প্রেমে পড়া বারণ !! Part- 09
আর একদিন যদি মুখ ফসকেও ‘ভাই’ বের হয় ,তবে দেখিস!
– কি করবেন?
– কি করবো?
রেহান ভাই আরেকটু কাছে এসে বললেন – দেখিস কি করি!
আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে
-হুহ!
বলে ঘুরে আমার কাজ করতে লাগলাম।
– অই হুহ! কি?
রেহান ভাই টান দিয়ে উনার দিকে ফেরালেন।
– কিছু না। এমন করে বলছেন যেন আমি ইচ্ছে করেই করেছি।
– ইচ্ছে করে করিসনি ঠিক, কিন্তু নিজেকে বিরাট বড় মাপের বুদ্ধু প্রমাণ করেছিস।এখন যা, একটা কফি নিয়ে আয়।
এইলোকটার জন্য কফি করতে করতে আমার জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে।
– বরের জন্য কফি! মিষ্টিটা একটু কম করে দিও ভাবি!
পিছনে তাকিয়ে দেখি রিয়াদ ভাইয়া আর মাহি আপু দাঁড়িয়ে।
– ভাইয়া,আপনি ভাবি ডাকছেন কেন??
– রেহান ভাইয়ের বউ বলে কথা! এই বাড়ির দশটা না, পাঁচটা না! একটাই মাত্র ভাবি!
তো কি ডাকবো?
– বুঝেছি।তো মিষ্টি কম দেবো কেন?
– মাহি,তুমি বোঝাও তোমার এই বোনকে। আমার দ্বারা হবে না বুঝে গেছি।
– কি বুঝাবে?
মাহি আপু আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে বলে
– আসলে হয়েছে কি হিয়া, বিয়ের পর নতুন নতুন সব কিছুই মধু মধু মনে হয়, তাই মিষ্টি কম দিলেও চলে।
এখন যদি করলার জুস নিয়েও ভাইয়াকে দিস, সেটা খেয়েও বলবে – সাধু! সাধু! তোমার হাতে জাদু আছে,এই হাতের ছোঁয়ায় সব কিছু অমৃত মনে হয়!!.
ফিল্মি স্টাইলে ডায়লগ দিয়ে যাচ্ছে মাহি আপু।
– ওওওও…. আচ্ছা! আচ্ছা! তাই বুঝি?!
তো রিয়াদ ভাইয়া তোমার হাতের কোন অখাদ্যকে অমৃত বলেছে শুনি?
– ওসব শুনতে নেই বেবি! ওটা সিক্রেট।
বলেই চোখে টিপ্পনী কাটলো।
– আরে আরে.. সিক্রেট ফাঁস হয়ে গেলে তোমার আপুর রন্ধন শিল্পের গুমর ফাঁস হয়ে যাবে কিনা!
– মানে?
– মানে, উনি আমাকে এক কাপ চা করে দিয়েছিলেন। অতি যত্নের ঠেলায় খুব সম্ভবত দু থেকে তিন চামচ দুধ,দু চামচ চিনি,আর আধা চামচ লবণ দিয়েছেন।
ও,হা, ডাক্তার সাহেবা স্বাস্থ্য সচেতন কিনা! তাই সাথে এলাচ,লবঙ্গ, আদাও দিয়েছেন।
বুঝতে পারছো কত সুস্বাদু হয়েছিলো!।
– তুমি আবার আমাকে খোটা দিচ্ছো? আমি কি জানতাম নাকি লিকার চায়ে আদা,লবঙ্গ এসব দেয়,দুধ চায়ে দেয় না!
জীবনেও আর কিছু করে খাওয়াবো না।
রিয়াদ ভাইয়া কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ। আসলে মাহি আপু কখনো কিচেনে যায়নি। সব সময় পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতো আর রান্নায় কখনো কোনো আগ্রহই ছিলো না। ফুপি অনেক বলেও কিছু হয়নি।
ওদের খুনসুটি আমার খুব ভালো লাগছে।
আমার কফি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।
রিয়াদ ভাইয়া আর মাহি আপু এটা নিয়েই পাল্টাপাল্টি যুক্তি দেখাচ্ছে। দিয়াও এসে যোগ দিলো।
আমি হাসতে হাসতে কফি নিয়ে চলে এলাম।
– এই নিন আপনার কফি।
– হুম।।
হাত বাড়িয়ে কফি নিলেন।
– এভাবে হাসছিস কেন?
– কি হয়েছে শুনবেন?
– বল, শুনি।
ওদের কথাগুলো বললাম। বলে আবার হাসি পেয়ে গেছে।
– ঠিকই তো বলেছে। মিষ্টি বউ থাকলে একস্ট্রা মিষ্টির দরকার নেই তো।।
উনার কথা শুনে আমার হাসি থেমে গেছে। উনি কি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন।গভীর দৃষ্টিতে, এই দৃষ্টিতে কিছু একটা আছে!!
-নে,কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দে।।
– কেন?
– মিষ্টি ঠিক আছে কিনা দেখে দিবি সবসময়।
– সেটাতো, এক চুমুক সবসময় ই খাই!
বলতে বলতে এক চুমুক দিলাম।
– জানি তো! কিন্তু আজকে হাসির জন্য ভুলে গেছিস।
এইরে! একটা ধরা খেলাম!!
– জানেন মানে?
-অইযে, আমার কফির কাপে আমার আগে একটা বিড়াল মুখ দেয়! সেটা জানি আমি।
– আমি বিড়াল?
উনি হাসতে হাসতে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন।
– কারো উপকার করলে এমন ই,কথা শুনতে হয়! ঠিক আছে, আর দেবো না।
আমি মন খারাপ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাঁধে গরম একটা বাতাস অনুভব করলাম।
না,ভুল হয়নি,এটা নিঃশ্বাসের।
রেহান ভাই আমার ঠিক পিছনে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ রেখে বললেন –
এই বিড়ালটি যদি মুখ না দেয়, সেই কফি তো খাওয়া যায় না। তুই যে রোজ এমন করিস সেটা অনেক আগে থেকেই জানি। একদিন দেখছিলাম, তারপর কিছু দিন খেয়াল করে দেখেছি।
শুন…
আমাকে উনার দিকে ফেরালেন।
– কি?
– আমি কিন্তু জেনেশুনেই কফি খেতাম।
এবার আমার ঠোঁটের কোনে হাসি আসলো।
– তার মানে আপনিও প্রেমে পড়েছিলেন!!?
– নাতো! জানিস না প্রেমে পড়া বারন??
– কেন বারন?
– তোর প্রেমে পড়া বারন ছিলো। তোর প্রেমে পড়ার কোনো কারণ ছিলো না।
– তাই বুঝি?
– হুম। কেন জানিস?
– কেন?
– উত্তর টা প্রথম আমিও জানতাম না।
এখন জানি।
কারণ তুই আমার প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গেছিস।যখন চাইতাম তোকে সামনে পেতাম। আমার প্রয়োজনের সবকিছু তো খেয়াল করতিস।কখনো মনে হয়নি তুই না থাকলে কি হবে!
তুই যখন আমার নিত্যদিনের অংশ হয়ে ছিলি,তাই তোর মাঝে মজে গেছি কখন নিজেই তো বুঝিনি।
বলেই কপালে একটা চুমু খেলেন।
আমার চোখ ভিজে গেছে।
আমি ভাবতাম এই মানুষটা আমার অনুভূতি বুঝে না।অথচ এই মানুষটাই আমার থেকে বেশি ভালোবেসে গেছে নিজের অজান্তেই।
-আপু…
দিয়া দরজার বাইরে থেকে ডাকলো।
রেহান ভাই সরে গিয়ে কফির মগ তুলে নিলো।
– ভেতরে আয়।
-তোকে আর ভাইয়াকে নিচে ডাকছে।
নিচে গিয়ে দেখি মাহি আপু, রিয়াদ ভাইয়া, আরিফ,দিয়া সবাই মিলে প্ল্যান করেছে ঘুরতে যাবে।
আব্বু,আম্মু,ফুপি তারা গেলেন না। আমরা অনেক বলার পরেও উনারা বাসায় থেকে গেলেন।
আমরা ১২টার দিকে বের হলাম। দুপুরের খাবারের পার্সেল নিয়ে সবাই লং ড্রাইভে শহরের বাইরে গেলাম।
যান্ত্রিক জীবনের বাইরে প্রকৃতির ছোঁয়ায় অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।
একটা নদীর তীরে এসে নৌকা করে ঘুরলাম অনেক সময়। বিকেলে শান্ত নদীর শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে গেছে।
মনে হয় অনন্তকাল যদি এভাবেই থাকতে পারতাম!!
দিয়া,আরিফ রেহান ভাইকে ধরলো একটা গান শুনাতে।
রেহান ভাই কিন্তু দারুণ গান করেন। সেই ছোট্ট বেলায় কত শুনেছি উনার গান! বাসায় প্রায়ই গাইতেন।
কিন্তু বাইরে থেকে ফেরার পরে আর গাইতে শুনিনি।
আজ সবাই ধরলো গাইতে।কিন্তু উনি রিয়াদ ভাইয়া থাকায় একটু ইতস্তত করছেন। মাহি আপু, রিয়াদ ভাইয়ার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত একটা গান ধরলেন —
——————
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো– তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণমঞ্জীরে।।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণ।।
মনে ক’রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী– তোমার
কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
ভুলিয়া তুলিয়া রেখো– তোমার
অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
একটি বিন্দু এঁকো– তোমার
ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো– তোমার
অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো– তোমার
অতুল গৌরবে।।
————–
গানটা শুনতে এতো ভালো লাগছিলো যে বলে বুঝাতে পারবো না। এই পরিবেশে যেন গানটা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
আমাদের ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।
সারাটা দিন সত্যিই অনেক আনন্দ হয়েছে সবার সাথে।
রাতে সবাই যখন যে যার রুমে চলে গেছে। তখন আমিও রুমে এলাম।
মাহি আপু আর দিয়ার সাথে অনেক সময় গল্প করলাম।
রুমে এসে দেখি রেহান ভাই রুমে নেই।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
– এখানে কি করছেন?
– শুনে কি করবি?
– কেন?
– তোর শোনার সময় কই!! এতো তাড়াতাড়ি তোর গল্প করা শেষ হয়ে গেলো??
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি- অনেক রাত হয়ে গেছে।
– এতটা বেজে গেছে! খেয়াল ই করিনি।
– হুম।
– রুমে আসবেন না?
– নাহ! এখানেই ভালো লাগছে।
আমিও গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ালাম।উনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হয় রেগে আছেন কিছুটা।
আমিও চুপ করে আকাশ দেখছি।
কিছু সময় পরে উনি বললেন
– তুই এখানেই থাক।আমি গেলাম।
বলেই রুমে চলে গেলেন।
আজব! আমি দাঁড়িয়ে আছি আর উনি চলে গেলেন রুমে!
রুমে এসে আমিও বললাম – কি সমস্যা আপনার? আমাকে ফেলেই চলে আসলেন?
নাহয় একটু দেরি হয়েছে, তাতে কি হয়েছে শুনি?
উনি হঠাৎ উঠে এসে আমাকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে
-এই মেয়ে, তুই কি কিছুই বুঝিস না? এতো বোকা কেন তুই?
উনার কথায় আমার মুখভার হয়ে গেছে।
চলবে….