল না কি এই লোক??অরিত্রান দ্রুত দেয়াল বেয়ে নেমে চেঁচিয়ে বললো,
—-“ তুমি করেছো!!”
ওয়াসেনাত হতবুদ্ধি হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
—-“ শেষে এই ভয়ংকর প্রানীর প্রেমে পড়লাম??কেনো??
#চলবে__