পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 15
__________________
বৃদ্ধা বোরকার ভিতরে থেকেই প্রশ্ন করলো,
—” তা দাদুভাই নতুন বিয়া করলা বুঝি??”
অরিত্রান এবার খুক খুক করে কেশে উঠে।ওয়াসেনাত হাত পা নাড়াচাড়া করতে শুরু করে।এরা যে উল্টাপাল্টা ভাবছে এটা ভাবা আদো উচিত নয় বলেই তার মনে হচ্ছে। সে তো আর এর বউ নয়।আর বউ হবেই বা কেনো??ওয়াসেনাতের রাগ উঠছে। অরিত্রান তাকে এভাবে ধরায় তো সবাই এমন ভাবছে।কেমন বাজে একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।ওয়াসেনাত মাথা উঁচিয়ে ফিসফিস করে মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
—” কিসব বলছে উনি??আপনি কিছু বলছেন না কেনো?আমি কি আপনার বউ??”
অরিত্রান কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ভাবে।তারপর চারপাশে একবার চোখবুলিয়ে দেখে।অনেক মানুষই আছে এখানে।গণধোলাই পরবে বলেই তার মনে হচ্ছে। এটা বাংলাদেশ। তার লন্ডন বা আমেরিকা না।এখানে ছেলে আর মেয়ে নিস্তব্ধ জায়গা দিয়ে হাত ধরাধরি করে হাটাও ঘোর অন্যায়।সেখানে সে জড়িয়ে আছে!!একবার যদি কেউ জানতে পারে মেয়েটা তার কেউ না, তাহলে একটা মার ও মাটিতে পরবে না।পরিস্থিতি ভয়ংকর। কথাটা ভেবেই অরিত্রান ওয়াসেনাতের কানের কাছে বিড়বিড় করে বললো,
—” পাগল হলে!! আমাকে কি গণধোলাই খাওয়াতে চাও?এরা যদি যানে তুমি আমার কেউ না পিটাবে আমাকে।তোমার বাংলাদেশর মানুষ কেমন তুমি জানো না?”
ওয়াসেনাত চারপাশে তাকিয়ে একটু হাসির চেষ্টা করে বললো,
—” কে বলেছে আমাকে এভাবে জড়িয়ে নিতে??নিজেকে বেশি শেয়ানা মনে করেন বুঝি??এহহ্ বুঝি না সব হলো হামলে পরার জন্য।ছেলেদের অলওয়েজ হামলে পরা,জড়াজড়ি, জাপ্টাজাপ্টি টাইপের স্বভাব।তাই নই কি??”
অরিত্রান কথাটা শুনে হালকা হাসলো।তারপর সম্মতি ভরা গলায় বললো,
—” হুম আই নো, আই নো,তবে এক হাতে কিন্তু তালি বাজে না।এতে নারীজাতি সমান তালে এগিয়ে।”
ওয়াসেনাত রাগে ফঁস করে উঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ডান পাশ থেকে আবার সেই থামা থামা ক্লান্ত কর্কশ গলা ভেসে আসলো।বৃদ্ধ ভদ্র লোক বললো,
—” কিগো দাদুভাই তোমারে আমার পত্নী কিছু জিজ্ঞাইছে তো!!হুনো নাই বুঝি??”
অরিত্রান লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ হেসে বললো,
—” হুম শুনেছি দাদু।বিয়ে!!এই আর কি!!
মহিলা বৃদ্ধা আরো উৎসাহিত হয়ে বললো,
—” এই আর কি মানে কিতা দাদুভাই??কত দিন হইছে হেডা কউ??আর বউয়ের হাতে কিতা হইছে??”
অরিত্রান দীর্ঘ কিছু নিঃশ্বাস গোপন করতে গিয়েও পারলো না।ফুঁস করে ওয়াসেনাতের চোখেমুখে আছড়ে পড়লো নিঃশ্বাসের গরম হাওয়া।ওয়াসেনাত সেই হাওয়ার ঝংকারে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।অরিত্রান আরো একটু গভীর ভাবে জড়িয়ে বললো,
—” কিছুদিন আগেই হয়েছে।একদম নতুন বউ আমার।সাথে আবার অসুস্থ। হাতটাও না বেখেয়ালি ভাবে ভেঙে ফেলেছে।যদি ও আমার দোষে!!”
শেষ কথাটা বলে অরিত্রান ওয়াসেনাতের মুখের দিকে তাকালো।ওয়াসেনাত ভারী অবাক।সাথে বাকরূদ্ধ হয়ে বড় বড় নীলাভ চোখজোড়া মেলে তাকিয়ে আছে।তার কানে ক্ষীণ মাত্রায় বেজে চলেছে অরিত্রানের ধুকপুক হৃৎপিন্ডের শব্দ ভাণ্ডার। মধুময় না হলে ও একটা অদ্ভুত শব্দ মনে হচ্ছে তার।মহিলা আবার আগ্রহ প্রকাশ করে বললো,
—” কি কউ ভাইজান??তুমি কি বউ ডারে মাইরধোর করো না কি??এডা কিন্তু খুবই খারাপ দাদুভাই। খুবই খারাপ।বউ মারলে গুহ্ হইবো। দেহো একটা মাইয়া ঘরদোর ছাড়িয়া তোমার লাইগা তোমার ভরসায় তোমার বাড়িতে থাকে।বউয়ের বেক দায়িত্ব তো তোমার।ওরে কেমতে তুমি মাইরলা??পুতুলের লাহান বউ তোমার।একদম মোমেরপুতুল।কামডা ভালা করো নাই।”
অরিত্রান খুবই চিন্তিতো ভঙিতে আপসোসের সুর তুলে বললো,
—” হুম দাদু একদম ভালো করিনি।আমি তো জানি।তার জন্য বেশি বেশি যত্ন নিচ্ছি। বউ একটাই।আমার নিজের বউ।আসলে ও খুবই চঞ্চল।ভুল করে ভুল জায়গায় চলে গিয়েছিলো তাই তো ব্যাথা পেয়েছে।”
কথাটা বলে আবার তাকালো অরিত্রান ওয়াসেনাতের দিকে।অবাক বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ওয়াসেনাত।তার হৃৎপিন্ডে একটা কথাই বার বার কড়া নাড়ছে “একদম নতুন বউ আমার।আমার নিজের বউ।” “আমার ” কথাটা ভারী মায়ার লাগছে তার।খুব আকর্ষণীয় মায়ায় বাঁধানো। যেনো অন্তরের অন্তরস্থল থেকে আসছে কথাটা।গভীর একটা আবেগ লুকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত নিজের ভাবনায় ডুবে ডুবে ভাবছে কি মিথ্যা বলতে পারে রে বাবা।একটার পর একটা ঢপ দিয়েই যাচ্ছে।যত নিশ্চুপ বান্দা ভেবে ছিলো ততটাও না এ।এ তো ঠাণ্ডা মাথার ভয়ংকর খিলাড়ি।
বৃদ্ধ ভদ্র লোক দাঁত বের করে হেসে লুঙ্গী ঠিক করতে করতে বললো,
—” হো দাদুভাই নিজের বউ।তা যত্বআত্তি কেমন নেও হুনি একটু খানি কউ চাই??”
অরিত্রান পড়েছে মহা ঝামেলায়।তার কি বউ আছে নাকি!!যার যত্ন করবে??আর বউয়ের যত্ন করে কিভাবে তাও সে জানে না।এখন কি করবে।বৃদ্ধ মানুষ অতিরিক্ত কথা বলে এটা সে জানে।তার নিজের দাদাও বক বক করে সারা দিন। বয়সের তালে তালে এদের কথার পাল্লা ও ভারী।অরিত্রান কয়েক সেকেন্ড আবার চুপ করে থাকে।ওয়াসেনাত ঘাড় বাঁকিয়ে অরিত্রানের গুমোড় মুখশ্রী দেখে।চিন্তার ছাপ নেই।খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।তবে বুকের ভেতরের টিপ টিপ শব্দ শুনা যাচ্ছে।যা থেকে ওয়াসেনাত বুঝতে পারছে সে চিন্তিত।ওয়াসেনাত ভদ্র লোক আর মহিলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
—” আরে দাদু উনার লজ্জা লাগছে।নিজের তারিফ কি কেউ নিজে করে বলো??উনি যে আমার কত যত্ন করে বলার মতো না।এই যেমন সকালের ব্রেকফাস্ট নিজে তৈরি করে।আমাকে কোলে তুলে ওয়াসরুমে নিয়ে যায়,নাস্তা নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।আরো কত কি।লজ্জা লাগছে উনার এগুলো বলতে।”
কথাটা বলেই ওয়াসেনাত অরিত্রানের টিশার্টে লজ্জায় মুখ লুকানোর ভঙ্গিতে নাক ঘঁষে।অরিত্রান আবার হালকা কেশে উঠে।এই মেয়ে তো তারো এক ধাপ উপরে। ভয়ংকর একটা অনুভুতি সাথে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।বৃদ্ধ লোক এবং তার বউ দু’জনেই হেসে উঠে।হাসার গতি কমিয়ে বৃদ্ধা মহিলা বলে,
—” খুবই ভালা।দাদুভাই তোমারে খুব ভালোবাসে।এটা তো আমি প্রথমেই বুঝবার পারছি।যে যত্ন করি বুকে লুইছে!!ভালোবাসা থাকে তো যত্নআত্তি থাকবোই।এই যে দেহো তোমার দাদা। এত বুড়া হইছে তাও ভালোবাসা কমে নাই।”
ওয়াসেনাত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।বৃদ্ধা লাজুক হয়ে মাথা নত করে।অরিত্রান ও মহা অবাক।”ভালোবাসা!”কথাটা তার কাছে খুবই নতুন শব্দ মনে হচ্ছে এমন ভাবে সে চমকে ওয়াসেনাতের দিকে তাকায়।ওয়াসেনাত বৃদ্ধার হাতের টকটকে লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,এত বয়স্ক হয়েও এত ভালোবাসা!! ব্যাপারটা তাকে খুবই আশ্চর্য করছে।তার অন্য দিকে না শুধু হাতের দিকেই চোখ যাচ্ছে।কুচঁকানো চামড়া সে হাতে একটা লাল টকটকে গোলাপ।ভদ্র লোকের লজ্জা লাগছে না।তিনি হেসে হেসে বৃদ্ধার একটা হাত ধরে আছে।অরিত্রানের বুকের পাশটা খুব ভরা ভরা লাগছে।ওয়াসেনাত আরো ঘেঁষে জড়িয়ে আছে।কারন সে এখন গভীর চিন্তায় মগ্ন।অবাক হওয়া গলায় ওয়াসেনাত বললো,
—” আপনাদের কি প্রেমের বিয়ে??”
বৃদ্ধ কিছু বললো না।কিন্তু বৃদ্ধা অবাক হওয়া কন্ঠে বললো,
—” কি কউ এগিন!!তওবা তওবা।আমগো যুগে কি প্রেম টেম ছিলো না কি।বাপ মা বিয়া দিছে।৫৬ বছরের সংসার আমার।পোলা মাইয়া শহরে থাকে।তোমার দাদা আমারে ঢাকা শহর একটু ঘুরাইতে আনছে বুঝলা।সেই বিয়ার পরে থেইকা সখ ঢাকা দেখমু।হেতে পুরোন করছে।অতো ভালা না বুঝলা।গ্রেরাম অনেক সুন্দর।গাছপালা কম,মানুষ, ধোঁয়া।ভালা লাগে না বুঝলা।”
ওয়াসেনাত মনোযোগী হয়ে শুনছে।মহিলা নিজের গ্রামের বর্ণনা দিয়েই যাচ্ছে।অরিত্রানের কানে তেমন কিছু আসছে না।সে ভালোবাসা নামক শব্দে গভীর ভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে।বৃদ্ধা কথার ছলে মেতেছে।সে বলেই চলেছে।ওয়াসেনাত বাম হাতে অরিত্রানের পিঠ খামছে মাথা বুকে দিয়ে শুনছে।মাঝে মাঝে হাসছে।সে হাসিতে বুক কাঁপছে অরিত্রানের।ওয়াসেনাত মাথা একটু উঁচু করে অরিত্রানের ঘাড়ের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,
—” দেখেন কত প্রেম এদের মাঝে।আমাদের বউ জামাই ভেবেও তারা মহা খুশি।অথচ তারা জানেই না আমারা নকল।”
অরিত্রান শীতল চোখে তাকায় মাথা নিচু করে।ওয়াসেনাতের চোখে দুষ্টুমি থাকলেও অরিত্রানের চোখ গভীর।চশমার ফ্রেমে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে।ওয়াসেনাত বাম হাত বাড়িয়ে চশমাটা টেনে নেয়।নিজের হিজাবের খোলা অংশ দিয়ে পরিষ্কার করে আবার অরিত্রানের চোখে পরিয়ে দেয়।অরিত্রান জড়িয়ে আছে এখনো।তার একটা হাত এখনো ওয়াসেনাতের পিঠে।ওয়াসেনাত আবার বললো,
—” এবার ঠিক লাগছে।আপনি কিন্তু খুব বোরিং মানুষ।”
—” আমি জানি।”
কথাটা বলেই অরিত্রান চোখ সরিয়ে নেয়।ওয়াসেনাত মৃদু হেসে বৃদ্ধাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—” দাদু ফুল কে দিলো? দাদা দিয়েছে??”
বৃদ্ধার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভারী লজ্জা পেয়েছে।বৃদ্ধার বিপরীত পাশের মেয়ে গুলো খিলখিল করে হেসে বললো,
—” আরে দাদু তোমাদের প্রেম তো দেখি বুড়া বয়সেও চলো মান।কাহিনী কি গো??”
বৃদ্ধা বোরকার নেকাপ টেনে বললো,
—” শুনো মাইয়ারা রূপ তো এক কালে শেষ হইবো কিন্তু মায়া মোহাব্বত তো আজীবন থাকে।এই যে দেখো আমি বুড়া হইয়া গেছি।চামড়া কুচঁকাই গেছে।কিন্তু মায়া!!হেইডা রইয়া গেছে দেইখা আমার সখ পুরাইতে আনছে ঢাকা, তোমগো দাদা।বুঝলা। এইডাই আসল ভালোবাসা। বুড়া কালে, বিপদে, কষ্টে যেডা লগে থাকে হেডাই ভালোবাসা। আর আমার লাল গোলাপ পচন্দ(পছন্দ)। তাই হেতেনে কিন্না দিছে।এডাই তো ভালোবাসা। বুড়া কালেও রং ফালটায়(পাল্টায়) নাই।একারে আগের মতো আছে।প্রতি দিন হাঁটের তাই আমার লাইগা লাল গোলাপ লোইয়া আনে।ঢাকা প্রথম আইছি তাই কিন্না দিছে।বউরে তার প্রিয় জিনিস দেওয়া নবীর সুন্নত।তোমগো লাহান অতো উপহার টুপহারের চাইতে এডা বেশি দামি বুঝলা।”
মেয়ে গুলো হাসি থামিয়ে দেয়।তারা বুঝতে পেরেছে তাদের টিটকারিতে ভদ্র মহিলা কষ্ট পেয়েছে।তাই এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে।ওয়াসেনাত মুগ্ধ হয়ে শুনছে।আর কিছুসময় পরে পরে অরিত্রানের দিকে তাকাচ্ছে।অরিত্রান বৃষ্টি দেখছে।কিন্তু কানটা একদম খাড়া।কি বলছে সে সব শুনছে।ওয়াসেনাত মিইয়ে যাওয়া গলায় মিনমিনে সুরে বলে,
—” বাহ্ সুন্দর উক্তি।আমি ও চাই কেউ আমার রূপে না মায়ায় পরে ভালোবাসুক।রূপ তো ফুরিয়ে যাবে একদিন না একদিন যা থাকবে সব তো হাড্ডি আর কুচঁকানো চামড়া।তখন না হয় শরীরের নয় মায়ার ভালোবাসা থাকবে।মায়া ছাড়তে নয় বাঁধতে শিখায়।”
কথাগুলো বলে ওয়াসেনাত বেকুব বনে গেলো।অরিত্রান তার দিকেই তাকিয়ে আছে।যদিও সে মিনমিন করে বলেছে।কিন্তু অরিত্রান সব শুনেছে।ওয়াসেনাত বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে অরিত্রানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
—” কিছু কি শুনেছেন??”
অরিত্রান জবাব দিলো না।মাথা তুলে উপরে তাকালো।ওয়াসেনাত কিছুক্ষণ আগেও দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলছিলো।শীতের প্রকোটে। এখন আর বলছে না।শরীর উষ্ণতায় ভরে উঠেছে।কিন্তু অরিত্রানের সাদা টিশার্ট ভিজে গেছে অনেকটা অংশ।” মায়ায় পরার মতই তুমি ” কথাটা মাথায় আসতেই অরিত্রান হালকা নিজেকে ঝাঁকিয়ে নেয়।কিসব ভাবছে সে।ওয়াসেনাতকে সে খুবই পার্সোনাল ভাবে চিন্তা করে ফেলছে যা মোটেও উচিত নয়।বৃষ্টি থেমে গেলেই তাদের গন্তব্য বদলে যাবে।ইতি হবে এসব সময় গুলোর।শুধু শুধু এগুলো মাথায় ডুকিয়ে লাভ কি।অরিত্রান নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বৃষ্টি বিলাসে মনোযোগী হয়।প্রকৃতি তার ভালো লাগে।পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত তার ঘুরে দেখা শেষ।তবে নিজের মাতৃভূমিই তার দেখা হয়নি কখনো।ব্যাপারটা তারও অদ্ভুত লাগে।তবে এদেশের ধোঁকাবাজ মানুষের সংখ্যা এতই বেশি যে সে ঘৃণ্য করতে বাধ্য এঁদের।
____________________
আকাশের অবস্থা থমথমে গুমোট।নিস্তব্ধতায় কেটে যায় দীর্ঘ সময়।ওয়াসেনাতের জামা ও অনেকটা শুকিয়ে গেছে।অরিত্রান তাকে ছেড়ে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে।যাতে লেপ্টে যাওয়ার অংশ তেমন চোখে না পরে।নিজের কাজ গুলো খুব ভাবাচ্ছে তাকে।অদ্ভুত সব কান্ড করছে সে।একটা মেয়ের প্রতি আসলেই সে খুবই যত্নবান হওয়ার মতো কাজ করছে।এতো যত্ন কেনো??অরিত্রান উত্তর খুঁজে না।
দীর্ঘ এক’ঘন্টা পরে বৃষ্টি কমে আসে।ওয়াসেনাত ভদ্রমহিলার সাথে দাঁড়িয়ে নানারকমের কথায় মেতে আছে।অরিত্রানের বুকের খাঁজ গুলো দৃশ্যমান হয়ে আছে।পাতলা টিশার্ট ভিঁজে গেছে অরিত্রানের। তাও ওয়াসেনাতের জামার কারনে।আশেপাশের মেয়েরা আড়চোখে তাকিয়ে সেই বুক দেখছে।সচরাচর এমন জিম করা বুক চোখে পরে না।নিশ্চুয়ই প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে এই সিক্স প্যাক, বডি তৈরি করেছে।ওয়াসেনাত কথার তালে তালে একবার তাকাতেই এই তাকা তাকির দৃশ্য দেখে।সাথে সাথে তার মেজাজ খিঁচড়ে যায়।চোখ গরম করে তাদের দিকে তাকায়।মনে মনে বলে,
—” ছিঃ ছিঃ এভাবে তাকিয়ে দেখার কি আছে?লুচু মেয়ে কতগুলো।হুহ!!”
ওয়াসেনাত অরিত্রানের পাশ ঘেঁষে কানের কাছে এসে বললো,
—” লুচু কোথাকার!!”
অরিত্রান ভ্রু-জোড় কুচঁকে বললো,
—” হোয়াট??”
—” হোয়াট বলে কাজ নেই।আপনি আসলেই লুচু!!”
—” কিন্তু হুয়াই??”
—” এই যে আপনার বডি সডি।এত বডি,সিক্স প্যাক কেনো বানিয়েছেন??”
অরিত্রান এবার বিস্মিত হয়ে বললো,
—” এতে সমস্যা কোথায়??আমার স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য আমি এটা করতেই পারি।এতে প্রবলেম কি?দিস ইজ মাই ফ্যাশন।হোয়াট’স ইউর প্রবলেম??”
ওয়াসেনাত সবার দিকে একবার তাকিয়ে আরো একটু ঘেঁষে মুখ ভেঙ্গচি কেটে বললো,
—” হুহহ্। স্বাস্থ্য ভালো না কি কোন ছাই।আমার এক স্যার বলেছে একটা ছেলে যখন বডি, সিক্স প্যাক তৈরি করে তারা একটা মেয়েকে দেখানোর জন্য তৈরি করে না।অনেকগুলো মেয়েদের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয়/রিপ্রেজেন্ট করার জন্য করে।আপনি যেহেতু করেছেন সে হিসেবে আপনি তো একটা লুচু।”
অরিত্রানের খুব হাসি পাচ্ছে। সে হাসতে পারছে না।এই মুহূর্তে হাসি পেলেও তার হাসতে ইচ্ছে করছে না।অরিত্রান কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো,
—” আমার টিচার ও একটা কথা বলে শুনবে??”
ওয়াসেনাত বিরক্ত মুখে বললো,
—” বলেন!!”
—” Girls fall in love with the artist but marry an industrialist.অর্থ মেয়েরা ভালোবাসে/প্রেম করে শিল্পীর সাথে কিন্তু বিয়ে করে একজন শিল্পপতিকে।সে হিসেবে বডি সিক্স প্যাক দেখিয়ে লাভ নেই।industrialist হলেই লাভ।তা মেয়েদের তুমি এই ব্যাপারে কি বলবে ??”
ওয়াসেনাত খুদ্দ গলায় বললো,
—” সবাই একনা।দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার এটা।”
—” ঠিক সেটাই।আমি স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্যেই জিম করি।এতে মেয়েজাতিকে টেনে এনে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়ার মানে নেই।”
ওয়াসেনাত থতমত খেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে।অরিত্রান গম্ভীর গলায় বললো,
—” আর হাসতে হবে না।চলো। বৃষ্টি থেমে গেছে প্রায়।”
ওয়াসেনাত ছোট করে জবাব দেয়,
—” আচ্ছা।”
অরিত্রান ওয়াসেনাত যাত্রীছাউনি থেকে বাহিরে আসার সময় বৃদ্ধা মহিলা অরিত্রানকে বললো,
—” তোমার বউরেও আমার হেতেনের মত গোলাপ ফুল দিও।এতে তোমগো ভালোবাসা আমাগো মত মজবুত থাকবো ফুলের ঘ্রাণের মতো।আর ভালোবাসিও। ভালোবাসা সম্পর্ক বাঁচাই রাখার ওও কি জানি কয় না??কি গো একটু কন না হেইডা।”
ভদ্র লোক হেসে বললো,
—” ভালোবাসা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার অক্সিজেন।
ভদ্রমহিলা মহা খুশি হয়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে বললো,
—” হো হো।যাও দাদুভাই খুশি থাকো।আর সারা জীবন এমন করিয়া বুকে আগলাইয়া রাইখো।আর তুমি মাইয়া!!তুমিও বেশি বেশি ভালোবাসিও।”
ওয়াসেনাত নিঃশঙ্কচে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অভিজ্ঞ সুরে বললো,
—” হুম দাদু।অনেক ভালোবাসবো।”
অরিত্রান স্তব্ধ হয়ে কান পেতে শুনে সেই কথাটা।ইশশশ্ কত ভয়ংকর কাঁপনি ধরানো কথা!!অনেক ভালোবাসবো!!সত্যি কি তা সম্ভব!!অরিত্রানের পাথরের মতো হৃৎপিন্ডটা মুহূর্তেই কেঁপে কেঁপে উঠছে।শরীরে রক্তের সাথে মিশে যেতে চাচ্ছে কথাটা।তীব্র ভাবে আঘাত আনছে তার বাঁ পাশ টায়।অরিত্রান চোখ বড় করেই তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,
—” কি হলো চলেন??রাত হয়ে এসেছে প্রায়।”
—” হহুম চলো!!”
পাশাপাশি হাটঁছে ওয়াসেনাত আর অরিত্রান। রাত ৭ টা হবে হয় তো বা তারও বেশি।রাস্তার চারপাশ ভিঁজা।পিছঢালা রাস্তায় শুকনো পাতা ভিজে লেপ্টে আছে।গাছে শিশির কণার মতো জমে আছে পানির বিন্দু বিন্দু কণা।হালকা ঝাঁকিতে ঝড়ঝড় করে ঝরে পরবে।ঠান্ডা বাতাসে কম্পিত হচ্ছে দু’জনেই।ওয়াসেনাতের কাঁধ জড়িয়ে অরিত্রানের জ্যাকেট। অরিত্রান পাশ ঘেঁষে হাটঁছে।আর মাঝে মাঝে আড়চোখ তাকিয়ে দেখছে ওয়াসেনাতকে।ওয়াসেনাত হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলো।হাসতে হাসতে বললো,
—” ব্যাপারটা মজার ছিলো।”
অরিত্রান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ হাসির দিকে।তারপর বলে,
—” কোন ব্যাপার??”
ওয়াসেনাত হাসি থামিয়ে বললো,
—” ভুলে গেলেন??আরে আমি যে আপনার বউ সেটা!!তাও আবার নকল বউ!!”
কথাটা বলে ওয়াসেনাত আবার হাসলো।অরিত্রান কিছু বললো না।মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে বললো,
—” তো এতে এতো হাসার কি আছে??নকল তো নকলই।”
ওয়াসেনাত হাসি থামিয়ে থেমে থেমে বললো,
—” আরে ধরেন আপনার আসল বউ আর আমি এক সাথে আপনাকে নিয়ে ওই দাদা দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে পরলাম।তখন কি হবে জানেন??”
অরিত্রান সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—” যানার প্রয়োজন মনে করছি না।”
—” আমি বলি!গণধোলাই খাবেন।তারা তো জানে আমি আপনার বউ।এই যুগে দু’বউ নিয়ে ঘুরা মুশকিল
আর এই আপনি সবসময় এমন রুডলি কথা বলেন কেনো??একদম এভাবে কথা বলবেন না।”
শাসনের স্বরে বললো ওয়াসেনাত।অরিত্রান থেমে দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাতের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর গলায় বললো,
—” বউ হওয়ার চেষ্টা করছো মনে হচ্ছে??আমি নিজের মতো চলি।কেউ আমাকে তার মতো চালাতে পারে না।তাই আমার কিভাবে থাকতে হবে বা কথা বলতে হবে তা তুমি বলার কে??”
ওয়াসেনাতের হাসি হাসি মুখ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো।তার খুব খারাপ লাগলো কথাটা।মনে মনে খুবই কষ্ট হচ্ছে। চাপা দমবন্ধ একটা কষ্ট।এভাবে তো না বললেও পারতো।তুমি বলার কে??কথাটা খুব গায়ে লেগেছে ওয়াসেনাতের। লোকটা কখনো খুব যত্ন করে।তখন মনে হয় এই লোকটার চাইতে ভালো আর কেউ নেই।আবার কখনো এত জোড়ে ছুঁড়ে মারে প্রচণ্ড লাগে তখন।একদম হৃৎপিন্ডে।
বাকি পথ ওয়াসেনাত একদম কথা বললো না।অরিত্রানের মাঝে অনুশোচনা বোধ হলো না।তার মনে হচ্ছে ওয়াসেনাতকে নিয়ে সে বেশি ভাবছে।এত বেশি ভাবা উচিত না।তার জীবন সাধারণ না।যে সবার মত করে মানুষের সাথে মিশতে পারে না।তার গন্তব্য ভিন্ন
একদম আলাদা।আর মেয়ে জাতিকে প্রশ্রয় দিলে মাথায় চড়ে বসে তখন নামাতে কষ্ট হবে অনেক।তাই আগে থেকেই সাবধান থাকা ভালো।কিন্তু তবুও তার মাঝে হালকা খারাপ লাগার নামে কিছু একটা হচ্ছে। হাসিখুশি মেয়েদের গুমুট হয়ে থাকলে ভালো দেখায় না বলেই তার মনে হচ্ছে। কিন্তু তবুও সে নিজের জায়গা থেকে সরবে না।তাই ওয়াসেনাতের সাথে পা মিলিয়ে হাটঁছে।কথা বলছে না। মেয়েটার আর তার পথ আলাদা আলাদা।একদম তার টাইপের মেয়ে না ওয়াসেনাত।রাস্তা নিশ্চুপ।ঠান্ডা। এলোমেলো শীতল হয়ে আছে।ঠিক তার মাঝে হেঁটে চলা মানুষ গুলোর মতো।তারাও চুপ।কথা বলছে মনে মনে।খুব গোপনে।মাঝে মাঝে গোপনীয়তা ভালো।থাকনা কিছু আবেগ অনুভুতি গোপনে। একদম নিজের মতো।
__________________
রিমি বেশ কয়েকবার কল করেছিলো ওয়াসেনাতকে।অপেক্ষা করছিলো ক্যাফের বাহিরে।ওয়াসেনাত আর অরিত্রানকে আসতে দেখেই তার যেনো জীবন ফিরে ফেলো।এই ছেলেটাকে সে মোটেও বিশ্বাস করতে পারে না।তবুও সে জানে ছেলেটা ভালো।ওয়াসেনাতকে দেখেই রিমি প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে।কলের কথা বলতেই ওয়াসেনাত বললো,
—” ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই রিসিভ করতে পারিনি।”
—” হাতটা তো ভিঁজে গেছে মনে হয়!!”
কথাটা বলেই রিমি অবাক চোখে জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।ওয়াসেনাত রাগে কষ্টে নিজের গাঁ থেকে খুলে জ্যাকেট অরিত্রানের দিকে ছুঁড়ে দেয়।অরিত্রানের মুখে এসে পরতেই ডান হাতে খপ করে ধরে ওয়াসেনাতের দিকে তাকায়।মেয়েটা রাগ চেপে রাখতে পারে না।অরিত্রান এবার হালকা হাসলো।ওয়াসেনাত রেগে ছিলো সে জানে তবে এভাবে রাগ ঝাড়বে জানা ছিলো না।ওয়াসেনাত রাগি গলায় বললো,
—” চল তাড়াতাড়ি। আজ হলে চলে যাবো।অনেক দেরি হয়ে গেছে ভিতরে যেতে দিবে বলে মনে হচ্ছে না।”
কথাটা বলে সামনে চলন্ত একটা রিক্সাচালককে দাড় করালো ওয়াসেনাত।অরিত্রান কিছুই বললো না।তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সে।রিমন অবাক চোখে তাকিয়ে ভাবছে অরিত্রানের সাথে এত ঘন্টা একটা মেয়ে টিকে গেলো কিভাবে??কিভাবে??তার তো মাথা ঘুরছে।রিমি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” দাড়া দাড়া আমার ব্যাগ তো ভিতরে রেখে এসেছি।”
কথাটা বলেই সে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো।পিছনে পিছনে রিমনও চলে যায়।ওয়াসেনাত রিক্সায় উঠে বসে।অরিত্রান জ্যাকেট হাতে গুছিয়ে নিয়ে পকেটে হাত গুঁজে সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে পরে।কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অরিত্রান।তারপর হঠাৎ মনে পড়ার মতো বললো,
—” তোমার ও কি প্রিয় ফুল লাল গোলাপ??”
ওয়াসেনাত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে অরিত্রানের দিকে তাকালো।কিন্তু জবাব দিলো না।কিছুসময় তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে সামনে চোখ রাখে। ওয়াসেনাত বুঝতে পারছে না তার এত রাগ কেনো লাগছে।”তুমি কে?”বলাতে??রিমি এসে পাশে বসে। রিমনের দিকে তাকিয়ে সে বললো,
—” আচ্ছা বাই।”
রিমনও দাঁত কেলিয়ে বললো,
—” বাই।ওয়াসেনাতকে তো কিছুই খাওয়াতে পারলাম না!!”
বলেই মন খারাপে করে মাথা নিচু করে।ওয়াসেনাত হেসে বললো,
—” আবার কোনো একদিন উশুল করে নিবো।”
রিমন হেসে বললো,
—” অবশ্যই!!”
অরিত্রান জবাবের আশা ছেড়ে জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নেয়।এত সময়ের ব্যবধানে এখন তার অনুশোচনা হচ্ছে। এভাবে বলা উচিত হয় নি হয় তো।আবার ভাবে বলেছে ভালো করেছে।দূরত্ব বাড়া ভালো।মেয়েটা মারাত্মক ভয়ংকর।তার মতো ব্যক্তিকে কাঁপিয়ে ছেড়েছে। কাল সে এ দেশ ছাড়বে মিথ্যা মায়ার কি দরকার। রিমন তাকিয়ে আছে অরিত্রানের মুখের দিকে।অরিত্রানের চোখ রিক্সার দিকে।মনে কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে। একবার কি তাকাবে??জবাব কি দিবে??রিক্সা অনেক দূর চলে যেতেই ওয়াসেনাত চট করে মাথা কাত করে পিছনে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
—” প্রিয় লাল গোলাপ নয় সাদা গোলাপ।”
অরিত্রান হঠাৎ আবার হেসে উঠে।শব্দ করে বলে,
—” পাগলি মেয়ে!!
অরিত্রানের কথাটা কানে যেতেই রিমন বিস্ময়ে জ্ঞান হারাবে হারাবে ভাব।এটা কি হলো??
.
.
#চলবে____