সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 11

সায়েম বাসায় এসেই ছবিগুলো ঘাটছে চেঞ্জ না করেই। মাহবুব চেঞ্জ করে এসে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে বলে,

-চেঞ্জ করতে যা।
-ভাইয়া দেখো তোমাদের এই পিকটা দারুণ হয়েছে। বাঁধাই করে রাখতে পারো৷
-দেখি।

মাহবুব ক্যামেরা নিয়ে সব ছবিগুলো দেখছে আর তখন নিশির ডাক পরলো।

-সায়েম?
-জ্বি ভাবি
-তোমার ভাইয়া কোথায়?
-আমার সামনেই।
-আসতে বলো তো।
-পারব না আমি আসতে। (মাহবুব)
-তাহলে সায়েম তুমি আসো একটু।

সায়েম উঠতে যাবে তখন সায়েমের হাত ধরে সায়েমকে বসায় মাহবুব কারণ ও জানে নিশি ওকে কেনো ডাকছে। শাড়ির সেফটিপিন খুলতে পারেনা নিশি।

-বস তুই। আমিই যাচ্ছি। (মাহবুব)
-পানি ঘোলা করে না খেয়ে পরিষ্কার থাকতেই তো খেতে পারো। (ক্যামেরা হাতে নিয়ে সায়েম)
-ফাজিল!

সায়েমকে বকে মাহবুব ঘরে গেলো। গিয়ে দেখে নিশি সব উলটা পালটা করে রেখেছে। চুলের মধ্যে ক্লিপ ঝুলছে, শাড়ির কোনো আগামাথা নেই।

-কি সমস্যা তোমার? শাড়ির সেফটিপিন খুলতে পারো না তো শাড়ি পর কেনো? (মাহবুব)
-চুলের ক্লিপগুলো একটু খুলে দাও তো আগে এরপর শাড়ির সেফটিপিন গুলো খুলে দাও। অসহ্য লাগছে আমার এখন।
-পারবনা। নিজেরটা নিজে খুলে নাও। (মাহবুব)
-তুমি তো পারবাই সাথে তোমার ঘাড় ও পারবে। জলদি খুলো। (চিরুনি হাতে নিয়ে নিশি)
-তুমি কি আমায় মারবা নাকি?
-মারতেও পারি সো হারি আপ। খুলো সব।
-এই কি খুলব? (চোখ বড় বড় করে মাহবুব)
-গাধা আমার ক্লিপগুলো খুলো।

নিশি ড্রেসিংটেবিল এর সামনে বসেছে আর মাহবুব একটা একটা করে চুলের ক্লিপ খুলছে। চুলের ক্লিপ খোলা হয়ে গেলে শাড়ির পিন খুলেদিলো। এরপর মাহবুব বের হয়ে যাওয়ার পর নিশি চেঞ্জ করে ডিনার রেডি করলো। নিশি রান্না করছে আর মাহবুব বাইরে সায়েমের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছিলো আর ক্যামেলিয়া জানালা থেকে দেখছিলো। সায়েম খেলবে বলে ব্যাডমিন্টন আর ফেদার নিয়ে এসেছিলো ঢাকা থেকে। নিশি রান্না করে বাইরে আসে ওদের ডাক দিতে। চারদিকে জোনাকিপোকার সবুজ আলো আর ঝিঁঝি পোকার ডাক। নিশি একটু দূর থেকে বলে,

-ওই খেতে আসো। এই ঠান্ডার মধ্যে বাইরে খেলছে।
-তো কি করব? ব্যাডমিন্টন খেললে শরীর এমনেই গরম হয়ে যায় ভাবি। তুমি খেলবা? (সায়েম)
-জ্বি না আমার এত শরীর গরম করার ইচ্ছা নাই। তারাতারি খেতে আসো দুইজনেই। আমি ওয়েট করছি।
-আসছি। (সায়েম)

নিশি বাসায় চলে আসে আর আঙিনায় থাকা গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছে। মাহবুব আর সায়েম তখন বাসায় ঢুকলো। নিশি খাবার সার্ভ করলো আর ওরা খেতে বসলো।

-ভাইয়া কালকে তো তুই অফিসে যাবি না?
-হ্যা।
-কালকে তাইলে আমার একাই ঘুরতে হবে।
-দূরে কোথাও যাবি না আর জঙ্গলে তো ভুলেও না।
-হ্যা জানি।

তিনজন ডিনার শেষ করে টিভি দেখতে বসলো। নিশি অবশ্য অন্য কাজ ও করছিলো। সায়েম একটা সোফা দখল করে শুয়ে হরর ফিল্ম দেখছে আর মাহবুব বসে আছে। সাড়ে দশটা বাজার পর মাহবুব হাই তুলছে।

-এই তুই মুভি শেষ করে ঘুমিয়ে যাবি। রাত জাগবি না। আর শোন জানালা বন্ধ করে দে সব। আমি ঘুমাতে যাই।
-আচ্ছা যাও। গুড নাইট।

মাহবুব গিয়ে শুয়ে পরে আর নিশি ওর কাজ শেষ করে আধা ঘণ্টা পর ঘুমাতে যায়। যাওয়ার আগে সায়েমকে চানাচুরের প্যাকেট আর কফি বানিয়ে দিয়ে যায়।

-আমি তো বলিনি এসব দিতে। তুমি বুঝলা কিভাবে যে আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছিলো? (খুশি হয়ে সায়েম)
-ব্যাপার নাহ এসব বোঝা। তোমার ভাইয়া বলেছিলো তুমি চানাচুর বেশি খাও। আচ্ছা বেশি রাত জেগো না। গুড নাইট।
-গুড নাইট সুইট ভাবি।
-তোমার ভাইয়া শুনলে তোমায় বাসা থেকে বের করে দিবে। (হেসে নিশি)
-পারবেনা। (সায়েম ও হাসছে)
-আচ্ছা গুড নাইট।

নিশি ঘরে এসে দেখে মাহবুবের ফোনে কল এসেছে কিন্তু ফোনটা সাইলেন্ট আর মাহবুব পাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। নিশি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে তৃশা নামে কেউ। নিশি অনেক অবাক হয়ে যায়৷ ফোনটা রিসিভ করে নিশি।

-হ্যালো। (নিশি)
-মাহবুব কোথায়? (তৃশা)
-ও ঘুমাচ্ছে কিন্তু আপনি কে?
-আমি তৃশা মাহবুবের বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু আপনি কে?
-বেস্ট ফ্রেন্ড ও আপনার আর এইটা জানেন না আমি কে? (নিশির অনেক কষ্ট লাগছে)
-না জানিনা। কে আপনি?
-আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কেই জিজ্ঞেস করবেন কে আমি। আর এত রাতে ফোন দিয়েছিলেন কেনো?
-দরকার ছিল তাই৷ আচ্ছা রাখছি। কাল মাহবুবের সাথেই কথা বলব।

তৃশা ফোন কেটে দিলো আর নিশি ফোনটা খাটের উপর ছুঁড়ে মারলো। তখন ওর মনে হলো মাহবুবের ফোনটা দেখা উচিৎ। নিশি মাহবুবের ফোন ধরে কিন্তু ফোন লক করা। ফোনে পাসওয়ার্ড লক। নিশি মাহবুবের নামে ট্রাই করলো, তৃশার নামে ট্রাই করলো কিন্তু হলো না। তখন ওর মনে পরে মাহবুব নিশির নাম দিয়েই ফোন লক করে রাখতো। নিশি তখন ওর নামে ট্রাই করার পর ফোনের লক খুলল। নিশি আগে কল লিস্টে যায় কিন্তু কিছুই নেই। ফোন মেসেজে গিয়েও কিছু পায়নি। এরপর গ্যালারিতে যাওয়ার পর নিশির চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মাহবুবকে জড়িয়ে ধরে একটা মেয়ের ছবি! মাহবুব ও মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেছিলো একহাতে। শুধুমাত্র ওই মেয়ের সাথেই মাহবুবের ছবি। বেশ কয়েকবার ওরা ডেটেও গিয়েছিলো। নিশি মাহবুবের হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপি সব চেক করলো। হোয়াটসঅ্যাপ এর প্রোফাইলে ওই মেয়েটার ছবি দেওয়া আর স্কাইপিতে ওই মেয়েটার সাথে ভিডিও চ্যাট। নিশি আর কিছু দেখলো না। নিশি ফোনটা রেখে দিলো আর ও খাটে বসলো। মাহবুব তখন উঠে যায়। নিশিকে ঘুমানোর জায়গা দেয়। কিন্তু নিশিকে শুতে না দেখে ও পিছু ফিরে তাঁকায় আর দেখে নিশি নিঃশব্দে কাঁদছে।

-কি হয়েছে? (উঠে বসে মাহবুব)
-তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড ফোন দিয়েছিলো। (চোখ মুছে নিশি)
-হ্যা দিতেই পারে। তুমি কি রিসিভ করেছো?
-হ্যা করেছিলাম রিসিভ।
-আমার পার্মিশন ছাড়া?
-সেইজন্য স্যরি। পার্মিশন নেইনি বলেই তো আজ এত কিছু দেখলাম নিজের চোখে।
-কি দেখছো?
-তোমার গার্লফ্রেন্ড কে। সুন্দর মানিয়েছে তো তোমাদের। ওই তাহলে আছে আমার কাজ করার জন্য! জানতাম না তো তাই কাল এই কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমার কাজ করার জন্য কেউ আছে কি না! আমায় বিয়ে করে দায় না সাড়লেও হতো। (নিশি কেঁদে কেঁদে কথা বলছে) এই জন্য আমায় ছোঁয়ার দরকার হয়না তাইনা? বাইরে তো ও আছেই।
-নিশি মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ। আমার ফোন ধরেছো তুমি?
-হ্যা ধরেছি।
-কি এমন দেখেছো যে এসব বলছো? (মাহবুব এখন সিরিয়াস)
-তোমার ফোন তুমি জানো না? আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখাচ্ছি। (চোখ মুছে নিশি)

সব দেখার পর মাহবুব বলল,

-তৃশা আরাফের বউ হয় আর ও তোমার সাথে মজা করেছে হয়ত। তৃশা জানে আমি সাড়ে দশটার পর ঘুমিয়ে যাই তাই তোমার সাথে মজা করেছে। আর এই মেয়েটা আরাফের ছোট শালিকা। কোনো এক পার্টিতে দেখা হয়েছিলো ওর সাথে। ভাইয়া বলেই ডাকে আমাকে। আর স্কাইপিতেই মাঝে মাঝে কথা হয় ওর সাথে। আর আমাকে জড়িয়ে ধরে ও একদিন পিক তুলতে চেয়েছিলো। ছোট বলে অনুমতি দিয়েছিলাম। আর হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করে ও অপেন করে দেয় তাই ও নিজের পিক ই দিয়েছে। আমিও আর চেঞ্জ করিনি। ক্ল্যারিফিকেশন পেয়েছো তুমি?
-এতবার ডেটে যাওয়া এত ক্লোজনেস এইসব কোনো ভাইবোনের হয়? তুমি কি আমায় বোকা পেয়েছো?
-বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার আর ডেটে যাইনাই। আরাফ আর তৃশা আমায় ওদের সাথে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলো আনফরচুনেটলি সেখানে ইকরা (মেয়েটির নাম) ও ছিল।
-মিথ্যেবাদী কোথাকার! কেনো বিয়ে করেছিলি আমায়? কেনো এই এতগুলো বছর আমায় কষ্ট দিয়েছিলি? (নিশি ডিরেক্ট মাহবুবের টি শার্টের নেক ধরে)
-দেখো নিশি আমি মিথ্যে বলতে শিখিনাই আর এসব বিষয়ে তো না ই। ইকরা তৃশার ছোট বোন। ইকরা মাত্র এলিভেনে পড়ে। আমার থেকে কতটা ছোট ও! এসব চিন্তা মাথায় আসে কেন তোমার?
-চুপ কোনো কথা বলবিনা তুই!

নিশি খাট থেকে উঠে যেতে নেয় তখন মাহবুব নিশির হাত ধরে আর ফোন হাতে নিয়ে আরাফকে কল করে।

-কিরে এত রাতে? (ঘুম ঘুম চোখে আরাফ)
-তোর বউ কই রে? ও তো আমার সংসারে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। (দাঁড়িয়ে মাহবুব)
-কেন তৃশা আবার কি করেছে?

এরপর মাহবুব নিশির সামনেই আরাফকে সব বলছে। নিশি জানত না আরাফের বউয়ের নাম তৃশা। আরাফ সব শুনে হাসছে আর নিশি কাঁদছে।

-দেখ ভাই হাসিস না। তোর শালিকাকে বলিস আমাকে যেন ভাইয়া না ডাকে।
-নিশিকে ফোনটা দে।
-কথা বলবেনা। লাউড দিচ্ছি যা বলার বল।

মাহবুব নিশির একহাত ধরে রেখেছে আর আরাফ নিশিকে বলছে,

-এই যে ভাবি শুনেন আমার বন্ধু ক্যারেক্টারলেস নয়। ইকরা আমার শালিকা আর মাহবুবকে ভাইয়া বলেই জানে। আর আমার বউ তোমার সাথে মজা করেছে। এইভাবে কান্নাকাটির কিছু নাই। একমাত্র তোমাকেই ভালবাসে ও। এইসব নিয়ে মাহবুবকে ডাউট করনা অন্তত।
-এখন ফোন রাখ। আর তৃশাকে বলিস ওর কান যদি আমি না ছিঁড়ছি! বউকে রেখে আমি ওকে বেস্ট ফ্রেন্ড বানাতে যাব? (আরাফকে ঝারি দিয়ে মাহবুব)
-তৃশাকে ঝারি দে! আমায় দিচ্ছিস কেনো? (আরাফ হাসছে)
-কালকে দিব। এখন রাখছি বাই।
-অল দ্যা বেস্ট দোস্ত! বউয়ের রাগ ভাঙ্গা এখন।

মাহবুব ফোন বিছানায় ফেলে দেয় আর নিশি সব শোনার পরেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মাহবুব নিশিকে ওর দিকে ঘুরায়। নিশির চোখ মুছতে মুছতে বলে,

-দেখো নিশি তুমি আমার প্রথম ভালবাসা আর তুমিই শেষ। তোমার জায়গায় অন্য কেউ কখনো ঢুকতে পারবেনা। শুধু শুধু কেঁদো না। (নিশিকে জড়িয়ে ধরে মাহবুব)
-স্যরি তুই তুকারি করেছি তোমার সাথে।
-ইটস ওকে। (নিশিকে ছেড়ে দিয়ে মাহবুব)
-ছেড়ো না প্লিজ। (মাহবুবকে জোর করে জড়িয়ে ধরে নিশি)

মাহবুব আর কিছু বলেনি কারণ কয়দিন নিজের ভালবাসাকে সরিয়ে রাখবে? এমন তো না যে এরেঞ্জ মেরেজ যার জন্য নিজেকে তৈরি করতে সময় লাগবে! মাহবুব ও নিশিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিলো। একটা সময় মাহবুব ও কেঁদে দিলো নিজের ভুলের জন্য।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *