পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 16

১২টা ছুঁই ছুঁই করে ঘড়ির কাটা ছুটে চলেছে আপন গতিবেগে।যেনো ছুটে চলার তীব্র ইচ্ছে তার।আর এটাই তার কাজ।সময় থমকে যায় না।কিন্তু আবেগ, অনুভুতি,ভালোলাগা,মানুষকে থমকে দেয় কিছুসময়ের জন্য।রাত ১০টার দিকে আবার গুমোট ধরে বৃষ্টি নেমেছে।জলপ্রপাতের মত বৃষ্টি।সেই বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসেনাত।জানালাটা পূর্ণ খোলা।বাঁকা বাঁকা বৃষ্টির ফোঁটা গুলো তড়িৎ বেগে ছুটে আসছে তার গায়ে।তার কোনো নড়চড় নেই।হলে এসেছে অনেক আগে।কিন্তু গায়ের জামাটা চেঞ্জ করার প্রয়োজন মনে করছে না সে।রিমি বেশ অনেক সময় নিয়েই তাকে দেখছে।সেই রিক্সায় বসে ও তাদের মাঝে তেমন একটা কথা হয় নি।রিমি লজ্জায় আর নিজে থেকে কথা বলেনি।কিন্তু ওয়াসেনাত যে এত নিশ্চুপ হয়ে যাবে এটা সে বুঝতে পারেনি।ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার ঠেকছে তার।জামা বদলে নিজেদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে সে।খাবারের প্লেট বিছানায় রেখে বেশ অনেক্ষন থেকে তাকিয়ে আছে ওয়াসেনাতের দিকে।বৃষ্টিকে গায়ে মাখতে ওয়াসেনাত এতটাই ব্যস্ত যে আশেপাশের খবর রাখার মত সময় তার নেই।সে ব্যস্ত!খুবই ব্যস্ত হয়ে সে কিছু ঘন্টা আগের স্মৃতিচারণ করছে।যেভাবেই হোক যে পরিস্থিতিতেই হোক সে একজন পুরুষের গায়ের সাথে লেপ্টে ছিলো কিছু ঘন্টা পর্বে।আগে কখনো সে এভাবে কোনো পুরুষের সংস্পর্শে আসে নি।কোনো পুরুষ তাকে নিজের মাথে এভাবে জড়িয়ে নেয় নি।জীবনে তার এইটুকুনি বয়সে প্রায় রাস্তায় একা চলার পথে ভীরে অনেকেই হাত ধরেছে তার।অনেকেই সুযোগ নিয়ে গায়ে ঢোলে পরেছে।ইচ্ছাকৃত ভাবেই হাতের উপর হাত রেখেছিলো। তখন তো তার খুব রাগ হতো।শরীর জ্বালিয়ে ঘৃণ্য করতো।কিন্তু আজ!আজ একটা ভয়ংকর অনুভুতি হয়েছে যার রেশ এখনো তাকে জড়িয়ে আছে।একজনের হাতের বাহু ঢোড়ে সে খুব যত্নে জড়িয়ে ছিলো।কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ওয়াসেনাতের হৃৎপিন্ড দ্রুত গতিতে চলা শুরু করে।মনের কুঠিরিতে অসংখ্য আবেগ জমা হচ্ছে। বন্দি মনের দরজাটা কড়া নাড়ছে।খুলে যেতে চাইছে।মনের বন্দি পাখিটা এবার মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে চাচ্ছে।তখনের সেই আবদ্ধকৃত দৃশ্য মনে হতেই এক অদৃশ্য অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভুতিতে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।নিজের অজান্তে নিজের মন ওয়াসেনাত অন্য কারো নামে করে দিচ্ছে।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার মন আজ তারই অজান্তে বাহিরে বিচরণ করছে।খুব করে চেয়েও সে বেধে রাখতে পারছে না মন নামক অদ্ভুত অদৃশ্য জিনিসটাকে।প্রেম নামক পীড়ায় সে দগ্ধ হচ্ছে। বার বার কড়া নেড়ে তাকে জানান দিচ্ছে দরজাটা খুলে দেও ভালোবাসায় সিক্ত হও।রিমি ওয়াসেনাতর পিঠে হাত রাখতেই সে বিষণ রকমের চমকে তার দিকে তাকায়।রিমি হেসে বললো,
—” কুল কুল আমি!এত ভয় পাচ্ছিস কেনো??”

ওয়াসেনাত একবার নিজের দিকে তাকায়।জামার সামনের অংশ ভিজে গেছে।বাম হাত দিয়ে ওয়াসেনাত নিজের মুখে লেপ্টে থাকা পানিগুলো মুছে নিয়ে আবার একবার রিমির দিকে তাকালো।এতটাই চমকিত হয়েছে যে সে কিছু বলতেই ভুলেগেছে।রিমি বেশ অবাক গলায় বললো,
—” কি রে তোর কি হয়েছে?”
ওয়াসেনাত হকচকিয়ে ভাবে।কিসব প্রেম ভালোবাসা নিয়ে সে চিন্তা করছিলো!!আশ্চর্য! সে তো কখনো এগুলো নিয়ে ভাবে না।আজ কি এমন হলো??ওয়াসেনাত নিজেকে বেখেয়ালি ভাবে অনেক কিছু বুঝিয়ে চলেছে।এর মাঝেই রিমি আবার গলা উঁচিয়ে বললো,
—” সমস্যা কি তোর??বোবা হয়ে গেলি না কি??ওই নুহাশের মত!”
“নুহাশ” নামটা যেনো আবার একবার ওয়াসেনাতকে বেখেয়ালি ভাবে চিন্তায় পেলে দিলো।না চাইতেই তার মনটা বড্ড অবাধ্য হয়ে পরেছে আজ।ওয়াসেনাত কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে ছোট করে জবাবে বললো,
—” হুম বল??”
রিমির মুখ আপনা আপনি হা হয়েগেলো।কাকে এতক্ষণ সে বকবক করে বলেই চলেছে?? তার তো এদিকে কোনো খবরই নেই।রিমি আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াসেনাত বললো,
—” পরে কথা বলবো এখন চেঞ্জ করে আসি।চল হেল্প করবি।”
কথাটা বলেই ওয়াসেনাত জায়গা ছেড়ে চলেগেলো।যাওয়ার সময় আরো একবার পিছন ফিরে বৃষ্টির দিকে তাকায়।সব বৃষ্টি তো এক!বৃষ্টি বরাবরি তার ভালো লাগে।কিন্তু আজকের বৃষ্টি অন্যরকম। একদম মন কাড়া বৃষ্টি।ওয়াসেনাত বৃষ্টির দিকে তাকালেই তার মনে হয় এই বুঝি সেই সময়টা মনে পরলো।সেই ভিজা জামা,যাত্রীছাউনি,আর বলিষ্ঠ দু’খানি হাত।যাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলো সে।ওয়াসেনাত যেনো নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।আজ তার হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে তার বয়সটা আবেগে পড়ার বয়স??তার তো আঠারো হয়ে গেছে।বাবার উক্তি মতে তো আঠারো শেষে হতেই বিবেকবুদ্ধি সচল হয়।তাহলে আজ এমন অদ্ভুত অনুভুতি কেনো হচ্ছে?ওয়াসেনাত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জামা চেঞ্জ করে আশে রিমিকে সাথে নিয়ে।রিমির পাশে পা গুটিয়ে বসতেই রিমি আগ্রহের সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
—” আজ তোরে ভারী অদ্ভুত লাগছে দোস্ত??কাহিনী কি??”
ওয়াসেনাত হঠাৎ লজ্জায় সংকোচিত হয়ে মিইয়ে যায়।কিছুসময় চিন্তিত থেকে আনমনে বলে উঠে,
—” আঠারোর পরে কি কেউ প্রেমে পড়তে পারে দোস্ত??”
রিমি বিস্ফোরিত চোখে ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে,
—” তুইইইইইই কি প্রেমে পরলি দোস্ত??”
ওয়াসেনাতের হুঁশ আসে।দ্রুত বলে,
—” আরে পাগল না কি!আমি প্রেমে পরতে যাবো কেনো??”
কথা এড়িয়ে যেতে যায় ওয়াসেনাত।রিমি টপ করে ব্যাপারটা ধরতে পেরে বললো,
—” দোস্ত বলনা। আমি তোর জীবন মরণের সাথী আর প্রেমের সাথী বানাবি না!!এটা হয় না দোস্ত!”
ওয়াসেনাত মুখ ঘুরিয়ে বললো,

—” ফালতু কথা রাখ।খাইয়ে দে!”
রিমি বিছানা ছেড়ে উঠে এসে ওয়াসেনাতের সামনে বসে বললো,
—” বল না দোস্ত।কোন সৌভাগ্যবানের প্রেমে পড়েছিস! ভাই বল না! বল না!”
ওয়াসেনাত বেকুবের মত বসে আছে।কিছু বলছে না।রিমির এমন উদ্ভট কার্যকলাপে সে প্রচণ্ড ভাবে বিরক্ত। ভুল করে একটা কথা মুখ ফঁসকে বলে দিয়েছে এটা নিয়ে সে এখন মহান রচনায় নাম লেখিয়ে বকবক শুরু করবে।ওয়াসেনাত বিছানায় সটাং হয়ে শুয়ে পরে।তার এখন একদম কথা বলত ইচ্ছে করছে না।চুপটি করে ভাবনায় ডুবতে ইচ্ছে করছে।রিমিও ওয়াসেনাতের পাশে মাথা রেখে বালিশ ছাড়া শুয়ে পরে।উপরের সিলিং ফেনটা শাঁ শাঁ করে চলছে।দু’জনের চোখ সেদিকে স্থির।ওয়াসেনাত হঠাৎ হঠাৎ নিজে নিজে হাসে।রিমি তা লক্ষ করছে।এক সময় এক হাত মাথার পাশে দিয়ে তাতে ভর করে ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে রিমি বললো,
—” ওয়াসু!!!”
রিমির সুর তুলে ডাকায় ওয়াসেনাত ছোট করে বললো,
—” হুম।”
—” দোস্ত তুই কি মাহিরের প্রেমে পরেছিস??”
ধপ করে ওয়াসেনাত বিছানায় উঠে বসে পরে।বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকে রিমির দিকে।ওয়াসেনাত রিক্সায় আসার সময় অনেক হেসে রিমনের সাথে কথা বলেছে তাই তার এটা মনে হচ্ছে। রিমির মুখটা চুপসে আছে।সে খুবই দুশ্চিন্তা গ্রস্ত।ওয়াসেনাত রেগে ঝাঁঝালো গলায় বললো,
—” তুই কি পাগল??”
রিমি মাথা তুলে বললো,
—” কেনো??”
—” ওই গোঁফা মাহিরের প্রেমে পড়তে যাবো কোন দুঃখে শুনি??”
রিমির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে।হেসে হেসে সে বললো,
—” আমি তো ওই এমনেই মনে করেছি।”
—” ওই গোঁফারে দেখলেই ভাই ভাই টাইপের ফিলিংক্স আশে।ওর প্রেমে পড়তে যাবো কোন দুঃখে। একটা প্রশ্ন ভুলে ভালে বলে দিলাম আর তুই সেটার পিছনেই পরে আছিস।যা ভাগ।”
—” স্যরি।চল খাইয়ে দি??”
—” লাগবে না।”ওয়াসেনাত মুখ ঘুরিয়ে বসে।
—” তোর কি লাগবে আমি ভালো বুঝি। চল।”
ওয়াসেনাত উঠলো না।রিমি খাবার নিয়ে খাওয়াতে শুরু করে।বিছানার কোণ ঘেঁষে ওয়াসেনাত মাথা রাখতেই রিমি ফিসফিসিয়ে বললো,
—” তাহলে কে সে??বল না ভাই??”
—” রিমি ঘুমাবি!!”ওয়াসেনাতের উচ্চঁ গলা।
ওয়াসেনাতের ঘুম আসছে না।বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি করতে গিয়ে বহু বার হাতে ব্যাথা পেয়েছে সে।তবুও তার ঘুম ধরা দিচ্ছে না।মনে ঘুরছে প্রশ্ন,আবেগ,অনুভুতি।সব কিছু ঘিরে তাকে গুটিয়ে এক নতুন অনুভুতিরা ভালোবাসা নামক প্রজাপতির মত ডানা ঝাঁপিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।শুধু উত্তর দিলেই মনের কোটার ভেদ করে উড়ে আসবে……..

____________________
রিমন বিগত ঘন্টা খানেক ধরে একটা গান বিড়বিড় করছে আর পাইচারি করছে অরিত্রানের আশেপাশে। অরিত্রান সাদা সোফায় বসে টি-টেবিলের উপরে পা রেখে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ দেখছে।কাল বিকেল ৪টায় তার ফ্লাইট। লন্ডন শহর তার নতুন ঠিকানা।সেখানে থাকবে কিছু দিন।রিমনের এমন চিন্তিত ভঙি আর বিড়বিড় করা দেখে অরিত্রান মাথা উঠিয়ে একবার তাকায়।আবার কাগজপত্র দেখতে দেখতে বললো,
—” কি হয়েছে??”
রিমন যেনো এই কথাটার অপেক্ষায় ছিলো।লাফিয়ে অরিত্রানের পাশে এসে বললো,
—” না, ইয়ে, মানে, আসলে, ওই ওয়াসেনাত, মানে তোর সাথে কি করছিলো।সরি সরি তোরা এক সাথে কি করছিলি??”
রিমনের এমন চকচকে মুখ দেখে অরিত্রান একটা বিরক্তিকর চাহনি দিলো।তারপর বললো,
—” কি করেছি তা বলতে আমি বাধ্য নই।”
রিমন নিজের চুল পিছনে নিতে নিতে বললো,
—” জানতাম এমন একটা আনসার দিবি।তবুও ভদ্রতার খাতিলে প্রশ্নটা করেছি।এবার আসল কথায় আসি।রিক্সায় বসে ওয়াসেনাত পিছনে চেঁচিয়ে “লাল নয় সাদা গোলাপ” কেনো বলেছে??ওটা কি তুই জিজ্ঞেস করেছিস??”
রিমন ভ্রু নাচাচ্ছে ক্রমাগত। আর মুখে একটা হাসি।অরিত্রান পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঘটঘট করে সব পানি খেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
—” কাল চলে যাবো আজ তোর সাথে ফালতু কথা বলে মেজাজ খারাপ করতে চাই না।যা এখান থেকে।ঘুমা।”
রিমন অরিত্রানের বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে বললো,
—” আজ তোর সাথে ঘুমাবো!!”
অরিত্রান চকিতেই তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,
—” হোয়াট!!”

রিমন জবাব দিলো না বুকের মাঝে হাতুরি পিটা হচ্ছে। ভয়ে সে জড়ো হয়ে আছে তবুও কত কত সাহস কাজে লাগিয়ে অরিত্রানের কয়েক ঘন্টার খবর বের করতে চাচ্ছে। কিন্তু অরিত্রান এত সহজে বলবে না।তাই টেকনিক কাজে লাগাচ্ছে।অরিত্রান গুমোট মুখ করে রিমনের সামনে এসে দু’হাত বুকে ভাজ করে বললো,
—” তুই ফালতু বকা বাদে কিছু যদি পারতি এত দিনে নিজের একটা উন্নতি করতে পারতি।এবার গেট লস্ট।”
রিমন বুঝলো অরিত্রান রেগে আছে।তাই বললো,
—” দাদাজান আসবে কাল সকালে।”
—” ভালো।আমার রুম থেকে বাহিরে যা।”
—” আচ্ছা তুই একা ঘুমাস কেনো??”
অরিত্রান বললো,
—” আবার ফালতু কথা!!”
—” আরে বল না।কাল তো চলেই যাবি একটু ঘুমাই??”
—” দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিস তুই।”
—” পাগলের কথা থেকে একটা কথা মনে এসেছে দোস্ত তুই কত কিউট করে পাগলী বলেছিস আমি তো ফিদা।”
অরিত্রান কিছুক্ষণ থেমে লাল চোখে তাকালো রিমনের দিকে।ঘুমানো ভুলে রিমন সাবধানে নিজের জীবন বাঁচিয়ে দেয় এক দৌড়।রিমিকে কল করে জিজ্ঞেস করবে কি কি করেছে এরা দু’জন। কাল অরিত্রান চলেগেলে না হয় ওয়াসেনাতকেই জিজ্ঞেস করবে।না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।
রাত গভীর খুব।ঘুমে দেশবাসী মরোমরো অবস্থা। কিন্তু এই সবার মাঝে থেকে ও অরিত্রানের চোখে ঘুম নেই।হোটেলের নিচের বাগানে সে হাটাঁঁহাটি করছে।তার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন গার্ডস।বাগানে অনেক গাছপালা।শান্ত নির্জন রাত।ঠান্ডা একটা মৃদুল হওয়া বইছে।বাতাসে যেনো মিষ্টি একটা গন্ধ। অরিত্রানের কাছে সে গন্ধের চাইতেও তীব্র তার গায়ের গেঞ্জির গন্ধটা।অরিত্রান সন্ধ্যার সেই টিশার্ট গায়ে এখনো ঘুরছে।এই শহর এই দেশ তার পছন্দ না।এই দেশের চাইতে তার কাছে কম মানুষ,কম ঝঞ্ঝাল, শান্ত বিদেশই ভালো লাগে।লাগে বললে ভুল হবে।লাগতো।এত বছরের জীবনে এই প্রথম এই দেশটার প্রতি তার অদ্ভুত একটা অনুভুতি কাজ করছে।মনে হচ্ছে এই দেশ ছেড়ে তার না যাওয়াই ভালো।আগে কখনো দেশের মাটিতে সেভাবে ঘুড়া হয় নি।কিন্তু এবার তো মাটির সাথে বৃষ্টির একটা গন্ধ গায়ে মেখে আছে।ভালো লাগছে না তার যেতে।শুধুই কি দেশের প্রতি তার মায়া জমেছে?? কথাটা মনের মাঝে বার বার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।কিন্তু অরিত্রান পাত্তাই দিলো না এমন একটা ভাব নিয়ে পাইচারি করছে।সময় নিজ গতিতে ছুটে চলেছে।অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলো এসে পড়ছে অরিত্রানের ঠিক মাথার কাছে।বেঞ্চিতে বসে পরে অরিত্রান শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।চারদিকে নীরবতার গুমোট একটা ব্যাপার খেলা করছে।সেই নীরবতায় আবার যোগ হয়েছে অরিত্রানের নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতাকে ঠেলে বিচলিত হচ্ছে অরিত্রানের মন।পিড়াপীড়ি করে বুঝাতে চাচ্ছে কিছু একটা।অরিত্রানের মনটা আজ ভিষন ভাবে দগ্ধ। মনে বার বার একটা বিষন্নতা কাজ করছে।থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে ওয়াসেনাতের মুখ।হাস্যোউজ্জ্বল সেই মুখ,অদ্ভুত রঙে আবৃত দু’টো চোখ,লাল লাল গাল আর সেই মায়াকাড়া মুখ।অরিত্রান চিন্তায় ডুবে এসবই ভাবছে।মনের কানায় কানায় যেনো মেয়েটার মায়া ভরে উঠেছে।মনে হচ্ছে তার চিন্তায় ডুবেই পার করতে পাড়বে বহু সময়।আচ্ছা এই দেশটা ছেড়ে গেলে কি ওয়াসেনাতকে পাওয়া যাবে??অরিত্রান চমকে উঠে নিজের চোখ আকাশ থেকে ফিরিয়ে নিলো।একটা মেয়েকে নিয়ে এতটা ডেস্পারেট কি করে হতে পারে সে?তার সব চিন্তা ঠেলে বার বার ওয়াসেনাত চলে আসছে।কেনো?অরিত্রান উঠে দাঁড়ালো। আরো কিছুক্ষণ হাঁটলো। হঠাৎ তার নিজের কথা মনে পরে সে নিজেই হেসে উঠে।”আমার বউ,নিজের বউ!!”
অরিত্রান নিজে নিজেই বলে,

—” বিয়ে না করেও অরিত্রান খানে বউ আছে।অদ্ভুত!!”
অরিত্রান কয়েক দফা নিজের সাথে একা নীরবে কাটিয়ে উপরে চলে আশে।জামাকাপড় গুছিয়ে সে বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলো।কাল আর কোথাও যাবে না। ভার্সিটির ইতি হয়েছে।নকল নুহাশ বাদ পড়েছে।ওয়াসেনাত নামটাও ব…।অরিত্রান বাদ দিতে পারলো না।মাথা থেকে সব ছুঁড়ে দিতে চাচ্ছে তাও পারছে না।অনেকটুকু জায়গা জুড়েই ওয়াসেনাত নিয়ে নিয়েছে।
________________________
রিমন অরিত্রানের রুমে উঁকিঝুঁকি দিতেই ধারাম করে নিচে পরে যায়।বেসামাল ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো তাই সে পরে গেছে।অরিত্রান ভ্রু-জোড়া কুচঁকে তাকিয়ে আছে।রিমনের কার্যকলাপ গুলো তার মোটেও পছন্দ না।অরিত্রান রিমনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
—” এমন ভাবে উঁকি দিচ্ছিস মনে হচ্ছে আমি মেয়ে নিয়ে রুমে বসে আছি।মেয়েও না আমার বউ নিয়ে। তা এত কেনো আগ্রহ শুনি??”
রিমন হাত ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
—” এমনেই একটু আগ্রহ দেখালাম।তুই তো আস্ত একটা আগ্রহ জাতীয় জিনিস।তাই না??”
—” আবার!! ”
—” তুই না কি রিহানকে ছেড়ে দিলি??না মেরে?কেনো?যাকে মারার জন্য এত দূর আসা।নকল মানুষ সেজে ভার্সিটিতে যাওয়া।আরো কত কি করলি।কাগজপত্র পাওয়া হয়েছে যানি। তবুও তো অরিত্রান খান মানুষ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র হয়।তা হলে কেনো দিলি?মাফ করতে তো অরিত্রান খান শিখেনি।এটা কি ছিলো?”
—” অরিত্রান খান আজও মাফ করতে পারে না।”

—” তা হলে এটা কি??কেনো ছেড়ে দিলি??
রিমনের সিরিয়াস ভঙ্গির প্রশ্ন শুনে অরিত্রান নিজের ব্যাগপত্র গার্ডসদের হাতে তুলে নিতে বলে হাঁটা শুরু করে।ফর্মাল ড্রেসে আজ আর নুহাশ না অরিত্রান খান বলেই তাকে মনে হচ্ছে। রিমন অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে অরিত্রানের যাওয়ার দিকে।অরিত্রানের এই হঠাৎ চুপ করে যাওয়া অভ্যাসটা নিতে পারে না রিমন।এমন কেনো ছেলেটা??সব সময় বলে সিরিয়াস হ, সিরিয়াস হ।কিন্তু যখনই সিরিয়াস হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে তখনই এমন গুমোট মেরে যাওয়া যেন অরিত্রানের জীবনের প্রধান এবং একমাত্র কাজ।সবসময় এমন না করলেও তো পারে অরিত্রান? কিন্তু এটা ওর জাতি গত সমস্যা বলেই তার মনে হয়।হুট হাট চুপ??বিরক্তি কর।কথাটা বলেই রিমন গম্ভীর মুখে অরিত্রানের পিছনে পিছনে হাটা শুরু করে।
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে।অরিত্রান ফোনে চোখ রেখে থাকলেও মাঝে মাঝে আড়চোখে জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে।রিমন মাথা উঁচিয়ে কিছুক্ষণ পর পর অরিত্রানের ফোনের স্ক্রিনে চোখ দিচ্ছে। তার ধারনা কালকে নিশ্চুয়ই এমন কিছু একটা হয়েছে যা সে জানে না।আর তার জানা খুবই প্রয়োজন। একটা ফুলের দোকান ক্রস করতেই অরিত্রান বললো,
—” গাড়ি পিছনে নেও।”
রিমন এত সময়ে প্রচণ্ড বিরক্ত। সে জানে তার বিরক্ত হওয়া আর না হওয়া একুই ব্যাপার।আর যাই হক তার দিকে তো আর অরিত্রান একটুও নজর দিবে না।তাই সে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। অরিত্রান গাড়ি থেকে নেমে একটা সাদা গোলাপ কিনে নিলো।কেনো নিলো তার জানা নেই।হঠাৎ গোলাপ গুলো দেখে তার কেমন যেনো একটা অনুভুতি হয়েছে।যার কারনে অনুভুতি আর চেপে রাখতে না পেরে সে কিনে নিলো একটা গোলাপ।

__________________
অরিত্রান গাড়ি থেকে নামতেই বুকের ভিতরে কেমন একটা হু হু করে উঠলো।মনে হচ্ছে খুব যত্নের প্রয়োজনীয় কিছু রেখে যাচ্ছে। যা তার খুবই প্রয়োজন। নিজের সানগ্লাস খুলে অরিত্রান আর একবার প্রান খুলে নিঃশ্বাস নেয়।এই দেশ ছাড়তে হচ্ছে মনের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যেয়ে।অরিত্রান ডান পাশ থেকে বাম পাশে ফিরতেই একটা বড় ঝাটকা খাওয়ার মত চমকে উঠলো।এটার জন্য মোটেও সে প্রস্তুত ছিলো না।এয়ারপোর্টের সামনে ওয়াসেনাত একটা ছেলের কাঁধে বাম হাত রেখে প্রান খুলে হাসছে।হাসিটা বড্ড অমায়িক।মনোমুগ্ধকর।অরিত্রানের জানা মতে ওয়াসেনাতের ভাই নেই।তবে এই ছেলে কে??ছেলেটা কে এটা ভাবার চেয়ে ওয়াসেনাতের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে অরিত্রান। হলুদ জামার লম্বা সিল্কের হাতাটা জড়িয়ে রাখা হাত ছেলেটার কাঁধে শান্ত ভঙ্গিতে লেপ্টে আছে।ছেলেটাও মনোমুগ্ধকর হাসি হাসছে।যেন কত আপন তারা।কত কাছের।কাছের কথাটা ভাবতেই অরিত্রান নিজের চাহনি আরো গভীর করে তাকায়।তার চোখের দুই কার্নিশে লাল লাল রক্তের ঝাঁপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে।কিছুক্ষণ আগের সব চিন্তা ফেলে তার রাগে হঠাৎ শরীর জ্বালা করে উঠছে।এই দৃশ্য যেন খুবই ভয়ংকর। যা দেখা মাত্র শরীরের রক্ত টগবগিয়ে উঠছে তার।জ্বলন্ত চক্ষু মেলে তালিয়ে আছে অরিত্রান। আর ভাবছে হঠাৎ এত হাসি উপচে পড়ার কারন কি??
.
.
#চলবে____