সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 50

সূর্যের কড়া রোদে চারপাশ ভীষণ রকমের উত্তপ্ত হয়ে আছে। গরমে সবার মরণ প্রায় অবস্থা। কেউ ফ্যান চালু থাকা সত্ত্বেও রোদের উত্তপ্ততায় ঘেমে একাকার হয়ে আছে তো কেউ এসির ঠান্ডা বাতাসে বাইরের গরম আবহাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাচ্ছে। জেনিদের বাসার ড্রইংরুমে বড় আকারের এসি চালু থাকা সত্ত্বেও দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে দিহান। বারবার রুমাল দিয়ে মুখ মুঁচছে সে। মুছবেই না কেন? জেনির বাবার ঠিক সামনে বসে আছে দিহান। একদম মাথা নিচু করে। তার চোখে-মুখে ভয় স্পষ্ট! জেনিকে হাড়াবার ভয়! আর অন্যদিকে জেনির বাবা মুখে কাঠিন্য নিয়ে তাকিয়ে আছেন দিহানের দিকে। রাগে তার মাথা জ্বলে উঠছে। ইচ্ছে করছে দিহানের গালে দু’একটা চড় বসিয়ে দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে সংজম করে কঠিন গলায় বলে উঠেন উনি,
— “জেনির সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে? নাকি এভাবেই___!”

উক্ত কথাটি শেষ হবার আগেই চমকে মাথা উঁচু করে তাকালো দিহান। অবাক হচ্ছে সে। নিজ মেয়ের ব্যাপারে এভাবে কেউ বলে? এসব উচ্চারণ করতেই তো বিবেকে বাঁধে। অথচ উনি! শুধু বিয়ের কথা বলেও তো সেসবের ইঙ্গিত দেওয়া যেত তাই না? কিন্তু জেনির বাবার কাছে এসব আশা করা নিত্যান্তই বোকামো। কেননা দিহানের জায়গায় যদি বড়লোক ঘরের কোনো ছেলে তার সামনে বসে থাকতো, তিনি নিশ্চয়ই তাকে এসব প্রশ্ন করতেন না। বরং বলতেন জেনিকে বিয়ে করতে অথবা সে জেনিকে ভালোবাসে কি-না সে সব প্রশ্ন! অথচ দিহানের বেলায়! দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিহান। জেনির বাবা উত্তরের আশায় অধির আগ্রহে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। দিহান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
— “আমাদের বিয়ে হয়েছে। আরও দু’তিন মাস আগে।”
— “কি জন্য বিয়ে করেছ তুমি আমার মেয়েকে?”
দিহান অবাক হয়ে বলে,
— “মানে?”

জেনির বাবা হেসে ওঠেন। হেসে হেসে বলে উঠেন,
— “নিশ্চয়ই টাকার জন্য বিয়ে করেছ তাই না? আরে আমি তো বলেছি আমার মেয়ের সাথে ভালোবাসার নাটক করলেই আমি তোমাকে টাকা দিবো। তাহলো বিয়ে করলে কেন? জেনির থেকে বিয়ের নাম করে বেশি বেশি টাকা নেওয়ার জন্য? আমার বলা এমাউন্ট থেকেও কি বেশি টাকা প্রয়োজন তোমার? তাহলে বলো। টাকা দিয়ে দিচ্ছি তোমায়। কিন্তু বিয়ে করার কাজটা ঠিক করো নি তুমি। জেনি অবশ্যই একটা আবেগি মেয়ে। ওর আবেগের সুযোগ নিয়ে রাতের আধারে ওসব করা মোটেও উচিত হয় নি তোমার। অবশ্যই না। এর জন্য জটিল কিছুর মুখোমুখি হতে হবে তোমার।”
জেনির বাবার কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে ভ্রুঁ কুঁচকে এলো দিহানের। এতক্ষন যা একটু ভীতু ভীতু ভাব ছিল তার মধ্যে, এখন সেটার ছিটেফোঁটাও নেই। বরং বিরক্তিতে তার মুখ তিতে হয়ে উঠেছে। এতটা অবুঝ আর বাজে লোক দিহান জীবনেও দেখে নি। অত্যন্ত বাজে লোক হিসেবে জেনির বাবাকে আবিষ্কার করছে আজ। দিহানের যদি টাকার প্রয়োজন হতোই তো সে কবেই নিয়ে নিতো টাকাগুলো। তারজন্য কি দিহানের বিয়ে করতে হবে? এমনি এমনিই তো সে টাকা পেত৷ শুধু শুধু বিয়ে করার কি প্র‍য়োজন? তাছাড়া তার কথা বলার ভাষা। ছিঃ কোনো বাবা নিজের মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলে? মেয়ের প্রতি কোনো দরদই প্রকাশ পাচ্ছে না তার। শুধু যেটা প্রকাশ পাচ্ছে তা হলো দিহানের মতো ছোট ঘরের ছেলের সাথে জেনি কেন বিয়ে করল! দিহান ভ্রুঁ দু’টো আরও কুঞ্চিত করে বলল,
— “আমার টাকার প্রয়োজন নেই শ্বশুড়মশাই। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করেছি পছন্দের বশে। আর সেটা এখন রুপান্তরিত হয়েছে ভালোবাসায়। আপনার টাকার প্রতি লোভ আমার কোনো কালেই ছিল না। আমি শুধু আপনার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। বলতে পারেন বিয়ের প্রস্তাব দিতে এসেছি।”
জেনির বাবা দিহানের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— “এভাবে?”
দিহান একটু লজ্জাবোধ করল অবশ্যই। তবে পরক্ষনেই ভাবলো, সে কেন লজ্জা পাবে? তার যতটুকু সামর্থ সে সেসবই এনেছে। সাত-আট কেজি মিষ্টি, বিভিন্ন ফলমূল, নাস্তা, জেনির জন্য কিছু শাড়ি এই-যা! লজ্জা ভুলে গিয়ে দিহান শান্ত সরে বলল,
— “আমি দুঃখীত আমার বাবা-মাকে আনতে না পেরে। আসলে আপনি এত তাড়াহুড়ো করে বলেছেন যে তাদের জানানো হয় নি এখনও।”
— “তাহলে ওরাও এখন পর্যন্ত জানেনা তোমার কার্যকলাপ?”
এবার বেশ বিরক্ত হলো দিহান। এত ঘুড়ানো পেঁচানোর মানে কি? জেনির বাবার কথার উল্টো পিঠে কিছু বলল না দিহান। ফলে তিনি আবারও বলে উঠলেন,
— “তোমার কি মনে হয় আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিবো?”
— “অবশ্যই! আপনি বাধ্য। ভুলবেন না জেনি আমার স্ত্রী। ও যদি আমার সাথে থাকতে চায় তাহলে আপনি আটকাতে পারবেন না ওকে। আর আপনি কিন্তু এটাও ভালো করে জানেন যে জেনি আমার সাথে আসবেই। এখানে থাকবে না ও। অনতত এখন না।”
কিছুটা হলেও দমে গেলেন জেনির বাবা। কঠিন কণ্ঠে জেনির মাকে জেনিকে আনতে বললেন। কিছুক্ষন পর জেনি এসেও গেল তাদের সামনে। বুকটা কেমন করে উঠল দিহানের। জেনির অবস্থা নাজেহাল। চোখ ফুলে এমন অবস্থা হয়েছে যে প্রায় চোখেই দেখতে পারছে না সে। খুব কেঁদে হয়তো। জেনির বাবা উঠে দাঁড়ালেন তৎক্ষনাৎ। জেনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— “তুমি কি এই ছেলেটার সাথে চলে যেতে চাও? যদি চাও তাহলে এখনই চলে যেতে পারবে। তবে মনে রাখবে এক কাপড়ে একেবারেই চলে যেতে হবে তোমার। হয় আমরা নয় এই ছেলেটা বেছে নিতে হবে তোমার।”
জেনি হালকা হেসে বলল,
— “অবশ্যই তোমরা আমার জীবনে প্রধানতম জন। তবে আমার জীবনে আমি কখনও তোমাকে আমার জন্য ভালো কিছু করতে দেখেনি ড্যাড। কখনও স্বাভাবিক চার-পাঁচটা বাবার মতো হেসে কথা বলতে দেখে নি। সময় নিয়ে ঘুড়তে যাওয়া অথবা আমার জন্য একটু সময় বের করা তো দূরের কথা। হয়তো বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।”
জেনির বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। দিহান উঠে দাঁড়ালো। জেনির হাত ধরে তারা জেনির বাবাকে সালাম করতে নিলেই তিনি সরে দাঁড়ালেন। দিহান হাসলো। হয়তো জানতো এমন কিছুই হবে। যাওয়ার আগে শুধু এতটুকু বলল জেনির বাবাকে,
— “চিন্তা করবেন না। আমি আমার দায়িত্ব থেকে পিছ পা হবো না।”
বেড়িয়ে এলো দিহান আর জেনি। জেনি দিহানের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুটপাতে হাঁটছে। মনটা বেশ শান্ত তার। তবে দিহানের মনে প্রকট চিন্তা। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখলো মাত্র আর পাঁচ’শ টাকা আছে তার। বন্ধু থেকে ধার নিয়েছিল আজকে। প্রায় ছয় হাজারের মতো। সেখান থেকেই এতকিছু কিনে আর মাত্র পাঁচ’শ টাকা আছে তার। কিভাবে কি করবে সে? কতকিছু মেনেজ করতে হবে তার। আজকে মাসের ২০তারিখ। পাঁচ’শ টাকা দিয়ে কিভাবে চলবে পুরো মাস? দিহান যে অফিসে চাকরি পেয়েছে সেখানের বস নিত্যান্তই ভালো। তার প্রয়োজন আছে জেনে পোস্ট খালি থাকায় আজকে থেকেই তাকে অফিসে জয়িন করতে বলেছেন তিনি। তবে এসবে আর আজকে যেতে পারেনি সে। কালকে থেকে যাবে আবার। দিহানের অফিসার বলেছেন ২০তারিখ থেকে ১তারিখ পর্যন্ত যতটুকু কাজ করবে সে, মাসের ১তারিখেই অফিসার সে-কাজের টাকা দিয়ে দিবেন তাকে। তবে বেশি না, পাঁচ-ছয় হাজার টাকা মতো হবে। এ টাকাই তার ধার গুলো পরিশোধ করতে চলে যাবে। বাকি রইল টিউশনি! অফিসের জন্য সেগুলো দিনে করা সম্ভব হবে না তার। রাতে করলে করা যেতে পারে। এবং তাকে করতেই হবে! কেননা টাকা যে নেই তার।
দীর্ঘশ্বাসের সাথে অস্থিরতা বেড়ে গেল দিহানের। জেনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে কিছুক্ষন।

______________________
রান্না ঘরে রান্না করছিলাম আমি। কোত্থেকে রেয়ান এসে রাগি ভঙ্গি করে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রান্নায় ব্যস্ত থেকে বললাম,
— “আপনি হাসপাতালে যান না কেন? সারাদিন বাসায় কি?”
রেয়ান দাঁত কিরমির করে বললেন,
— “যাবো না আমি। ইমার্জেন্সি অপরেসন ছাড়া ওখানে কাজ কি আমার। তোমাকে একা রেখে যাবো না মোটেও।”
— “আমি একা কোথায়? আম্মু আছেন, সোফায় সারাদিন ফোন চালাতে ব্যস্ত থাকা দেবর আছে। এবং মাঝে মাঝে আব্বুও থাকেন বাসায়। তাহলে?”
— “যদি আমিই না থাকি তাহলে ওরা থেকে লাভটা কি?”
আমি কিছু বললাম না প্রতিউত্তরে৷ হাতে থাকা কাঠের চামচটা পাশে রেখে তাকালাম তার দিকে। শান্ত স্বরে বললাম,
— “কি হয়েছে? এত রেগে আছেন কেন?”
— “কেন আবার? জানো না? তোমাকে মানা করেছিলাম না রান্না না করতে? কাজের লোকের অভাব আছে নাকি বাসায়! তুমি রান্না না করলে চলে না?”
— “উহু চলে না।”
বলতে বলতেই আবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি। উনি কিছুক্ষন ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে৷ তারপর হুট করেই পাজাকোলে তুলে নিলেন আমায়। সিঁড়ি দিয়ে রুমের দিকে যেতে যেতে জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে উঠলেন,
— “আম্মু! রান্নাঘরে কি যেন পুড়ে যাচ্ছে দেখো তো।”
প্রতিউত্তরে নীলা রাহমান আর নুহান হেসে উঠল। আমি লজ্জায় যেন এখনই মাটিতে মিশে যাবো। রেয়ান বাঁকা হাসলেন। রুমে নিয়েই হাতে একটা সুটি কাপড়ের ঢোলাঢালা জামা ধরিয়ে দিলেন। তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে আবারও চলে গেলেন রুমের বাইরে। আমি কিছুক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম বিস্ময়ে৷ পরক্ষনেই চলে গেলান রেডি হতে। অত:পর রেডি হওয়া শেষে আমাকে একটা পার্কে নিয়ে গেলেন রেয়ান। উদ্দেশ্য পুরো পার্কে হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটবেন আমাকে নিয়ে।
.
.
চলবে…