সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 09

গাড়ির পেছনের সীটে বসে আছি আমি আর রেয়ান। সামনেই গাড়ি চালাচ্ছেন ড্রাইভার। এদিকে আমি খানিকটা অবাক। এ গাড়িটা বলে ডক্টরের নিজের গাড়ি। অথচ আমার জানা মতে উনি কোনো গাড়ি আনেনি এখানে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে। জবাবে উনি মুচকি হেসে ছিলেন মাত্র। তার জবাব না পেয়ে অনেকটা বিরক্ত আমি। রেয়ানের থেকে চেপে বসে জানালার দিকে দৃষ্টি স্থীর আমার। আড়চোখে ডক্টরের দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম, সে আমার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পাত্তা দিলাম না আমি। স্থীর তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে।
হুট করে রেয়ান আমার কোলে মাথা রেখে হাঁটু গুজে শুয়ে পড়লেন। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার। তারওপর সামনে ড্রাইভার আছেন। বাইচান্স উনি যদি পেছনে ফিরেন কিংবা সামনে থাকা আয়নায় থাকান তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভাবতেই দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম….
— “কি সমস্যা কি আপনার?ড্রাইভার আছে দেখছেন না? এত বেহায়া কেন আপনি?”
উনিও আমার দেখা-দেখি ফিসফিসিয়ে বললেন….
— “তোমার জন্যে! আর শুনো ড্রাইভার চাচা পেছনে ফিরবে না। তাই ডিস্ট্রাব করো না তো।”
— “সামনের আয়না দিয়ে দেখলে? তাছাড়া আপনিই বা আমার কোলে মাথা রেখে শুবেন কেন? কোন সাহসে?”
— “আমার সাহসের আধা অংশও তুমি দেখনি মিস মরু!”
আমাকে চোখ টিপ মেরে উঠে বসলেন রেয়ান। ড্রাইভার চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন….
— “চাচা গাড়ি থামান তো একটু!”
গাড়ি থামালো ড্রাইভার চাচা।চোখে-মুখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে রেয়ানের দিকে তাকালেন উনি।রেয়ান একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলেন…..
— “চাচা সামনের আয়নাটা একটা কিছু দিয়ে বেঁধে দিন তো।আমার মিসেসের সমস্যা হচ্ছে।”
দাঁত কেলিয়ে হাসলেন ড্রাইভার চাচা।লাজুক ভঙ্গিতে বললেন…..
— “আইচ্ছা বাবা!”

বিনিময়ে রেয়ানও হাসলেন। আমার দিকে তাকাতেই তার হাসি যেন আরও বেড়ে গেল।আমার কোলে আবার মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন উনি।দু’হাত দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আবদার ভরা কণ্ঠে বলে উঠেন…..
— “আমার চুলটা একটু টেনে দাও মরুভূমি।”
এবার যেন রাগটা তীব্র হলো আমার। উনার চুল জোড়ে জোড়ে টানতে লাগলাম। এতে উনি “আহহ” শব্দ করে আমার দিকে তাকান। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠেন…..
— “মিস মরু! কি করছো তুমি।আসতে টানো আমার চুল।”
— “কি মরু,মরুভূমি ডাকছেন আমাকে।আমার নাম মিরা। এগুলো না! মিরা ডাকতে পারলে আমার নাম ধরে ডাকবেন নাহলে ডাকবেন না।”
— “সাট আপ মরুভূমি! চুপ-চাপ আমার মাথায় হাত বুলাও। আদার ওয়াইজ আমি বাধ্য হবো তোমাকে গাড়ি থেকে বের করে দি….”
কথা শেষ করার আগেই ড্রাইভার চাচা গাড়ি ব্রেক করে দেন। আচমকা ব্রেক দেওয়ায় আমি আর রেয়ান দু’জনেই শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সামনে থাকা সীটে বাড়ি খেতে যাবো তার আগেই রেয়ান তার হাত দিয়ে আমার কপাল ধরে ফেললেন। ফল স্বরুপ উনি হাতে ব্যথা পান।
অনেকটা রেগে গেছেন উনি। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে উঠে বসলেন রেয়ান। ড্রাইভার চাচাকে কিছু বলতে যাবেন তার আগেই সামনের জানালা থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ ভেসে উঠে। মেয়েটা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল……
— “আমাকে কি একটু লিফট দেওয়া যাবে।”
সাথে সাথে রেয়ান বলে উঠলেন…..
— “না।”
গাড়ির ভেতর থেকে কোনো ছেলের মধুর কণ্ঠ শুনে জানালা দিয়ে ভেতরের দিকে আরেকটু উঁকি দিলো মেয়েটি। রেয়ানকে দেখতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সে আর বলল…..

—- “স্যার প্লিজ আমাকে লিফট দিন।আসলে ফ্রেন্ডদের সাথে ঘরতে এসেছিলাম।ভুলে পথ হারিয়ে ফেলেছি।ওদেরকে খুঁজেছি অনেক কিন্তু পাচ্ছি না।খুঁজতে খুঁজতে এখন কোথায় এসেছি জানি না। কাইন্ডলি আমাকে একটু আমার হোটেলে পৌঁছে দিলে খুশি হবো।”
রেয়ান কিছুক্ষন মেয়েটার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন…..
— “হোটেলের নাম কি?”
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটার। হোটেলের নাম বলেই গাড়ির দরজা খুলে সামনে বসে পড়ল সে। আমি মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জানালার দিকে ফিরে রইলাম।গাড়ি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে।এদিকে মেয়েটা বারবার রেয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।কিছু হয়তো বলবে। ইচ্ছে দমাতে না পেরে রেয়ানের দিকে ফিরে বসল মেয়েটি।হাসিমুখে বলল…..
— “আমি নয়না। আপনি?”
রেয়ানের কোনো হেলদোল হলো না। নয়নার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন….
— “রেয়ান!”
— “ও! আচ্ছা উনি কে?” (আমাকে উদ্দেশ্য করে)
রেয়ানের মুখে এবার বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো।যেন এ প্রশ্নেরই অপেক্ষা করছিলেন উনি। এক হাত দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে তার একদম কাছে নিয়ে গেলেন।কপালে কয়েকটা চুমু দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন…..
— “এবার বুঝেছেন ও আমার কে?”
মেয়েটার মুখ মুহুর্তেই মলিন হয়ে গেল।সোজা হয়ে বসল সে। আমি শুধু অবাক হয়ে ওদের কান্ডটা দেখছি। পরক্ষনেই রেয়ান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। তার থেকে অনেকটা দূরত্বে বসতেই সে আবারও আমার কোলে মাথা রাখলো। মেয়েটা আড়চোখে সেটা দেখতেই তার মুখ যেন আরও কালো হয়ে গেল।
.
মেয়েটাকে ওর হোটেলে পৌঁছে দিয়েই আবার গাড়ি চলতে লাগলো অজানা গন্তব্যের দিকে।বলতে গেলে গন্তব্যটা শুধু আমার জন্যই অজানা। কারন রেয়ান আর ড্রাইভার চাচা তো জানেন তারা কোথায় যাচ্ছেন। একমাত্র আমাকেই বলা হয় নি আমরা কোথায় যাচ্ছি। বার কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি রেয়ানকে। উনি কিছু বলেন নি তখন। তাই এখন আর জিজ্ঞেস করছি না।কি দরকার? উনি যখন বলতে চাচ্ছেন না তখন এভাবে বারবার বেহায়ার মতো জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজন নেই। অন্তত আমার জন্য প্রয়োজন নেই!
হঠাৎ আরেকটা ভাবনা এটে বসে আমার মাথার ভেতর। অদ্ভুত ভাবে আজকে অজ্ঞান হচ্ছি না আমি।না মাথায় চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। তবে কি আসতে আসতে ঠিক হচ্ছি আমি? ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।হঠাৎ চোখ গেল দূরে থাকা ট্রাকের দিকে। মুহুর্তেই মনে হলো না আমার ধারণা ভুল! আমি কখনও ঠিক হতে পারবো না। অতীত যে বারবার পিছু নেয় আমার। এ-ই যে ট্রাকটা, বিরক্তির কারন হয়ে উঠেছে আমার। অতীতের স্মৃতিটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠে।চোখ ছাপশা হতে শুরু করে আমার।
.
সন্ধ্যারদিকে মামীর কাছে রেয়ানের কল আসে। আমার জ্ঞান হারানোর সমস্ত ঘটনা উনি খুলে বলেছেন মামীকে। সব শুনে মামীর যেন শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়। ফুফিয়ে কেঁদে উঠেন উনি। আবদ্ধ পাশে বসেই টিভি দেখছিল। মামীর কান্নার আওয়াজে মামীর দিকে তাকায় সে। মামীকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে পরে আবদ্ধ। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সব এক এক করে বলেন উনি। এবার আবদ্ধও যেন ভেঙ্গে পরে। ছোট বেলা থেকেই ওর বেস্ট বোন মিরাপু। সবসময় আদরের ভেতর রাখতো তাকে। আপন বোন না হলেও আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি তাকে ভালোবাসে। সবসময় তার পাশে থাকতো। এখন আমার এ-ই অবস্থায় সে-ই আমার পাশে থাকতে পারছে না। ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে আবদ্ধের।ইচ্ছে করছে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু আফসোস! সেটা সে পারবে না। এতে মামী যে আরও ভেঙ্গে পরবে। কোনো রকম মামীকে শান্তনা দিয়ে রুমে রেখে আসে মামীকে। নিজে চলে যায় ছাদে। কেন যেন বড্ড একা একা লাগছে। দীঘির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু কিভাবে কথা বলবে? পরক্ষনেই মনে হলো সে তো আজকে দীঘিকে একটা ছোট্ট কিপেট মোবাইল দিয়েছিলো যাতে দীঘির সাথে কথা বলতে পারে সে। ভাবতেই দীঘিকে কল দিলো আবদ্ধ। প্রথবারে কল ধরে না দীঘি। তিন-চারবার কল দেওয়ার পর ফোন রিসিভ করে সে।সাথে সাথে আবদ্ধের কঠিন গলা ভেসে উঠে দীঘির কানে….
— “কি হলো? এতক্ষন লাগে ফোন ধরতে?”
— “আসলে ওয়াশরুমে ছিলাম। সরি!”
আবদ্ধ দমে গেল। আমতা আমতা করে বলে উঠল….
— “ও! তোর কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই কল করলাম।”
— “কিছু কি হয়েছে?আপনার গলা কেমন যেন শোনাচ্ছে।”
— “তুই তো জানিস আমার একটা বড় বোন আছে।ওইদিন বলেছিলাম না খালাতো বোনের কথা?? ওর মানোসিক সমস্যা! কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না জানিস। আমি না ওকে খুব ভালোবাসি। বোনটা আমার অনেক ভালো। এই ছোট ভাইয়ের সকল আবদার পূরণ করত মিরাপু। আর আমি কিনা তার ভালোবাসার মূল্যে তাকে একটুও ঠিক করতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে রে পিচ্চি।”
— “কি হয়েছে আপনার আপুর সাথে?”
— “আসলে একদিন মিরাপু খালা আর খালুকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়ার খুব বায়না করে। ফলে তারাও রাজি হয়ে যায়। শপিংমল থেকে আসার সময় মিরাপু দোকান থেকে কি যেন কিনছিলো তাই খালা আর খালুকে বলে গাড়িতে বসতে সে আসছে একটু পর। খালা আর খালু তাই করে। শপিংমলের সামনে অনেক গাড়ি রাখা ছিল তাই মলের অন্য পাশে গাড়ি পার্ক করা ছিল তাদের। গাড়ির কাছে যাওয়ার সময়ই একটা ট্রাক ওদের দু’জনকে মেরে দেয়। এদিকে মিরাপু একটা বিকট আওয়াজ শুনে পিছনে ফিরে তাকান। সাথে সাথে তার হাত থেকে শপিং ব্যাগগুলো পড়ে যায়।রাস্তার একদম মাঝখানে পড়ে থাকা খালা আর খালুর নিথর রক্তাক্ত দেহ পড়ে ছিল। মিরাপু দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে বসে পড়েন। মা-বাবাকে এভাবে দেখে তার হিতাহিত জ্ঞান প্রায় শূণ্য। কি করবে বুঝতে পারছিল না। ততক্ষনে ট্রাকটাও অনেক দূরে চলে গিয়েছিল আর মানুষের ভিরও জমে যায় তাদের চারপাশে।মিরাপু চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলছি একটু সাহায্য করার জন্য।কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে নি।তাদের ধারণা এটা পুলিশ কেস, পুলিশ আসা ছাড়া কিছু করতে পারবে না তারা।একসময় আপুও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।তারপর থেকে ঘর থেকে বের হয় না সে।মানুষের প্রতি এক ভয়ংকর ঘৃনা তৈরি হয়ে যায় মিরাপুর।এখন সেটার-ই চিকিৎসা চলছে।”

— “আপনাকে এগুলো কে বলেছে?”
— “মিরাপু!”
— “ও! চিন্তা করবেন না আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো দীঘি।আবদ্ধ মানুষটা আসলে অনেক ভালো। বোনকে কতই না ভালোবাসে সে।আচ্ছা আবদ্ধ তাকে কতটা ভালোবাসে?হয়তো অনেক!
দীঘির কোনো সারাশব্দ না পেয়ে আবদ্ধ বলল….
— “কি হয়েছে?মন খারাপ?”
— “না!”
— “ও, আচ্ছা স্কুল থেকে বাসায় আসার পর তোর মা বাবা কিছু বলেছিল?”
দীঘি এবার কি বলবে আবদ্ধকে।তাকে যে তার মা-বাবা অনেক মেরেছে।এ কথা তো আবদ্ধকে বলা যাবে না।আবদ্ধ তো কেংকারি বাঁধিয়ে দেবে। তারচেয়ে মিথ্যা বলবে সে….
— “না কিছু করে নি বাবা-মা।”
— “সত্যি তো?”
— ” হ হুম!”
— “আচ্ছা তাহলে রাখি। কালকে সকালে নিতে আসবো তোকে।”
— “আচ্ছা”
ফোন কেটে দিলো আবদ্ধ।এদিকে দীঘি পড়ল মস্ত বড় এক চিন্তায়।তার শরীরে যে মারের দাগ স্পষ্ট। কিভাবে আবদ্ধ থেকে এ দাগ গুলো লুকাবে সে?
.
.
.
#চলবে🍁🍁