পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 14
অরিত্রান তার সামনের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত নিঃশঙ্কচে বসে বসে পা দুলাচ্ছে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুশিতে দোল খাচ্ছে।চারপাশে মুখ ঘুরিয়ে সে খুবই আরাম করে নিঃশ্বাস ফেলছে।কিন্তু অরিত্রান পাড়ছে না।তার কেমন জানি লাগছে।দোকানের একপাশেই আবর্জনার স্তুপ।একটু দূরে হলেও একটা বাজে গন্ধ আসছে।বেঞ্চটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে কত হাজার জীবাণু হবে এই বেঞ্চে।আর সেখানেই কত আনন্দের সহিত বসে পা দুলিয়ে চলেছে ওয়াসেনাত।কিভাবে??হাউ??কথাটা মাথায় আসলেও সে কিছু বলতে পাড়ছে না।ওয়াসেনাত হঠাৎ পা দুলানো বন্ধ করে চোখ তুলে অরিত্রানের দিকে তাকালো।কৌতুহলী হয়ে বললো,
—” কি হলো আপনি দাড়িয়ে আছেন কেনো??বসুন!!”
অরিত্রান দ্রুত বললো,
—” নো! নেভার!
ওয়াসেনাত ভারী অবাক গলায় বললো,
—” মানে??কেনো??”
অরিত্রান বেঞ্চের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের জ্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,
—” আসলে খুব গরম তো তাই।”
ওয়াসেনাতের ভ্রু জোড়া মুহূর্তেই কুঁচকে এলো।কুঁচকানো ভ্রু বাঁকিয়ে সে বললো,
—” নুহাশ সাহেব!!গরম লাগার সাথে বসার কানেকশন কি??ঠিক বুঝলাম না।”
অরিত্রান এত প্রশ্নে বিরক্ত হলেও কিছু না বলে সামনের চায়ের কাপের দিকে তাকাচ্ছে।মাটির কাপ দেখে সে যতটা বিস্মিত তার চাইতে মনে মনে সন্তুষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে কাপটা ওয়ান টাইম।ওয়াসেনাত জবাবের আশায় তাকিয়ে থেকে জবাব না পেয়ে নিজের কুচঁকানো ভ্রু আরো কুঁচকিয়ে বললো,
—” সমস্যা কি??বসেন!!”
—” আমি দাঁড়িয়ে খাবো।এতেই ভালো লাগছে।”
ওয়াসেনাত নাছোড়বান্ধার মত ভঙিতে অরিত্রানের ডান হাত নিজের বাম হাত দিয়ে টেনে পাশে বসিয়ে দেয়।আকর্ষীক কান্ডে অরিত্রান হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওয়াসেনাতের দিকে।ওয়াসেনাত মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বলে,
—” আরে নুহাশ সাহেব আপনি তো জানেন না চা বসে খেতেই মজা।তাই বসে খান। ভালো লাগবে।”
অরিত্রান কিছু বললো না।কিছুক্ষণ আগেও সে শঙ্কচে ভুগছিলো কিন্তু এখন!!এখন তারও খুব ভালো লাগছে। ওয়াসেনাতের পাশে বসে তার অন্য রকম অনুভুতি হচ্ছে। আকাশে ঘন মেঘ জমেছে।বৃষ্টি আসার পূর্বাভাস। বাতাস হচ্ছে হালকা হালকা।সে বাতাসের ধাক্কায় শিহরিত হয়ে কাঁপছে আশেপাশের বিশাল বিশাল গাছের ঘন পল্লব।মানুষ কমে এসেছে অনেকটা।তারা দু’জন একটা বেঞ্চের দুই প্রান্তে বসে আছে।অরিত্রান চারপাশে তেমন তাকাচ্ছে না।তার মনে হচ্ছে তাকালেই অপছন্দনিয় অনেক কিছু চোখে পরবে তখন দেখা যাবে সে আর বসে থাকতে পারবে না।এত নোংরা পরিবেশের সাথে সে তেমন পরিচিত না।ঢাকা শহর পৃথিবীর নোংরা শহর গুলোর মাঝে অন্যতম।সে জানে এই কথাটা।কখনো ভাবেও নি এভাবে ফুটপাত ধরে হাঁটবে বা চায়ের দোকানে বসে চা খাবে।জীবনটাই অদ্ভুত। ভয়ংকর অদ্ভুত।কথাটা ভাবতে ভাবতেই অরিত্রান নিজের বাহুর দিকে তাকায়।সত্যি অনেকটা অংশ ছিঁড়ে গেছে।চারটা আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট। অরিত্রান ঘাড় কাত করে ওয়াসেনাতের দিকে তাকায়।ওয়াসেনাতের চোখ চায়ের কাপের চামচ নাড়ানোর দৃশ্যে স্থির।বাতাসের ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা হাওয়ায় ওয়াসেনাতের হেজাবের ছাড়া অংশ টুকু উড়ছে।দুলছে জামার বিভিন্ন অংশ।হেজাবের অংশটুকু অরিত্রানের চোখেমুখে এসে পরতেই সেই মাতাল করা গন্ধ তার নাকে বারি খায়।বাতাসে দুলে একবার মুখে পড়ছে আবার সরে যাচ্ছে। অরিত্রানের তো বিরক্তি লাগার কথা কিন্তু লাগছে না।ভালো লাগছে।খুবই ভালো।ওয়াসেনাত একবার মাথা কাত করেই অরিত্রানর মুখে নিজের হেজাবের অংশ দেখে জিভ কাঁটে।বাম হাত ঘুরিয়ে হেজাব টেনে বললো,
—” সরি নুহাশ সাহেব ।”
অরিত্রান জবাব দিলো না।মেয়েটা কথায় কথায় সরি নামক বাক্য কি ভাবে উচ্চারণ করে??কই সে তো পরে না।ওয়াসেনাত চোখ বাঁকিয়ে বললো,
—” আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো??”
অরিত্রান জবাব দিলো না।শুধু একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।ওয়াসেনাত বিরক্তি নিয়ে “ধ্যৎ” করে শব্দ করে উঠে।অরিত্রান নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করি না।যা বলার দ্রুত বলাই ভালো।”
ওয়াসেনাত খুশিতে গদগদ হয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললো,
—” আচ্ছা আপনি এত বড় হয়েও মাস্টার্স করছেন??কেনো??না মানে বয়স তো কম হয় নেই তাই বললাম।”
—” সেটা পার্সোনাল মেটার।বলার প্রয়োজন মনে করছি না।”
ওয়াসেনাত ঠোঁট উল্টে মনে মনে বলে খারুস তুই বউ পাবি বলে মনে হয় না।কথা তো বলে না যেনো বুলেট ছুঁড়ে।প্রতিদিন সকালে কি করলার জুস খায় না কি??একটু মিষ্টি কথা নেই মুখে।ওয়াসেনাত মনে মনে বলতে বলতেই বস্তাবেও মুখ ফুসকে বলে দিলো।সে বললো,
—” আপনি কি করলার জুস খান??এত তিতা তিতা কথা বলেন কেনো??মিষ্টি ভাষা শিখেন নি??মধু দেয় নি মনে হয় আপনার আম্মু।জন্মের সময় মুখে মধু দিলে আপনিও মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারতেন।লাইক মি।”
অরিত্রান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
—” তেতো জিনিস শরীরের জন্য উপকারী।করলা আরো বেশি।সো এগুলো খাওয়া উচিত।”
—” ওয়ায়য়াক আপনি খান বসে বসে।আরে জীবন তো একটাই আর এই জীবনে জিহ্বায় যা ভালো লাগবে টেস্টি লাগবে তাই খাওয়া উচিত।”
অরিত্রান কিছু বললো না।মৃদু হাসলো।ওয়াসেনাত আবাক হয়ে বললো,
—” এই আজ আপনার কি হলো বলেন তো??কিছুক্ষণ পর পর হাসছেন।আরে আল্লাহ্ ভয়ংকর ব্যাপার!! আমার তো দারুণ অদ্ভুত লাগছে।তবে আপনার হাসিটা খুবই সুন্দর।”
অরিত্রান আবার একবার নিচ থেকে মাথা তুলে তাকালো।”আপনার হাসিটা খুবই সুন্দর “কথাটা তার কানে বাজছে।ওয়াসেনাত আবার একটা হাসি দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকালো।অরিত্রান তাকালো না।গম্ভীর মুখে আবার নিচের দিকে তাকালো।আকাশে থোকা থোকা মেঘ জমেছে।কালো মেঘ কুণ্ডলীপাকিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।ওয়াসেনাতের মনে হচ্ছে তার জীবনের মতোই কি এরা ছন্নছাড়া??হয় তো।তার তো মা নেই। যার কোলে সে মুখ লুকাবে।বাবা তো কাছেই থাকে না।কতটা বিচিত্র জীবন তার।সব থেকেও নেই।পরিবার নেই।নেই ঘর ভর্তি ভালোবাসা। অরিত্রান মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো ওয়াসেনাত অন্যমনস্ক হয়ে আছে।নীল চোখ জোড়া ছলছল করছে।মেয়েটা কি কাঁদছে?? কাঁদলে তো গাল বেয়ে পানি পড়ার কথা।কিন্তু পড়ছে না তো।অরিত্রান নিজের চিন্তা ধারায় ভারী অবাক।সে কারো কষ্ট, পাশে বসেই উপলব্ধি করার মানুষ তো নয়।তাহলে এখন কেনো উপলব্ধি হচ্ছে। অদ্ভুত সব জিনিস হয় তার, এই মেয়ে আশেপাশে থাকলেই।
—” ভাইজান চা ডা ঠান্ডা হইয়া যাই বো তো।লন তাড়াতাড়ি। আমার আরো কাম আছে তো!ও ভাইজান!!!”
বাচ্চাটার গলা উঁচু ডাকে অরিত্রান ওয়াসেনাত দু’জনেই যেন চমকে উঠে।ওয়াসেনাত ভারী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।অরিত্রান শান্ত চাহনি নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো।হাত বাড়িয়ে বললো,
—” দেও।”
ওয়াসেনাত চায়ের কাপ নিতে নিতে বললো,
—” আপনাকে এ….”
অরিত্রান আর বলতে না দিয়ে নিজেই বললো,
—” বলতে পারো।”
ওয়াসেনাত খানিকটা অবাক হলো।মুখ হা করতেই বুঝে গেলো সে কিছু জিজ্ঞেস করবে??ভারী আশ্চর্য তো!!ওয়াসেনাত নিজের অবাকতাকে পাশে রেখে বললো,
—” আচ্ছা আপনার কুকুর গুলোর নাম কি??”
—“ট্রেক,স্ট্রেফ।”
—” এটা কোনো নাম হলো??”
—“কেনো?? ”
—” আরে ওদের নাম টমি রাখতে পাড়তেন। মিনি রাখতে পাড়তেন।এমন আজগুবি নাম দেওয়ার মানে আছে??নাম উচ্চারণ করতেই দাঁত হাতে চলে আসবে।”
অরিত্রান চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে চিন্তায় মগ্ন।সে ভাবছে মাটির তৈরি পাত্র তার ঠোঁটে লাগলে ঠোঁটে কি মাটি লেগে যাবে??আর চায়ের সাথে তো নিশ্চিত মাটি মিশে গেছে।এখন সে মাটি খাবে??কিভাবে এটা সম্ভব??ওয়াসেনাতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অরিত্রান বললো,
—” মাটি কি চায়ের সাথে মিশে যাবে??”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক হয়ে কিছুসময় অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তারপর নিজেকে সামলে সে বললো,
—” কি সব বলছেন!!এই পাত্র আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়েছে।মাটি তো পুড়ে কঠিন হয়েছে।এখান থেকে কিছু মিশা সম্ভব না।ইম্পসিবল!!”
অরিত্রান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপটা মুখের সামনে একবার নেয় তো একবার সরিয়ে ফেলে।আগে কখনো সে এমন মাটির পাত্রে খায় নি।তাই কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে।ওয়াসেনাত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে ভাবে চায়ে চিনি একদম হয় নি।আসলে চিনি ঠিকই আছে সে বেশি চিনি দিয়ে চা খায়।তা না হলে তার তিতা লাগে।অরিত্রান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভারী অবাক!এত মজার চা তার ফাইভ স্টারে,বিদেশে,এমন কি সে যত জায়গায় খেয়েছে কোথাও পাওয়া যায় নি।সত্যি অসাধারণ লাগছে তার।ওয়াসেনাত পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে অরিত্রানের দিকে হালকা এগিয়ে বললো,
—” চিনি কম হয়েছে না??”
অরিত্রান ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে।ওয়াসেনাত চা খায় না!! এটাই তার মনে হচ্ছিলো। এখন তো সে সিউর।
______________________
মাদৌলি পার্টিতে মত্ত হয়ে নাচা নাচি করছে।মদের গ্লাস ছেড়ে সে বোতলে চুমুক দিচ্ছে। একদম বেপরোয়া জীবন তার।সাথে আছে কিছু হাঙ্গিবাঙ্গি বান্ধবী। তারাও আনন্দে আছে।সব বড় লোক বাপের কন্যা।মাদৌলি হাপাঁতে হাপাঁতে সোফায় এসে বসে।ফোনটা অনেক্ষন থেকে বেজেই চলেছে।তুলছে না সে।বেশ বিরক্তি নিয়েই কল রিসিভ করতেই অপর পাশের ব্যক্তি গভীর গলায় বললো,
—” কি শুরু করেছো তুমি??কখন থেকে কল করছি??আমাকে কি তোমার বাবা মনে হয় না??একজন বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্ক হোতে হয় গভীর ইউ নো ।”
মাদৌলি মাতাল গলায় হাসে।হাসতে হাসতেই বলে,
—” কামন বাবা এসব লো লেভেলের কথা রাখো তো।অরিত্রানের খবর আছে তোমার কাছে??কোন হোটেলে উঠেছে এটা আমি জানি কিন্তু সেখানে ঢুকা যাচ্ছে না কেনো??গার্ডসদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করো প্লিজজ।”
মেয়ের কান্ডে প্রচণ্ড বিরক্ত মাদৌলির বাবা।বাঘের মুখে হাত দিতে বলছে তার মেয়ে।এত সোজা অরিত্রানের ইন্টারন্যাশনাল গার্ডসদের টাকা দিয়ে হাত করা??তাহলে তো ইহান চৌধুরী আরো আগেই অরিত্রানের চাপ্টার ক্লোজ করে দিতো।তার মেয়েটা আসলেই পাগল।এভাবে আর যাই হোক অরিত্রান খানকে পাওয়া যাবে না।সে তো আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না যে তার মেয়ে বলবে আর তিনি কিনে আনবেন। যতসব। মাদৌলির বাবা প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” অরিত্রানকে দিয়ে এখন আর কি কাজ তুমি নাকি নতুন একটা ছেলের সন্ধান করছো??”
মাদৌলি রেগে চেঁচিয়ে বললো,
—” মনসুর তোমাকে বলেছে এগুলো না??শালার জীবনের মায়া নাই।মেরে পুতে দিবো বলে দিলাম।”
—” শেটআপ মাদৌলি। ও বলে নি ভার্সিটি থেকে কল করে বলেছে। তুমি নাকি নুহাশ নামের কোন ছেলের খবর নিতে বলেছো।এগুলো কি??”
—” তুমি চুপ করো তো।আগে বলো খবর পেয়েছো??”
—” নাহ্।”
মাদৌলি কল কেঁটে দিলো।বাবার কাছে খবর পাবে না সে জানে।মনসুরকে কল দিতেই সেও বললো কোনো খবর পাওয়া যায় নি।রাগে মাদৌলি ফোনটা ছুঁড়ে ভাবছে কে এই নুহাশ?? এর তো কোনো না কোনো রহস্য আছে।
_____________________
কয়েকটা বখাটে ছেলে এসে দোকানে চায়ের অডার্র দিয়ে ওয়াসেনাতের দিকে ভ্রু কুচঁকে তাকিয়ে বিশ্রী করে একটা হাসি দেয়।শার্টের উপরের বুতাম খোলা।চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। গাঁ থেকে বাজে মদের গন্ধ আসছে।মুখে সিগারেট। অরিত্রান তাকালো না।ওয়াসেনাতের পাশে এসে দু’জন বসতেই ওয়াসেনাত আরো চেপে অরিত্রানের গাঁ ঘেঁষে বসে।অরিত্রান এবার মাথা তুলে একবার তাকায়।মদের গন্ধ তার চাইতে ভালো কে আর বুঝবে।অরিত্রান ছেলে গুলোর দিকে একবার তাকিয়ে চশমা ঠিক করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করে আরামের সহিত বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।ওয়াসেনাতের পাশের ছেলেটা তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতেই ওয়াসেনাত অরিত্রানের দিকে আরো এগিয়ে আসে।অরিত্রান আরো একটু সরে বসতেই ওয়াসেনাত অরিত্রানের হাত চেপে আরো ঘেঁষে বসে।অরিত্রান মহা অবাক।তবে কিছু মুখে প্রকাশ করলো না।অরিত্রানদের সামনের বেঞ্চে বসেছে চারজন। তারা বার বার ওয়াসেনাতকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে।সিটি বাজাচ্ছে।ফুলটুসি,কমলাসুন্দরী বলে তাকেই ইঙ্গিত করে নানা অশ্লীল কথাবার্তা বলছে।হাত দিয়ে বাজে ইশারা দিচ্ছে। ওয়াসেনাত এগুলো বুঝে অরিত্রানের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—” কি বাজে ছেলে আল্লাহ্!! মন চাচ্ছে ঘুষি মেরে নাক,মুখ ফাটিয়ে দিতে।ঠিক না নুহাশ সাহেব??”
অরিত্রান একবার শান্ত চোখে তাকালো।তারপর বললো,
—” তো বসে আছ কেনো?? মেরে দেও??এসব ব্যাপারে দেরি করা উচিত না।হ্যারিআপ।”
ওয়াসেনাত বিষম খেলো।সে ভেবেছে অরিত্রান এদের ঘুষিটুষি দিবে তাই সেই আগবাড়িয়ে বলতে গেলো।কিন্তু এই পোলা তো বদমাইশ। কথাটা সে ভুলেই গেছে।ওয়াসেনাতের অবস্থা করুন।তার এখন প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে।সাধারণ কান্না না এই মাঝ রাস্তায় পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।খারুস টাইপের শয়তান লোক।ওয়াসেনাত আর একটু কাছে এসে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—” আরে আমি মারলে আপনার হিরোপান্তির কি হবে বলুন তো??এদের তো আপনি সাইজ করবেন।হিরো হিরো ভাব!!বুঝেন না কেনো!!হু”
অরিত্রান পূর্বের মতো থেকেই বললো,
—” আমি তো হিরো নই।”
ওয়াসেনাত হতাশ গলায় বললো,
—” তাহলে ভিলেনের মত কিছু করেন??”
অরিত্রান ফোনটা পকেটে পুড়ে একটা হাত পিছনে নিয়ে কিছু একটা করলো।ওয়াসেনাতের সে দিকে খেয়াল নেই।সে চিন্তায় মগ্ন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এই সময়ে বখাটেদের পাল্লায় পরা মানে!!ভয়ে ওয়াসেনাতের গলা শুকিয়ে আসছে।অরিত্রান ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
—” আরে তোদের পছন্দ হয়েছে না কি??”
থমথমে পরিবেশ। ছেলেগুলো নিজেদের মত বকবক করা ছেড়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত অরিত্রানের হাতে চিমটি দিয়ে বললো,
—” ছিঃ এগুলো কি বলছেন।আপনি কি ওদের মত না কি??”
—” তুমি নিজেই তো বলেছো ভিলেনের মত কিছু করতে।ওরাও ভিলেন তাই ওদের সাথে তাল মিলালাম।ভুল কিছু হয়েছে বুঝি!!”
ওয়াসেনাত দাঁত কটমট করে ছেলেগুলোর দিকে তাকায়।তারা চুপচাপ বসে আছে।আগের মত কিছুই করছে না।কেনো??ওয়াসেনাতের মাথায় কিছুই ডুকছে না।সে পাশে তাকিয়ে দেখে পাশের ছেলেটা অনেকটা দূরে চলেগেছে। আর নিজের হাত ধরে বসে আছে।মনে হচ্ছে কেউ হাতের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।অরিত্রান উঠে দাঁড়ালো। জ্যাকেট হাতে গুঁজে কাপটা ছুঁড়ে দিয়ে সামনে হাটা শুরু করে।ওয়াসেনাত আরো অবাক।চেঁচিয়ে বললো,
—” আরে আরে যাচ্ছেন কোথায়??এদের মাঝে আমাকে একা রেখে কই যাচ্ছেন??”
অরিত্রান মাথা ঘুরিয়ে বললো,
—” দোকানের পেমেন্ট করো।আর এরা!!এরা কিছু করবে না তোমাকে।আফটার অল এরা আসল ভিলেনের সাথে কিঞ্চিৎ পরিচিত হয়েছে।তাই না গাইস্!!”
কথাটা বলেই অরিত্রান ঠোঁট বাঁকিয়ে মাথা দুলিয়ে হাসে।ওয়াসেনাত আগা মাথা কিছু না বুঝে দোকানের টাকা দিয়ে মনে মনে ভাবছে লোকটা এরকম কেনো??টাকা না দিলেও একটু তো বলতে পারতো। “আমি দিয়ে দি??” এই মহান বাঙালীর ভদ্র ভাষাটা না বলেই চলে গেলো??জিজ্ঞেসই করলো না।একদম ম্যানের্স জানে না!!হু!!বাচ্চা ছেলেটা ভাঙতি টাকা নিয়ে এসে বললো,
—” আপামনি পাউরুটির টাকা ভাইজান দিয়ে দিছে।আপনারে আর দেওয়া লাগবো না।”
ওয়াসেনাত অবাক হয়ে ভাবছে কেমন লোকরে বাবা পাউরুটির টাকা দিতে পারলো আর চায়েরটা একটু বলতেও পারলো না।কিপ্টুস।বড়লোক গুলো আসলেই কিপটা হয়।সুধে আসলে ট্রিট আদায় করে ছাড়লো।ভালো কথা!!মাত্র তো বিশ পঁচিশ টাকা। হু!!
ওয়াসেনাত যাওয়ার আগে একবার পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে ছেলেগুলো জড়ো সড়ো হয়ে বসে আছে।কিছুক্ষণ আগেও যারা বিশ্রী ভাবে তাকাচ্ছিলো তাদের এমন অবস্থা ওয়াসেনাতকে ভাবাচ্ছে।আসলে হলোটা কি??
_______________________💕
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে প্রায়।হয় তো ৬টা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। অন্ধকার নামছে চারপাশে।কালো কালো অন্ধকার দলা বেধে আসার আগেই মেঘেরা ভিড় জমিয়েছে।কল কল করে পানি পড়ার মত বৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রীছাউনিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাত আর অরিত্রান।অরিত্রান আগে আগে এসেছে বলে বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে দিতে না পারলেও ওয়াসেনাত পিছিয়ে পড়েছে।টাকা দিয়ে আশার সময়ই প্রবল বৃষ্টি নামে।মাঝ রাস্তায় সে প্রায় ভিজে ছুপছুপে হয়ে গেছে।ছাউনিটা কিছুটা দূরেই ছিলো।বাসে যাত্রীরা এখান থেকেই উঠে।ঝুম বৃষ্টি।এত বৃষ্টি কোথা থেকে এসেছে বুঝতে পারছে না ওয়াসেনাত।ঝকঝকে আকাশে এত বৃষ্টি হওয়ার কথা না।দৌড়ে এসে সে অরিত্রানকে এখানেই পেয়েছে।অরিত্রান তার কার্যকলাপ অনেক আগে থেকেই আড়চোখে দেখছিলো।কিন্তু একটুও এগিয়ে গেলো না।আজব লোক।ওয়াসেনাতের খুব রাগ হচ্ছে। সাথে অভিমান।এভাবে একা রেখে চলে আসলো??এত খারাপ কেনো??মনে মনে বিড়বিড় করে ওয়াসেনাত এগুলো বলছে আর জামা ঝাড়ছে।সব ভিজে শরীরে লেপ্টে আছে।হাতের প্লাস্টারও ভিঁজে গেছে।পানি না ঢুকলেও উপরের অংশ ভিজে গেছে।বাতাস বইছে প্রবল হারে।এত বাতাস বৃষ্টি একসাথে কেনো এলো কথাটা ভাবতেই ওয়াসেনাতের রাগ লাগছে।জামার প্রতিটি খাঁজ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।আশ্চর্য ভাবে তার জামাটা ভিজেছে।ভিজা জামায় গায়ে বাতাস লাগতেই রীতিমতো শীতের প্রকোপে কাঁপছে ওয়াসেনাত।অরিত্রান বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো দেখছে।খুব দ্রুত বেগে ছুটছে তারা।ওয়াসেনাত হেজাব ঝাড়তেই অরিত্রানের মুখে পানির ছিটকা আছড়ে পড়ে।অরিত্রান ভ্রু-জোড়া কুঁচকে ওয়াসেনাতের দিকে তাকালো।ভিজা মুখশ্রী, থরথর করে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া।শীতে কুঁকড়ে আছে শরীর।অরিত্রানর চোখ আর বেশিক্ষণ সে দিকে থাকলো না।পাশে থাকা ছেলেদের চোখ ওয়াসেনাতের ভিজা শরীরের দিকে তাক হয়ে আছে।অরিত্রান সবার দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিজের হাতের জ্যাকেট ওয়াসেনাতের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে।ওয়াসেনাত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঠোঁটের কম্পন কমেনি এক বিন্দু।বরং অরিত্রানের গায়ের গন্ধ যেনো তার গায়ে লেপ্টে গেছে।কথাটা ভেবেই ওয়াসেনাতের রঞ্জে রঞ্জে শিরশির করে শীতল রক্ত হঠাৎ করেই আরো শীতল হয়ে উঠে।শীত নামক জিনিসটা তাকে আরো আঁকড়ে ধরে।অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিত্রান বললো,
—” এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো??প্লাস্টার ভিজে গেছে তাই দিলাম।যাতে আর পানি না পরে।”
কথাটা বলে অরিত্রান আবার সামনে চোখ রাখে।এই শহর তার অপরিচিত। ঢাকা শহরের কোনো প্রান্তই সে চিনে না।ফোনের মাধ্যমে সে মেপ দেখেই সব জায়গায় যায়।সেখানে আজ সে একটা মেয়ের সাথে কত দূর চলে এসেছে।কোনো গার্ড ছাড়াই।অরিত্রান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওয়াসেনাতের দিকে তাকায়,দেখে ওয়াসেনাত থরথর করে কাঁপছে।কাঁপুনের মাত্রা খুব বেশি। বাতাসের কারনেই এটা হচ্ছে। ভিজা গায়ে বাতাস লাগছে বার বার।অরিত্রান ওয়াসেনাতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়।দেখে পাশের ছেলে গুলোর চোখ ওয়াসেনাতের উপরেই আছে।অরিত্রান এক হাতে ওয়াসেনাতের বাম হাত টেনে তাকে আরো কাছে টেনে আনে।অরিত্রানের হাতের ছোঁয়া মুহূর্তেই কাঁপনি বারিয়ে দেয় ওয়াসেনাতের। এই হাতের ছোঁয়া সেদিনো ছিলো।সে দিনও টেনে নিয়েছিলো।কিন্তু তাতে ছিলো হিংস্রতা।তাহলে আজকের ছোঁয়ায় কি আছে??অরিত্রান নিজের হাত ওয়াসেনাতের বাহুতে রাখে,টেনে তাকে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে।সবাই একটুও অবাক হলো না।কিন্তু ওয়াসেনাত স্তম্ভিত!!চমকিত!!পুলকিত!! হয়ে অরিত্রানের বুকের পাশে মাথা রাখে।চোখ গুলো গোল গোল হয়ে আছে তার।এটা কি হচ্ছে?? কিছুই যেনো তার মাথায় ডুকছে না।হেজাব পরেছে বলেই কি ডুকছে না!! না কি তার মাথা মোটা!!গলার স্বর ছোট হয়ে এসেছে ওয়াসেনাতের। মিনমিনে গলায় সে বললো,
—” আরে আরে করছেন কি??”
অরিত্রান জবাবে শান্ত গলায় বললো,
—” কিছুনা।চুপ করে থাকাই তোমার জন্য ভালো।”
অরিত্রান ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের ছেলেগুলোর দিকে তাকাতেই তারা চোখ নামিয়ে কাছুমাছু করে চোরের মতো সামনে তাকায়।ভয়ে আটখানা হয়ে উঠে তাদের মুখশ্রী।তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা অনুতপ্ত। চোখ দিয়ে বলতে চাচ্ছে,” ভাই সরি”কিন্তু মুখে বলতে পারছে না।দু’হাতে জড়িয়ে নিজের গায়ের সব উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে অরিত্রান ওয়াসেনাতের মাঝে।অরিত্রানের বুকে এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছে।অরিত্রান একবার চোখ বন্ধ করে আবার খুলে।ওয়াসেনাতের দিকে না তাকিয়ে বুঝে সে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ভালো লাগছে তার!অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে!যা তার এই জীবনে আর কখনো লাগেনি!কখনো না!মনে হচ্ছে হাজারটা,দিন, মাস, বছর,জীবন পার করে দিতে পারবে এভাবে জড়িয়ে থেকে।আচ্ছা সব মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেই বুঝি এমন হয়?? নাকি শুধু এই মেয়েকে ধরেছে বলেই হচ্ছে?? সব মেয়ে!সব মেয়ে আর এতো এক নয়!সবাইকে ধরলে তো এমন হৃৎপিন্ড কাঁপে না!সবার জন্য তো তার চিন্তা হয় না!শুধু এর কষ্ট গুলো চোখে পরে!কেনো!মেয়েটার কাছে অসীম পাওয়ার আছে।আছে সীমাহীন পাগলামি! আছে কথার ঝুলি!আছে হাসি!মিষ্টি হাসি!যা তার শরীরময় কাঁপিয়ে তুলছে খনে খনে।এ এক অদ্ভুত অনুভুতি! যার কোনো নাম নেই অরিত্রান খানের কাছে।ধূমকেতুর মত তার জীবনে হঠাৎ চলে এসেছে।একদম হঠাৎ!
—” ও দাদুভাই বউনি??”
ভাঙা ভাঙা গলার কথা শুনে অরিত্রান চমকে পাশে তাকায়।একজন সাদা পাঞ্জাবী পড়া বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। লাল লাল দাঁতে হেসে আছে।অরিত্রানের সাথে চমকের আর এক ধাপ উপরে উঠে ওয়াসেনাত উঁকি দেয় অরিত্রানের বুকে থেকেই।অরিত্রানের এক হাত ওয়াসেনাতের মাথায় আর এক হাত পিঠে।দু’জন মহা চমকিত চোখে তাকিয়ে আছে।কিছু বলতে যাবে তার আগেই বৃদ্ধার পাশ থেকে কালো বরকা পড়া মহিলা এগিয়ে এসে বললো,
—” আরে তুমি যে কি কউ!!দেখছো না বউয়ের শীত করে তাই টাইন্না নিজের বুকে লইছে!”
.
.
#চলবে____