সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 26

সায়েমকে জড়িয়ে ধরে নিশি কথা বলছে। সায়েম হু,হ্যা,ওহ তে উত্তর করছে। নিশি আবারো প্রশ্ন করে,

-তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে সায়েম?
-বাইরে।
-কেনো বাইরে ছিলে?
-জানিনা।

নিশিকে ছাড়িয়ে সায়েম সামনে আগায়। নিশি সায়েমের টি শার্ট টেনে ধরে। সায়েম চোখ বন্ধ করে থেমে যায়। সায়েম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিশি সায়েমের সামনে এসে ওর চোখের দিকে তাঁকায়।

-কিছু কি হয়েছে তোমার?
-নাহ। আমি ঘুমাই? মাথা ব্যাথা করছে।
-একটাবার বলো কি হয়েছে? আমি কি কোনো ভুল করেছি?
-না নিশি। তুমি কি ভুল করবে? বাই দি ওয়ে শাড়ি পরেছো কেনো?
-ভালো লাগছে না? (শাড়ির আচল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশি)
-ভীষণ মিষ্টি লাগছে। সেই বিয়ের দিন হাল্কা সাজে দেখেছিলাম তোমায়। এরপর তো আর সাজতে দেখিনি। আজকে হঠাৎ দেখে ভালো লাগলো। মনোমুগ্ধকর সারপ্রাইজ ও বলতে পারো।
-আচ্ছা কালকে আমি মাহবুবের কথা বলাতে কি তুমি এমন করছো?

নিশির প্রশ্ন শুনে সায়েম চুপ হয়ে গেলো। আসল কারণ তো এইটাই। কোন স্বামী চাইবে নিজের বউয়ের মুখে আরেক স্বামীর প্রশংসা শুনতে? নিজের কাছে কি খারাপ লাগবেনা? কষ্ট হবেনা? সায়েম তখনি চুপ থাকে যখন নিশি ওর সত্যিটা ধরে ফেলে। নিশির কাছে এখন সব পরিষ্কার। নিশি খাটের উপর বসে আছে মাথা নিচু করে আর সায়েম হাত ভাঁজ করে জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকার রূপ দেখছে।

-সায়েম, আমার কাছে তুমি যেমন সত্যি মাহবুব ও কিন্তু ঠিক ততটাই সত্যি। ও আমার ভালবাসা ছিলো, আমার বিশ্বাস ছিলো। কিভাবে ভুলে যাব আমি মাহবুবকে?
-আমি তোমার ভালবাসা নই? আমি তোমার বিশ্বাস নই? (একটু হেসে সায়েম)
-সায়েম আমি তোমায় কি করে বোঝাই? তুমি আমার বর্তমান।
-আচ্ছা বাদ দাও। চেঞ্জ করে এসো। ঘুমাই। ভালো লাগছে না।
-সায়েম আমি কিন্তু তোমার জন্যই সেজেছি। কতদিন পর চোখে কাজল লাগিয়েছি সেইটা তুমি দেখছো না?
-বললাম তো অনেক প্রিটি লাগছে। (নিশির গালে একহাত দিয়ে সায়েম)
-এখন তুমি আমায় কোলে নিবা।
-রিজন?
-আমি বলেছি তাই নিবা।

সায়েম নিশিকে কোলে নিলো। নিশি সায়েমের গলা জড়িয়ে ধরে আছে।

-এইবার রুফ টপে চলো। (নিশি)
-এত রাতে?
-হ্যা চলো।
-তুমি এত হাল্কা হচ্ছো কেন?
-না মুটিয়ে যাচ্ছি।

দুইজন কথা বলতে বলতে ছাদে গেলো। ছাদের ওপরে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ঘর আছে। পুরোটা ঘর খড়ের আর উপরে নীল রঙের টিন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ছোট্ট একটা বেড আছে সেখানে আর বাহারি রকমের শোপিস। মাহবুবের পছন্দের জায়গা এই ঘরটা। মাহবুবের বাবা শখ করে এই ঘরটা বানিয়েছিলেন। ছোট মায়ের ঘরের দরজা খোলা ছিলো। ছেলে আর ছেলের বউকে এইভাবে ছাদে যেতে দেখে হাসলেন তিনি। চারতলা সিঁড়ি বেয়ে সায়েম নিশিকে নিয়ে ছাদে গেলো। ছাদে যাওয়ার পর নিশি চিলেকোঠার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,

-ওইখানে নিয়ে চলো।
-ওখানে গিয়ে কি করবা? অনেকদিন ধরে ঘরটা বন্ধ। ধুলাবালি আছে।
-প্লিজ চলো।

সায়েম আবার দেড়তলা সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় গেলো। এইবার সায়েম খানিকটা অবাক হলো। খানিকটা না বেশ অবাকই হলো।

-এই ঘর সাজিয়েছে কে? (সায়েম নিশিকে কোল থেকে নামিয়ে)
-আমি।
-কবে?
-আজকে বিকেলে।
-কিন্তু কেনো?
-সারপ্রাইজ কি তুমিই আমায় দিয়ে যাবা? আমি দিতে পারিনা?
-ফুল কে এনে দিলো তোমায়?
-দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছি।
-বাগানবিলাস আমার পছন্দের ফুল। শুধু পছন্দের না খুব পছন্দের।
-সেইটা কি আমার অজানা?
-আসলেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
-বউকে থ্যাংকস দিতে হয়?
-না৷ আকাশ দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। চলো নিচে যাই।
-না। এখানেই থাকব আজ।
-মাইসারা?
-ছোট মা দেখে রাখবে মাইসারাকে।

ওদের টুকটাক কথার মাঝে বাইরে প্রচন্ড বাতাস বইতে শুরু করলো। সায়েম দ্রুত জানালা, দরজা লক করে দিলো। বাতাসের শব্দ এখন আর শোনা যাচ্ছেনা। ঘরে জায়গায় জায়গায় অনেক ক্যান্ডেল রাখা । সায়েম সেগুলো ছুঁয়ে দেখছিলো আর তখনি কারেন্ট চলে গেলো। নিশি যেন এরই অপেক্ষায় ছিলো। নিশি ম্যাচ হাতে নিয়ে সবগুলো মোম জ্বালালো। এই ঘরে কেউ থাকেনা বলে এখানে আইপিএস এর সংযোগ দেওয়া হয়নি। পুরো ঘর মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে গেলো। সায়েম হঠাৎ খেয়াল করলো মোমের আলোতে নিশির চেহারা স্বর্নের মতো উজ্জ্বল করছে। লিপস্টিকের রঙটা এত দারুন কেন? নাকি ওর ঠোঁট গুলোই দারুন? ম্যাচের কাঠি ফেলে দেওয়ার পর সায়েম নিশির হাত ধরলো। নিশি সায়েমের দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু নাচালো।

-আজকে তোমায় এত চঞ্চল লাগছে কেনো? (নিশির কাছে গিয়ে সায়েম)
-আমি যেমন তেমনি তো লাগার কথা!
-না, আজকে বেশিই চঞ্চল লাগছে। (নিশির চুলগুলো খুলে দিলো সায়েম)
-না সায়েম।
-আবার না?
-ছাড়ো।
-ছেড়ে দিব?
-জানিনা।
-এইসব কিছু কি শুধুই সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এরেঞ্জ করেছো?
-তাও জানিনা।
-আমি হয়ত জানি। (নিশিকে আরো কাছে এনে সায়েম)
-না জানোনা।

বৃষ্টির ফোঁটায় টিনের চালে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। এতটাই শব্দ যে সায়েম আর নিশিকে একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে কথা বলতে হচ্ছে আর অপরজন তা শুনছে। দুই বছরে এত সুখ কি সায়েম পেয়েছিলো? নিশির আচরণ হঠাৎ এত পালটে গেলো কি করে? এইসব ভাবনা যেমন সায়েম ভাবছে আবার ভাবছে নিশি হয়ত সায়েমকে বুঝে তাই এমনটা করেছে।

সকাল সাতটায়,

সায়েম অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এই ছেলে ঘুম ছাড়া হয়ত কিছু বুঝেনা। নিশি ঘুম থেকে জেগে মাইসারাকে খুঁজছে তখন ওর মনে হলো মাইসারা তো নিচে আর ও ছাদে! নিশি উঠতে যাবে তখন শাড়ির সাথে টান খেয়ে আবার শুয়ে পরে। নিশির শাড়ি প্রায় অর্ধেকটাই সায়েমের বুকের নিচে আর সায়েম উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।

-এইভাবে কি কেউ আচল জড়িয়ে ঘুমায়? (মনে মনে নিশি) সায়েম? এইই সায়েম? অনেক বেলা হয়ে গেছে। তুমিও ফোন আনোনি আর আমিও আনিনি। কয়টা বাজে দেখতে পারছি না তো। উঠো প্লিজ। (নিশি)
-আই লাভ ইউ। (নিশিকে জড়িয়ে ধরে সায়েম)
-তুমি উঠবা নাকি বেত নিয়ে আসব? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে স্বপ্ন দেখছো? এইইইইই! (সায়েমকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিশি)
-এইভাবে কেউ চিল্লায়? (উঠে বসে সায়েম)
-এই মাত্র কাকে আই লাভ ইউ বললা তুমি? (চোখ রাঙিয়ে নিশি)
-তো…. তোহা কে। (তোমাকে বলতে গিয়ে ইচ্ছে করেই তোহা বলল সায়েম যাতে নিশি রেগে যায়)
-তোহা কে?
-আমার চারটা গার্লফ্রেন্ড এর মধ্যে দ্বিতীয় টা। খুব ভালো মেয়ে জানো? কতকিছু রেঁধে খাওয়াতো আমাকে! (চোখ বন্ধ করে সায়েম)
-হারামি (একটা শোপিস ছুড়ে মেরে সায়েমের দিকে) ঘুমা তুই। আমি নিচে যাচ্ছি।
-ওই আমি তোমায় ছাড়া আর কাকে আই লাভ ইউ বলব? (নিশির হাত ধরে কাছে এনে) তোমাকেই বলেছি। তোহা নামে কাউকেই চিনিনা। ইউ আর দা বেস্ট আর কাউকে লাগবেনা। (নিশির কপালে চুমু দিয়ে সায়েম)
-এখন কি উঠবা? টি শার্ট টা পরবা? যাবা নিচে?
-আরেকটু থাকি এভাবে?
-থাকো তুমি।

সায়েমকে ধাক্কা মেরে নিশি শাড়ি, চুল সব ঠিকঠাক করে নিচে যায়। আজকে ফজরের নামাজটাও পরা হয়নি। এভাবে সারারাত জেগে রোমান্স করলে উঠবে কিভাবে? ছাদের জমে থাকা পানিগুলোতে রোদের আলো পরে চিকচিক করছে। ওই আলোতে নিশির চোখ ঝলসে যাচ্ছে। ছোট মায়ের বদৌলতে সবাই জানে নিশি আর সায়েম ছাদে রাত কাটিয়েছে। তুর্না বাসায় ছিলো বলে ব্রেকফাস্ট ওই রেডি করলো। নিশি ঘরের বেল বাজালো। তুর্না এসে দরজা খুলল। তুর্না মুখে আঙুল দিয়ে হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে। ছোট মায়ের ও মুখ উজ্জ্বল লাগছে। মাইসারাকে খাওয়াচ্ছে ছোট মা। নিশির মা ও কেনো যেনো হাসছে। নিশি এইবার বিপাকে পরে গেলো।

-বউমা কোথায় ছিলে? (ছোট মা)
-আসলে! (নিশি থতমত খাচ্ছে)
-আন্টি আমিই বলছি। খেয়াল করেছেন সায়েম ভাইয়াও কিন্তু ঘরে নেই। হয়ত ছাদে ছিলো রাতে। (তুর্না হাসছে)
-না মা আসলে কারেন্ট ছিলো না রাতে তাই গিয়েছিলাম। ঘরে গরম লাগছিলো। (নিশি)
-ও! শাড়ি পরে গিয়েছিলে আপু? (তুর্না)
-বেশি কথা বলিস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

নিশি দ্রুত চলে যায়। নিশির যাওয়া দেখে সবাই হাসছে। ওদের হাসার মাঝেই সায়েম চলে আসে।

-আন্টি হিরো চলে এসেছে। (তুর্না)
-কে হিরো? (সায়েম)
-কেন ভাইয়া? হিরোইনের পর যে এন্ট্রি নিলো। সারারাত কোথায় ছিলা? (তুর্না)
-ছাদে।
-কেন?
-এই কেনের জবাব নাই। আমার ছাদ আমি নাকি যেতে পারব না আর তার জন্য জবাবদিহি করা লাগবে!

সায়েম দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে বেডরুমে আসলো। নিশি গোসল করছে। সায়েম ঘরের দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করছে।

-নিশি দরজা খোলো।
-কেন?
-আমি তোমার সাথে গোসল করব।
-পা ভাঙব এখন।
-ভাঙো গা। তুমি দরজা না খুললে আমি দরজাই ভেঙে ফেলবো বললাম। (টাওয়েল নাচাতে নাচাতে সায়েম)
-আচ্ছা আসো। মাথার মগজটা ভেজে খেয়ে ফেলছো তুমি আমার।
-হ্যা এখন রক্তকে সস বানাবো।
-ইডিয়েট। (সায়েমের পিঠে শ্যাম্পুর বোতল দিয়ে মেরে নিশি)

ব্রেকফাস্ট টেবিলে এই প্রথম সায়েম আর নিশি একসাথে আসলো। দুজনকে দেখেই হাসিখুশি মনে হচ্ছে। তুর্না আর মেহরাব দুজন দুজনের দিকে তাঁকিয়ে হাসছে। ছোট মা আর নিশির মা খেয়ে উঠে গেছে। ঘরে হেঁটে হেঁটে মাইসারা খেলছে।

-সায়েম ভাইয়ায়ায়ায়ায়া! (তুর্না)
-কি? (সায়েম)
-কালকে কি কি করলা? শালিকা হিসেবে বলতেই পারো। (সায়েমকে চোখ মেরে তুর্না)
-কি করবো? আজব তোহ! নিশি তোমার বোন কি বলছে এসব? (মাইসারাকে কোলে নিয়ে সায়েম)
-কি বলছিস তুই? (নিশি)
-আহা আপু তুমি ঢুকো না এর মাঝে! কথা হচ্ছে ভাইয়ার সাথে।
-ঠিক আছে ঢুকলাম না। খেতে আয়।
-আসছি। খবর বের করছি ওয়েট! (তুর্না সায়েমকে বলল)
-কি আর খবর বের করবা? তুমি আবার খালামনি হবা এই ই। (সায়েম)
-হাহাহাহাহা। সেইটাই কি?
-হোপ সো। (হাসতে হাসতে সায়েম)

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *