পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 17
-” ভাইয়া এবার আমার গিফট গুলা দে??”
অরূপ অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
—” জীবনে শুনেছিস এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে ফকিরের মত গিফট খুঁজতে??ওয়াসু তুমি শুনেছ??”
অরূপ ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে বলতেই ওয়াসেনাত আবার একদফা হেসে অরূপের কাঁধে হাত রাখে।হাসি আটকে বললো,
—” ফকিন্নি একটা বুঝলেন!!”
রিমি দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
—” ফাইজলামু হচ্ছে?? ভাইয়া এটা কিন্তু মোটেও ভালো হচ্ছে না।এত দিন পরে দেশে এসেও তুই আমার সাথে টিটকারি মারছ?”
অরূপ ইনোসেন্ট একটা ভাব মুখে টেনে বললো,
—” তুই কি আমার বন্ধু লাগিস যে টিটকারি করবো??”
—” ভাইয়া আবার!! ”
অরূপ হেসে বললো,
—” আচ্ছা আচ্ছা গিফট বাসায় গিয়ে পাবি।আগে গাড়িতে উঠতে দে আমাকে।আর আব্বু আম্মুকে কিছু বলেছিস??”
ওয়াসেনাত রিমি দু’জনেই চেঁচিয়ে বললো,
—” নাআআআআআআআ।”
অরূপ রিমির ভাই।এত দিন লেখাপড়া এবং কাজের জন্য অস্ট্রেলীয়ায় ছিলো।আজ দেশে এসেছে।রিমির সাথে ওয়াসেনাতের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকে।সেই সূত্রে তার পরিবারের সাথে ও তার সম্পর্ক গভীর।অরূপ আজ আসবে এটা তার বাবা মাকে জানানো হয় নি।সারপ্রাইজ দিবে তাই।রিমি আর ওয়াসেনাত জানতো।তাই গাড়ি নিয়ে অরূপকে নিতে এসেছে।
অরিত্রানকে সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিমিন পিছিয়ে এসে বললো,
—” কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো??তোর জিনিস নিয়ে যাওয়া হয়েছে।চল??”
অরিত্রান জবাব দিলো না।গাড়িটা চোখের সামনে মিলিয়ে গেলো।তারপরেও অরিত্রান চোখ সরিয়ে নিলো না।তার মনে কি চলছে রিমন বুঝতে না পেরে আবার ধাক্কা দিয়ে বললো,
—” কিরে যাবি না??”
অরিত্রান গম্ভীর মুখে বললো,
—” না যাবো না।”
কথাটা বলে অরিত্রান আর দাঁড়ালো না।আবার গাড়িতে উঠে বসলো।রিমন কিছুই বুঝলো না।মাথা তার ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আছে।অরিত্রান গলা হাকিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো,
—” ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করো।”
ড্রাইভার চমকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়।গাড়ির শব্দে রিমনের হুঁশ আসে।সে দ্রুত লাফিয়ে গাড়ির দরজা খু্লে উঠে বসে।অরিত্রান অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে ছেলেটা কে??কি সম্পর্ক তার সাথে ওয়াসেনাতের??ওয়াসেনাতের কি বয়ফ্রেন্ড আছে??তাহলে সে কি কাউকে ভালোবাসে??কথাটা ভাবতেই দমবন্ধ হওয়া একটা অনুভুতি হয় অরিত্রানের।টেনে নিজের গায়ের ব্লেজার খুলে ফেলে।শার্টের উপরের কিছু বুতাম খুলে ফেলে।হাঁসফাঁস করে।কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছে। এই দেশে থাকতে ইচ্ছে করার প্রয়োজনটা তাহলে কি ওয়াসেনাত??
________________
অরূপের সাথে তাদের বাসায় এসেছে ওয়াসেনাত আর রিমি।আজ অনেক বছর পরে ভাইকে কাছে পেয়ে রিমির খুশি দেখার মত।বাড়িতে একটা খুশির আমেজ পরেছে।অরূপ তার পরিবারের সাথে খুশি বিনিময় করছে আর তাদের জন্য নিয়ে আসা জিনিসগুলো দেখাচ্ছে।ওয়াসেনাত সোফার একটা কোনে বসে আছে।মনটা অস্থির,অবাধ্য হয়ে আছে গতকাল থেকে।মনাটা তার কথা শুনছে না। অদ্ভুত সব ইচ্ছে জাগছে মনে।ভিষন ভাবে টানছে তাকে কালকের সেই সময়টা।লোকটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।এত ইচ্ছে তার আগে কখনো করে নি।সে প্রেমে সিক্ত হয়েছে।কথাটা যেনো বার বার তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে অবাধ্য মন।অরূপ ওয়াসেনাতের জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে।ওয়াসেনাত হিজাব পছন্দ করে তাই অস্ট্রেলিয়ার মত দেশ থেকেও তার জন্য হিজাব নিয়ে এসেছে।অরূপ নিজের রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখছে ওয়াসেনাত আগের মত অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।অরূপের দৃষ্টি স্থির।মেয়েটার প্রেমে সে হেরেছে বহু আগে।সেই প্রথম দেখায় প্রেমে পড়েছিলো।তখন তো ওয়াসেনাত খুব ছোট।কতই আর বয়স হবে ১৩–১৪ হবে।যখন ছেড়ে গিয়েছিলো তখনও ছোট ছিলো।কিন্তু আজ বহু বছর পরে দেখে তার মনে হচ্ছে মেয়েটা আর ছোট নেই।চোখে মুখে এখন লাজুকলতা আছে।যেনো সদ্য ফোঁটা ফুল লাজুক হেসে নেতিয়ে পড়ছে।তবে বদলায়নি কিছু শুধু যোগ হয়েছে অদ্ভুত কিছু ভালো লাগা।সেই চোখে আজও সে হেরে যায়।নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে।ভয়ংকর ভাবে হাটু কাঁপে এর সামনে আসলে।অরূপ ওয়াসেনাতের পাশে এসে বসে।তার দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে।খুবই চিন্তায় মগ্ন ওয়াসেনাত।এত চিন্তা কিসের??সে কি অরূপের কথাই ভাবছে??অরূপের মুখে খুশির জ্বল নামে।মৃদু স্বরে আদুরী গলায় ডাকে,
—” ওয়াসু!!”
ওয়াসেনাতের তেমন হেলদুল হলো না।সে আগের মত বসে আছে।অরূপ আবার হালকা গলায় ডাক দিলো,
—” ওয়াসু!!”
ওয়াসেনাত এবারো শুনলো না।অরূপ এবার উচ্চ শব্দে ডাক দিলো,
—” ওয়াসেনাত!!”
সাথেই চমকে উঠে পাশে তাকালো ওয়াসেনাত।অরূপকে নিজের এত কাছে বসে থাকতে দেখে চট করে সোফার কোণায় চলে গেলো।অরূপ শরীর দুলিয়ে হেসে বললো,
—” ভয় পেলে না কি!!”
ওয়াসেনাত লাজুক একটা হাসি দিয়ে বললো,
—” আরে না ভাইয়া।কখন এসে বসেছেন??আমি তো টেরই পেলাম না।”
অরূপ গভীর চাহনি দিয়ে তাকিয়ে বললো,
—” পাবে কিভাবে তুমি তো নিজের ভাবনায় হারিয়ে ছিলে।তা এত চিন্তা কার নামে বরাদ্দ করেছ শুনি??আর হ্যা এমন বাজে একটা শব্দ “ভাইয়া” বলে একদম ডাকবে না।”
ওয়াসেনাত প্রথমে হালকা হাসলো।পরে বললো,
—” তা হলে আপনাকে কি বলে ডাকবো ভাইয়া??”
—” আবার ভাইয়া!!বাজে লাগে শুনতে।”
—” বারে রিমির ভাই মানেই তো আমার ভাই।”
—” মোটেও না।রিমির ভাই মানে কি আমি জাতির ভাই ??”
—” জাতির না কিন্তু আমাদের মত মেয়েদের ভাই তো।”
অরূপ খুদ্দ গলায় বললো,
—” তাহলে তো আমার বউ ও আমাকে ভাই ডাকবে। এটাই বলতে চাচ্ছ তুমি??”
ওয়াসেনাত নিজের দু’গালে দুই হাত দিয়ে বললো,
—” তওবা তওবা কি বলেন ভাইয়া আপনার বউ আপনাকে বরং জান, কলিজা, বাবু, বেবি, আরো কত কি আছে না ওই সব নামে ডাকবে।”
অরূপ মাথার ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে হাসে।তারপর মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,
—” তো ডাকো না ওই সব নামে।”
ওয়াসেনাত না শুনতে পেয়ে বললো,
—” কিছু বললেন ভাইয়া।”
অরূপ বিরক্ত গলায় বললো,
—” প্রতি কথায় একবার ভাইয়া ডাকা কি খুব প্রয়োজন??”
ওয়াসেনাত হেসে দিলো।অরূপ মুগ্ধ নয়নে সে হাসি দেখছে।প্রথম দেখা হয়েছিলো ভরা বর্ষায়।রিমিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময়।তখনই তরতর করে বৃষ্টি পরছিলো।সেই দিন হেসে হেসে বৃষ্টিতে ভিজছিলো ওয়াসেনাত।আজও মনে পড়লে সারা শরীর শিরশির করে কাঁপে তার।সেই হাসির প্রেমে পড়ে আজও নিজেকে সামলে উঠে একবারো বলতে পারলো না “ভালোবাসি”মনে মনে গভীর ভয় পায় সে।তবে সে জানে ওয়াসেনাত তারই হবে।শুধু অপেক্ষা।সেই সময়ের।অরূপের মা এগিয়ে এসে ওয়াসেনাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—” আম্মু তুমি আজ না গেলে হয় না??মানে আজ তো হলে যাবে না।রিমি তো কিছু দিন এখানেই থাকবে।এত দিন পরে অরূপ এসেছে। তুমিও থাকো।”
ওয়াসেনাত দ্রুত বললো,
—” না আন্টি।আজ বাবাও আসবে।যেতে হবে।থাকা যাবে না।”
ওয়াসেনাতের বাবা আসবে কথাটা শুনেই অরূপের মুগ্ধ হওয়া চোখ মিলিয়ে গেলো।সে ভেবেছে আজ ওয়াসেনাত এই বাড়িতে থাকবে।ছাদে বসে একটু আড্ডা দিবে।না না কথার ছলে ওয়াসেনাতকে দেখবে।তৃষ্ণাটা বহু দিনের।তার তো শুধু দেখতেই হচ্ছে করে।অরূপ করুন চোখে মায়ের দিকে তাকালো।মা যেন চট করে ছেলের মনের কথা ধরে ফেলে বললো,
—” না আজ তোমাকে যেতে দিবো না।আজ এখানেই থাকবে।তোমার মায়ের মত আমি আর আমার কথা রাখবে না??”
ওয়াসেনাতের দুর্বল জায়গায় আঘাত পড়েছে।তবুও সে অনড়ভাবে বললো,
—” বাবা না আসলে আমি সত্যি থাকতাম আন্টি।আজ অনেক দিন পরে বাবা আসছে।আমাকে না দেখলে তার মন খারাপ হবে।”
অরূপের মা একবার অসহায় চোখে তাকাতেই ওয়াসেনাত করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।মেয়েটা বড্ড মায়াবী।একদম আদর আদর লাগে।এমন দৃষ্টি উপেক্ষা করা যায় না।অরূপের মা মুচকি হাসলেন।মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—” আচ্ছা তবে খেয়ে যেতে হবে।”
ওয়াসেনাত প্রান খুলে একটা হাসি দিয়ে বললো,
—” তা তো অবশ্যই আন্টি। আমি তো নিজের হাতে খেতেই পারি না।হাতের প্লাস্টার..! ”
হাত উঁচিয়ে নিরীহ ভঙ্গিতে দেখালো ওয়াসেনাত।অরূপ ওয়াসেনাতের হাতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—” হাত কিভাবে ভেঙ্গেছে বললে না যে??”
ওয়াসেনাত থতমত খেয়ে চুপসে যায়।রিমি এগিয়ে এসে বললো,
—” আর বলিস না ভাইয়া একটা বাজে ছেলে পড়ে ভার্সিটিতে।সে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে দিয়েছে।”
অরূপ মুহূর্তে রেগে বললো,
—” প্রতিবাদ করলে না তুমি??আর বিচার দেওয়া উচিঁত ছিলো তোমার।দিয়েছ??”
ওয়াসেনাত হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো,
—” তার প্রয়োজন ছিলো না ভাইয়া।সে ক্ষমা চেয়েছে।”
—” ক্ষমা চালেও এরা বখাটে ছেলে এদের ছেড়ে দেওয়া উচিঁত না।”
ওয়াসেনাত হেসে বললো,
—” আরে না উনি তেমন ছেলে না।আর ক্ষমা মহান গুন।যে করতে পারে না সে প্রকৃত ভালো মানুষের কাতারে পরে না।”
অরূপ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
—” বেশি ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছে তোমার মনে হয়!!তবে এত ভালো মানুষী ভালো নয়।”
______________________
অরিত্রান হোটেলে আসলো না।নুহাশের রূপে ভার্সিটির হলে এসে ওয়াসেনাতকে খুঁজেছে।তারা বলেছে ওয়াসেনাত আর রিমি হল থেকে ছুটি নিয়েছে।কথাটা যেন অরিত্রানের বুকে তীরের মত বিঁধছে।লণ্ডভণ্ড লাগছে সব।এতটা বিচলিত সে নিজেকে কখনো হতে দেখেনি।অরিত্রানের আজ নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। বুকের মাঝে একটা হারানোর ভয় গট করে চেপে বসেছে ।কেনো হচ্ছে তার এমন??সে তো তার হৃদয়কে ভয়, ভীতি,আবেগ অনুভুতি, দয়ামায়া থেকে সরিয়ে নিয়েছে বহু আগে।তৈরি করেছে পাথরের হৃদয়। তার পিছনে তারই গার্ডসরা এটাই বলে বেড়ায়।শুধু গার্ডস না অনেক মানুষই বলে সে দয়ামায়াহীন পাথরের তৈরি হৃৎপিন্ডের অধিকারী।শেষ বার তার মায়া হয়েছিলো মার্কে খুন করার সময়।এই মার্ক তার উচ্চস্তরের প্রথম ধাপের প্রথম সিঁড়ি ছিলো।যাতে সে উঠেই এগিয়ে এসেছে এত দূর।তার রক্তাক্ত শরীর দেখেই তার বুকে শেষবার মায়া হয়েছিলো।বেচারা বাঁচার জন্য আকুতি মিনতি করেছিলো।কিন্তু সে ছাড়ে নি।কেটে টুকরো টুকরো করেছে তার গায়ের প্রতিটি খাঁজ।হাত, পা,মাথা সব আলাদা করেছিলো।এতে তারও দোষ ছিলো না।বেঁচে থাকতে হলে মার্ককে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া তার কাছে উপায় ছিলো না।সে মার্ককে না মারলে মার্ক তাকে মেরে দিতো।তখন হয় তো সেও দয়া করতো না।তবে এই মার্কই তাকে ক্ষুধায় মরা থেকে বাঁচিয়েছে।আর ভয়! সেটা প্রথম বার হয়েছিলো মায়ের গলা কাটা দেহ দেখে।বার বার মনে হয়েছিলো মা যাতে বেঁচে যায় কিন্তু বাঁচলো না।তার সামনেই বড় বড় সবুজ চোখ মেলে দম ছেড়েছিলো।আর শেষ বার হয়েছিলো ইহানকে বন্ধু ভেবে নিজের সব সম্পদ তার হাতে তুলে দেওয়ার সময়।যত বারই তার ভয় হয়েছে ততবারই সে হেরেছে।যার কারনে ভয়টা তার তীব্র হচ্ছে।
অরিত্রান মাঝ রাস্তায় গাড়ি দ্বার করিয়ে বসে আছে।ভয়ে তার বুকের একটা পাশ ধিকি ধিকি শব্দ করছে।সে! অরিত্রান খান!এসব ভয় মায়া দয়া তো সেই অনেক বছর আগেই ছেড়ে এসেছে।তবে আজ কেনো আবার নতুন করে ভয় জাগছে মনে।তাহলে কি আবার কিছু হারিয়ে ফেলবে??কথাটা যেনো অরিত্রানকে ভিতর থেকে কুঁকড়ে তুলছে।মেয়েটার সাথে তার দেখা খুবই কাকতালীয়। একবার না বহুবার দেখা হয়েছে।সবই কাকতালীয়। কিন্তু আজ সে নিজে দেখা করতে চাচ্ছে তা আর পারছে না।কাকতালীয় দেখা হলেও সে যখন চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে ওয়াসেনাতকে লুকিয়ে দেখত তা তো কাকতালীয় না।আড়চোখে সবার অগোচরে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকা সেটাও কাকতালীয় না।তার ছোঁয়া ভেতর থেকে কেঁপে উঠাটাও কাকতালীয় না।হৃৎপিন্ডের এই শব্দও কাকতালীয় না।এত অনুভুতি,আবেগ কোথা থেকে আসছে সেটাই অরিত্রানের মাথায় আসছে না।তার এত অনুভুতির নাম কি??অরিত্রান নিজের ব্লেজার পিছন থেকে নিয়ে তার ভেতর থেকে সাদা গোলাপ হাতে নেয়।ফুলটা কেনো কিনেছিলো??অরিত্রান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হঠাৎ ওই দৃশ্য দেখার পরেই মাথাটা গেলো তার।সব এলোমেলো হয়েগেছে।কে সেই ছেলে??কেনো এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলো??কেনো আবার এত হাসি??সব যেন তাকে এলোমেলো করে দিলো।পাগলের মত কিসব করে বেড়াচ্ছিলো।হঠাৎ নিজেকে পাগল পাগল লাগছিলো।মেয়েটা যে তার এত কাছের তা হঠাৎ করেই তার মনে হচ্ছে। খুব প্রয়োজনীয় মানুষ সে!!অরিত্রানের শান্ত মন আবার অশান্ত হয়ে উঠে মুহূর্তে।তার জানা প্রয়োজন ছেলেটা কি সত্যি ওয়াসেনাতের খুব কাছের কেউ??অরিত্রানের বুকে জ্বালা করছে।মনে মনে সে খুবই অবাক।সে! অরিত্রান! অরিত্রান খান!জেলাস হচ্ছে??
_______________________
রিমির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাত।অশান্ত মন নিয়ে বড্ড বিরক্ত সে। যাকে নিয়ে এত ভাবনা এত চিন্তা সে কি তার কথা ভাবে??মোটেও না।ছেলে তো ছেলে না যেন আগুন।সব সময় কেমন রেগে রেগে থাকে।শীতল মুখেও ভয়ংকর রাগ তার।এত ঠান্ডা ভাবেও কেউ রেগে থাকতে পারে এটা ওয়াসেনাতের জানা ছিলো না।গুমোট মেঘের মত মুখ,লম্বা লম্বা অঙ্গুল দিয়ে সিল্কি চুলগুলো শাঁ করে উড়িয়ে দেওয়ার সেই ভয়ংকর ভঙি।মারাত্মক চাহনি।ওয়াসেনাত অবাক হয়ে নিজে নিজে বলে উঠে,
—” ছিঃ একটা ছেলেকে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মোটেও উচিঁত না ওয়াসু।পাপ হবে পাপ।”
কথাগুলো বলে আবার নিজে নিজে হেসে উঠে ওয়াসেনাত। আবার হঠাৎ করেই মুখটা কালো হয়ে যায়।যাকে নিয়ে এত জল্পনাকল্পনা তার কি আদো ওয়াসেনাতের কথা মনে পড়ে।কালকের সেই “তুমি কে” কথাটা মনে পড়তেই ওয়াসেনাতের ছোট মনে অসংখ্য মেঘ বাসা বাঁধে।সে কি জানে কতটা কষ্ট পেয়েছে ওই কথাটায় ওয়াসেনাত?মনটা কাঁচের মত ঝনঝন করে ভেগে টুকরো হয়েছিলো তখন।ওয়াসেনাত অভিমানী চোখে বাহিরে চোখ রাখে।অরূপ অনেক্ষন থেকে ওয়াসেনাতকে পর্যবেক্ষণ করছে।মেয়েটা এত কি ভাবে?অরূপ গলা ঝেঁরে বললো,
—” বাসায় যাবে, না কি আজ থাকবে??”
ওয়াসেনাত আবার একবার চমকে তাকায়।অরূপের তীক্ষ্ণ নজর।ওয়াসেনাত আমতা আমতা করে বললো,
—” এখনই যাবো ভাইয়া।”
অরূপ বিরক্ত। খুবই বিরক্ত সে।মেয়েটা কথায় কথায় ভাইয়া বলে।আশ্চর্য তার বউ হয়ে যখন আসবে তখনও কি ভাইয়া ভাইয়া ডাকবে!!ছিঃ কথাটা ভেবেই অরূপ নাক মুখ কুঁচকে নিয়ে ওয়াসেনাতকে বললো,
—” ভাইয়া ডাকবে না বলে দিলাম!!”
ওয়াসেনাত দুষ্টুমি করে হেসে বললো,
—” কেনো ভাইয়া??”
অরূপের মাথায় হাত।রাগে দু’হাতে চুল টেনে বললো,
—” ডাকো ভাইয়া।বেশি বেশি করে ডাকো।এই ডাকের ইতি একদিন করেই ছাড়বো।এখন বলো এত কি চিন্তা করো সারা দিন??”
ওয়াসেনাত থমথমে হয়ে বললো,
—” কই কিছু না তো!!”
—” কিছু তো একটা আছে।সামথিং সামথিং!!”
ওয়াসেনাত হেসে বারান্দা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
—” নাথিং নাথিং ভাইয়া।”
—” আবার!!”
বলেই অরূপ ওয়াসেনাতের পিছনে ঝুট লাগায়।ওয়াসেনাত সবার থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই অরূপ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।ওয়াসেনাত বললো,
—” ভাইয়া কোথায় যাচ্ছেন??”
—” তোমাকে দিয়ে আসবো।”
—” দরকার নেই।আমার বাড়ি তো কাছেই।আর রিক্সা নিয়ে নিবো আমি।”
অরূপ নাছোড়বান্দা হয়ে বললো,
—” না আমি দিয়ে আসবো।চলো।”
ওয়াসেনাত অনেক বার বললো।অরূপ শুনলো না।এত জার্নি করে এসেও সে ওয়াসেনাতকে দিয়ে আসবে এটা ওয়াসেনাতের খুব ভালো লাগছে।একটা বড় ভাই এমনই হয় বুঝি।তারও প্রয়োজন ছিলো।কিন্তু তার তো ভাইও নেই বোনও নেই।কিছু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওয়াসেনাতের গভীর থেকে।
অরূপের বেশ ভালো লাগছে।পাশাপাশি হাটছে। গাড়ি না নিয়ে রিক্সায় গেলে আরো ভালো হতো।কিন্তু ওয়াসেনাত কি না কি ভাবে তা চিন্তা করে সে আর রিক্সা নিলো না।ওয়াসেনাত গেটের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে।অরূপ গাড়ি নিয়ে এসেছে।গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় অরূপের মনে পরে ওয়াসেনাতের জন্য নিয়ে আসা জিনিসগুলো তো সাথে নেয় নি।অরূপ বেরিয়ে পড়লো।ওয়াসেনাতকে বললো,
—” তুমি ভিতরে বসো।”
ওয়াসেনাত চিন্তিত হয়ে বললো,
—” কিছু কি ফেলে এসেছেন??”
—” হুম খুব প্রয়োজনীয়। নিয়ে আসি তুমি বসো।”
অরূপ যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ওয়াসেনাত গাড়ির দরজা খুলতেই হাতে টান পড়ে।ওয়াসেনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। এই লোক এখানে কেনো??ওয়াসেনাত নিজেকে সামলিয়ে বললো,
—” নুহাশ সাহেব আপনি??এখানে?? কেনো??”
তিনটা প্রশ্নের একটারও উত্তর না দিয়ে অরিত্রান এক টানে ওয়াসেনাতকে কোলে তুলে নিলো।ওয়াসেনাত যেনো আকাশ থেকে পরলো।হা করে তাকিয়ে আছে অরিত্রানের মুখের দিকে।আর অরিত্রান! সে ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে চলেছে।ওয়াসেনাত অরিত্রানকে ধরে নি।অরিত্রানের কেনো যেনো ব্যাপারটা পছন্দ হলো না।ওয়াসেনাতের দিকে না তাকিয়ে বললো,
—” আমার গায়ে nosogenic রোগ নেই।সো গলা জড়িয়ে ধরো।”
ওয়াসেনাত চরম আশ্চর্য হয়ে হা করে আছে। ছুঁয়াচে রোগ নেই কথাটা হাস্যোকর হলেও সে হাসছে না। সে অবাক।মহা অবাক।এমন কিছু এই জীবনেও আশা করেনি সে।অরিত্রান গলার কন্ঠ গম্ভীর করে বললো,
—” ছেড়ে দিবো!!”
কথার তালে তালে সে ওয়াসেনাতকে একটু ঝুঁলিয়ে দিলো।ভয়ে চোখবুজে নিয়ে ওয়াসেনাত দু’হাতে অরিত্রানের গলা জাপ্টে ভাবছে আজ সূর্য কি উঠেছে, না কি উঠে নি!!এসব কি হচ্ছে!!সে কি বেঁচে আছে না কি মারা গেছে?এমন অদ্ভুত আশ্চর্য জিনিস স্বপ্নেই হচ্ছে মনে হয়?
.
.
#চলবে____