অঙ্ক টিচার !! লেখাঃ শারমিন আক্তার { সাথী }
শারমিন আক্তার
__প্রায় দু বছর পর হঠাৎ করে তনয়া তার অঙ্ক টিচার মানে আয়াতকে দেখলো।
দেখে পুরো হা হয়ে গেলো। কখনো ভাবেনি কলেজে উঠে প্রথম দিন প্রথম ক্লাসে এভাবে আয়াত স্যারকে দেখতে পাবে। তনয়া এবার ইন্টার প্রথম বর্ষে।
আয়াতকে দেখার সাথে সাথে তনয়ার হাতটা নিজের বাম গালে চলে গেলো। দু বছর আগে চড়ের দাগ বা ব্যাথা কোনটাই এখন নেই কিন্তু মনের মধ্যে চড়ের দাগ বা ব্যাথা ঠিকই রয়ে গেছে কিছুটা লজ্জার কিছুটা ভয়ের ব্যাথা। তাই নিজের অজান্তেই হাতটা গালে চলে গেলো।
আয়াতও যে তনয়াকে দেখে কম অবাক হয়েছে তা কিন্তু না! তনয়ার মত আয়াতের চোখে মুখেও বিস্ময়! আয়াতের দুবছর আগের ঘটনা মনে পরে গেলো। আয়াত কখনো ভাবেনি তনয়াকে আবার দেখতে পাবে।
কয়েক মাস আগেই আয়াত এ কলেজে জয়েন করেছে অংক টিচার হিসাবে।
আয়াত তনয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে পাগলি মেয়েটা নিজের গালে হাত দিয়ে রেখেছে। সেটা দেখে আয়াত নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো। তনয়া আয়াতের হাসিটা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না আয়াত কেন হাসতেছে? তবুও তনয়া এক ধ্যানে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আয়াত সবার সাথে কথা বলতে বলতে তনয়ার কাছে এসে বললো—–
আয়াতঃ কি ব্যাপার তুমি গালে হাত দিয়ে আছো কেন?
আয়াতের কথায় তনয়ার ধ্যান ভাঙলো।
তনয়াঃ মামামম মানে?
আয়াতঃ কি বললা? ঠিক শুনি নাই জোড়ে বলো?
তনয়াঃ গাল থেকে হাতটা সরিয়ে কিছুনা স্যার।
আয়াতঃ তাহলে গালে হাত দিয়ে আছো কেন? দাঁতে ব্যাথা করছে নাকি? মুচকি হাসি দিয়ে।
তনয়াঃ (বেটা বজ্জাত খোচা দিয়ে কথা বলে আমার দাঁতে না আমার মনে ব্যাথা করে) (মনে মনে) না স্যার এমনিতেই গালে চুলকাচ্ছিল।
আয়াতঃ ওহ। তো এবার পড়ায় মনোনিবেশ করি?
সো স্টুডেন্ট আজ আপনাদের কলেজে প্রথম ক্লাস। কলেজের প্রথম দিন খুব সুন্দর হওয়া চাই। কারন এই দিনটা সারা জীবন মনের পাতায় স্মৃতি হয়ে রেখে যায়।
অবশ্য অনেকের শকিং বিষয় হয়েও মনে পাতায় স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়।
তনয়া বুঝতে পারছে কথাটা আয়াত ওকে খোচা দিয়ে বলেছে। তাই মনে মনে বলছে বেটা বজ্জাতের হাড্ডি। কাটা ঘায়ে লবনের ছিটা দিচ্ছি। কই বাত নেহি। আমিও সুযোগ পাবো। তখন কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিবো তনয়া কি জিনিস? এখন আছিতো দুজন একই কলেজে। হি হি হা হা।
আয়াতঃ কলেজ লাইফ মানেই মজা হই হুল্লর। কিন্তু সাথে সাথে পড়াশুনাও করতে হবে কিন্তু!
আর আমার পরিচয়টাতো পেয়েই গেছেন? আমি আয়াত। আপনাদের ম্যাথ টিচার। আজতো প্রথম ক্লাস তাই বেশি বক বক করবো না। কারন আমি জানি এটা আপনাদের অহস্য লাগবে।
আরে আমার নিজেরইতো টিচারদের বক বক শুনতে ইচ্ছা করে না তো আপনাদের কি বলবো?
আয়াতের কথায় ক্লাসের সবাই হেসে দিলো। এর মধ্যে একজন ছাত্র বললো
——–স্যার কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?
আয়াতঃ হ্যা বলো। কিন্তু তার আগে তোমার নাম বলো?
——–ফাহাদ!
আয়াতঃ ওকে ফাহাদ বলো? কি বলবে?
ফাহাদঃ স্যার আপনাকে দেখে টিচার মনে হয় না?
আয়াতঃ (হালকা হাসি দিয়ে) আচ্ছা! তো কি মনে হয়?
ফাহাদঃ স্টুডেন্ট এর মত লাগে!
আয়াতঃ আসলে আমি প্রফেসনাল টিচার না। আমি এবার মার্স্টাস করতেছি।
ফাহাদঃ তাহলে শিক্ষকতা কেন?
আয়াতঃ আসলে আমার এটা ভালো লাগে। এটাতো একটা প্রাইভেট কলেজ আর কলেজের প্রিন্সিপাল আমার আঙ্কেল। তিনিই বললেন যে যাতে কলেজে এসে প্রাকটিস করি এতে আমার পিছনের পড়াটা চর্চা থাকবে। নিজের সময়ও কাটবে।
ফাহাদঃ কুল স্যার। তা কত দিন প্রাকটিস করবেন স্যার।
আয়াতঃ এই বছর দুই। গল্প আর ইনট্রোডাকসনতো অনেক হলো এখন একটু পড়াশুনা করি!
তারপর আয়াত সামান্য কিছু পড়ালো। পুরো ক্লাসে তনয়া বার বার আয়াতের দিকে তাকালো। যখন আয়াতের চোখে চোথ পড়তো চোখ নামিয়ে নিতো।
কলেজ ছুটি আজ তাড়াতাড়ি হলো তাই তনয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে তনয়া সোজা নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো।
তনয়া মাঃ তনয়া ফ্রেস হয়ে খেতে আয়।
তনয়াঃ ভালো লাগছে নাতো পড়ে খাবো।
তনয়ার মাঃ আজব মেয়ে। ঠিক আছে।
তনয়া শুয়ে শুয়ে ভাবছে ঠিক কিভাবে কি? পৃথিবীটা সত্যিই গোল। এখানে হারিয়ে যেতে চাইলে ঘুরে ফিরে ঠিক একই জায়গায় চলে আসতে হয়।
কখনো ভাবিনি আয়াত স্যারের সাথে আবার দেখা হবে। যদিও চাইলে দেখা করতে পারা যেতো কিন্তু আমি নিজে থেকেই তা চাইনি। তাকে দেখলে ভয়ের থেকে বেশি লজ্জা লাগে। যে আজব কান্ড করেছিলাম তাতে লজ্জা হবারইতো কথা।
চলুন ঘুরে আসি দুবছর আগে—-
তখন তনয়া কেবল নবম শ্রেনীতে উঠেছে। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী তনয়া। সে কারনে দুটো ম্যাথ। সাধারন গনিত আর উচ্চতর গনিত।
প্রথম প্রথম তনয়া বাকি বন্ধুদের সাথে স্কুলের কোচিং এ পড়তো কিন্তু বাড়ি থেকে স্কুল বেশ দূরে হওয়ায় স্কুল কোচিং একসাথে সামলাতে খুব কষ্ট হতো। তনয়ার বাবা সেটা খেয়াল করলেন। একমাত্র মেয়ে বলে কথা! তিনি বললেন তোর জন্য ঘরে টিচার রেখে দিবো।
তারপর তনয়ার স্কুলের টিচারের কাছে গেলো কিন্তু তিনি বললেন তার সময় হবে না।
অবশেষে তনয়ার বাবা তার বন্ধুর ছেলে মানে আয়াতকে বললো যাতে তনয়াকে পড়ায়। আয়াত তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে অঙ্ক নিয়ে। আয়াত অংকে ভিষন ভালো।
প্রথমে আয়াত পড়াতে রাজি হয়নি। কারন আয়াদের অবস্থা খুব ভালো। প্রাইভেট পড়ানোর কান দরকার নাই। কিন্তু তারপর যখন আয়াতের বাবা পড়াতে বললেন তখন আর না করতে পারলো না।
প্রথম যেদিন আয়াত তনয়াকে পড়াতে গেলো। তনয়াতো আয়াতকে দেখে পুরো ক্রাস। কারন আয়াত দেখতে একেবারে চকলেট বয়।
তনয়া হা হয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আয়াতঃ হালকা কাশি দিয়ে তুমিই কি তনয়া?
তনয়াঃ জ্বি। আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন স্যার?
আয়াতঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো তুমি?
তনয়াঃ খুব ভালো। স্যার আপনাকে দেখে স্যার স্যার লাগে না!
আয়াতঃ আচ্ছা তাহলে কেমন কেমন লাগে?
তনয়াঃ থাক বললে মাইন্ড করবেন বলার দরকার নাই।
আয়াতঃ বলো মাইন্ড করবো না!
তনয়াঃ আপনাকে একদম চকলেট বয় লাগে!
আয়াতঃ কিছুটা হাসি দিয়ে। আচ্ছা তাহলে তোমাকেও তো চকলেট গার্ল লাগে। কারন তুমিও খুব কিউট।
আয়াত কথাটা এমনি বললো কিন্তু তনয়ার মনের মধ্যে তো এক কেজি লাড্ডু ফুটলো।
আয়াতঃ আচ্ছা তাহলে পড়া শুরু করি?
তনয়াঃ ওকে!
আয়াত সপ্তাহে তিনদিন তনয়াকে পড়াতো। আয়াত যখন তনয়াকে পড়াতো তখন তনয়া প্রায়ই আয়াতের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আয়াতের চোখে চোখ পড়লেই নামিয়ে নিতো। ব্যাপারটা আয়াত খেয়াল করলেও তনয়ার ছেলেমানুষি ভেবে ইগনোর করতো। কিন্তু তারপরও আয়াতের খুব অসস্তি লাগতো।
তনয়া অনেক ছেলে মানুষি করতো। আয়াত মাঝে মাঝে বকা দিলেও তনয়ার ছেলে মনুষিটা ওর খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আয়াত কখনো তনয়াকে সে নজরে দেখেনি।
ধীরে তনয়ার কিশোরী মনটায় ভালোবাসার একটা ছোট্ট ফুল ফোটে আর সে ফুলটার নাম দেয় #আয়াত।
আয়াত তনয়ার হাবভাব দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারতো। তাই ভাবলো তনয়াকে ইনডায়রেকলি বুঝাতে হবে। কারন এ বয়সে এ ধরেন কিছু হওয়াটা নরলাম। কারন বয়সটাই খারাপ। বেশি কিছু বললে ব্যাপারটা উল্টা হয়ে যেতে পারে। তাই অনেক ভেবে চিন্তে তনয়াকে বললো——
–ফজরের নামাজ পড়ার বেশ কিছুক্ষন পর মেসেঞ্জারে একটা লম্বা মেসেস দেখে তনয়ার খুব হাসি পেলো। তাই একা একা দাড়িয়ে নিজের অজান্তেই হাসছে।তোমাকে কিছু কথা বলি?
তনয়াঃ হ্যা স্যার বলেন?
আয়াতঃ জানো তনয়া মানুষের জীবনে সব থেকে খারাপ বয়স কোনটা?
তনয়াঃ নাতো? কোনটা স্যার?
আয়াতঃ তেরো থেকে আঠারো বছর বয়সটা।
তনয়াঃ কেন স্যার?
আয়াতঃ তনয়াকে ঠিক কিভাবে বুঝাবে তাই ভাবতেছে? তারপর বললো।
এই সময় মানুষ ছেলেবেলা আর ম্যাচিওর বয়সের মাঝামাঝি থাকে। এ বয়সে খারাপ জিনিসটা ভালো আর ভালো জিনিসটাকে খারাপ মনে হয়। এ বয়সের কিশোর কিশোরীদের শিক্ষানীয় কথা আসহ্য লাগে।
এ বয়সে খারাপ জিনিসটা উপরের চাকচিক্য দেখে তার প্রতি আর্কিষ্ট হয়ে ভুল করে কিন্তু যখন বুঝতে পারে ভুল করছে তখন করার মত আর কিছু থাকে না।
যে এ বয়সের ভ্রম থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে তার জীবনটা অনেক সুন্দর হবে।
দেখো এ বয়সে ভালোলাগা জিনিসটা মনের সাথে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে যায়। তখন বোঝা যায় না কোনটা ভালোলাগা আর কোনটা ভালোবাসা। ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে আলাদা একটা পৃথিবী তৈরী হয়ে যায়। যে পৃথিবীতে প্রথম প্রথম ফুলের সমারোহ থাকলেও কিছুদূর যেতেই দেখবে ফুল গুলো ঝরে গিয়ে সেখানে কাটার উৎপত্তি হয়েছে!
আমি কি বলতে চাচ্ছি তুমি বুজেছো?
তনয়াঃ জ্বি স্যার।
আয়াতঃ কি বুঝলা?
তনয়াঃ আই লাভ ইউ।
আয়াতঃ (চোখ বড় বড় করে) হোয়াট?
তনয়াঃ হোয়াট না স্যার! উত্তরটা আই লাভ ইউ টু হবে!
আয়াতঃ জাস্ট সেটাপ। আমি তোমাকে এতক্ষন কি বুঝালাম? সব কি তোমার মাথার উপর দিয়া গেছে?
তনয়াঃ না স্যার। এক কান দিয়ো ডুকছে অপর কান দিয়া বের করে গিয়েছি।
আয়াতঃ চুপ একদম চুপ। (ধমক দিয়ে) তোমাকে বললাম না এ বয়সে কখনো ভালোবাসা হয়না। এটা হয় ভ্রম নয় ভালোলাগা।
তনয়াঃ নো স্যার আই রিয়ালি লাভ ইউ।
আয়াতঃ তোমার মত ইডিয়েট মেয়েকে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব না! গুড বাই। এই বলে রাগ করে হন হনিয়ে চলে গেলো আয়াত।
আর তনয়া হা হয়ে আয়াতের যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। আর ভাবতেছে। কি এমন বললাম?
মেয়েরা প্রপোজ করলে ছেলেরা আরো খুশি হয়ে একসেপ্ট করে আর এতো উল্টা।
পরোক্ষনেই তনয়ার মনে পড়লো আয়াত যদি বাবাকে বলে দেয়? তাহলে তো সর্বনাশ। তাছাড়া সামনের মাসে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। এখন নতুন টিচার কোথায় পাবো?
যাক নিজের ইগো বর্তমানে ব্যাগে রেখে স্যারকে ফোন দিয়ে স্যরি বলি। দেখি বেটা ঘ্যারতেরা মানে কিনা?
এই ভেবে তনয়া আয়াকে ফোন দিলো। প্রথম কয়েকবার রিং হয়ে কলটা কেটে গেলো।
তারপর আয়াত ধরলো—
তনয়াঃ হ্যালো———
চলবে———