সাঁঝের প্রেম !! Part- 09
নিশি মাহবুবের সামনে গিয়ে বলে,
-তোমার ঘরে ঘুমাবেনা?
-না। এখন থেকে সেইটা তোমার ঘর। (ফোন রেখে মাহবুব উঠে বসে)
-আমার ঘর কি তোমার ঘর নয়? (নিশি)
-না।
-ও! তাহলে বিয়েটা শুধু সম্মান রক্ষার জন্যই?
-সন্দেহ আছে তাতে?
-না এখন আর সন্দেহ নেই।
মাহবুব নিশি দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। নিশি চেয়ার টেনে বসলো। আবার বলতে শুরু করলো,
-আচ্ছা যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। মাফ করা যায়না আমাকে?
-কি হয়েছে? (দাঁড়িয়ে গিয়ে মাহবুব)
-যার জন্য তুমি আমায় কাছে টানতে পারছো না!
-ইউ নো হোয়াট নিশি আমি তোমার ডাল ভাতেও নেই, সেখানে তোমার মাংস ভাতে নিজেকে আশা করি কিভাবে বলো?? (মুচকি হেসে মাহবুব)
-প্লিজ তুমি উলটাপালটা একিউজ কর না আমাকে।
-আমি কোথায় তোমায় একিউজ করছি নিশি? আমি তো সত্যি কথাটাই বলেছি। বিয়ে করলেই কি সংসার করতে হবে? না তো। বিয়ে করেছি তোমায় বউয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কিন্তু বউ বানানোর জন্য নয়।
-আবার বলছো যে দয়া করেছো? এখন আমি তোমার দয়ার পাত্রী তাই তো।
-আমি আল্লাহ নই যে তোমায় দয়া করব? ওয়ান্স আপন এ টাইম ভুল করেছি নিজে না বুঝেই আজ সেই ভুলটাই শুধরেছি৷ এর বেশি কিছুই না।
-তাহলে আমাদের এখন থেকে এভাবেই বাঁচতে হবে?
-কেনো? সমস্যা আছে? এইটাই তো চেয়েছিলে তুমি। (পিছে ঘুরে মাহবুব)
-আচ্ছা ঘুমাও তুমি। গুড নাইট।
মাহবুবকে গুড নাইট বলে নিশি মাহবুবের বেডরুমে চলে আসে। মাহবুব গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ায়। নিশি গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে খাটে বসে। চাদর মুচড়াচ্ছে নিশি আর মাহবুব জানালার পাশেই দাঁড়ানো।
পরেরদিন সকালে,
নিশি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখে সাড়ে ছয়টা বাজে। নিশি ভাবলো,
-ও তো আটটায় অফিসে যাবে। রান্না করতে হবে এখন। না আর ঘুমালে হবেনা৷
নিশি দাঁত ব্রাশ করে, হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যায়। নুডুলস আর পাউরুটি টোস্ট করে নিশি। মাহবুব ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে যায়। নিশিকে রান্না করতে দেখে মাহবুব আর কিছু বলেনি। মাহবুব টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে যায় গোসল করতে। গোসল করে এসে মাহবুব শার্ট-প্যান্ট পরে ডায়নিং এ আসে। নিশি তখন মাহবুবের দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দেয়।
-থ্যাংক ইউ। (মাহবুব)
-হুম।
নিশি মাহবুবকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে রান্নাঘরের কাজগুলো শেষ করে। মাহবুব কাটাচামচের জন্য রান্নাঘরে ঢুকে আর নিশিও তখন পিছু ঘুরে। নিশি মাহবুবের সাথে ধাক্কা খাওয়ায় মাহবুবের শার্টে ময়লা লেগে যায়।
-স্যরি আমি বুঝিনি তুমি যে পেছনে।
-ইটস ওকে। আমায় একটা ফর্ক দাও।
-দেইনি?
-না।
-আচ্ছা বসো দিচ্ছি।
মাহবুব শার্ট চেঞ্জ করে এসে আবার খাওয়া শুরু করে। যাওয়ার আগে নিশিকে বলে যায়,
-যা লাগবে ক্যামেলিকে বলো। ও আমার বাসার পাশেই থাকে। তুমি ডাকলেই ও চলে আসবে। বলে যাচ্ছি আমি ওকে।
-আমি আর কারো কাছে কিছু চাইনা। (নিশি)
মাহবুব আর কোনো জবাব না দিয়েই জুতার ফিতা লাগিয়ে বেরিয়ে যায়। নিশি পেছনে ঘুরে দেখে ডায়নিং টেবিলে মাহবুবের ঘড়ি। নিশি ঘড়িটা নিয়ে খালি পায়েই বাইরে বেরিয়ে যায়। মাটির রাস্তা দিয়ে মাহবুব হেঁটে যাচ্ছে। নিশি মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাহবুবকে পিছু ডেকে থামায়। এরপর নিশি খালি পায়ে হেঁটে গিয়েই মাহবুবকে ঘড়িটা দিয়ে আসে। মাহবুবের হাতে তখন নিশি আরেকটা ঘড়ি দেখে।
-ওহ স্যরি আমি ভেবেছিলাম এইটাই হয়ত পরো। পিছু ডাকলাম বলে কিছু মনে করনা।
-না ঠিক আছে।
নিশি ঘড়িটা হাতে নিয়ে বাসায় চলে আসে। বাসার আঙিনায় ঘড়িটা রেখে নিশি বাড়ির পেছনের দিকটায় যায়। গিয়ে দেখে কালো কাপড় দিয়ে বাইক ঢাকা। নিশি কাপড়টা সরিয়ে দেখে এইটা মাহবুবের বাইক। যেই বাইকে ওদের লাখো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। নিশি আবার বাইকটা ঢেকে রেখে দিলো। বাড়ির পেছনে গাছের পাতা দিয়ে ভরে গেছে। নিশ্চই মাহবুব ঝাড়ু দেয়না। নিশি ওড়না কোমড়ে গুজে চুলগুলো হাত খোপা করলো। এরপর আশেপাশে ঝাড়ু খুঁজলো। ঝাড়ু নিয়ে নিশি বাড়ির পেছন দিকটা পুরো পরিষ্কার করে ফেলে। পাতাগুলো এক জায়গায় স্তূপ করে নিশি আগুন জ্বালিয়ে দেয় যাতে পাতাগুলো পুড়ে যায়। আগুনের শিখা দেখে ক্যামেলিয়া মাহবুবের বাসার পেছনের দিকটায় আসে।
-ভাবি এইগুলো পোঁড়াচ্ছেন কেন? (ক্যামেলিয়া)
-তুমি কে?
-ক্যামেলিয়া।
-ওহ সুন্দর নাম তোমার আর দেখতেও তুমি সুন্দরী। কিসে পড়?
-সিক্সে পড়ি। ভাইয়া অফিসে গিয়েছে না?
-হ্যা।
-ভাবি তুমি দেখতে অনেক মিষ্টি তো।
-থ্যাংক ইউ। আগুন নিভে গেছে। আসো তুমি আমার বাসায়। একসাথে গল্প করব আমরা।
-ঠিক আছে।
নিশি আঙিনা থেকে ঘড়িটা নিয়ে বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপর হাতমুখ ধুয়ে ক্যামেলিয়াকে নুডুলস খেতে দিলো আর নিজেও খাচ্ছিলো।
-তোমার রান্না তো অনেক মজা ভাবি। (ক্যামেলিয়া)
-ধন্যবাদ। তুমি ব্রেকফাস্ট করেছিলে?
-হ্যা করেছিলাম তো।
-কি দিয়ে?
-মুরগি দিয়ে।
-তোমার আম্মু কোথায়?
-বাসায় কাজ করছে।
ক্যামেলিয়ার সাথে নিশির একাকীত্বর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ক্যামেলিয়াকে পড়া দেখিয়ে দেয় নিশি আর দুজন দিনের অনেকটা সময় একসাথে থাকে। নিশি ঘর গোছায় আর ক্যামেলিয়া বসে বসে বকবক করে। দুপুরে রান্নার সময় ক্যামেলিয়া নিশিকে টুকটাক সাহায্য করে যায়। আর রাতে নিশি সেই একাই এক ঘরে পরে থাকে আর মাহবুব আলাদা ঘরে।
তিনদিন পর,
সেদিন শুক্রবার ছিলো। মাহবুব বাসায়। নিশি টিভি দেখছিলো আর মাহবুব পাশে বসেই কম্পিউটার ঘাটছিলো। ঠিক সেই সময় দরজায় বেল বাজলো। নিশি উঠে গিয়ে দরজা খুলে৷ নিশি কাউকেই চিনেনা। নিশি মাহবুবকে ডেকে বলল,
-দেখো কে এসেছে?
-আসছি।
মাহবুব দরজার সামনে এসে দেখে মাহবুবের ছোট মা, বাবা আর ছোট ভাই।
-তোমরা? (অবাক হয়ে মাহবুব)
-বিয়ে তো করেছো একবার বাবাকেও জানাও নি আর আমাকেও না। সৎ মা বলে কি সেইটা জানার অধিকার হারিয়েছি? (ছোট মা)
-ভেতরে কি আসব? (বাবা)
-প্লিজ। (মাহবুব)
নিশি কখনো তাদের দেখেনি তাই চিনেনা। নিশি আব্বু আম্মুকে সালাম দিলো মাথায় ঘোমটা টেনে। সায়েম নিশিকে জিজ্ঞেস করে,
-কেমন আছো ভাবি?
-হ্যা ভালো।
-এতবছর পর আসতে ইচ্ছে করলো তাহলে? (মাহবুব)
-তুমি বেঈমান হতে পারো মাহবুব কিন্তু আমরা নই। (ছোট মা)
-তা আপনি ঠিকই বলেছেন। কেমন আছেন?
-যেমন থাকার কথা।
নিশি সবাইকে শরবত এনে দিলো কিন্তু ছোট মা খেলো না। মাহবুব ছোট মা আর বাবাকে একরুমে থাকতে দেয় আর সায়েমকে আরেকরুমে৷ মাহবুব নিশিকে আড়াল করে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
-দুপুরে কি রেঁধেছো?
-শিং মাছের ঝোল আর চিংড়ি মাছ ভুনা।
-সায়েম এসব খাবেনা। ডিম ভাজো ওর জন্য আর ভাত তো বেশি রাঁধো নাই না?
-না।
-ভাত রান্না কর তারাতারি। বিকালে বাজারে যাব আমি।
-আচ্ছা আমি রাঁধছি।
নিশি সবার ফ্রেশ হওয়া হয়ে গেলে সবাইকে খেতে দেয়। মাহবুব ও লাঞ্চ করতে বসে। মাহবুব কারো সাথে বেশি কথা বলেনি। ছোট মা নিশিকে বলছে,
-কেমন মেয়ে তুমি নিশি? শ্বশুর শ্বাশুড়ির অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করে ফেললে? লজ্জা শরম কি কিছুই নেই তোমার? এতগুলো বছর পর আজ আবার মাহবুবের ব্রেইন ওয়াশ করেছো?
-ছোট মা আশা করব আপনি আপনার সম্মান রক্ষা করে আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। (খাওয়া বন্ধ করে মাহবুব)
-তুমি কি এখন আমাকে শিখাবে আমি কি বলব? (রেগে গিয়ে ছোট মা)
-আপনাকে এসব কথা কেউ বললে আমার বাবার যেমন লাগবে ঠিক তেমনি আমার সামনে আমার বউকে কেউ অপমান করলে আমার গায়ে লাগবে। আর আমি প্রটেস্ট করবই।
-দেখেছো তোমার ছেলে আমার সাথে কিভাবে কথা বলছে তাও তুমি কিছু বলছো না? (খাওয়া রেখে ছোট মা)
-মাহবুব তুমি কিন্তু বড্ড বারাবারি কর। উনি তোমার মা হয় না? (বাবা)
-হয়ত হয়। নিশিও কিন্তু আমার বউ হয় বাবা। ও আমার ব্রেইন ওয়াশ কেন করবে? আমি কি আমার বাবার মতো হয়েছি যে বউয়ের কথায় চলব?
-মাহবুব? (মাহবুবকে ধমক দিয়ে ছোট মা)
-স্যরি ছোট মা। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। উঠছি আমি।
কেউই তখন ঠিক করে খেলো না। মাহবুব খেয়েই বাজারে চলে যায়। নিশিকে তখন ছোট মা যা নয় তাই শোনায়। অবশ্য এতে নিশির কিছু যায় আসেনা। নিশি প্লেট ধুচ্ছিলো আর তখন মাহবুব ফোন করলো। নিশি হাত ধুয়ে ফোন রিসিভ করলো।
-হ্যা বলো।
-কি কি আনবো এইটাই তো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি।
-মুরগি আনো, ডিম ও শেষ আর কিছু কাঁচা সবজি।
-আচ্ছা আর মাছ?
-যেকোনো বড় মাছ।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
মাহবুব বাজার করে এনে দেখে নিশি চা বানাচ্ছে শ্বশুর শ্বাশুড়ির জন্য। মাহবুবকে আসতে দেখে নিশি ব্যাগগুলো ধরে আর জিজ্ঞেস করে,
-চা দিব তোমায়?
-না। ছোট মা কই?
-ঘরে আছে।
-আমি যখন ফোন দিলাম তখন কাঁদছিলে কেনো? উনি কি আবার কিছু বলেছে?
-কই কাঁদছিলাম? (চোখ নিচু করে নিশি)
-মিথ্যে একদম বলবেনা আমার সাথে। তখন ফোনে কিছু বলিনি। বলো কি বলেছে?
-তুমি ভুল শুনেছো। আমি কাজ করছিলাম তখন। যাইহোক আমি ছোট মা আর আব্বুকে চা দিয়ে আসি।
নিশি কথাটা ইগনোর করেই শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে চা দিতে গেলো। ছোট মা চা খেতে খেতে বলে,
-আমার বোনের মেয়ে এখনো মাহবুব বলতে অজ্ঞান আর ও তোমার মধ্যে ডুবে আছে। এই কি আছে তোমার মধ্যে?
-সেইটা তো জানিনা ছোট মা। তবে ও আমার জন্য পাগল না আর অজ্ঞান ও হয়নি।
-তর্ক করবেনা একদম! যাও এখন।
নিশি এসে রাতের খাবার বানাতে শুরু করে। মাহবুব নিশিকে হেল্প করলো রান্নার কাজে। ডিনার সেড়ে সবাই একটু গল্প করলো। বাবা বলল,
-তোমার বাড়ির ডিজাইন টা আমার পছন্দ হয়েছে। খুব সুন্দর।
-হুম।
-গাড়ি কিনবে কবে?
-সেই এবিলিটি এখনো আমার হয়নি বাবা। খুব ভালো আছি এইটুকু নিয়ে। (মাহবুব)
সবাই যখন ঘুমাতে গেলো তখন নিশি একটা কথা মনে করে খুব হাসছে। নিশির হাসির মানে মাহবুব বুঝেছে কিনতু এছাড়া আর কিছুই করার নেই।
-আজকে তোমার সাথে ঘুমাতে হবে। (মাহবুব)
-জানি।
-ফ্লোরে তো ঘুমানো যাবেনা। কাঠের ফ্লোরে আমি ঘুমাইনি কখনো।
-তোমাকে তো আমি ফ্লোরে ঘুমাতে বলিনি। তুমি খাটেই ঘুমাবা। আর না ঘুমালে দুপুরে আমার হয়ে বড় বড় কথা যে বলেছো ছোট মা কে তা মিথ্যে হয়ে যাবে।
মাহবুব আর কোনো জবাব না দিয়ে থ্রি কোয়ার্টার আর টি শার্ট পরে আসে। দরজা লক করে সব চেক করে মাহবুব ঘুমাতে আসে। নিশি তখন হাতে লোশন মাখাচ্ছিলো আর লোশনেরই ঘ্রাণ পুরো ঘরে। এই লোশনটা নিশি বিয়ের আগেও মাখতো তাই মাহবুব নিশিকে সেইম ব্রান্ডের লোশন এনে দিয়েছে। মাহবুব চশমা ড্রেসিংটেবিল এর উপর রেখে খাটের এক কোনায় গিয়ে শোয়। নিশি চুলে বিনুনি করে ঘুমাতে আসে। মাহবুব শুয়ে শুয়ে সেই একই কাজ করছে, ফোন টিপছে। নিশি মাহবুবের শরীর থেকে চাঁদর নিয়ে নিজের শরীরে দেয়। মাহবুব নিশিকে এত কাছে পেয়েও ছুঁতে পারছেনা সেই কষ্টেই মরে যাচ্ছে ও। কিছুক্ষণ পর মাহবুব বলে,
-পাতলা কম্বল আছে আরেকটা তোমার পায়ের নিচে। সেইটা গায়ে দাও।
-না। এইটাই ঠিক আছে।
-আমার জন্য ঠিক নেই। সো প্লিজ… (নিশির শরীর থেকে চাঁদর টান দিয়ে মাহবুব)
-ওকে।
চলবে