মধুরেণ সমাপয়েৎ !! Part- 04
ভেতরে যেয়ে যেনো মাথার উপর বাজ ভেংগে পড়ে সাফওয়ানের। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখে বিল্ডিং এর সব মহিলা সিনিয়র সিটিজেন সেখানে উপস্থিত। মোটা ষাড় অর্থাৎ বাড়িওয়ালা আবুল কালাম আজাদ সাহেব এবং আর দুজন পুরুষ বেডে বসা। আয়াত তাদের সামনে দাঁড়ানো। গম্ভীর মুখে আজাদ সাহেব কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আলমারির পাশে মায়া মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এখন সাফওয়ানের মাথায় রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই চিন্তা, এতোরাতে বাড়ি ছাড়া হলে কোথায় যাবে!! ভীড় ঠেলে আয়াতের কাছে যেতেই এক মহিলা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,
– তোমার দ্বারা এমন কিছু আমরা কিছুতেই আশা করি নি সাফওয়ান। ভেবেছিলাম তুমি একটা ভালো ছেলে।
সাফওয়ান একটা ঢোক গিলে বলে,
– কি হয়েছে আন্টি, কি করেছি আমি??
আজাদ সাহেব এবার উঠে দাঁড়িয়ে সাফওয়ানের সামনে এসে গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
– আমি আশা করি নাই তুমি এমন কাজ করবা, ভাবছিলাম তুমি আমার ছেলের মতো। কিন্তু বউমারে ঘরে আনছো অথচ আমাদের একবারও জানাইলা না। সে তো মায়া আসছিলো বইলে আমি জানতে পারছি। মেয়েটার একটা জামাও নাই, ও তোমার জামা পড়ে আছে। দুপুরে পরোটা আর ডাল খাইছে। আমাকে বললে খাবার পাঠায়ে দিতাম। যাক গে, বউমা তুমি কিন্তু সংকোচ করবা না। তোমার এই আজাদ চাচা আছেন, তুমি আমার কাছে মায়ার মতোই। তাই কোনো অসুবিধাতে আমাকে স্মরণ করবা। সাফওয়ান আসছে, আমরা এখন যাই। চলেন আপনারা।
– জ্বী চাচা (আয়াত)
– আর সাফওয়ান বিয়েটিয়ে করছো, এখন আর একা না তুমি। তোমার ঘরে একটা বউ আছে, তাই এখন থেকে দায়িত্ববান পুরুষ হইতে চেষ্টা করো। ব্যাচেলার জীবন কিন্তু শেষ।
..
আজাদ সাহেবের কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো সাফওয়ানের। হা করে একবার আয়াতের দিকে আর একবার বাকিদের দিকে দেখছিলো। আয়াত ইনাদের কি এমন বললো সবাই আয়াতকে এতোটা স্নেহ করছে। উপরে মোটা ষাড় যে কিনা সাফওয়ানের সাথে সারাটাক্ষণ ভাড়া ভাড়া করে মাথা খারাপ করে দেয়, সে আয়াতকে বউমা বউমা করে তুলো তুলো করছেন। আয়াতের পরনে একটা নীল জামদানি শাড়ি, যা আয়াতের নয়। তার মানে বিল্ডিং এর একজন আন্টি পরতে দিয়েছেন। হচ্ছে টা কি!!
…
আন্টিরা সবাই আয়াতকে নতুন সংসারের যাবতীয় টিপস দিয়ে যাচ্ছেন। সাফওয়ান ফ্রেশ হয়ে সাদা টিশার্ট আর নেভী থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে নিলো। আন্টিরা যাবার পর আয়াত যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দরজা লাগিয়ে পেছনে ফিরতে দেখে সাফওয়ান তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছে যাচ্ছে। ভেজা চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে, টিশার্টটা বুকের সাথে যেন মিশে আছে। ছয় ফিট লম্বা, সুঠাম দেহী পুরুষ, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ায় পায়ের খানিকটা দেখা যাচ্ছে, ভেজা পায়ের পশম গুলো লেপ্টে আছে। না চাইতেও চোখ তার দিকেই আটকে আছে, ছেলেটার মধ্যে কি যেন একটা আছে।
– এভাবে দেখলে তো নজর টিকা দিয়ে হাটতে হবে।
….
সাফওয়ানের কথায় হুশ ফিরে আয়াতের। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় মাথাকাটা যাবার মতো অবস্থা। মনে মনে বললো,
– আল্লাহ, মাটি টা ফাঁক করো ঢুকে যাই।
আয়াতের কাজে সাফওয়ানের খুব হাসি পাচ্ছে। টেবিলে রাখা ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
– এখানে কিছু জামা কাপড় আছে। আর খাবার নিয়ে এসেছি। আচ্ছা তুমি বিল্ডিং এর লোকদের কি এমন বলেছো যে তারা তোমায় মাথায় তুলে রেখেছে?
– ও, ওইটা। আসলে হয়েছে কি…
দেড় ঘন্টা আগে,
মায়া চলে যাবার পর থেকে একা একা বোর হচ্ছিলো আয়াত। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। হঠাৎ খুব জোরে দরজা ধাক্কা দিলে লাফ দিয়ে উঠে সে, মনে হচ্ছিলো ঘরে ডাকাত পড়েছে। ধীর পায়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে এক দল মহিলা আর ৩ জন মধ্যবয়স্ক পুরুষ ঢুকে পরলো। আকর্ষিত ভাবে এতো মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ায় আয়াত ভয়ে শিটিয়ে যায়। সবাই তাকে মাথা থেকে পা অবধি এমন ভাবে দেখছেন যেন একটা চিড়িয়াখানার জন্তু দেখছে। তাদের মধ্য থেকে মায়া সামনে এসে একজন মোটা ভুড়ি এবং রাজকীয় গোঁফধারী পুরুষকে বলতে লাগলো,
– এই যে, সেই চোর। বলেছি না সাফওয়ান ভাইয়ের কাপড় পড়ে আছে। আবার বলছে সাফওয়ান ভাইয়ের স্ত্রী।
– হয়েছে, এবার তুমি চুপ করে থাকতে পারো।
তাদের কথোপকথনে বুঝতে বাকি রইলো না ইনিই বাড়িওয়ালা। এই লোকটাকেই সাফওয়ান মোটা ষাড় বলে। মানুষটার চেহারা একটু ষাড়ের মতোই। গোলগাল মুখ, রাগী রাগী চোখ, ঠোঁটের উপরে রাজকীয় গোঁফ। মানুষটার উচ্চতা খুবই কম কিন্তু বিশালাকার দেহ; দেহ না ভুড়ি। লোকটি এগিয়ে এসে আয়াতের সামনে দাঁড়ান। তারপর রাগী কন্ঠে বলেন,
– তুমি কে? এখানে কি করো?
– আ…আমি
– কি আমি?? আমি কি
– আ…আমি সা…সাফওয়ানের ব…বউ
– তোতলা নাকি?
– ন….না
– আমি তো জানি সাফওয়ান অবিবাহিত, ব্যাচেলর। কবে হলো তোমাদের বিয়ে।
– আংকেল, আসলে আমরা কালকে পালিয়ে বিয়ে করেছি।
– হ্যা?
– জ্বী, পালিয়ে বিয়ে করেছি। আসলে আমাদের সম্পর্ক চার বছরের, বাবা কাল জোর করে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সাফওয়ান তো ভালো চাকরি করে না, তাই সাফওয়ানকে মেনে নেন নি আংকেল। কি করবো বলুন উপায় ছিলো না আমাদের। তাই আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছি। আমার কাছে কোনো কাপড় ও নেই তাই সাফওয়ানের কাপড় পড়েছি। আমি বাধ্য করেছিলাম সাফওয়ানকে, এখানে সাফওয়ানের কোনো দোষ নেই।
বলেই কান্না করতে লাগলো আয়াত। আয়াতের কান্না রামিম সাহেব ব্যতীত যে কোনো মানুষকে গলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। আজাদ সাহেব আয়াতের মাথায়ে হাত রেখে নরম স্বরে বলেন,
– কিন্তু মা, কাজটি কি তুমি ভালো করছো? তোমার মা-বাবা কতোই না কষ্ট পেয়েছেন বলো।
– আংকেল যদি আমার হাতে উপায় থাকতো আমি কি এরকম করতাম বলুন। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাবা-মা ঠিক একদিন আমায় বুঝবে দেখবেন।
বলতে বলতে গলা ধরে এসেছে আয়াতের। আসলেই কি রামীম সাহেব বুঝতে পারবে তাকে! যদি রামীম সাহেব নিয়ে দেবার জন্য এতোটা অস্থির না হতেন তবে কি আজ এভাবে পালিয়ে আসতে হতো তাকে!
– মা, তুমি আমার সাথে আসো আমার একটা শাড়ি আছে ওইটা পড়বে। নতুন বউ, এভাবে টিশার্ট পড়া মানায় না।
এক আন্টির কথায় ধ্যান ভাঙ্গে আয়াতের। তারপর আন্টি আয়াতকে শাড়ি পড়িয়ে দেন, আয়াত সবার জন্য কফি বানায়। একটা আড্ডার আমেজ তৈরি হয়। মায়া মুখ কালো করে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। আয়াতের বুঝতে বাকি নেই মেয়েটা তাকে চরম অপছন্দ করে। ঢাকার ব্যাতিব্যস্ততার মাঝে কোনো অপরিচিত মানুষও এতোটা আন্তরিক হতে পারে এটা যেনো কল্পনার বাহিরে আয়াতের জন্য। মানুষগুলোকে মিথ্যে বলতে একদম ভালো লাগছে না তার। কিন্তু করার ও কিছু নেই; নয়তো সাফওয়ানকে ঘর ছাড়া হতে হবে।
ফ্লাসব্যাক শেষ হলে দেখে সাফওয়ান হা করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তুড়ি দিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে,
– কি হলো, এভাবে ক্যাবলাকান্ত এর মতো কি দেখছেন?
– তুমি অভিনেতা হলে কিন্তু ভালো নাম কামাতে পারতে।
– তা তো আমি জানি।
– কিন্তু মিথ্যে কথা না বললেই পারতে।
– কি করবো বলুন! আপনার প্রেমিকা পুরো আটঘাট বেধে এসেছিলো। আপনার সুপ্ত প্রেমকে কলি থেকেই উঠিয়ে ফেলার জন্য সরি। বাট আই হ্যাড নো চয়েজ।
– কিহহ! কিসের প্রেমিকা, ও আমার কেউ লাগে না।
– ন্যাকা, যেন কিছু বুঝে না। ওখানে কেউ না থাকলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতো।
– আজিব, আমি তো ব্যাচেলর তাই না? সত্যি সত্যি বিয়ে করলে এ বাড়িতে তুলবো কিভাবে?
– বিয়ে করে বউকে নিয়ে এই চিলেকোঠায় উঠবেন নাকি?? আর উঠলেও বলবেন আমি দা নিয়ে আপনাকে দৌড়ানি দিয়েছিলাম, আমাকে তালাক দিয়ে দিয়েছেন।
– ধন্য তুমি, ইফাদের সত্যি কপাল পুড়েছে।
ইফাদের কথা শুনতেই উজ্জ্বল মুখটা মিয়ে গেলো আয়াতের। সাফওয়ান আয়াতের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে ইফাদের খোঁজ এখনো পায় নি। আয়াতের মন ভালো করতে বললো,
– আমি আজকে গ্রিল নিয়ে এসেছি। ভালো খেতে, এখনো গরম আছে চলো খেয়ে নেই।
– আমার খিদে নেই
– এই দেখো, আমি এতোদিন একা একা খেয়েছি। আজ তুমি আছো, আমি চাই না একা একা খেতে। চলো না প্লিজ
সাফওয়ানের জোড়াজুড়িতে না পেরে শেষমেশ খেতেই হলো আয়াতকে। খাওয়া দাওয়া শেষে আয়াত বেডে আর সাফওয়ান নিচে বিছানা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো। সারাদিনের ক্লান্তি আর কালরাত না ঘুমানোর জন্য সাফওয়ান শুতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো। কিন্তু আয়াতের চোখে যেন ঘুম নেই। মনে যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এপাশ ওপাশ ফিরে যখন ঘুম আচ্ছিলো না তখন উঠে ছাদে চলে যায় সে। ফোনে ইফাদের নাম্বার ডায়াল করতেই ফোনটি অন পায়। বেশকিছুক্ষণ বাজার পর কেউ ফোনটি রিসিভ করে। আয়াত হ্যালো বলতেই শুনতে পায়………
চলবে