সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 27 (Last-Part)

সায়েমের কথা শুনে তুর্না হাসবে না মজা নিবে বুঝতেছে না। শেষে তুর্না সায়েমকে ছেড়েই দিলো। বড় বোনের সাথে তো আর মজা নেয়া যায় না। সায়েম মাইসারাকে কোলে নিয়ে খেলছে আর মাইসারা সায়েমের সাথে কথা বলছে। নিশি সবাইকে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করছে আর সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে বারবার হাসছে। সায়েম ও মাথায় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। সায়েমের কাছে এসে নিশি বলে,

-ব্রেকফাস্ট করবানা?
-ডিনার, ব্রেকফাস্ট সব কালকে রাতেই করে ফেলেছিলাম না? এখন কি খেতে হবে? (কথাটা আস্তে করে বলল সায়েম)
-ফাজলামো রাখো। তারাতারি টেবিলে বসো। (কোনোরকম হাসি থামিয়ে নিশি)

সায়েম মাইসারাকে ফ্লোরে ছেড়ে দিয়ে খেতে বসলো। নিশি, তুর্না, সায়েম, তুর্নার হাজবেন্ড সবাই মজা করছে আর খাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষে নিশি ঘরে যায়। সায়েম তখন বই পড়ছিলো। নিশিকে দেখে সায়েম বলল,

-সেইদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার।
-কোনদিন?
-যেদিন তোমার পায়ে ধরেছিলাম বিয়ে করার জন্য।
-সেই কথা কেন মনে করছো? সেই ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত।
-জানো নিশি তোমার ভালোর জন্যই, তোমার খুশির জন্যই সেইদিন আমি পেছোতে পারিনাই। আব্বু, আম্মু, আমার শ্বাশুড়ি মা আর বিশেষ করে আমার তখনকার হবু বউ বারবার আমায় ফোর্স করছিলো যাতে তোমায় বোঝাই। শেষে এক প্রকার প্রেসার নিয়েই লাজ লজ্জা ভেঙে তোমায় বিয়ের কথা বলেই ফেললাম। এজন্য তুমি আমায় যা নয় তা বলেছিলে নিশি মনে আছে?
-আছে। (খাটের উপর বসে নিশি)
-চড় ও দিতে গিয়েছিলে। যাইহোক এই বইয়ের আহসান আর নওশিনের গল্পটা অনেকটা সেইরকম ই তাই মনে পড়ে গেলো।
-শেষ চিঠি পড়ছো?
-হ্যা। (বইটা রেখে সায়েম)
-সেইদিন আমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল করিনি হয়ত। আফসোস হচ্ছে অনেক পুরোনো অনেক কথা ভেবে।
-হ্যা নিশি আমি হয়ত ভাইয়ার মতো হতে পারিনি বাট অজস্র চেষ্টা করি তোমায় খুশি রাখার। মাঝে মাঝে হয়ত রাগ করি, অনেক কথা বলি বাট মনের কথা একটাই সেইটা হচ্ছে তোমায় খুশি দেখতে চাই এট এনি কস্ট।
-বুঝেছি সেইটা।

তুর্না আজ শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছে। নিশি আবারো একা হয়ে গেলো। সায়েম যথেষ্ট চেষ্টা করে বউ আর মেয়েকে সময় দেয়ার। এক সপ্তাহ পর সায়েম সিদ্ধান্ত নেয় ওরা কক্সবাজার যাবে। বাসায় মা, বাবাকে ফেলে নিশি যেতে রাজি না কিন্তু সায়েম যাবেই। এক্ষেত্রে নিশির বাধা ও মানবেনা। শেষে সবার অনুরোধে নিশি যেতে রাজি হয়। যাওয়ার দিন নিশি কালো রঙের শাড়ি পরে। অনেকদিন পর নিশি বোরকা ছাড়া বাইরে বের হলো। ফ্লাইটে যেতে হয়েছিলো ওদের কারণ মাইসারাকে নিয়ে এতদূর জার্নি করা অসম্ভব। সায়েম একহাতে মাইসারাকে কোলে নিয়ে আছে আরেকহাতে ট্রলি টানছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সায়েম একটা ক্যাব ভাড়া করে হোটেলে উঠলো। নিশির কেনো যেন মনে হচ্ছে আগে কেনো আসলাম না ঘুরতে? আগে আসলে তো সায়েমের এই ম্যাচিউরড এটিটিউড দেখতে পেতাম। চারতলায় সায়েম আর নিশির রুম। রিসিপশন থেকে চাবি নিবে বলে নিশির কোলে মাইসারাকে দিয়ে যায় সায়েম। আর মেয়েও বাবা ভক্ত। কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। এজন্য নিশি মাইসারাকে নিয়ে একটু হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিশি শাড়ির কুচিতে পা লেগে পরে যেতে নেয়। সায়েম নিশির হাত ধরে আরেক হাতে মাইসারাকে ধরে।

-আস্তে নিশি। (সায়েম)
-কি করে পরে যাচ্ছিলাম বুঝলাম না।
-মাইসারাকে দাও আমায়। আসো তুমি। শাড়ি সাবধানে
ধরো।
-হুম।

রুমে গিয়ে সায়েম মাইসারাকে খাটে বসালো। মাইসারা আবার কান্না জুড়ে দিলো বাবা নামিয়েছে বলে।

-আম্মু আমি চেঞ্জ করব না? (মাইসারাকে আবার কোলে নিয়ে সায়েম)
-রাখো একটু। আমি শাড়িটা পাল্টে আসি।
-যাও।

একটা ঝুড়িতে অনেক চকলেটস আছে যেগুলো মাইসারা চাচ্ছে কিন্তু সায়েম ঢাকা থেকে মাইসারার জম্য চকলেটস কিনে এনেছে যেগুলো মাইসারা খায়। কারণ হোটেলের চকলেট কেমন না কেমন হয়! ট্রলি থেকে সায়েম মাইসারাকে চকলেট বের করে দিয়ে বলল,

-মা এইত তোমার চকলেট। ওইগুলো ভালো না। এইটা ভালো।
-খুলে দাও।
-আচ্ছা দিচ্ছি।

সায়েম মাইসারাকে চকলেট দিয়ে বসিয়ে শার্ট খুলল। সায়েমের পরনে শুধু প্যান্ট আর বেল্ট। সায়েমকে খালি গায়ে দেখে মাইসারা তাঁকিয়ে আছে।

-বাবা জামা! (মাইসারা)
-আম্মু তোমার আব্বু এখন গোসল করবে না?

কথাশুনে মাইসারা খিলখিল করে হাসছে আর চকলেট মাখানো হাত দিয়ে সায়েমের বুকের পশম টানছে।

-আহহহ! বাবা ব্যাথা পায় তো মা। (সায়েম)
-হাহাহাহাহা
-এত হাসছে কেন আজকে আমার বুড়িটা? (মাইসারার গাল টেনে সায়েম)
-বাবা বাইরে যাব না?
-যাব মা।

নিশি শাড়ি পালটে বাইরে আসে। থ্রিপিসের পেছনের চেইন অর্ধেক লাগিয়ে আর পারছেনা লাগাতে নিশি।

-সায়েম?
-হ্যা বলো।
-হেল্প করনা!
-ওয়েট।

সায়েম মাইসারাকে মাঝে বসিয়ে দিয়ে নিশির জামার চেইন লাগিয়ে দেয়।

-যাও গোসল করে এসো।
-দেখো মেয়ের কাজ! (বুকে হাত দিয়ে দেখিয়ে সায়েম)
-হাহাহা বুকে চকলেট লাগিয়ে দিয়েছে। ভালই করেছে।
-মেয়েটা আধো আধো কথা বলছে। ওর মুখে বাবা শুনে কি শান্তি যে পাই বলে বোঝাতে পারবনা। আচ্ছা আমি গোসল করে আসি।

সায়েম এগিয়ে যেতে নেয় তখন নিশি সায়েমের হাত ধরে। নিশি সায়েমের দিকে ফিরে সায়েমের বুকের উপর লেগে থাকা চকলেট গুলো খায়। সায়েম নিশির হাত ধরে আছে। সায়েম থ হয়ে যায়। কি করছে নিশি?

-কি হলো এইটা? (অবাক হয়ে সায়েম)
-যা হওয়ার। যাও এখন গোসল করে এসো। (ঠোঁট মুছে নিশি)

সায়েম নিশির চুলের মুঠি ধরে মুখ উঁচু করে গলার নিচে কিস করে। নিশি সায়েমের পেট খামচে ধরে। সায়েম তখন নিশিকে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিশিও সায়েমকে জড়িয়ে ধরে। এইদিকে মাইসারা যে তাঁকিয়ে আছে সেইদিকে কারোরই হুশ নেই। মাইসারা বসে বসে খেলছে আর ওরা রোমান্স করছে। ছেলেমেয়ে ছোট থাকলেই এই এডভান্টেজ পাওয়া যায়, বড় হয়ে গেলে হিসেব করে চলতে হয়!

বিকেলে সূর্যের শেষ আলোয় সায়েম আর নিশি হাত ধরে বিচে হাঁটছে। সমুদ্র দেখে মাইসারা আনন্দে লাফাচ্ছে। সায়েম কিছুতেই মেয়েকে কোলে রাখতে পারছেনা। মেয়ে পানিতে নেমে গড়াগড়ি করবে। সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মেয়েকে কোল ছাড়া করেনি সায়েম। বাতাসে নিশির খোলা চুলগুলো উড়ছে আর লম্বা চুলগুলো সায়েম ধরে ধরে ছেড়ে দিচ্ছে। পরেরদিন দুপুরে সবাই মিলে বিচে গোসল করলো। সায়েম মাইসারাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর মাইসারা ব্যস্ত পানিকে নিয়ে। নিশি ওইদিন প্রথম সায়েমের অনুমতি নিয়ে জিন্স আর লং টপস পরেছিলো আর সায়েম থ্রি কোয়ার্টার আর পাতলা টি শার্ট পরেছিলো। তিনজনের ছবি সায়েম আম্মুকে হোয়াটসঅ্যাপ করলো। ওদের খুশি দেখে বাড়ির সবাই খুশি। আম্মু বলেই ফেলল,

-আসার পর যেন শুনি আমি আবার দিদুন হব।

কথাটা শুনে সায়েম লজ্জা না পেলেও নিশি পেয়েছিলো।

সাত বছর পর,

বাড়ির পরিবেশ পালটে গেছে আর পাল্টেছে অনেক কিছুই। বেঁচে নেই নিশির মা। বুড়ো শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়েই নিশির জীবন। মাইসারা ক্লাস ফোরে পড়ছে আর নীলের বয়স মাত্র ছয় বছর। নীল নিশি আর সায়েমের ছেলে। নীলের বয়স পুরোপুরি ছয় হয়নি। কেবল নার্সারিতে পড়ছে ও।

-নীল বাবা আমাকে এই রঙের বক্সটা দিয়েছে। প্লিজ আমায় দিয়ে দাও ভাই। আমি বাবাকে বলব তোমায় এইরকম আরেকটা এনে দিতে। (মাইসারা)
-না। এইটা আমার। তুমি পাপার থেকে আরেকটা নিয়ে নিও। (নীল)

দুজনের ঝগড়ার মাঝে নিশি এসে বলল,

-মাইসারা ভাইকে এইটা দিয়ে দাও। তুমি তোমার বাবাকে বলো আরেকটা এনে দিতে।
-না আম্মু। এইটা বাবা আমায় গিফট করেছে। আমি কাউকে দিতে পারবনা। ভাইকে বলো না আমার সব রঙ পেন্সিল নিয়ে যেন এইটা দিয়ে দেয়। (কাঁদতে কাঁদতে মাইসারা)

সায়েম তখনি ঘরে ঢুকলো। গলার টাইটা খুলে আর শার্টের একটা বোতাম খুলে সায়েম সোফার উপর বসে পরলো। নিশি সায়েমকে দেখে ছেলে মেয়েকে বলল,

-প্লিজ তোমাদের বাবার সামনে ঝগড়া করনা। সারাদিন পর এসেছে। তোমাদের সমস্যা আমি মিটমাট করে দিচ্ছি৷ মাইসারা আম্মু তুমি এখন ঘরে যাও। আমি আসছি। (নিশি)

মাইসারা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে যাচ্ছে। সায়েম দেখছে মাইসারা চোখ মুছতে মুছতে ঘরে যাচ্ছে। সায়েম দাঁড়িয়ে গিয়ে মাইসারাকে ডাকে।

-আম্মু? (ব্লেজার খুলে সায়েম)
-জ্বি বাবা।
-এইদিকে আসো।

মাইসারা আসার পর সায়েম মাইসারার সামনে নিচু হয়ে বসে আর মাইসারার চোখের দিকে তাঁকায়।

-কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? তোমার আম্মু আবার বকেছে? (সায়েম)
-না বাবা।
-তাহলে?
-বাবা ভাই আমার রঙ পেন্সিল বক্সটা নিয়ে নিয়েছে যেইটা তুমি আমায় দিয়েছিলে। এত করে বললাম আমার সব রঙ নিয়ে এইটা দিয়ে দিতে তাও ভাইয়া শুনলো না।
-নীল এইদিকে এসো। (নীলকে চোখ রাঙিয়ে সায়েম)
-বলো পাপা। (নীল ভয়ে কাঁপছে)
-সায়েম ছেড়ে দাও। আমি দেখছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো যাও। (নিশি)
-তুমি কথা বলো না নিশি। নীল আপুকে বক্সটা দিয়ে দাও।
-আমার পছন্দ হয়েছে এইটা পাপা। (নীল)
-নীল আমি বলছিনা আপুকে এইটা দাও আর সরি বলো।

নীল মাইসারার হাতে বক্সটা দিয়ে সরি বলল।

-বাবা এইটা তো আপুকে আমি দিয়েছিলাম। তোমাকে যে এত খেলনা দেই আমি আপু কি সেইগুলো নেয়? তাহলে তুমি কেনো ওর গিফটের জিনিস নিবা? (নীলের গালে হাত দিয়ে সায়েম)
-তুমি আপুকে অনেক ভালবাসো তাইনা পাপা? এইজন্য আপুও তোমায় অনেক ভালবাসে। (নীল)
-তোমাকেও আমি ভালবাসি, শুধু আপুকে না। তোমরা দুজনেই আমার ভালবাসা। (মাইসারা আর নীলকে জড়িয়ে ধরে সায়েম) আগামীকাল তোমায় আমি এই রকমই বক্স এনে দিব।
-লাগবেনা পাপা। আপু আমায় রঙ করতে দিবে বলেছে তবে একবারে দিবেই না।
-আচ্ছা যাও। পড়তে বসো। নিশি ল্যাপটপ টা নিয়ে ঘরে এসো।

সায়েম ঘরে যাওয়ার পর নিশি কয়েক মিনিট ড্রইংরুমে বসে ভাবছে সায়েমের মন থেকে মাইসারা মুছে যায়নি বরং আরো মায়ার দাগ কেটে আছে। মাইসারাকে নীলের থেকেও বেশি ভালবাসে সায়েম তবে ছেলে মেয়েদের বুঝতে দেয়না। নিশির কাছে দুই সন্তানই সমান। সায়েমের কাছে মাইসারা একটু বেশিই প্রিয়। নিশি তখন হাসিমুখে ল্যাপটপ টা নিয়ে ঘরে যায়। জীবনের সবচেয়ে বড় চিন্তা শেষ এখন কেবলই সুখের সময়। অন্ধকার দিয়ে জীবন শুরু হলেও শেষমেশ আলোর দেখা তো পেলাম।

বিদ্রঃ গল্পটা শেষ করছি। জানতে চাইবো না গল্পটা কেমন হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *