ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি- সিজন ২ – Part- 11

পুরোটা বিকেল বাইরে কাটিয়ে মাগরিবের আজানের একটু আগে ওরা বাসায় ফিরলো ।
নীরা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো বারবার ঘড়ি দেখছিলো , গাড়ির শব্দ পেতেই সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো ।
উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো_
— কোথায় গিয়েছিলেন? এত দেরী হলো কেনো?
তার উত্তেজনাপূর্ণ কন্ঠস্বর মিথির একদম ভালো লাগলো না । অদ্ভুত হিংসা বোধে তার ভেতর জ্বলে উঠলো । সে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো নীরার দিকে ।
রাইদ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো_
— লাঞ্চ করতে বেরিয়েছিলাম তোমার ম্যামের সাথে ।
নীরা’র কাছে এই উত্তর যেন আনএক্সপেক্টেড ছিলো । সে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ।
ওর দিকে বিশেষ খেয়াল না দিয়ে রাইদ পাশ কেটে ভেতরে চলে গেলো ।
মিথি’র কাছে নীরার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো নীরা যেন তার স্বামীর অপেক্ষা করছিলো , বিশেষ নজর না দেয়ায় যে কষ্ট পেলো ।
বিরক্তিকর একটা নিঃশ্বাস ফেলে সেও ভেতরে চলে গেলো ।
ঘরে গিয়ে দেখা গেলো কোমরে এক হাত দিয়ে রাইদ কি যেন ভাবছে আর দুষ্টু ভাবে হাসছে ।
নিশ্চয়ই কোনো অসভ্যতামীর ফন্দি আঁটছে । মনে মনে এ কথা বলে হ্যান্ডব্যাগ টা রেখে চুলের ব্যান্ড আর ইয়ার রিং গুলো খুলে রাখতে থাকলো মিথি ।
রাইদ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে ওর ঠিক পেছনে এসে ওর কোমর দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো ।
আয়নায় প্রতিবিম্বতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মিথি ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো , কি?
রাইদ ওর ডান কাঁধের চুল গুলো বাম কাঁধে সরিয়ে ডান কাঁধে থুতনি রেখে আহ্লাদ মাখানো গলায় বললো_
— চলো না করি ।

— কি করবো?
— আরে ভয় পাচ্ছো কেনো আমি গোসল করার কথা বলছি ।
— দরকার নেই এখন একটু শীত পড়েছে আমি গোসল করবো না ।
— ছিঃ ছিঃ কি বলো সারাটা দিন বাইরে কাটালে তোমার গা দিয়ে ঘামের গন্ধ আসছে । চলো গোসল দিবা ।
— কোনো দরকার নেই । ঘামের গন্ধ আসছে ভালো কথা আপনি দূরে সরে থাকেন ।
— উঁহু মোটেও না । আমার ঘুম মাটি হয়ে যাবে দূরে সরে থাকলে ।
— কেনো ঘুম মাটি হবে কেনো ।
— তোমাকে ছাড়া ঘুমাই বুঝি?
— এমনভাবে বলছেন যেন বিয়ের আগে আমাকে ছাড়া ঘুমোন নি ।
— বিয়ের আগে আর পরের মধ্যে তো পার্থক্য আছে তাই না?
— আপনাদের অভিনয় শিল্পীদের বিয়ে করতে নেই । এত সুন্দর অভিনয় আপনারা পারেন!
— এখানে অভিনয়ের কি দেখলে?
— এই যে কি সুন্দর রোম্যান্টিক ভঙ্গিতে আহ্লাদ করে আমার সাথে কথা বলছেন অথচ আপনি আমাকে ভালোবাসেন না । সারা পৃথিবীর সামনে কি সুন্দর অভিনয় করে চলতে পারেন অথচ আমি আপনার কাছে একজন বেড পার্টনার আর পারমানেন্ট দাসী ছাড়া কিছুনা অবশ্য পারসোনাল দাসীও বলা চলে কিন্তু বেতন নেই ।
মিথিলার এমন ধারার কথা শুনে রাইদের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গেলো কিন্তু ও যথাসম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো_
— একদম ঠিক বলেছো কি বলো তো তোমার কাছে আসলে আমার মাথা ঠিক থাকে না । নিজের চাহিদা পূরণ করতে আবার আমি কোনো অভিনয় করিনা একদম বাস্তব থাকি ।

— আমি তো আপনার চাহিদা মেটাবার বস্তু ।
— ভুল বললে বস্তু নয় জীব আমার অর্ধাঙ্গিনী ।
— অর্ধাঙ্গিনী সে ই হয় যে অর্ধাঙ্গের কাছে রেসপেক্ট এবং ভালোবাসা পায় সাথে অধিকারও ।
— অধিকার আমি তোমাকে দিয়েছি কিন্তু তুমি খাটাতে পারোনা আর রেসপেক্ট-ভালোবাসা আমি দিতে চাই কিন্তু তুমি নিজ হাতে সেই পথ বন্ধ করছো ।
— মানে?
— অতসব বুঝে কাজ কি? নিজেকে চাহিদা মেটাবার বস্তু মনে করছো এখন আমার তোমাকে চাই । সো লেটস গো ।
মিথি কে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো রাইদ ।
মিথি ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুঝবার চেষ্টা করলো রাইদ কি আসলেই ওকে ভালোবাসতে চায়? নাকি সব অভিনয় ।
__
একের পর এক হাঁচি দিচ্ছে রাইদ তা দেখে মিথিলা হেসে কুটিকুটি ।
হাঁচির মধ্যে আবার রাইদ ধমক দিচ্ছে তাকে , একদম যাতে না হাসে নইলে ওরও সর্দি লাগিয়ে দিবে ।
মিথি কৌতুকের স্বরে বললো_
— আমার নাকে নাক লাগিয়ে বুঝি সর্দি পাস করবেন?
— প্রয়োজন হলে তাই করবো ।
— ছিঃ ছিঃ ঘেন্না ।
— এক্ষুণি যদি চা না এনে দাও তা’হলে আমি ঘেন্নার কাজ টাই করবো ।
— ইয়াক ছিঃ! আর আপনি চা খান বুঝি?
— হ্যাঁ খাই কোনো সমস্যা?
— এতবড় তারকা আবার চা খায়!

— কেনো তারকা দের চা খাওয়া পাপ? আর আমিও আর পাঁচটা মানুষের মতই মানুষ । সেটা কাজের মধ্যে হোক বা কাজের বাইরে । আমারও পছন্দ অপছন্দ আছে । আমি আগে থেকেই চা খেতাম , তোমারই মনে নেই ।
— হবে হয়তো । গরম পানিতে ভাপ নিবেন?
— আগে চা নিয়ে আসো ।
রাইদের কথা শেষ হতেই দরজায় নক পড়লো ।
বিছানায় বসে ও মিথি কে অর্ডার করলো_
— দেখো তো কে?
— আপনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনি যেতে পারলেন না?
— না আমার পায়ে ব্যাথা তুমি দেখো ।
— এত্ত নাটক ।
মুখ ভেঙ্গিয়ে দরজা খুলে দিলো মিথি । নীরা দাঁড়িয়ে আছে কফি নিয়ে ।
রাইদ ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলো_
— কে এসেছে?
নীরা গলা বাড়িয়ে বিনীত স্বরে উত্তর দিলো_
— স্যার আমি এসেছি কফি নিয়ে ।
— কিন্তু তোমার স্যার তো কফি খাবে না নীরা ।
— বাইরে থেকে এসেছে কফি খেলে ভালো লাগবে আর হাঁচিও তো দিচ্ছেন উনি বারবার ।
— নীরা আমি কফি খাবো না এখন চা খাবো তোমার ম্যামকে বলেছি ।
— তা’হলে কফিটা?
— ওটা তুমি খেয়ে নাও ।
— আচ্ছা স্যার।
— আর নীরা শোনো?
— জ্বী?
— তোমার ম্যাম আজ রান্না করবেন তাকে হেল্প করো একটু ।
— জ্বী আচ্ছা স্যার ।
নীরা প্রস্থান করার পর মিথি অবাক হয়ে রাইদ কে জিজ্ঞেস করলো_
— আমি কখন বলেছি রান্না করবো?
— রান্না তো তোমায় করতেই হতো তাই আগেভাগে আমিই বলে দিলাম ।
— আসলে এমনি এমনি নিজেকে দাসী বলিনা আমি ।
— আমার চাওয়া পাওয়া যদি তোমার কাছে ফায়ফরমাশ মনে হয় আর আমার ছায়াতলে থাকা যদি তোমার দাসত্ব মনে হয় তা’হলে এটা তোমার বোঝার ব্যর্থতা ।
এর কোনো উত্তর ঐ মুহুর্তে দিতে পারলো না মিথি , রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে দরজা টা শব্দ করে লাগিয়ে চলে গেলো ।

গম্ভীরমুখে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে নীরা । ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি মেলে একবার তাকিয়ে পরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায় মিথিলা । চা যখন অলমোস্ট হয়ে এসেছে ঐ মুহুর্তে নীরা প্রশ্ন করে_
— আপনারা ক্যাসেল ব্ল্যাকে গেছিলেন তাইনা?
— হ্যাঁ তুমি কীভাবে জানলে?
— ইন্সটাগ্রামে দেখলাম । তো আপনি ওরকম নরমাল ড্রেসাপ করেই গেছিলেন অড লাগেনি?
— অড লাগার কি কথা ছিলো? আমার ব্যক্তিত্ব আমার পোশাকে নাকি আমার ব্যবহারে?
— না তবুও । এতবড় একজন তারকা আর ফ্যাশন ডিজাইনারের সাথে বাইরে গেলেন খুব নরমাল , ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ভাবে ব্যাপারটা অদ্ভুত ।
— যার যার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা । আমার নিজের কাছে কিংবা আমার হাজবেন্ড আর কলিগের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগেনি তাদের কাছে কিছু মুহুর্ত স্মৃতিবন্দী করা মুখ্য ছিলো । করেছি এখন কেমন ড্রেসাপ করে সেটা করা হয়েছে এই দিকটায় নজর দেয়ার সময় বা ইচ্ছা কারো হয়নি ।
মিথির উত্তর শুনে নীরার মুখখানা কালো হয়ে গেলো ।
আর কথা না বাড়িয়ে মিথিও কাপ এনে চা ঢালার জন্য প্রস্তুতি নিলো ।
গরম পাতিল টা কাপড় দিয়ে ধরতেই নীরা পেছন থেকে দ্রুত পায়ে এসে অনেকটা ইচ্ছে করেই গায়ে পড়ে বললো_
— দিন আমি করছি ।
ওর হুট করে আসায় বাঁধলো বিপত্তি চায়ের পাতিল টা হাত থেকে পড়ে গেলো মিথিলার । টগবগ ফুটতে থাকা গরম চা পড়ে যাওয়ার সময় ওর হাতে কিছুটা ছিটকে আসলো এমনকি হাতে গরম পাতিলের একাংশ লাগলো বাকিটা সম্পূর্ণ পায়ের ওপর পড়ে গেলো ।
মাত্র চুলো থেকে নামানো ফুটন্ত এই তরল শরীরে লাগার সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠলো মিথি ।
নীরা ততক্ষণে পাশ থেকে সরে পড়েছে ।
৭০% যেহেতু পায়ে পড়েছে তাই যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিচে বসে পড়ে মিথি । একহাত দিয়ে পা চেপে ধরে কেঁদে ওঠে ।
এদিকে রাইদ মিথির আর্তনাদ শুনে এক প্রকার ছুটে আসে ।
রান্নাঘরে বেহাল দশা দেখে হতবিহ্বল হয়ে মিথিকেই প্রশ্ন করে _
— কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
মিথি ভাঙা কন্ঠে কোনোরকমে বলে _
— আমার পা
রাইদ পায়ের দিকে নজর দিতেই আঁতকে ওঠে ।
সাদা পা ফুলে টকটকে লাল হয়ে আছে ,সাথে যে হাত দিয়ে পা চেপে ধরে আছে সেই হাতও ।
পাশেই চায়ের পাতিল পড়ে থাকতে দেখে যা বোঝার বুঝে যায় ও ।
তড়িঘড়ি করে এসে ক্রন্দরত মিথি কে কোলে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায় আর স্বান্তনা দিয়ে বলতে থাকে_
— একদম কেঁদো না কিছু হবে না আমি আছি তো ।
আমরা এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যাবো তুমি কেঁদো না ।
চিৎকার করে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলে রাইদ ।
এদিকে নীরা মেঝেতে পড়ে থাকা অবিন্যস্ত জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে । শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলে_ “খুব ব্যাথা লেগেছে না ম্যাম?”

নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার মিথির ট্রিটমেন্ট করিয়ে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয় । প্রেসক্রিপশনে কিছু ঔষধের নাম লিখে এগুলো নিয়মিত খেতে বলে আর সময় পর পর ড্রেসিং করাতে বলে ।
ড্রাইভারের হাতে প্রেসক্রিপশন দিয়ে ঘুমন্ত মিথির পাশে বসে রাইদ ।
দু হাত আর এক পায়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে ।
সেগুলিতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে ওর চোখে জল চলে আসে ।
মিথির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হয় যন্ত্রণার ছাপ ঘুমের মধ্যেও স্পষ্ট ।
মিথির গ্রীবায় ঠোঁট ছুঁইয়ে রাইদ ফিসফিসিয়ে বলে_
— আ’ম স্যরি । আমি চা বানাতে না বললে হয়তো আজ এভাবে ব্যাথা পেতে না তুমি ।
এদিকে খবর শুনে ছুটে এসেছিলো রফিক । দরজায় নক না করে ঢুকতে গিয়ে রাইদের ফুঁপিয়ে কান্না আর কাতর কন্ঠ শুনে নস্টালজিক হয়ে যায় রফিক ।
ভেতরে আর ঢোকা হয়না । নিঃশব্দে কেবিনের দরজা লাগিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় ।
অজান্তেই হেসে ফেলে । নিজে নিজেই বলে_
— কি অদ্ভুত স্যার। আজ তার ছোট্ট যন্ত্রণায় আপনি কাতর হয়ে যাচ্ছেন স্যার অথচ আপনি বিয়েই করেছিলেন তাকে যন্ত্রণা দিতে ।
সে যখন জানবে তার ভালোবাসার মানুষকে আপনি নিজ হাতে খুন করেছেন , ভালোবেসে বিয়ে করেননি তখন সে আরো কষ্ট পাবে । আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইবে ।
তখন আপনি কি করবেন স্যার? এভাবে কাতর হয়ে প্রশ্ন করবেন, কেনো ও আমায় ভালোবাসেনি?
চলবে,