আলোছায়া !! Part- 31 (অন্তিম পর্ব)
বেলা বাজে বারোটা। সকালের পাখিদের কোলাহল বন্ধ হলেও থেমে নেই জনমানুষের জীবন। নতুন দিনের মধ্যাহ্নে কর্মব্যস্ত মানুষেরা লেগে পড়েছে তাদের নিত্যকার কাজে। আশেপাশের সৃষ্ট এই কোলাহল বাসে কিংবা ভিড়ভাট্টায় সর্বদা কানে স্বাভাবিক ভাবে লাগলেও আজ কাঁটার মত বিঁধছে উল্লাসীর কানে। অসহনীয় লাগছে চারিপাশের এই কোলাহল। করিডর ঘিরে পায়চারী করা ছেড়ে দিল উল্লাসী। এক নজর কেবিনের দিকে দিয়ে পাশ ফিরতেই হন্য পায়ে মুবিনকে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তবে তার এই স্বস্তি দ্বিগুণ বেড়ে গেল মুবিনের পেছনে থাকা চৈতালির উপস্থিতিতে। মনের ভেতরটায় তার উৎফুল্লতা ছেয়ে যেতেই কয়েক কদম এগিয়ে চৈতালির হাত শক্ত করে চেপে ধরলো সে। চোখমুখে তার এক তৃপ্তির ঢেউ খেলে যেতেই নজরে পড়লো খানিকটা দূরে মুবিনকে নিয়ে এগুনো মেসবাহর দিকে। তৎক্ষনাৎ বুকের ভেতরটায় কূ ডেকে উঠলো উল্লাসীর। তবে কি চৈতালিকে সাথে করে নিয়ে আসায় মুবিনকে বকবে মেসবাহ? ভাইয়ে ভাইয়ে ঝামেলা হবে? দ্রুত চৈতালির হাত ছেড়ে দিল উল্লাসী। কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে দ্রুত পায়ে এগুলো সে মেসবাহদের দিকে।
“এটা কি রাইট প্লেস চৈতালিকে সাথে নিয়ে আসার? তুই তোর লাইফের ডিসিশন নিয়েছিস.. এন্ড দ্যাটস এনাফ। বাট ইউ হ্যাভ নো রাইট টু হার্ট সামওয়ান ওর হার ফ্যামিলি।”
ভাইয়ের কথায় মাথা নীচু করে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিল মুবিন।
“আমি তাহলে চৈতালিকে কোথায় রেখে আসতাম?”
ভ্রু কোঁচকালো মেসবাহ।
“হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে?”
“হ্যাঁ..”
“তাহলে বাসায় রেখে আসতি!”
“আমার মাথায় কাজ করেনি ভাইয়া। আর না আমার এতটা ধৈর্য ছিল।”
“কেনো ধৈর্য ছিল না? পুষ্প কে? পুষ্প মরুক বাঁচুক তাতে তোর কী?”
“থামুন না! এখন এসব থাক..”
দুই ভাইয়ের মাঝে কথোপকথনে বাঁধ সাধলো উল্লাসী। মিনতির সুরে মেসবাহর উদ্দেশ্যে কথাখানা বলতেই প্রতিত্তোরে বেশ ঝাঁজালো স্বরে মেসবাহ বললো,
“আমি ওর কাজে রীতিমতো অবাক! চৈতালিকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, পুষ্পকে ছেড়েছিস, পুষ্পও তোর মানসম্মানের খাতিরে নীরব আছে। তাহলে তুই আবার কেনো নিজেকে বেজ্জতি করতে চৈতালিকে এখানে নিয়ে এসেছিস?”
“আসলে সময়টাই ওমন ছিল। আমরা মৈত্রীকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যখন বাসায় ফেরার প্লান করছিলাম তখন যেমন পুষ্পর ভাবির কল পেয়ে একদন্ড অপেক্ষা করিনি তেমন মুবিন ভাইও করেনি। পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিল.. মুবিন ভাই হয়তো ব্ল্যাংক হয়ে পড়েছিল। কী করবে ভেবে না পেয়ে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল।”
“ব্ল্যাংক কেনো হয়ে পড়বে? তাও এমন একটি মেয়ের জন্য যাকে জীবন থেকে সরালেই নিস্তার পায় সে?”
মেসবাহর প্রশ্নে ব্যাকুলতা নিয়ে মুবিন বললো,
“নিস্তার পাইনা ভাইয়া.. আমি নিস্তার পাই না। আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেও পুষ্প বা চৈতালি কেউ আমার জন্য কষ্ট পাক তা কখনোই চাই না।”
“কিন্তু মুবিন ভাই আপনাকে তো একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে.. কষ্ট একজনকে পেতেই হবে। তবে আপনার এই সিদ্ধান্তহীনতা কারণে আপনারা তিনজনই কষ্ট পেয়ে যাচ্ছেন। আর বেচারি পুষ্প তো…”
বুকের ভেতরটা হু হু উঠলো মুবিনের। অসহায় মুখে সে উল্লাসীর দিকে তাকাতেই সে আবারও বললো,
“জ্ঞান ফিরেছে। জ্বরের পরিমাণ বেশি হয়ে পড়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।”
কেবিন থেকে বেরিয়েই দরজার সম্মুখে বাচ্চাসহ একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল সোহানা রহমানের। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরতেই তিনজনের জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। চোখমুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে মুবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার আসলে ভুল হয়েছিল তোমায় কল করায়। আমার বোঝা উচিৎ ছিল যে ছেলে তার অতীতে এভাবে মিশে আছে সে কী করে দুই দিনের পুষ্পর জন্য সব কিছু ফেলে ছুটে আসবে?”
সোহানা রহমানের কথায় উপস্থিত তিনজনের মাথা নুইয়ে পড়ায় গলার জোড় বাড়ালেন তিনি। নজর ঘুরিয়ে মেসবাহর দিকে দিয়ে বললেন,
“আমার সাথে সবটা শেয়ার করে পুষ্প। আমিও সব শুনে সঠিক পথের সন্ধান দেবার চেষ্টা করি। বিশ্বাস করুন আজ সকালে ওকে ডাকতে গিয়ে যখন ওর নির্জীব শরীরটা দেখলাম, আমি কেমন যেনো পাগল হয়ে পড়লাম। পুষ্প আর সুইসাইড? অসম্ভব! আমি চিনি ওকে। জানি কতটা কঠিন পথ পেরিয়ে আজ ও এসেছে এখানে। পূর্বেই যেখানে ভেঙে পড়েনি সেখানে এখন তো অবশ্যই নয়। তবে ওকে এত করে ডাকার পরও যখন ও উত্তর করছিল না বিশ্বাস করবেন না আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল। আমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে বাবাকে, পাপনকে কলও করছিলাম। তবে কারো কোনো সাঁড়া পাচ্ছিলাম না.. পালস চেক করছিলাম, নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা দেখার চেষ্টা করছিলাম। তবে ওই যে অস্থির মন আমার! কিছুতেই মানতে চাইছিল না.. বরং একরাশ আতংকে আমি দিশেহারা বোধ করছিলাম। শেষমেষ তাই কোনো উপায় না দেখে কল করে বসলাম আপনাকে আর মুবিনকে। আপনি দ্রুত হাসপাতালে নেবার কথা বললেন.. কিন্তু বিশ্বাস করুন এই বিষয়টি একদম মাথায় আসেনি আমার। বিপদে পড়লে এভাবেই কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে বসে মানুষের?”
মাথা নাড়লো মেসবাহ। বিলম্বে বললো,
“এটা স্বাভাবিক। মাথায় চাপ পড়লে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যায়।”
মেসবাহর কথাটি কানে এলেও তাতে দৃষ্টিপাত করলেন না সোহানা রহমান। পূর্ব সুরেই তিনি বললেন,
“মেয়েরা বরাবরই আবেগী স্বভাবের হয়। আর মায়েরা হয় বাস্তববাদী, শক্ত মনোবলের অধিকারী। তবে আমি হয়তো এখনো পুরোদমে পুষ্পর মা হয়ে উঠতে পারিনি৷ পারলে অবুঝের মতো মুবিনকে ডাকতাম না যার দেখা পেয়ে পুষ্পর কষ্ট কমবে না। বরং আরও দ্বিগুণ বাড়বে। আমি বাস্তববাদিতার পরিচয় না দিয়ে আবেগী এক নারীর পরিচয় দিয়েছি। অথচ আমি যখন ওদের বাড়িতে নতুন বউ হয়ে আসলাম তখন বাবা বলেছিলেন, ননদকে কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে। তাতে আর যাইহোক ক্ষতি হবে না। আমি জবাবে মাথা নেড়েছিলাম.. পুষ্পকে আমার ঘরে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। মেয়েটি তখন খুব মনমরা ছিল.. চুপচাপ ছিল। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতো না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দিত.. দিত না। তবে সময় যত গড়াতে শুরু করলো আমি ততই ওকে বুঝতে শুরু করলাম৷ ওর মাঝের প্রতিবন্ধকতাগুলো ধরে ফেললাম। ধরে ফেললাম ওর ভালোলাগা, খারাপলাগাগুলো। ও আমার কাছে বরাবরই এমন এক ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ছিল যাকে স্নেহ দিয়ে আমি এতদূর এনেছি৷ ও প্রাণখুলে হাসতে শিখেছে, কথার ফুলঝুরি খুলে বসতে শিখেছে আপনজদের সাথে। ওকে আমি শিখিয়েছি একটি ব্যর্থতা কখনোই জীবনের প্রাপ্তি নির্ধারণ করেনা। নির্ধারণ করে তোমার মনমানসিকতা, জীবনকে নিয়ে তোমার ভাবনা।”
ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন সোহানা রহমান। মুবিনের আসহায় মুখের দিকে চেয়ে মায়া হলেও নিজেকে সামলে আক্ষেপের সুরে বললেন,
“অভাব জিনিসটি পুষ্প কখনো দেখেনি। বাবা কখনোই পুষ্পকে অভাবের মুখ দেখতে দেয়নি। বাবা চেয়েছিল ভালো চরিত্রের একজন মানুষের হাতে তার এই ছোট্ট মেয়েকে তুলে দিতে। যে ওকে আগলে রাখবে, বুঝবে, ভালোবাসবে। তবে তুমি মোটেও তেমন মানুষ নও মুবিন। ওর বাবা আর ভাই যদি জানতে পারে তুমি অন্য আরেক মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পুষ্পকে ছেড়েছো, তাহলে এখান থেকে তুমি সম্মানের সাথে ফিরতে পারবেনা। তবে পুষ্প যেহেতু চায় না তুমি ওর বাবা বা ভাই দ্বারা অসম্মানিত হও তাই বলছি চলে যাও। সঙ্গে আনা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যাও। আমার ভুল হয়েছে তোমাকে কল করে। আমি ভুল করে ফেলেছি.. তবে তুমি মেয়েটিকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও।”
“পুষ্প?”
অস্পষ্ট সুরে মুবিন পুষ্পের নাম আওড়াতেই পাশ থেকে উল্লাসী বললো,
“পুষ্প ভালো আছে.. আর ভাবিও ঠিক বলছেন। আপনি বরং চৈতালি আপুকে নিয়ে চলে যান। আর যদি না যেতে চান তাহলে সিদ্ধান্তও সেভাবেই নিন।”
সিদ্ধান্ত..সিদ্ধান্ত.. সিদ্ধান্ত! মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে একটি সিদ্ধান্তে স্থায়ী হতে পারছেনা কোনোভাবেই। বুকচিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো মুবিন। অস্থির মন তার বারেবারে বলছে এবার সময় এসে গেছে। এমন দমবন্ধ অবস্থায় মাথায় হাজারো দায়বদ্ধতা নিয়ে ভীষণ অসহায় বোধ হয় তার। বেঁচে থাকা কঠিন মনে হয় এপৃথিবীর বুকে।
“পুষ্প?”
কেবিনে ঢুকেই তন্দ্রাঘোরে থাকা পুষ্পকে দুর্বল গলায় ডেকে উঠলো চৈতালি। তবে বিপরীতে সেদিক থেকে কোনো সাঁড়া না পেয়ে বেডের দিকে এগিয়ে এল সে। পাশে রাখা টুলে বসে ক্যানোলা পড়ানো হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই খানিকটা নড়ে উঠে চোখজোড়া মেললো পুষ্প। ঝাপসা দৃষ্টিতে মাঝবয়েসী এক মেয়ের কোলে বাচ্চা এক শিশুকে দেখে আবারও চোখ বুঝতেই পাশ থেকে আবারও ডাক শুনতে পেল সে।
“আমি চৈতালি.. মুবিনের সাথেই এসেছি তোমায় দেখতে.. মন খারাপ করোনি তো? করলেও করতে পারো। এটুকু অধিকার অবশ্যই তোমার আছে। আমার ভাবনা অনুযায়ী যে তুমি চলবে তেমন তো নয়।”
থেমে গেল চৈতালি। পুষ্পর হাতের আঙ্গুল আবারও স্পর্শ করে পূর্ব সুরেই বললো,
“এটুকু পথ আসতে আসতে আমি ভেবেছি.. অনেক ভেবেছি। নিজেকে নিয়ে ভেবেছি, তোমাকে নিয়ে ভেবেছি, মুবিনকে নিয়ে ভেবেছি। একটা সত্যি করে কথা বল তো? আমি কি তোমায় খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম?”
প্রশ্নটি করে একদন্ড অপেক্ষা করলো চৈতালি। তবে বরাবরের মতোই পুষ্পর দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুকচিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো সে।
“তোমার আজ কিছু হয়ে গেলে আমি বা মুবিন নিজেদের কখনোই মাফ করতে পারতাম না। তুমি জানো মুবিন তোমায় কতটা ভালোবাসে পুষ্প? জানো না তাইনা?”
চৈতালির কথা শেষ হতেই আবারও চোখজোড়া মেললো পুষ্প। চৈতালির কোলে নিশ্চুপ ভঙিতে খেলে যাওয়া বছর দুয়েকের মতো বাচ্চাটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।
“পাঁচবছর আগে যে ভালোবাসা আমি মুবিনের চোখে দেখেছিলাম আজও তা দেখতে পাচ্ছি। তবে শুধু কাল ভেদে মানুষটি ভিন্ন। ভালোবাসার উদাহরণ দিতে গিয়ে সবুজ একবার বলেছিল, ভালোবাসা পরিবর্তন হয় না.. একজন মানুষের হৃদয়ে তার অবস্থান থাকে চিরকাল। শুধু পরিবর্তন হয় ভালোবাসার মানুষটি। যাকে ঘিরে একসময় এক আকাশ স্বপ্ন দেখা হতো তাকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখা না হলেও স্বপ্ন তো থেমে থাকে না। আমি সেদিন তার কথার সাথে সেদিন একমত না হলেও আজ এই অবস্থানে এসে দাঁড়ানোর পর একমত হয়েছি।”
উদাসীন মনে কথাটি বলেই হেসে উঠলো চৈতালি। পুষ্পর ব্যথায় ভরা নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে হাসিমুখেই বললো,
“তোমায় খুব হিংসা হয় আমার… খুব। রাগ করলে?”
এবারে মাথা নাড়লো পুষ্প। চোখেমুখে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে সে চৈতালির দিকে তাকাতেই সে আবারও বললো,
“মুবিন আমায় কল করেছিলো সকলের মতোই সহমর্মিতা দেখাতে.. তবে আমি ভুল বুঝে তার ফায়দা লুটতে চাইছিলাম। বড্ড স্বার্থপরের মতো সময় বুঝে ফায়দা নিয়েও নিলাম। ছেড়ে আসলাম সংসার। যে সংসারের টানে আমার এখনো ইচ্ছে হয়না ফিরে যেতে। আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। প্রাক্তনের স্বামী মারা গেলে কল করে খবর নেওয়া কি পাপ? অসুস্থ সন্তানের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা কি অন্যায়? নাকি প্রাক্তনকে বিভীষিকাময় জীবন কাটাতে দেখেও মুখ ফিরিয়ে নেয়া কোন বোধসম্পন্ন মানুষের কাজ? একসময় মুবিন আমায় পরিবার, সমাজের কথা ভেবে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তবে ঢাকায় আনার পর দায়বদ্ধতার খাতিরে পুরোনো ভালোবাসার জের থেকে হলেও নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছে। বিশ্বাস করো.. আমি খুব করে চাইছিলামও আমদের জীবনটা আবারও আগের মতো হয়ে যাক। তবে আমার এই চাওয়ায় কি আমি সুখী হতে পারতাম? পাঁচ বছর পরেও জীবন একই গতিতে চলবে এটা ভাবা ছিল আমার বোকামি। অনিশ্চিত জীবন যেখানে প্রতি ক্ষণেক্ষণে তার মোড় বদলায় সেখানে পাঁচ বছরে সে একইভাবে কীভাবে থাকে? তাছাড়া আমার তো বেঁচে থাকার মতো অবলম্বন রয়েছে.. আমি বেঁচে থাকতে পারবো। তবে নিজের জীবনে আমি আমার ভালোবাসা পাইনি বলে আজ অন্যকেও পেতে দিব না.. এতটাও স্বার্থপর আমি নই।”
“আপনার মুবিনকে দরকার।”
অস্ফুটস্বরে পুষ্প বলে উঠতেই ম্লান হাসলো চৈতালি।
“মুবিনকে আমার দরকার নেই.. বেশি দূর পড়াশোনা করিনি বলে কি জীবনটাও একা টেনে নিতে পারবোনা আমি?”
চৈতালির হাসিটি পুষ্পর বুকে এসে তীরের মতো লাগতেই আশ্রুবিক্ষিপ্ত চোখে কেঁদে উঠলো সে।
“আমাকে মাফ করুন..”
“বোকা মেয়ে.. কাঁদছো কেনো? মুবিনের নাম আমার কপালে লেখায় ছিল না। থাকলে হয়তো পাঁচবছর আগেই ওকে পেয়ে যেতাম আমি। নিজেকে দোষী ভেবো না পুষ্প। তুমি আসোনি আমাদের মাঝে। কারণ আমি আর সে কখনো আমরা হয়েই উঠতে পারিনি।”
পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে পুষ্পর হাতের মাঝ থেকে হাত সরিয়ে উঠে পড়লো চৈতালি। পাশ ফিরে মুবিনকে দেখেও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে এসে মৃদুস্বরে বললো,
“কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত। আর আমার এই বিপদে হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তোমাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে.. অবশ্যই সুন্দর হবে।”
কেবিন ছেড়ে চৈতালি বেড়িয়ে যেতেই তার যাত্রাপথের দিকে খানিকক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুবিন। বুকের ভেতরটা তার কষ্টে মুচড়ে উঠলেও চৈতালিকে আর থামাবে না সে। ভেবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে এল মুবিন। বেডের এক কোণায় বসে পুষ্পর হাত নিয়ে বুকে চেপে ধরলো তার। গভীর কিছু শ্বাস ছেড়ে ঢোক চেপে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“নিজের ভুলেই একবার হারিয়েছিলাম ভালোবাসা। একই ভুল পূনরায় আর দৌঁড়াতে চাই না পুষ্প..”
মুবিনের বুকের ভেতরের কম্পন স্পষ্ট অনুভব করলো পুষ্প। চোখভর্তি জল নিয়ে সে তার হাত টেনে নিয়ে ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিয়েই ঠোঁটের কোণায় ফুটিয়ে তুললো এক আকাশ হাসির ঢেউ।
যারা কখনোই মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দ্বিধায় পড়েনি তারা ভীষণ ভাগ্যবান। এর কী নিদারুণ যন্ত্রণা তা হয়তো মুবিনের মতো ভুক্তভোগীরাই বোঝে.. মুবিনকে বুঝতে একটু ভুল করেছিল সে। তার মন বারেবারে বলছিলো মুবিন কখনোই অন্য মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে পড়তে পারেনা। তবে আজ যখন মুবিন তার প্রতি বিরক্ত হয়ে মনের জমানো কথাগুলো বিনা সংকোচে বলে দিল তখন আর সেই সন্দেহর জায়গাও রইলো না তার। বাসে করে আসা পথের প্রতিটি মুহূর্ত সে ভেবেছে। মনের গভীরে ডুব দিয়ে নয় বরং মুবিনের অস্থির হয়ে পড়া মুখের দিকে চেয়ে বুকে পাথর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। মুবিন তাকে আর ভালোবাসে না। বরং করুণা করে। আর সেই করুণা নিয়ে মুবিনের অস্থির চিত্ত দেখে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া অনার মতো স্বার্থপর কেনো হবে সে? কেনো অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নিতে নেবে বাজে সিদ্ধান্ত?
“চৈতালি? কোথায় যাচ্ছো? এই চৈতালি?”
পেছন থেকে আসা এক পুরুষালি গলার স্বরে ভাবনার অবসান ঘটলো চৈতালির। থেমে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। লম্বা একটি দম ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় সে লেগে পড়লো বুকের ভেতরের জমানো কষ্টের এক বৃহৎ পাহাড় লুকানোর চেষ্টায়।
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“গ্রামে.. আব্বা-আম্মার কাছে। আমি এখানের কিছুই চিনি জানি না.. আমাকে একটু বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসবেন?”
মাথা নাড়লো মেসবাহ। চৈতালির ঝেমটে পড়া মুখের দিকে একবার তাকালেও দ্রুত নজর সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললো,
“জীবন আশ্চর্য রকমের অনিশ্চিত। আমরা ভীষণ অসহায় ভাগ্য বিধাতার কাছে। ভাগ্য কোথায় কখন আমাদের নিয়ে এসে দাঁড় করায় তা আমরা বুঝতে পারিনা। তবে আমি বলবো গ্রামে যাওয়া তোমার জন্য মোটেও ঠিক হবে না।”
“তাহলে কোথায় যাবো আমি? গল্প সিনেমার মতো কোনো এক দেশে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন পাড় করবো?”
“তুমি আমাদের সাথে থাকো.. আমরা তো দুজনেই থাকি৷”
চৈতালির কথার পিঠে পাশ থেকে বলে উঠলো উল্লাসী।
জবাবে ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকালো চৈতালি।
“না.. ছেলের কথা চিন্তা করেও আমায় ফিরতে হবে, লড়াই করতে হবে। আগেও তো আমায় গ্রামের অনেকেই অনেক কিছু বলেছিল। তাই বলে কি সেখানেই থেমে ছিল আমার জীবন? জীবন যে কারো জন্য থেমে থাকে না তা উপরওয়ালা আজ কঠিন এক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে আমায়..”
ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙে মুখ খুললো মেসবাহ। থেমে থেমে রাশভারি কন্ঠে বললো,
“পুষ্পের প্রতি ভালোবাসা হয়তো মুবিন তখনো উপলব্ধি করতে পারেনি। তবে যখন উপলব্ধি করতে পারলো তখন অনেক হিসেব বদলে গেছে। ভালোবাসা কখন কার জন্য জন্মে তা কেউ জানে না। ভালোবাসা একবারই হয় কথাটি কতটা যৌক্তিক তা আমার জানাও নেই। তবে যদি দ্বিতীয়বার ভালোবাসা না যেত তবে পৃথিবীর শত- সহস্র মানুষ থমকে যেত যা প্রকৃতির স্বাভাবিকতা নয়। আর তাই প্রকৃতি আমাদের ভালোবাসায়.. একে অপরের উপর দূর্বল করে তোলে। দ্বিতীয়বার ভালোবাসলেই যে প্রথম জনকে ভালোবাসেনি এটিও যৌক্তিক নয় কারণ অনুভূতি আপেক্ষিক। তবে হ্যা অবশ্যই একই সময়ে দু’জন ভিন্ন ব্যক্তিকে প্রেমের স্বার্থে ভালোবাসা অন্যায়। এখানে মুবিন ভুল করেছে। তবে চিরন্তন সত্যর মতো এটিও একটি সত্য যে কারো জীবনই পরিপূর্ণ নয়। স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট নিয়েই আমাদের চলতে হয়। এটাই জীবন। অতীত কখনো ফিরে আসে না। এটা সবাই জানে। তবুও মানুষ অতীত নিয়ে পড়ে থাকে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে না পারলে জীবনে সাফল্য আসবে না। শুধুমাত্র অতীত নিয়ে আফসোস করা বন্ধ করতে না পারার কারণে জীবনে ব্যর্থ হবে। হ্যাঁ, মানছি কিছু অতীত ভুলে যাওয়া আসলেই কঠিন। যেগুলো চাইলেও ভোলা যায় না। কিন্তু সেগুলো যদি আপনার ভবিষ্যতের ক্ষতি করে, তবে তার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া জরুরী। এটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আশা করি তুমি অতীত ভুলে আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে চৈতালি।”
ম্লান হাসলো চৈতালি।
“আপনার সাহায্য দরকার। যদিও আমি মুবিনকে বলেছিলাম। তবে আমি আর চাইছি না মুবিন আমার ব্যাপারে সময় অপচয় করুক।”
“কী সাহায্য বলো? অনা তুমি দুজনেই আমার কাছে সমান। অনা যেমন অতীত আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলে আমি ওকে বাঁধা দিতাম তেমন তোমাকেও দিচ্ছি। কারণ জীবনের অর্থ বা স্বার্থকতা.. কোনোটাই অতীত ভেবে কাটিয়ে দেয়াতে নয়। বরং সবকিছু ঝেড়ে ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই।”
মাথা নাড়লো চৈতালি।
“সবুজের সম্পত্তির বিষয়ে। ওর বাবার বাড়িটা কি কোনোভাবে আমি পেতে পারিনা? রেল স্টেশনের পাশেরটা। আসলে চাচা-চাচির সাথে একই সাথে বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে আলাদাভাবে থাকতে চাই।”
“অবশ্যই সম্ভব। আমাদের বাংলাদেশী আইন অনুযায়ী স্ত্রী, সন্তান দু’জনে মিলেই স্বামীর সম্পদের ৭৫% পেয়ে যায়। আমার এক বন্ধু.. উকালতি পেশায় রয়েছে আজ বহুবছর হলো। ওকে দিয়েই কেস ফাইল করে একটা নোটিশ পাঠিয়ে দিলে খুব অল্পদিনের মাঝেই জায়গাজমি তুমি বুঝে নিতে পারবে।”
“এটুকু উপকার করলে আমার খুব উপকার হতো.. অন্তত বাবামায়ের উপরে বোঝা হয়ে থাকতে হবে না। তাছাড়া বিয়ের পর সবুজের চাপে এইচএসসি আমি দিয়েছিলাম.. তবে রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। পড়াশোনাও আগায়নি খুব একটা। এই লেখাপড়া নিয়ে আমার কি কিছু করা সম্ভব?”
“অবশ্যই সম্ভব। প্রাইমারি স্কুলে ঢুকতে পারো। তাড়াছা সবুজ সরকারি কলেজের টিচার ছিল না? এই সুযোগ সুবিধাটুকু তো তোমার পাওয়ার কথা। কলেজ না হলেও তারা অবশ্যই একটি ব্যবস্থা করে দিতেই পারে। আর আমি মনে করি এটা খুব ভালো চিন্তাভাবনা। একজন মেয়েকে অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিৎ। পুরুষ মানুষ ছাড়া নারীরা কেনো চলতে ফিরতে পারবে না? তুমি যথেষ্ট ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছো চৈতালি। আই প্রাউড অফ ইউ। আমি আছি তোমার পাশে।”
ঠোঁটে হাসি নিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো চৈতালি। একে অপরকে ভালোবাসতে অনন্তকালের প্রয়োজন নেই। কিছু মুহূর্তই যথেষ্ট। সেই কিছু মুহূর্ত আর হাসি-কান্নার স্মৃতিগুলো নিয়ে এতকাল প্রতীক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছায়াময় একটি জীবন কাটিয়ে এলেও আজ থেকে সে মুক্ত। এবারে কি তবে দেখা পাবে সে আলোয় ঘেরা প্রতীক্ষাহীন জীবনের? বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলেও পেছন ফিরে তাকিয়ে একবার মুবিনকে দেখার মতো সাহস হলো না চৈতালির। মেঝেতে আঁকানো ফুলপাতার দৃশ্য ঝাপসা দৃষ্টিতে নজরে আসায় চমককে আরও গভীরভাবে বুকে আঁকড়ে ধরলো সে। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ থাকে, যাদের প্রাপ্তির খাতাটা বরাবরই শুণ্য থাকে। প্রকৃতি যেন পণ করে বসে থাকে তাদের হস্ত সর্বদাই রিক্ত রাখার। তার চরিত্রটিও বোধ হয় তেমনই এক পোড়াকপালির। যে বছরের পর পর ভালোবাসা পাবার আশায় অজস্র যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করে কাটিয়েছে দিন। অপেক্ষার প্রহর গুনেছে বছরের পর বছর। তবে বইয়ের শেষের পাতায় এসেও পায়নি তার বুক নিংড়ানো ভালোবাসার কোনো প্রতিফল…
-সমাপ্ত
বিদ্রঃ শেষ পর্বে ধন্যবাদ সেইসকল পাঠকদের যারা যুক্তিযুক্ত আলোচনা করে আমায় সাহায্য করেছেন।❤ বিশেষ করে মাশনুভা আপুকে। ভালোবাসা নেবেন সকলে।