সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 49

.
আকাশ মেঘলা মেঘলা হয়ে আছে। দমকা হাওয়া বইছে চারদিকে। সেখান থেকে কিছু বাতাস জালানা দিয়ে পর্দা পেরিয়ে পুরো ঘর ভরপুর করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে এসে ছুঁইয়ে দিচ্ছে আমার পুরো মুখশ্রী। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিছানায় অঘোরে ঘুমাচ্ছেন রেয়ান। সাথে আমাকেও আটকে রেখেছেন নিজ বাহুডোরে। এদিকে বিকাল প্রায় ৪টা বেজে ২২মিনিট। এতক্ষন বিছানায় না ঘুমিয়ে শুয়ে থাকতে অতি মাত্রায় বিরক্ত লাগছে আমার। শোয়া থেকে উঠার জন্য একটু প্রয়াস করতেই রেয়ান নিজের বাহুডোরে আরও আবদ্ধ করে নেন আমায়। গলায় নাক ঘেষে ঘুমু ঘুমু স্বরে বলে উঠেন,
— “এত নড়াচড়া কেন করো হাঃ? ঘুমাতে দাও। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।”
— “বিকাল হয়ে গেছে। ৪টার বেশি বাজে এখন। এতক্ষন ঘুমাতে হবে না আপনার। উঠুন! আব্বু-আম্মুকেও তো তাদের নানা-নানু হওয়ার সংবাদ দিতে হবে তাই না?”
আমার কথায় পাত্তা দিলেন না রেয়ান। নিজের মতো করে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তুমি এত নরম তুলতুলে কেন মরুভূমি? আগের থেকেও বেশি নরম তুলতুলে হয়ে গেছ। ইচ্ছে করে সারাদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে থাকি আর ঘুমাতে থাকি!”
উনাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে বসলাম আমি। রেয়ান মুখ একটুখানি করে ফেললেন মুহুর্তেই। পরক্ষনেই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। পেটে মুখ গুঁজে আদুরে কণ্ঠে বলে উঠলেন,

— “দেখেছিস তোদের মাম্মাম কেমন! তোদের বাবাইকে একটু ঘুমুতেও দেয় না। কত পঁচা দেখেছিস! তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে এসে যা আমার বাবুরা। আমরা মিলে তোদের মাম্মামকে শাস্তি দিবো।”
বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকে এলো আমার। বললাম,
— “কি শুরু করেছেন আপনি। উঠুন!”
— “উহুমঃ দেখছো না আমি আমার বাবুর সাথে কথা বলছি। সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। বসে বসে কান্ড দেখতে লাগলাম তার। আর মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। সে আগের নেয়-ই পেটে মুখ গুঁজে আছেন। বিড়বিড় করে বলছেন,
— “আমার বাবুরা! বাবাইয়ের কথা শুনবি সবসময়। মাম্মামকে কষ্ট দিবি না কখনও। মাম্মাম কষ্ট পায় এমন কিছু করবি না। পেটে ধীরে ধীরে কিক দিবি। জোড়ে দিবি না মোটেও। এতে মাম্মাম ব্যথা পাবে। কষ্ট পাবে! আর আমার পিন্সেস কিংবা পিন্সরা তো অনেক ভালো। তারা এমন কিছুই করবে না যাতে মাম্মাম কষ্ট পায়। তাই না?”
নিজ মনেই বিড়বিড় করে বলছেন রেয়ান। যা স্পষ্ট কানে আসছে আমার। তার এমন অদ্ভুদ সব কান্ডে হাসলাম আমি। পরক্ষনেই লেগে গেলাম তাকে শোয়া থেকে উঠাতে। উনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। আমি তার চাহনী উপেক্ষা করে বলে উঠলাম,
— “ফ্রেশ হয়ে আসুন যান। আর একটা কথাও না। ফ্রেশ হয়ে দু’জনে মিলে নিচে যাবো আব্বুর কাছে। এখন ফ্রেশ হতে যান।”
আগত্যা উনি ফ্রেশ হয়ে এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। হাতের তোয়ালে আমার দিকে এগিয়ে একটু ঝুঁকে বলে উঠলেন,
— “মরুভূমির রাজ্যের রাণী! আমার মুখটা একটু মুছে দিবেন প্লিজ!”
আমি এক ধরণের ভাব নিয়ে মুছে দিলাম তার মুখ। রেয়ান দুষ্টুমী করে একহাত পেটে রেখে অন্য হাত শূণ্যে ভাসমান করে মাথা ঝুঁকে বলে উঠলেন,
— “আপনার এমন দয়ায় আমি ধন্য মরুভূমি রাণী।”
আমি হাসলাম। টেনে নিচে নিয়ে গেলাম তাকে। নিচে যেতেই ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন রেয়ান। আমি চলে গেলাম রান্নাঘরে। নীলা রাহমানের সাথে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম মুহুর্তেই। এদিকে রাহুল আহমেদ সোফায় বসে খবরের পত্রিকা পড়ছেন। রেয়ান ক্ষাণিকটা গভীর কণ্ঠে তাকে ডেকে উঠলেন,
— “আব্বু!”
রাহুল আহমেদ পত্রিকা পড়ার মাঝেই বলে উঠলেন,
— “হুঃ”

রাহুল আহমেদের এমন অমনোযোগী উত্তর দেখে রেয়ান বিরক্ত হলেন। উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
— “আব্বব্বব্বব্বব্বা জানননননননন!”
রেয়ানের এহেন চিল্লানোতে এবার রাহুল আহমেদ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
— “শুনছি তো। চিল্লাচ্ছো কেন? কি বলবে বলো এখন।”
পত্রিকাটা টেবিলে রেখে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন রাহুল আহমেদ। রেয়ান আগের নেয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “তুমি নানা হতে যাচ্ছো আব্বা।”
রাহুল আহমেদ ক্ষাণিটা সময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
— “কি বললে? আবার বলো তো!”
— “তুমি নানা হচ্ছো।”
রাহুল আহমেদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। পরক্ষনেই তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলেন,
— “এত ভালো খবর আর তুমি এ কথাটা আমাকে এভাবে বলছ! যাও দোকানে গিয়ে কয়েক কেজি মিষ্টি নিয়ে এসো। তারপর আবারও হাসি-মুখে এ সংবাদটা আমাকে দিবে। যাও এখন। তা নাহলে বউমার কাছেও ঘেষতে দিবো না তোমাকে।”
হতভম্ব হয়ে রাহুল আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন রেয়ান। তার বাবা যে কোন প্রজাতীর মানুষ তা ভেবে পান না উনি। উনার মতে হিটলারকেও হার মানাবেন রাহুল আহমেদ।
_______________________
বেখায়ালী ভাবে জেনির ঘাড়ে থাকা দিহানের চিহ্নগুলো জেনির মা দেখে ফেলেছেন। যা মূখ্য করে জেনির বাসায় রিতিমতো একটা ঝড় বয়ে গেছে। জেনির বাবা-মা যা নয় তা বলেছেন জেনিকে। জেনির ফোন নিজের কাছে নিয়ে তাকে রুম বন্দী করে ফেলেছেন জেনির বাবা। জেনি অন্ধকার রুমে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মাত্র। ইতিমধ্যে জেনির বাবা দিহানকে ফোন করে আসতে বলেছেন তাদের বাসায়। এদিকে দিহান জেনিকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে এসে সোফায় বসেছিল মাত্র। এমন সময় জেনির ফোন আসতেই ফোনটা রিভিস করে সে। তবে জেনির বদলে জেনির বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে কানে। একরাশ অস্থিরতা নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে দিহান। কি হয়েছে তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে দিহান। জীবনের কোনো কঠিন মুহুর্তের সাথে লড়াই করতে হবে তার। তবে যে করেই হোক না কেন জেনিকে তার চাই-ই চাই। নাহলে যে সে শূণ্যে ভেসে উঠবে আরও একবার!
দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিহান। মানিব্যাগে মাত্র ১হাজার টাকা আছে তার। এটাই এ মাসের তার শেষ সম্বল। অথচ এ টাকাটাই খরচ করে ফেলতে এখন। প্রথম নিজ শ্বশুড় বাড়ি যাবে সে। কিছু তো কিনে নিয়ে যেতে হবে দিহানের। তবে কি নিবে? ১হাজার টাকা দিয়ে কিছু নিয়ে গেলেও জেনির পরিবারের কাছে সেটা কমই মনে হবে। না! আজকে জেনির বাসায় যেতে পারবে না সে। বন্ধুদের কাছে কিছু টাকা ধার করে তারপর কালকে একেবারে যাবে। কিন্তু জেনির বাবা যে এখন যেতে বলল! এখন কি করবে সে? আর ভাবতে পারলো না দিহান। মাথায় চিনিচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।

_________________________
রাত প্রায় ১২টা। ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর আমার পেছনে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান। বাতাসের গুনগুন শব্দ কানে এসে বারি খাচ্ছে আমাদের। চোখের সামমে ভাসমান হয়ে আছে ব্যস্ত শহরের নিস্থব্ধ মুহুর্ত। হঠাৎ আমার চুল ঠিক করে দিতে দিতে রেয়ান বলে উঠলেন,
— “অগো শুনছেন মরুভূমি রাজ্যে মহারাণী!”
— “জ্বী বলুন দুষ্টুরাজ্যের দুষ্টরাজা।”
আমার কথায় হাসলেন রেয়ান। বললেন,
— “ওই দিন এসে যাচ্ছে মরুভূমি! যেখানে আমি নিজ হাতে আমার সন্তানকে পৃথিবীতে আনবো। কতটা ভাগ্যবান আমি মরুভূমি। কল্পনা করতে পারো?”
প্রতিউত্তর দিলাম না আমি। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। আরেক দফা হাসলেন রেয়ান। আমার চুলে মুখ গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
— “ওগো মরুভূমি রাজ্যের মহারাণী,
ওগো আমার মনের রাজ্যের চাবিকাঠি!
লজ্জা পেয় না প্রেয়সী
বুকে চিনিচন ব্যথা হয় বড্ড।
তোমার হাসিতে যখন পুরো পৃথিবী হেসে ওঠে
বিশ্বাস করো! সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে আমার তোমার মাতাল করা কেশের ঘ্রাণে মরণ প্রায় আমার।
ওগো রুপবতী! এতটা মায়া কেন তোমার?
মেরে ফেলতে চাও কি আমায়?
যদি তাই-ই চাও, তাহলে তুমি প্রতিবারই অক্ষম হবে। কেননা তোমার মায়াতে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছি আমি, চাইলেও পিছু ছাড়াতে পারবে না তুমি!
ওগো মায়াবতী! আবারও বলছি আমি,
মনে গেঁথে রেখ কেমন
ভালোবাসি শত বছর!”
.
.
চলবে….