আলোছায়া !! Part- 30
বুকসেল্ফ থেকে সমররেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী বইটি নিয়ে বিছানায় এসে বসলো পুষ্প। বইয়ের পাতা খুলে তা বিছানায় রেখে হাত দিল চুলে। খানিকক্ষণ আগেই মাথার ব্যথায় অতিষ্ঠ হয়ে মাথায় পানি ঢেলেছে সে। যার পর থেকেই ভেজা জবজবে চুল নিয়ে তার শুরু হয়েছে হাঁচি। শরীরের ভেতরটাও ম্যাজম্যাজ করছে। শীত করতে শুরু করেছে এই প্রবল গরমের মাঝেও।
আঁধভেজা চুলেই হাত খোপা করে বিছানায় শুয়ে পড়লো পুষ্প। পাশের বইটি হাতে নিয়ে চোখ বোলতে শুরু করলো পাতার পর পাতা।উপন্যাসটির জয়িতা চরিত্রটি খুব করে টানে তাকে। হতে ইচ্ছে করে তার মতো শক্ত মনোবলের একজন নারী। মনোবল যে তার শক্ত নয় তেমন নয়, তবে কোথাও একটি শেকড়ে পা বাঁধা থাকায় বারবার উষ্ঠা খেয়ে পড়ে সে। চেষ্টা করেও পারেনা জয়িতাকে অনুসরণ করতে। তাদের সমাজের কারণে নাকি নিজের মনোবলের অভাবে? ঠিক কী কারণে পেরে উঠে না সে? আর প্রেম ভালোবাসার অধ্যায়টি? তার জ্বালে আটকা পড়া থেকে কি রক্ষা পেয়েছিল জয়িতা? পায়নি তো.. বরং স্বার্থক প্রেমিকা হিসেবে সে নিজেকে সপে দিয়েছিল প্রেমিকের বুকে। বুকচিরে বেরিয়ে আসা গভীর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরে শুলো পুষ্প। কাঁপা হাতে বইয়ের পাতা উলটাতেই চোখজোড়া ভিজে উঠলো তার। কল্যাণের মৃত্যুর কাহিনীটুকু পড়তে চোখজোড়া ভিজে উঠে তার। বুকের ভেতরটা অদ্ভুত এক কষ্টে হাহাকার করে উঠে বারেবারে।
সময় নিয়ে চোখের পানি মুছে নিল পুষ্প। মন আবারও বইয়ের দিকে ঘোরাতে চাইলেও পেরে উঠলো না আর। কথায় আছে কষ্ট কষ্ট বাড়ায়। এক কষ্ট থেকে উঠে আসে মনের কোণায় জমে থাকা শতশত কষ্টের কথা। আর তার সাম্প্রতিক কষ্ট.. যার নেই কোনো সীমাপরিসীমা। যার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো রাস্তা.. ভালোবাসা কেন এমন হয়? বিরহ ছাড়া ভালোবাসার গতিপথ কি লেখা যায় না? লম্বা একটি দম ছাড়লো পুষ্প। চোখের পানি আজ বাঁধা মানতে চাইছেনা কোনোভাবে। অথচ আজ সে নিজেকে নিজে কথা দিয়েছিল। কাঁদবে না সে মুবিনের জন্য.. একদম কাঁদবে না। একফোঁটাও কাঁদবে না।
উপরওয়ালা হয়তো আপনাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছে বলেই আমাকে দিয়ে আপনাকে এতটা ভালোবাসিয়েছে.. যে ভালোবাসার ব্যর্থতায় বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় আমার। মুবিনকে কেনো একথা বললো সে? কেনো জানালো তার মনের কথা? ভালোবাসার কথা? নিশ্চয় এখন নিজেকে অপরাধী ভাবছে মুবিন। হয়তো জীবনে এগিয়ে চলতে বারেবারে কথাটি কানে বাজবেও তার। হয়তোবা কখনো থমকে দাঁড়াবে। আফসোস করবে তাকে নিয়ে। বুক ঠেসে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হতেই আবারও পাশ ফিরলো পুষ্প। বাতাসে জোরে জোরে কিছু শ্বাস ফেলে চোখজোড়া বুজলো সে। মুবিন তাকে ভালোবাসে না, তাকে অনুভব করেনা, তার বিয়োগে কষ্টে ব্যথিত হয়না। তবে তার হয়। বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত কষ্ট হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে.. তবে পরক্ষণেই মুবিনের অসহায় মুখের প্রতিচ্ছবি চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই নিজেকে বোঝায় সে। বুকের ভেতরের জ্বলুনি কমাতে দৌড়ে ছুটে যায় বাবার বুকে। এই একটিই নিরাপদ স্থান রয়েছে তার.. যেখানে মাথা রেখে চোখ বুজলেই কষ্ট খানিকটা হলেও কমে আসে তার।
মাথার ভেতরটা খানিকক্ষণ বাদে বাদে দপদপ করে উঠায় উঠে বসলো পুষ্প। এলোমেলো হওয়া চুল মুঠ ভরে চেপে ধরে দুই হাটুর মাঝে মাথা গুঁজে চেপে ধরলো মাথা। বারবার শুধু তাকেই কেনো কষ্ট পেতে হয়? তাকেই কেনো ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়ে আবারও উঠে দাঁড়াতে হয়? এত খারাপ সে? এত পাপ করেছে? নয়তো উপরওয়ালা কেনো সন্তুষ্ট নয় তার প্রতি? চোখজোড়া দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ায় আরও শক্ত করে মাথাটা চেপে ধরলো পুষ্প। বন্ধ হওয়া নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মুখ খুলে নিঃশব্দে একটি চিৎকার দিল সে। সন্ধ্যায় একদফা কান্নাকাটির পর ঠিক করেছিল আর কাঁদবে না সে। মনকে অন্যদিকে ঘোরাতে নানান কাজে নিজেকে ব্যস্তও রেখেছিল। তারপরও কেনো শেষমেশ নিজেকে আটকাতে পারলো না সে? তবে কি সে ব্যর্থ? নয়তো বারেবারে কেনো জীবনের কাছে ব্যর্থ হতে হয় তার? ব্যর্থতার এই গ্লানি নিয়ে আর কত পথ পেরুবে সে?
হাত ঘড়িতে সময় দেখে লিফট ছেড়ে সোজা হাটা ধরলো মেসবাহ। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায় বেশ ধীরপায়ে এগুলো ফ্ল্যাটের দিকে। দরজা খোলা থাকুক, কিংবা মৈত্রী একা ঘুমিয়ে থাকুক.. কোনো কাজেই রাগবে না সে। উল্লাসীর উপর দেখাবেনা কোনো ক্রোধ। তবে ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই সদর দরজা বন্ধ পেয়ে কপাল কোঁচকালো মেসবাহ। বাসার চাবি খুঁজতে টাউজারের পকেট ঘাটলেও তাতে তার অস্তিত্ব না পেয়ে কলিংবেল চাপলো সে।
সেকেন্ড ত্রিশেক না যেতেই ভেতর থেকে উল্লাসী এসে দরজা খুলে দেয়ায় বেশ অবাক হলো মেসবাহ। তবে তার রেশ চোখমুখে না ফুটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ভেতরে ঢুকতেই তার হাত টেনে ধরলো উল্লাসী। একহাতে তাকে শক্ত করে ধরে রেখে অন্য হাতে সদর দরজা বন্ধ করলো সে। তারপর তাকে নিয়ে এগুলো ড্রয়িংরুমের দিকে।
“আপনি চান আমি ম্যাচুউর হই? আমি আপনাকে বুঝি? আপনার মনমতো চলি?”
উল্লাসীর করা প্রশ্নের জবাব দিল না মেসবাহ। কপালের মাঝখানটায় ভাজ ফেলে উল্লাসীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে।
“আমি সবটাতেই রাজী.. সবই করবো আমি। শুধু আপনি আমায় এটুকু বলে দিন সূচনা কোত্থেকে করবো? আমি মাঝেমাঝে ম্যাচুরিটি আনার চেষ্টা করি। কিন্তু তারপর আবার কী হয়ে যায়! আবারও আগের মতোই ব্যবহার করি। কিন্তু এসব করলে তো হবে না। আপনি ঠিক বলেছেন। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে.. আমাকে সবকিছু বুঝতে হবে। সংসার তো আপনার একার নয়। তাহলে সবকিছুতে সেক্রেফাইস আপনি একা কেনো করবেন? আমাকে ইভানা আপুও বুঝিয়েছে। কিন্তু আমি সবকিছু বোঝার পরও অভ্যাসবশত এমন একটা কাজ করে বসি যে পরে অনুশোচনা নয়। কী করে নিজেকে পরিবর্তন করবো আমি?”
অসহায় গলায় বললো উল্লাসী।
জবাবে ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মেসবাহ বললো,
“পরিবর্তন তোমাকে হতে হবে না। তুমি এমনই থাকো। তবে কিছু কাজ বুঝেশুনে করো। প্রতিটি কাজ করার আগেই তার ভালো খারাপ দু’টি দিকই বিবেচনা করো। মিথ্যা বলাটা কমিয়ে দাও। আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো.. আমি কেনো তোমায় ভালোবাসবো না? তুমি আমার স্ত্রী। আর এই একটি কারণই যথেষ্ট সারাজীবন ভর তোমাকে ভালোবাসার।”
চোখজোড়া ছলছলে হয়ে উঠতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উল্লাসী। ভেজা গলায় থেমে থেমে বললো,
“স্যরি.. আমি বারবার আপনার মনে কষ্ট দেই। কিন্তু আমি জানি আপনি মানুষটি কেমন.. ইভানা আপুকেও স্যরি বলেছি। আর কী করতে হবে বলুন?”
“আপাতত কান্নাকাটি বন্ধ করো.. বিয়ের দিন থেকে তোমাকে শুধু কেঁদেকেটে বুক ভাসাতেই দেখছি। এখন কান্নাকাটির একটা প্রতিযোগিতা দিলে তুমি তো শাবানাকেও টক্কর দেয়ার মতো ক্ষমতা রাখবে মনে হচ্ছে!”
হেসে উঠলো উল্লাসী। চোখভর্তি জলের সাথে ঠোঁট ভর্তি হাসির ঢেউ। কী অপরূপ এক দৃশ্য! বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে যাবার মতো দৃশ্য দেখে হেসে উঠলো মেসবাহও।
“আপনার রাগ কমেছে? আপনি জানেন আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কেনো যান এভাবে হুটহাট রাতে আমাদের ফেলে? এনিয়ে চারবার একই কাজ করেছেন।”
“বাব্বাহ! এসব আবার গুণেও রাখা হয়?”
“কেন রাখবো না বলুন? আমার যে বুকের ভেতরটায় শূন্য শূন্য লাগে তা আপনি তো বোঝেন না!”
ঠোঁটের কোণায় হাসি নিয়েই উল্লাসীকে টেনে বুকে নিল মেসবাহ। পরম শান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে আসা হৃদয়ের কম্পন শোনাতে জোরে বুকে চেপে ধরলো তাকে।
“পাগলী একটা!”
মেসবাহর ট্রিশার্টের বোতাম খোঁচাতে খোঁচাতে পূর্ব সুরেই উল্লাসী বললো,
“আপনার আমার পাগলামিগুলো আর ভালো লাগেনা?”
“লাগেনা তেমন না.. ভদ্র পাগলামি গুলো আমার সবসময়ই ভালোলাগে।”
“আর অভদ্র পাগলামিগুলো?”
“সত্যি বলবো?”
“হু..”
“মাঝেমাঝে খুব প্যারা দেয়। তোমার আসলে সময় অসময় বুঝতে হবে। যখন দেখবে আমি খুব ক্লান্ত, মাত্র হসপিটাল থেকে এসেছি তখন পাগলামিগুলো এড়িয়ে যাবে। তখন হয়ে যাবে আমার লক্ষীবউ।”
“ডান.. তাই হবে। কিন্তু আপনি তখন খুশি হলেন কেনো?”
“কখন?”
“ওইযে প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট নেগেটিভ আসার পর!”
উল্লাসীর মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ালো মেসবাহ। কন্ঠে তৃপ্ততা ফুঁটিয়ে বললো,
“আমার তো আর দরকার নেই। মৈত্রীতেই আমি খুশি। আমি আর ওমন পরিস্থিতিতে পড়তে চাইনা যেখানে আমার হৃদয় বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। আমার পুরো পৃথিবী থেমে যায়..”
“তারমানে বলতে চাইছেন আমার কিছু হলে আপনার হৃদয় বেরিয়ে যাবে? আপনি তখন হৃদয়হীন মানবে পরিণত হবেন?”
“এইযে শুরু হলো! কথাটা একটু বুঝেশুঝে বল না মা!”
মেসবাহ বিরক্ত সুরে কথাটি বলতেই খলখলিয়ে হেসে উঠলো উল্লাসী। তার বুক থেকে মাথা তুলে হাসামাখা স্বরেই বললো,
“বাচ্চা আমার আরেকটা লাগবেই চান্দু! তাতে আপনি রাজী থাকুন আর নাই থাকুন!”
“চান্দু কী? এসব কথা তোমাকে কে শেখাচ্ছে?”
ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ। তবে তার সে কথায় পাত্তা না দিয়ে ডাইনিংয়ের দিকে এগুতে এগুতে উল্লাসী বললো,
“আসুন.. খেয়ে নেই। আগে খেয়েদেয়ে দুর্বল শরীর শক্তি সঞ্চয় করি।”
“ডুবে থাকতে চাই আমি সবসময় তোমার খেয়ালে। ঘিরে থাকতে চাই সবসময় তোমার স্মৃতিতে। তোমাকে ছাড়া তো এখন এজীবনই অচল। তোমার জন্যই তো থমকে রয়েছে জীবনের সড়ক।”
“কবি হয়ে গেছেন?”
“ভালোবেসে মানুষ কবি হলে আমার দোষ কোথায়?”
“দোষ? সে তো আপনার দ্বিধাদ্বন্দে.. আপনার ভালোবাসার রঙ প্রতি মুহুর্তে মুহূর্তে বদলায় কেনো বলুন তো?”
পুষ্পর করা প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল মুবিনের। এলোমেলো হয়ে উঠলো চারপাশটা। হাতের পাশে বেজে উঠা ফোনটি কানে নিয়েই সে অস্পষ্ট সুরে বললো,
“পুষ্প?”
“আমি শফিক। তুমি কোথায় মুবিন? দ্রুত এসো একবার হাসপাতালে। চমককে ডিসচার্জ করতে হবে দশটার আগেই। কেবিন তো ভাড়া হয়ে গেছে। ভাই একটু দ্রুত এসো।”
“ঠিকাছে..”
শফিকের কথায় ঘোর কাটলেও আবারও মিইয়ে পড়লো মুবিন। তাকে ভালোবেসে ফেলেছে পুষ্প, সে হয়ে পড়েছে পুষ্পর প্রতি দূর্বল আর চৈতালি তো ভালোবাসেই তাকে। কিন্তু এই ত্রিভুজ জীবনের জটিল চক্রের সমাধান কোথায়?
চমকের ডিসচার্জের কাজ সেরে তাদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল মুবিন। হাত ঘড়িতে সময় দেখে সে তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে একটি সিএনজি ডেকে বাসার ঠিকানা বলতেই পাশ থেকে চৈতালি বললো,
“এখানে বাসস্ট্যান্ড কোথায়? আমাকে বাসে তুলে দিলেও চলবে। আমি একাই যেতে পারবো।”
“কোথায় যাবে?”
মুবিন কপাল কোঁচকাতেই চৈতালি স্বাভাবিক সুরে বললো,
“গ্রামে।”
“গ্রামে? গ্রামে যাবে তুমি?”
“হ্যাঁ.. আমি তো গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম ছেলের চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসা শেষ.. ছেলেও সুস্থ। তাহলে কেনো ফিরে যাবো না গ্রামে?”
সিএনজি চালককে আগ্রহের সাথে তাদের কথোপকথন শুনতে দেখে তাকে বিদায় করে দিল মুবিন। তারপর বেশ স্বাভাবিক সুরেই বললো,
“গ্রামে ফিরে গিয়ে কোথায় উঠবে?”
“আব্বা আম্মার কাছে।”
“তারা তোমায় সাপোর্ট দেবে?”
“কেনো দেবে না? ছেলেমেয়ের উপর যতই কঠিন বিপদাপদ আসুক না কেনো সবশেষে কিন্তু বাবামাই এসে দাঁড়ায় তাদের জন্য। তারা আসলে স্বামী বা প্রেমিকদের মতো চাইলেও ছেড়ে দিতে পারেনা। রক্তের টান.. চাইলেও তো ছিন্ন করা যায়না।”
“আমি তবুও বলবো তুমি যেও না।”
ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটালো চৈতালি।
“কোথায় থাকবো? তোমার বাড়িতে?”
“হ্যাঁ..”
“আর মানুষ? মানুষ কী বলবে?”
ঢোক চেপে আশেপাশে নজর বোলালো মুবিন। সময় নিয়ে গাল চুলকোতে চুলকোতে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমরা তো বিয়ে করবোই..”
“কেনো বিয়ে করবো? তোমার দয়ার পাত্র হতে?”
মুবিনের দিকে প্রশ্নটি ছুড়লেও তার কোনো জবাব না পেয়ে চৈতালি আবারও বললো,
“তিনিদিন আগে আমি বিষয়টি জানতে পারলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম.. বিশ্বাস করো আমি চাইছিলাম। মনপ্রাণ দিয়ে চাইছিলাম পুষ্পর প্রতি তোমার অনুভূতি টুকু যেনো শুধু দূর্বলতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।”
আবারও ঢোক গিললো মুবিন। চিপের কোণা বেয়ে কয়েক ফোঁটা ঘাম ঝড়ে পড়ায় তা মুছে বললো,
“এটা শুধু দূর্বলতাই।”
“তবে আমাকে নিজের কাছে রাখতে কোনো জোর খাটাচ্ছো না তুমি মুবিন?”
“সবকিছু নিজের মতো করে ভাবলে হয়না চৈতালি।”
“নিজের মতো করে ভেবে এসেই তো ভুল করেছি। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আমি পাঁচবছর আগে থেমে থাকলেও অন্যজনও যে থাকবে তেমন তো নয়!”
“কীসের আশায় আমি থাকতাম চৈতালি? তুমি বিবাহিত.. বাচ্চা আছে। স্বামী নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করছো।”
“সুখে শান্তিতে সংসার করলে নিশ্চয় বাচ্চা পেটে নিয়েও আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসিনা।”
“কী বলতে চাইছো তুমি চৈতালি? আমার জীবনে আগানোর কোনো পথ নেই? সুযোগ নেই?”
“আমি তা বলিনি।”
“তবে তুমি বোঝাতে চাইছো সেটাই.. আমি একবারও বলিনি তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। তোমার প্রতি খারাপ লাগা থেকেই আমি তোমায় কল করেছিলাম। আর তুমিই আমায় সেদিন বলেছিলে আমায় নিয়ে যাও। কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তোমায় আনিনি..”
“বলো.. তোমার মনের জমানো কথাগুলো আজ তুমি আমায় বলো। আমিও জানতে চাই আমাকে নিয়ে তোমার মনের জমানো কথাগুলো।”
জলভরা চোখে চৈতালি অবিশ্বাস্য সুরে কথাটি বলতেই লম্বা একটি দম ছাড়লো মুবিন। ক্ষণিকেই মাথা গরম করার মতো স্বভাব তো তার নয়। তবে কেনো এভাবে চড়াও হচ্ছে সে চৈতালির উপর?
“স্যরি চৈতালি.. চলো বাসায় চলো। আমরা বাসায় শান্তিমতো বসে তারপর কথা বলি।”
মাথা নাড়ালো চৈতালি।
“কাউকে একবার ভালোবাসলে তাকে ছেড়ে আসতে হয় না। আর যে ছেড়ে আসতে পারে সে আসলে কখনো ভালোইবাসেনি। বিষয়টি কেনো আমি পাঁচবছর আগে অনুধাবন করলাম না?”
“আমি তোমায় ভালোবাসিনি?”
“হ্যাঁ.. বাসোনি।”
“তুমি বড্ড স্বার্থপরের মতো কথা বলছো.. তোমার সমস্যা কোথায় চৈতালি? পুষ্পকে নিয়ে নতুন করে ভাবায়? নাকি তোমার স্মৃতি আমার হৃদয়ে ফ্যাকাসে হয়ে পড়ায়?”
ব্যথিত স্বরে বললো মুবিন।
জবাবে কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লো চৈতালি। একহাতে ছেলেকে চেপে ধরে অন্যহাতে গাল মুছতে মুছতে বললো,
“আমাকে প্লিজ বাসে উঠিয়ে দাও.. নয়তো আমি কোনো একদিক চলে যাবো।”
হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে অপরিচিত এক নাম্বার দেখে কল কেটে দিল মুবিন। অস্থিরতা নিয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে সে চৈতালির হাত আঁকড়ে ধরতেই আবারও বেজে উঠলো তার ফোন।
“আমাকে ছাড়ো.. আর পুষ্পর ফোন ধরো।”
“পুষ্প নয়। তোমাকে আমি আগেও বলেছি আমার সাথে পুষ্পর আর কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি প্লিজ বাসায় চলো। আমরা সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেব।”
“আমি গ্রামে যাবো মুবিন.. তুমি কলটা ধরো।”
বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেলেও মুবিন নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টায় ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিতেও ওপাশ থেকে ভেসে এল এক মেয়েলী গলার স্বর।
“পুষ্প আর কথা বলছে না মুবিন.. তুমি এমন কথা কেন দিয়েছিলে যা রাখতে পারবেই না?”
(চলবে)