আড়ালে ভালোবাসার সংসার !! Part- 31
বিথীর ঠোঁটের কাটা জায়গাতে চেপে ধরায় সে চাপা আর্তনাদ দিয়ে ওঠে তা দেখে বিধান মুচকি হাসে। বিথী বিধানের হাসি দেখে অবাক হয়ে যায় কারণ কাউকে ব্যথা দিয়েও যে কেউ হাসতে পারে তা সে আগে জানতো না।
বিধান হঠাৎ হাসি থামিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
লাগছে তাই না? অনেক লাগছে………..এর চেয়েও না অনেক বেশি লেগে ছিলো আমার এইখানটায়……….জ্বলে যাচ্ছে এইখানে তোমার জন্য…..
বিথী কাপা কাপা গলায় বলে উঠে, আ-আমি ক-ককি করেএএছি!
বিধানঃ.কি করেছো তাই না! আমার ভালোবাসার অপমান করেছো………..কি করো পারলে আমার ভালোবাসার চিহ্নগুলোকে এভাবে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলতে!
বিধানের করুণ আকুতিভরা চোখ জোড়া পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পারছে। কেনো জানি বিথী এই চাহনি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারছে না সে।
বিথী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিধানের থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল, শুধু কি আমিই অনুভূতিগুলোকে উপেক্ষা করি!
বিথীর এই কথায় বিধান অবাক হয়ে গেলো। বলতে গেলো কিছুটায় ভাবনায় পড়ে গেলো সে আসলেই কি সে বিথীর অনুভূতিকে উপেক্ষা করেছে তাহলে কখন করেছে। খুব বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না তার মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা কারণ সেদিনই শেষ কথা হয়তো শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিলো বিথীর সাথে। ঐদিনের পর বিথী তার সামনে পড়েনি সেটা ইচ্ছে করে কিনা অনিচ্ছেতেই তা সে জানে না।
বিধান বিথীর ইঙ্গিতটা বুঝতে পারতেই সে মনে মনে বলে, এই জন্যই পাখিটা অভিমান করে এতোদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে আমার ছায়াতল থেকে…….আর আমি কিনা তা বুঝতেই…..অবশ্য বুঝবো কি করে আমি তো এতোদিন আজকের ট্রিপটাতে যাওয়া পসিব্যাল করার জন্যই দিন-রাত এক করে কাজ করছিলাম কারণ আমার বিথী পাখিটার যে বড্ড ইচ্ছে ছিলো এখানে আসার। সেও তো পারতো আমাকে একটু বুঝতে বুঝাতে তা না! ছিহ বিধান! তুই কি হাপিয়ে উঠছিস বিথীর থেকে তাহলে কেমন ভালোবাসিস যা মেয়েটার রাগ ভাঙা!
(বিঃদ্রঃ আমরা মানবগোষ্ঠী আসলে নিজ ব্যথায় কাতর বেশি তাই নিজের নদী সমান সমস্যা থাকলে অন্যের সাগর সমান সমস্যার এক ফুটোও আমাদের চোখে পড়ে না। এজন্যই দেখুন বিথী নিজ কষ্ট-অভিমানের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলো আর বিধান নিজ রাগ-অবহেলার বেড়াজালে। অথচ দুজন দুজনকে কতই না কষ্ট দিয়ে ফেলেছে জান্তে-অজান্তে তা কেউ একবার মনেও পড়লো না। কথায় আছে না, নিজ পেটে দানা না গেলে অন্যের পেট কয়দিন ধরে খালি তা জানার আগ্রহ কখনোই থাকে না। বিথী-বিধানের ক্ষেত্রেও তাই)
বিধান বিথীর দিকে তাকিয়ে দেখলো বিথী বিধানের কোলে বসা অবস্থায়ই তার বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিধান বিথীকে আলতো হাতে পিছন বিধানের দিকে মুখ করে বসালো এবং এতে বিথী কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং মাথা নিচু করে থাকলো। বিধান বিথীর হিজাবটা খুলে দিলো কারণ বিধানের বড্ড ইচ্ছে করছে তার মায়াবনের মায়াবি রাজকন্যার চুলের ঘ্রাণ নিতে সে যে অনেকদিন ধরে তাকে কাছে পায় না।
বিধান হিজাব খুলে বিথীর মুখটা দুই হাতে তুলে ধরে ফুঁ দিয়ে সামনে আসা চুলগুলো সরিয়ে বলল, অভিমান হয়েছে আমার জানটার তাই না? সরি গো বুঝতে পারিনি আমি……. (বলেই একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো) জানতে চাইবে না কেনো সেদিন রাগ দেখিয়েছিলাম?
বিথী এতোক্ষণ চোখ জোড়া বন্ধ করেছিলো এখন চোখ খুলে বিধানের দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হু।
বিধান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, রাগার কারণ না জেনেই এতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছো আমায়। ফেলে রেখেছো আমার ভালোবাসার অনুভূতি মিশা চিহ্নগুলো তুমি!
বিধানের কথায় আবার বিথী বাহিরের দিকে তাকিয়ে অভিমানি গলায় বললো, জানি তো কেনো বকেছেন আমি আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক গলিয়েছি তাই! আসলে ঐ যে চাঁদ দেখছেন না ঐটা আপনি আর আমি হলাম ক্ষুদ্র বামুন। ক্ষুদ্র বামুন হয়ে চাঁদের ধরা ঠিকই পেয়েছি তবে হয়তো যোগ্যতার অভাবে তার বিষয়াদি তে ভাবার অধিকারটি পাইনি। (বলেই চোখ জোড়া বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল)
বিধানের বিথীর কথায় নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। সে মনে মনে বলে উঠলো, অজান্তেই কি এই প্রাণ ভ্রমরটাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। যাকে সবার কুদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখি তাকে নিজেই মুচড়ে ফেলেছি! নাহ বিথু পাখিটাকে বুঝাতে হবে আমি কেনো এমন করেছি!
কথাগুলো বলে আবার বিথীর দিকে চোখ জোড়া স্থীর করতেই দেখলো বিথীর বন্ধ চোখ জোড়া দিয়ে অশ্রু বেয়ে চলেছে। চাঁদের আলোয় সে অশ্রুকণাগুলো মুক্তোর মতো জলজল করছে শ্যাম মুখে তাই বিধান দেরি না করে দু হাতে বিথীর মুখ আকরে ধরে প্রেয়সীর ঝড়ানো মুক্তগুলো শুষে নিলো ঠোঁট জোড়া দিয়ে। এ কাজে বীৎী অবাক চোখে তাকিয়ে যেই না কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই বিধান তার এক আঙুল দিয়ে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে বলল, বিথু পাখি চুপ করে আমার কথাগুলো শুনে নেও তারপর আমাকে ভুল মনে হলে বলো…..
বিথী জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো তাই বিধান মুচকি হেসে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলতে শুরু করলো, বিথী তুমি হয়তো জানোই না আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তাই তো আজ নিজেকে বামুন আর আমাকে চাঁদ বললে………..আচ্ছা বিথী একটা সত্য কথা বলো তো এতোদিনের কি আমি একবারও আমার ভালোবাসার গভীরতা কিছুটা হলেও বুঝাতে পারিনি?
বিধানের কথায় বিথী মাথা নিচু করে ফেলে মনে মনে ভাবে, আসলেই তো লোকটার প্রতিটি আচারণ, কথা, ভঙ্গিমায় প্রকাশ পায় তার ভালোবাসা তাহলে আমি কি…..
বিধান বিথীর ভাবনার ঘোর ভাঙিয়ে বলে, জানতে চাইছিলে না সেদিন কেন রাগ দেখিয়েছিলাম তোমায়! সেদিন তোমার দোষেই তোমাকে বকেছিলাম যদিও বেশি রিয়েক্ট করে ফেলেছিলাম………..তুমি যখন কিচেন থেকে ড্রইংরুম আসো তখন তোমার শাড়ির আচল খসে তোমার পেট ও কোমর দেখা যাচ্ছিলো। আর নিহাল সেটা চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো তার উপর পড়েছিলে পাতলা সিল্কের শাড়ি তোমার শরীরের অন্যান্য ভাজগুলোও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। সে বারবার সেদিকে কুদৃষ্টি দিচ্ছিলো। তোমাকে বারবার যাওয়ার জন্য ইশারা করার পরও তুমি যাচ্ছিলে না…….বরং একবার ভেঙচি কেটেই আমার দিকে আর তাকাচ্ছিলেই না। আর এতোদিনে আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা নিশ্চয়ই আছে তাহলে তারপরের ঘটনা তো বুঝতে পারারই কথা……
বিথী মনে মনে বলল, আসলেই তো উনি আমাকে ইশারা দিয়েছিলো কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম উনি আমাকে ঐ জায়গা থেকে সরাতে চাচ্ছে দিশার সাথে সময় কাটানোর জন্য……..ছিহ না বুঝেই কত কিছুই ভেবে ফেলেছি!
বিধান আবার বলতে শুরু করলো, তুমি ভাবতে পারো আমি তোমাকে না বলে নিহালকে কিছু বললাম না কেনো……তুমি জানো এমনেই মামাদের সাথে সম্পর্ক এখন ভালো নয় তার উপর যদি এই বিষয়টা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাই তাহলে কি হতে……। সে বাদ দাও তোমারও দোষ ছিলো…….
(বিঃদ্রঃ অনেক সময় অবস্থান পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষ চাইলেও প্রতিবাদ করতে তখন নিরব হয়ে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। অনেক সময় হয়ে থাকে আমাদের বাবামা আমাদের দোষ নেই জেনেও কোনো এক আত্মীয়ের কথায় আমাদের সবার সামনে বকে কিন্তু এই কারণেই। পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী কখনো কখনো নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় যেমনটা বিধান করেছে। বিধান যদি নিহালের উপর নিজের রাগের বর্ষণ করতে তাহলে হয়তো পারিবারিক সম্পর্কে ফাটোল ধরতো কারণ নিহালের বিরুদ্ধে কোনো সঠিক প্রমাণও নেই শেষ পর্যন্ত দোষ আসতো বিথীর গায়েই। তাই রাগটা আপন মানুষের উপর প্রকাশ করতেই মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাছাড়া সেই আত্মীয়টা যাওয়ার পর বাবামাকে যেমন আমাদের দিকটা বলি। তেমনই বিথীর নিজের রাগ বুঝানোর দরকার ছিলো কিন্তু ওই যে চাপা স্বভাব )
বিথী কথাটা শুনে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালেই বিধান মুচকি হেসে বলে, কোনো বাইরের পুরুষের সামনে তোমার সেই পোশাকে আসা উচিত হয়নি। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখা উচিত কাপড় ঠিক আছে কিনা……এসব অসাবধানতার সুযোগ নেয়ার জন্য নানা কুকুর আমাদের সমাজে অহরহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ঐ শাড়িগুলো শুধুমাত্র আমার সামনে পড়ার জন্য আনিয়ে ছিলাম পিয়েকে দিয়ে তাছাড়া সুতি শাড়ি, কুর্তি, থ্রিপিস এসব আছে। (বলে বাঁকা হাসলো)
আর বিথী লজ্জায় লাল মাথা নিচু করে হয়ে মনে মনে বলল, উনি ঠিকই বলেছেন জামা-কাপড়ের দিকে নজর রাখা উচিত কে কোন নজরে দেখে বলা যায় না!
বিধান এবার বিথীর মুখ আবার এক হাত দিয়ে বিথীর মুখটা উঁচু করে ধরলো তবে এবার বেশ শক্ত করেই ধরলো তারপর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, এবার বলেন মায়াবিনী আপনার কি শাস্তি হওয়া উচিত আমার ভালোবাসার উপহারগুলোকে অবহেলা করার অপরাধে।
বিথী আমতা আমতা করে বললো, ওগুলো তো আমার কাছেই!
বিধান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে! মানে কোথায়?
বিথী নিজের কাধে ঝুলে থাকে স্লিং ব্যাগটা খুলে মাথা নিচু করে বলল, এইখানে!
ধানবি রাগী কণ্ঠে বলল, স্টুপিড এইখানে রাখার জন্যকে দিয়েছি!
বেশ জোড়েই ধমক দিয়ে বলল কারণ ওরা একদম পিছনের সিটে বসেছে যা সবার থেকে অনেক দূরে মাঝের খালি সিটগুলোর কারণে। তার উপর সবাই ঘুম তাই কারো শুনার ভয় নেই।
বিথী ধমকে কেপে উঠে বলল, আমি এ_খনই প-পড়ে ন-নিচ্ছি!
বিধান বিথীকে কিছু না বলে বিথীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে একেক করে সব অলংকার পড়িয়ে দিলো আর সাথে বিথীর হাতে, ঘাড়ে, গলায়, কপালে ভালোবাসার ছোঁয়া দিতে ভুলল না। সবশেষে বিথীকে তীক্ষ্ণ নজরে বলল, সব নাহলে ঠিক আছে শাড়িটা যে পড়লে না তার উপর অন্যের অনুভূতি মিশে থাকা বস্তু নিজের শরীরে জড়িয়েছো গায়ে!
বিধান কতটা শান্ত ভঙ্গিমায় বললেও তার রাগ যে সপ্তম স্তরে তা বিথী বুঝতে পেরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বরবর করে বলল, দ-দেখুন আমি জানতাম না এই শাড়ি উনার দেয়া তাহলে জীবনেও পড়তাম না……হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটাই পড়েছি বিশ্বাস করুন!
বিধান বিথীর গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল, তাহলে আমার আনা শাড়ি কেনো পড়লে না? রাগ করে?
বিথী বিধানের প্রশ্ন নিরব সম্মতি জানালে সে বলল, কুল! তোমাকে ক্ষমা করলাম তবে শর্ত আছে। দুটো একটা করতে হবে এক তুমি এখনই এই শাড়িটা চেঞ্জ করবে নয়তো ঐখানে যেয়েই দিশা থেকে শাড়িটা চেয়ে নিবে!
বিথী এখন পড়লো মহাবিপাকে কারণ দুটোই তার জন্য লজ্জাজনক। বিথীকে কিছু বলতে না দেখে বিধান বলল, তাহলে কি শাস্তি নিবে।
বিথী তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, না! না! আমি আগামীকালই দিশার থেকে শাড়ি চেয়ে নিবো!
বিধান বিথীর উত্তরে মুচকি হেসে বিথীকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বিথীকে নিয়ে মেতে উঠলো আপন ভালোবাসার দুষ্টুমিতে।
বিধানের ঘুম ভাঙলো ভোরের এক ফালি রোদের আগমনে। মিটমিট করে চোখ খুলতেই ঝুঁকে থাকা দৃষ্টিতে প্রথম নজরই পড়ে বুকে থাকা এক মায়াবি রাজকন্যা। তাকে দেখতেই মুচকি হেসে উঠে বিধান মনে মনে বলল, এই মায়াবিনীটা কি সত্যিই আমার! বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাকে তার আড়ালেই…….জেদ ও শক্তির বলে পেয়েও গিয়েছি তাকে তবে………তবে সে কি সত্যিই আমার……সে কি আমাকে ভালোবাসে আমার মতোই আমার আড়ালে! নাকি…….
বিধান আর বেশি ভাবলো না। বিথীর দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার শাড়ির আচল আজও ঠিক নাই। আজ অবশ্য তার জন্যই সেই কথাটা ভাবতেই মুচকি হাসি ফুটলো মুখে। তাই সেই বিথীকে নিজের কোল থেকে পাশের সিটে বসিয়ে দিয়ে ষাড়ি ঠিক করে দিলো তারপর বাইরের দিকে তাকাতেই দেখলো সবেমাত্র সূর্য উঠেছে আর গাড়িতে সবাই এখনও ঘুম। তাই কেউ দেখার আগেই বিথীকে কোলে তুলে আবার আগের সিট জোড়ায় যেয়ে বসে পড়লো।
বিধানঃ চাচা আর কতক্ষণ লাগবে রেজর্টে পৌঁছাতে? সময় তা কম হলো না!
ড্রাইভারঃ আরে বাবা বলো না………এতো জ্যাম পড়েছিলো তোমরা তো ঘুমিয়ে ছিলে তাই দেখো নাই!
বিধানঃ ওহ……….অবশ্য এখন ডিসেম্বর মাস প্রায় সবাই এই সময়টাতে ভেকেশনে যায় তাই হয়তো এতো জ্যাম।
ড্রাইভারঃ হ্যাঁ বাবা।
বিধানঃ তা চাচা কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?
ড্রাইভারঃ আর ঘন্টা দুয়েক বাবা।
বিধানঃ ওহ।
দুপুরবেলা, বিথী মাত্র শাওয়ার নিয়ে বের হলো। সকালেই এখানে এসেছে তারপর ব্রেকফাস্ট ও রেজর্ট ঘুরে দেখতে বড্ড ক্লান্ত সে তাই শাওয়ার নিয়ে নিলো রুমে এসেই। বিথী চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কক্সবাজারের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যালকনিতে গেলো আর সেখানে বিধান কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। বলতে গেলে বেশ চেঁচামেচিই করছে ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটির সাথে। বিথী ব্যালকনিতে এসেও বিপাকে পড়েছে কারণ বিধানের ধমকে বিথীই কেপে উঠছে। বিধান হঠাৎ পিছনে তাকাতেই বিথীর উপর নজর পড়ে তাই ফোনে চেঁচামেচি করতে করতেই বিথীর দিকে এগিয়ে যেয়ে একাহাতে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আরেক হাতে ফোনে কথা বলছে। বিথী খোলা দিক দিয়ে যেতে নিলে বিধান নিজের শরীর দিয়ে চেপে ধরে।
বিথী নড়চড়া করতে থাকায় বিধান বিথীর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে এক ভ্রু উঠিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি সমস্যা তার?
বিথী বিধানের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বললো,ছ-আড়েন ন_না আমাকে!
বিধানঃ মিস্টার রয় আমি জানি ইউ হ্যাভ টু ফিক্স দিস প্রবলেম এট এনি কস্ট অর এলজ……
মিস্টার রয়ঃ…………
বিধানঃ ওকেহ……রিমেম্বার হোয়াট আই হ্যাভ সেইড!
মিস্টার রয়ঃ………..
ফোন কেটে দিয়ে বিথীর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সে আগের মতোই করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চুল থেকে বেয়ে বেয়ে পানি পড়ছে, চোখের পাপড়ি আর ভ্রুতেও পানিকণা জমে রয়েছে। তাকে দেখতে কোনো রূপকথার মায়াবি হরিন ছানার মতো লাগছে যাকে দেখলে মানুষ এতোটাই মোহিত হয় সব ভুলে তার পিছনেই ছুটতে লাগে। বিধানও তার ব্যতিক্রম নয় তাই কিছু না বলেই বিথীকে কোলে তুলে নিলো। বিথীও কিছু বলল না তার মাতাল দৃষ্টি দেখে কারণ সেও তো চায় তার আড়ালে ভালোবাসার সংসারের পূর্ণতা। থাক না তার ভালোবাসাটা অপ্রকাশিত, বিধানের আড়ালেই থাক তা। এই সংসারের পূর্ণতা নাহয় বিধানের ভালোবাসার জোড়েই হোক।
বিকালে বিথীর ঘুম ভাঙলো বাইরের থেকে আসা শব্দে। গলাটা চিনতে বেশি সময় লাগলো না বিথীর তবে উঠতে পারলো না বেড থেকে বিধানের শক্ত শরীরটা নিচে যে চাপা পড়ে আছে সে। আর বিধান মহাশয় ঘুমে ব্যস্ত তাই অগত্যা ভিতর থেকে জবাব দেয়া শুরু করলো।
আরিশাঃ বিথীইইই! কিরে জবাব দিচ্ছিস না কেন?
বিথীঃ হ্যাঁ বল আরিশা!
আরিশাঃ কি করছিলি জবাব দিচ্ছিলি না কেনো! (সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে)
বিথীঃ তোর গোয়েন্দাগিরি বন্ধ করে কি বলবি বল তো! (বিরক্তবোধ করে)
আরিশাঃ হুহ! আমি তো তোকে জন্যই আসছি……..তোকে জানাতে যে আমরা একটু পর বীচে ঘুরতে বের হবো তাই তৈরি হয়েনে তুই আর জিজু!
বিথীঃ আচ্ছা! আমরা রেডি হয়ে নিচে লবিতে আসছি……..
আরিশাঃ ওকেহ।
আরিশার ও বিথীর এমন চড়া গলার কথোপকথনে বিধানের ঘুম সেই কখন ভেঙে গিয়েছে। সে তো শুধু বিথীর চোখ খুলের ঘুমে থাকা অবস্থানে থেকে নিশ্চুপভাবে বিথীকে দেখে যাচ্ছে। যার কারণে বিথীও খেয়াল করেনি বিধান জেগে গিয়েছে। আরিশার সাথে কথা শেষ হতেই বিধান চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করলো এবং বিথী আরিশার যেতেই চোখ যায় বিধানের দিকে।
বিথীর মনে মিনে বলল, এই ছেলেটাকে ঘুমালে এতোটা স্নিগ্ধ লাগে বলার মতো নয় ঠিক যেনো বছর তিনেকের ছোট্ট শিশু।
কিছুটা আনমনা হয়ে এসব ভাবতেই ভাবতেই বিধানের কপালে আসা চুলগুলোকে সরিয়ে কপালে চুমু খেলো আর নাকে নাক ঘষে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ভালোবাসি। বড্ড ভালোবাসি তোমায় তোমার আড়ালেই!
বিধান বিথীর এই কাজে অবাক নয় আশ্চর্য হলো। হওয়ারই কথা যেই মেয়েটা তার সামনে সবসময় তার হতে দূরে থাকতে সে কিনা নিজে থেকেই তাকে আজ ভালোবাসার স্পর্শ দিলো। আবার ভালোবাসিও বলল। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা সে কতটা সুখকর ও মাধুর্যময় তা সে জীবনে প্রথম বুঝতে পারছে।
বিধান মনে মনে বলল, আমিও ভালোবাসি……শুধুই তোমাকে তবে এখন তোমার আড়ালে নয় তোমার সম্মুখেই!
তারপর বিধানের মাথাটা আলতো করে বুক থেকে সরিয়ে বালিশে রাখিলো এবং নিজেও ধীরগতিতে উঠে বসলো যাতে বিধানের ঘুম না ভাঙে। বিধানের শার্ট দিয়ে কোনোরকম গা ঢেকে যেই না উঠতে যাবে বিধান এক হেচকা টানে বিথীকে বিছানায় ফেলে বিছানার সাথে চেপে ধরলো। বিথী তো ঘটনার আকষ্মিকতায় পুরোই থম ধরে গিয়েছে। যাকে বলে একদম স্তব্ধ।
বিথীর স্তব্ধতা ভাঙিয়ে বিধান বলে উঠলো, কি করছিলে একটু আগে!
বিথীর উপর যেনো আকাশ ভেঙে পড়েছে কথাটা শুনে। কিছুটা এমন ভঙ্গিমাতেই সে।বিধানের দিকে তাকালো। বিধানের বিথীর এমন কাণ্ডে মুখ ফেটে হাসি এলেও সে দাঁতে দাঁত চেপে তা আটকালো। বরং আরও গম্ভীর ভঙ্গিমায় বিথীর দিকে তাকিয়ে থাকলো।
এদিকে বিথী মনে মনে ভাবছে, বিথী হারামী তুই কি করলি? এখন তোকে না জানি কতটা লুচু ভাবছে বিধান! এ্যা এ্যা! আমি এখন কি করবো!
বিধান বিথীকে কিছু একটা ভাবতে দেখে আবার গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি হলো বলে কি করছিলে?
বিথী ক্যাবলাকান্তের মতো একটা হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ক_ই ক-কিছু করিনি তো!
বিধান শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, তাহলে আমার এখানে ( কপাল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) কি কোনো হাতি চুমু দিয়েছিলো?
বিথী হাতি বলায় রেগে বোম হয়ে বলল, কি বললেন আমি হাতি!
বিধান দুষ্টু হেসে বলল, তুমি তো কিছু করোনি যে করেছে!
বিথী আবার রেগে বলল, তো আমিই তো করেছি! আমি কোনদিক দয়ে হাতি হ্যাঁ? আপনি একটা মাথামোটা!
বিধান এবার বিথীর কপালে চুমু দিয়ে বলল, তাহলে মেনে নিলে তুমিই চুমু দিয়েছো আবার আমাকে মাথামোটাও বললে…….এখন তোমাকে কি শাস্তি দেয়া যায় বলো তো!
ইথীব করুন চোখে বিথীর দিকে তাকালে বিধান বললো, আচ্ছা যাও সহজ শাস্তি দিবো বিকজ আই লাভ ইউ!
বিথী কথাটায় ভিষণ খুশি হলেও তা বেশিক্ষণের জন্য স্থায়ী হলো না কারণ বিধান ঠোঁট কামড়ে বললো, আজ আমরা একসাথে শাওয়ার নিবো!
বিথী বারবার না করলেও বিধান কি শুনে আর তার কথা।
সন্ধ্যা, সবাই নাস্তা করে বের হলো বিচের উদ্দেশ্যে। বিচটা রেজর্টের থেকে অনেক কাছেই তাই বেশি হাটতে হলো না সবার। সবাই অনেক ইঞ্জয় করলেও বিথীর প্রচণ্ড বিরক্তবোধ হচ্ছে। তার কারণ বিধান ও দিশার হাসাহাসি ও মাত্রাতিরিক্ত বন্ধুসুলভ আচারণ। তাছাড়া দিশাকেও বিথীর মতো আগলে রাখছে বিধান যা শুধু বিথীর কাছেই নয় আশা ও আরিশার কাছেও দৃষ্টিকটু লাগছে। তারা তো একবার বিথীকে বলেও ফেলেছে একথা।
আশাঃ এই বিথী শোন! এই মেয়েটাকে কিছু বলতে পারিস না।
বিথী মলিন হেসে জিজ্ঞেস করলো, কেন আপু?
আরিশাঃ তোর চোখে কি ছানি পড়েছে নাকি! দেখিস না জিজুর সাথে কেমন হাসাহাসি করছে আবার কথায় কথায় জিজুর কাধে-হাতে হাত রাখছে!
বিথীঃ আরে তোমরা বেশি ভাবছো। ও কিছু না উনারা কাজিনস আবার বেস্টফ্রেন্ড তো তাই আর কি……
আশাঃ আচ্ছা! তুই যা ভালো বুঝিস……..তবে দেখিস তুই যেটাকে ইঁদুরের গর্ত ভাবছিস সেটা না আবার সাপের গর্ত হয়।
বলেই আশা আরিশাকে নিয়ে চলে গেলো। আর বিথী একই জায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো এবং তার কানে বারবার আশার শেষ উক্তিটিই বাজছে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবছে, নাহ আমিই বেশি ভাবছি! হ্যাঁ আমিই ভুল ভাবছি বিধান তো আমাকে কতো ভালোবাসে।
মনে মনে এসব ভাবলেও ভিতরটা বড্ড পোড়াচ্ছে। বেশ কিছু সময় বিচে থেকে সবাই রেজর্টে ফিরে আসলো এবং যার যার রুমে খাবার পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে গেলো রেস্ট নিতে। বিথী কিছু অর্ডার না করেই রুমে চলে গেলো তাই বিধানও কিছু না বলেও তার পিছু পিছু চলে এলো। বিথী নিজের শাড়ি বদলে একটা কটন ধুতি ও শর্ট কামিজ পড়লো। বিধান আজই বিথীকে এই রূপে দেখছে তাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে বিথীর দিকে তাকিয়ে আছে তবে বিথীর সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার মাথায় তখনও দিশা ও বিধানের কথাই ঘুরছে। আর আশার কথাটা না চাইতেও স্মৃতির পাতায় বারবার ভেসে উঠছে।
বিধান বিথীর অন্যমনস্ক থাকা খেয়াল করে বিথীকে ঝাপটে ধরে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে! খারাপ লাগছে নাকি মাথা ব্যথা? এমন বিষণন লাগছে যে।
বিথী মনে মনে ভাবছে, বিধান আপনাকে কি করে বলবো আপনাকে হারানোর ভয় ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে!
বিধান আবার জিজ্ঞেস করো উঠলো, কি হলো বলো!
বিথী মলিন হেসে বলল, নাহ একটু খারাপ লাগছে আরকি!
বিধান মুচকি হেসে বলল, তাহলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আজ সারাদিন তো অনেক দখল গেলো। বিশেষ করে আমার জন্য……..রাতটা নাহয় ছাড় দিলাম!
কথাটা বলেই চোখ টিপ দিলো আর মুহূর্তেই যেনো বিথীর সব ভয়, সংশয়, দ্বিধা, কষ্ট লজ্জার আবরণে ঢাকা পড়ে গেলো। বিধান বিথীকে নিজ হাতে খায়িয়ে দিয়ে বিথীকে ঘুমপরীর রাজ্যে পাড়ি জমালো।
চলবে,,,,