যদি তুমি জানতে !! Part- 16
-আমি দ্বিতীয়বারের মতো আবারও দেরি করে ফেললাম..
-সাঈদ ভাই প্লিজ ওই দিপ….
মাথায় চোট পাওয়ায় সাঈদ ভাইয়ের বুকেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লাম। এরপর কিছু মনে নেই।।
সকালে চোখ খুললে দেখি আমি রুমে শুয়ে আছি। মাথার উপরে ফ্যান চলছে। পাশে বড় আপু বসে আছেন। আমি উঠে বসতে নিলে আপু আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। আর বললেন-
-ফিহা ঠিক আছিস?
-আপু আমি এখানে কীভাবে?সাঈ…
-শান্ত হ ফিহা। সব বলছি।জানিস কাল রাতে আমার সাথেও অদ্ভূত কিছু ঘটেছে। আমি ডাইনিং টেবিল থেকে পানি খেয়ে রুমের দিকে আসছিলাম কেউ পিছন থেকে মুখ চেপে রুমাল শুকিয়ে দেয়। এরপর কিছু মনে নেই। সকালে উঠে দেখি আমি ফ্লোরে শুয়ে আছি। মাথা হ্যাং করে আছে। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে তোর রুমের দিকে গেলে ফ্লোরে ছিপছিপ রক্ত ছিল। রুমে ঢুকে দেখি তুই নেই। ভয়ে তোকে পুরো বাড়িতে খুজতে থাকলে ছাদে এসে তোকে ফ্লোরে আঘাত অবস্থায় দেখি। আমার অনেক ভয় করছে রে!!
-আপু তার চেহারা দেখেছো? সাঈদ ভাই কোথায় আপু? উনি কাল আমার সাথে ছিলো!!পাশে ছিলো !!
-কি বলছিস! সাঈদ ভাইয়া তিনদিন ধরে নিখোজ। বিয়ের দিন দুপুরের পর থেকে কেউ তার খোজ পাচ্ছেনা! বড় খালামনি না পারতে পুলিশকে খবর দিয়েছে। আর তুই বলছিস ভাইয়া তোর সাথে ছিল!!
-হ্যাঁ সত্যি বিশ্বাস কর ভাইয়া সাথে ছিল। উনি রাতের বেলা আমার কাছে এসেছিলেন। ওই হায়েনা যাওয়ার পর এসেছিল আপু, সাঈদ ভাই ছিল!
-পাগলের মতো কথা কেন বলছিস! সাঈদ ভাই গুম হয়ে গেছে, কেউ কিচ্ছু জানে না উনার ব্যাপারে!! খালামনি, খালু চেষ্টা চালাচ্ছেন উনাকে খুজার!
-না..ওটা সাঈদ ভাই-ই ছিলো! আমি কোনো ভুল দেখিনি ! আমি ভুল দেখিনি!
-ফিহা প্লিজ শান্ত হ। তুই কল্পনা করেছিস ফিহা। ভাই ছিলো না। তুই নিজেই দেখ তুই ছাদে ওভাবে পড়ে থাকলে ভাই কি তোকে রুমে নিয়ে আসত না! ফেলে রাখতো নাকি? ওটা ভুল দেখেছিস ফিহা।
-মা খালামনি কখন আসবে আপু? আমি উনাদের বলব ওটা ভাই ছিল!
-পাগলামো করিস না।তোর অবস্থা দেখে আরো ঝামেলা হবে। মা খালামনি সবাই খুব চিন্তায় আছে। ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখ ফিহা।
আপুর কথা বিশ্বাসই হচ্ছিল না সাঈদ ভাইকে নিয়ে আমি কিনা স্বপ্ন দেখেছি।ওটা স্বপ্ন হলে আমি তাহলে ভুল দেখেছি? ওটা সাঈদ ভাই ছিলনা? মানে ওখানে সাঈদ ভাই ছিলই না??খালামনি আসুক আমি সব বলব ভাই এসেছিল, আমি কোনো ভুল দেখিনি! ভাই আমার সাথে রাগ করে ওভাবে ফেলে চলে গেছে। হ্যাঁ উনি রাগ দেখিয়ে এমন করেছে!
আপু আমার পাশে বসেই সময় কাটিয়ে দিল। আপু কাল খুব ভয় পেয়েছে। এ কারনে আমরা দুবোন একসাথেই শুয়ে বসে আছি। ঘন্টাখানিক পর বাড়ির সব সার্ভেন্ট এসে কাজ করতে শুরু করেছে। আমরা নাস্তা না খেয়ে সময় পার করছি কখন বড়রা আসবেন, সব জানাব। ঠিক দুপুরের দিকে মা, বড় খালামনি, মেজো খালামনি, দিপ ভাই, ভাবি সবাই চলে এসেছেন। একটা সার্ভেন্ট এসে জানিয়ে যায় সবাই ফিরে এসেছেন। আপু উঠে সবাইকে দেখতে গেল। একটু পর দেখি সব হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে আমার পাশে ঘেরাও করে দাড়িয়ে একেক রকম প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। খালামনি এসে পাশে বসলেন। মা আমার কপালে ব্যান্ডেজ দেখে আতকিয়ে উঠলেন।মেজো খালামনি চেচামেচি করছেন।বড় খালামনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
-মা আমার, তোকে না করেছিলাম একা একা থাকিস না, চল আমাদের সাথে। কিন্তু তুই গেলি না। দেখলি ওই অজ্ঞাত মানুষ তোকে কি করলো।।
-খালামনি আমি ঠিক আছি। কিছু হয়নি।
-ফিহা মুখ দেখেছিস?
-না খালামনি, ঢাকা ছিল।
হঠাৎ দেখি সাঈদ ভাই ভিড় ঠেলেঠুলে আমার পায়ের ওখানে দাড়িয়ে হাসছেন। আর বলছেন-
– নাবিলা আমি আছি। তোর সাঈদ ভাইয়ের কিছু হয়নি।
আমি সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে সবাই পিটপিট করে অবাকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন কোনো ভূত দেখে ফেলেছেন। খালামনি আমার থুতনি উচু করে বললেন-
-ফিহা হাসছিস কেন?
-খালামনি দেখতে পাচ্ছো না আমি সাঈদ ভাইকে দেখে হাসছি!!
-কোথায় সাঈদ? এখানে তো সব আমরা।
-ওইযে সাঈদ, আমার পায়ের কাছে দাড়িয়ে..
আমি আঙ্গুল তুলে পায়ের ওখানে ইশারা করলে সবাই একবার আমার দিকে একবার ওইদিকটায় তাকায়। সবাই হা করে আছেন। হা করে থাকাটাই স্বাভাবিক !! ভাই উনাদের সামনে তিনদিন পর এসেছেন!! মা চোখের পানি ছেড়ে বললেন-
-ফিহারে তুই কি দেখাচ্ছিস!! ওখানে কেউ নেই। তুই কি বলছিস রে মা!
-আরে মা ফাইজলামি বন্ধ করো তো ! ওইযে সাঈদ ভাই দাড়িয়ে চোখে দেখো না! খালামনি, তুমি মাকে কিছু বলনা!! মা সবসময় না না করতে থাকে!
খালামনিকে বলার পর কি হলো তা বুঝলাম না, সবাই এক হতাশ মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ আমার কথামতো সেদিকে তাকালো না। খালামনি দিপ ভাইয়াকে বললেন-
-দিপ আজকে সব কাজ ফেলে ফিহাকে নিয়ে একটু ডাক্তারের কাছে যাবি? আমি সিরিয়ালের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তুই একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা।
-আচ্ছা খালামনি। বিকেলের দিকে ফ্রি আছি, নিয়ে যেতে পারবো।
.
.
আমি যে দুইদুইবার কল্পনা করেছি তা আমার মাথাব্যথা ঠিক হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি। বারবার ভাইকে নিয়ে কল্পনার জগত সাজিয়ে ফেলতাম। কিন্তু এখন অনেকটা সুস্থ।ব্যাথা নেই। আমি খালামনিকে হাজার বার না যাওয়ার জন্য বললেও লাভ হয়না। উনি আজ দিপ ভাইয়ের সাথে ডাক্তারের কাছে পাঠাবেনই। দিপ ভাই কালরাতের মতো চাহনি দিয়ে ছিলেন। জানিনা আজ কোন খেলা হবে!
বিকেলের দিকে দিপ ভাইয়ের গাড়িতে খালামনি তুলে দেন। পাশে ড্রাইভিং সিটে দিপ ভাই বসে আছেন। গাড়ি ছাড়ার আগ পযর্ন্ত চেষ্টা চালালাম আমি যাব না। কিন্তু খালামনি কসম দিয়ে দিলেন। উনি বললেন আমি নাকি ভয়ে কারনে সবকিছু কল্পনার নজরে দেখছি। দিপ ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। পথিমধ্যে দেখলাম উনি ডাক্তারের ক্লিনিক মতো না যেয়ে অন্য রাস্তা ধরেছেন।খালামনি আমাকে ঠিক ওই ক্লিনিকটার নামই বলেছিল। কিন্তু দিপ ভাইতো ওটা পিছনে রেখে আসলেন। ভয়ে চুপসে যাচ্ছি। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন-
-কাল রাতে তুই আমার উপর থুথু মেরেছিলি, সেটার পুরষ্কার তোকে আজ দিব। তোর মতো হাজারটা মেয়েকে আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি, আর ওই জায়গায় তুই কিনা আমার মাথা হেট করছিস। ওয়েট এন্ড ওয়াচ্! তোকে খাব ভেবেছিলাম বাট প্ল্যান চেন্জ ! এখন তোকে টর্চার করবো দেন খাব!
আমি উনার কথা শুনে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি হাত না সরিয়ে গাড়ি ডায়ে-বামে করে নিচ্ছেন। আমি দুহাত ধরে গাড়ির ব্রেক করতে চাইলে দিপ ভাই গালে একনাগাড়ে থাপ্পড় দিতে থাকেন। আমার চুল মুঠো করে ধরে টান ধরলে আমি সেখান থেকে হাত ছেড়ে দেই। দিপ ভাই বামহাতে আমার চুল খাবলে ধরেছেন আর ডানহাতে গাড়ি চালাচ্ছেন। উনি গাড়ি আরো স্পিডে নিতে লাগলেন। একটার পর একটা উল্টোদিক থেকে আসা গাড়িগুলো আমাদের গাড়ির দিকে হর্ণ বাজিয়ে চলছে। আমি উনার হাতে নখ বসিয়ে দিলে উনি আরো ক্ষেপে যান। চুল আরো শক্ত করে ধরে গাড়ির জানালার গ্লাসে বারি দেন। আমার পাশে থাকা জানালার গ্লাস চুরমার হয়ে ভেঙে যায়। কালরাতে যে জায়গায় আঘাত পেয়েছি ওটার ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত বেরুতে থাকে। আমি ব্যথা পেয়ে শান্ত হয়ে উঠলে সে আগের মতোই গাড়ি চালাতে থাকে। হঠাৎ আমাদের গাড়ির পিছন অংশে থেকে তীব্রবেগে শব্দ হলো। আমি মাথায় হাত দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি একটা বাইকার হাতে হকি স্টিক নিয়ে গাড়ির কাচ ভেঙে দিয়েছে। দিপ ভাইও পিছনে তাকিয়ে দেখে কাচ ভেঙে পিছনের সিট ভেসে আছে। ভাই আরো জোরে গাড়ি চালালে পিছন থেকে আসা বাইকারটা আরো স্পিডে একবার আমার পাশে আরেকবার দিপ ভাইয়ের পাশে ক্রস করতে থাকে। আমি স্পষ্টভাবে খেয়াল করে দেখি, ওইদিন আমাদের রিক্সার পিছু নেওয়া “বখাটে”। একটুপর আবার সে দিপ ভাইয়ের ওপাশটায় এসে জানালায় হকিস্টিক দিয়ে জোরে বারি দেয়। সাথেসাথে দিপ ভাইয়ের সাইডে থাকা গ্লাস ভেঙে গালে কিছুঅংশ ঢুকে যায়। দিপ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলে-
-গাল থেকে কাচের টুকরা বের কর! হারি আপ!
আমি কাচ বের না কলে উল্টা আরো চেপে দিয়েছি! দিপ ভাই “আহ্ ” করে চিৎকার দিয়ে উঠলে আমি ব্রেক কষার চেষ্টা করি। কিন্তু আবারো বৃথা! দিপ ভাই আমাকে সশরীরের শক্তি দিয়ে অনেক জোরে থাপ্পড় মারেন। থাপ্পড়ের চোটে ঠৌটের কোনা কেটে, সেখান থেকেও রক্ত পড়তে থাকে। আমি ঠোঁটের কোনায় হাত লাগিয়ে দেখি রক্ত ! দিপ ভাই তার গাল থেকে এক খামচে কাচের টুকরা বের করে। আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ ভাই আমার দিকে ঝুকে আমার সাইডে থাকা গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সিটবেল্ট বাধা ছিলনা আমার।এরপর এক ধাক্কা মেরে চলন্ত গাড়ি থেকে মেইন রোডে ফেলে দেন। আমি তাল সামলাতে না পেরে কিছুদূর গড়িয়ে যেয়ে থেমে যাই।তাকানোর চেষ্টা করলে চোখ মুখ ঝাপসা দেখি। সবকিছু অস্পষ্ট দেখতে থাকি। ঝাপসা চোখে মনে হচ্ছে কেউ গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে দৌড়ে আসছে। এরপর কিছু মনে নেই……………
.
.
চোখ মেলে তাকালে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি। জানালা ভেদ করে সকালের রোদ রুমে পড়ছে। অনুভব করি মাথায় ব্যান্ডেজ, শরীর অনেকটা ব্যাথা। আমি মাথা ধরে উঠে বসলে চারপাশ তাকিয়ে পর্যবেক্ষন করতে থাকি, আসলে আমি কোথায় আছি। হঠাৎ মনে পড়ে আমি গাড়িতে ছিলাম। দিপ ভাই গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছেন। সব মনে পড়তেই যা বুঝলাম এইমূহুর্তে আমি বড় খালামনির বাসায় আছি। রুমটা সাঈদ ভাইয়ের। বিছানাটা তার। তাহলে কি খালামনি সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন?? উত্তর নেই। উঠে দাড়ালে চোখ আটকালো বারান্দায়। কেউ দাড়িয়ে দাড়িয়ে ধোয়া উঠা মগে চুমুক দিয়ে কফি বা চা খাচ্ছে। আমি সামনে যেয়ে কাধে হাত রাখলে সে পিছন ফিরে তাকায়।তাকে দেখে আমি কয়েকপা পিছিয়ে ভ্রুকুচকে তাকাই। সামনে দাড়িয়ে ডেশিংম্যান মুচকি হাসছে। সে আমাকে পাশ কাটিয়ে টেবিলে মগ রেখে সোফায় পা তুলে বসে বলল-
-বেক্কল ওভাবে দাড়িয়ে থাকিস না ! নাহলে আবার বেতাল হয়ে পড়বি!
-আমি জানি তুমি আবারও আমার কল্পনায় এসে বকছো। আমি তোমাকে বিশ্বাস করবোনা!
-ও তার মানে আমাকে নিয়ে কল্পনাও শুরু করেছিস! ছি ছি! কি না কি কল্পনা করছে!এখন তো লজ্জা করছে আমার।।
-তুমি কল্পনাতেও এভাবে বকো কেন? সামনে যখন ছিলে তখনও বকেছো, এখন কল্পনাতেও বকে যাচ্ছো!
-ওই গর্দভ ! দেখছিস না তোর সামনে বসে আছি!
-তুমি কল্পনাতে কতো কিছুই তো করো।।
-কত কিছু করি মানে!!
-ওইযে কাল রাতে দিপ যাওয়ার পর আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে।।।
-বাহ্! আমি তোর কল্পনায় এতো রোমান্টিক??
-এর চেয়েও বেশি।
-ওয়াও!! এখন তোর কি নমুনা লাগবে? আমি তোর কল্পনা নাকি আসল?
-হ্যাঁ! একদম পাক্কা নমুনা লাগবে!
বলা শেষ করতেই সাঈদ ভাই পা নামিয়ে সোফা ছেড়ে আমার কাছে আসলেন। উনি দুহাতে আমার গাল জড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন-
-বিশ্বাস হয়েছে?
-না!
উনি মুখ আরো কাছে এনে কপালে ঠোট ছুয়িয়ে বললেন-
-এখন বিশ্বাস হয়েছে?
-নাহ্!! কাল তুমি এর চেয়ে বেশি আদর করেছিলে।
সাঈদ ভাই আমার দিকে আরো একটু ঝুকে গলার কাছে মুখে এনে এক কামড় বসিয়ে দিলেন। আমি “আহ্” করে উঠলে বলেন-
-নাবিলা এখন বিশ্বাস হয়েছে?
-তাই বলে রাক্ষসের মতো কামড় দিবে নাকি!
হঠাৎ আমার খেয়াল হলো সাঈদ ভাই কামড় দেয়ার পরও আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন। তার মানে এটা স্বপ্ন না!!! সত্তি!!সাঈদ ভাই আমার সামনে! আমি ভুল দেখছিনা!!
সবকিছু তোয়াক্কা না করে আমি উনাকে শক্ত জড়িয়ে ধরি। উনার হৃৎপিন্ডের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। অজান্তেই চোখ ভাসিয়ে কান্না করছি।। সাঈদ ভাই সত্যি আমার কাছে! আমি উনাকে পেয়ে ফিরে পেয়েছি!!! ভাই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি উনার টিশার্ট খামচে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছি। সাঈদ ভাই আমার চুলে হাত ডুবিয়ে বললেন-
-কাম ডাউন নাবিলা। আমার কিছু হয়নি। কান্না করিস না। থাম!!
-মাফ করে দিও সাঈদ ভাই,
-চুপ। আমি জানি তুই কোনো ভুল কাজ করতেই পারিস না। আমি আমার নাবিলাকে চিনি।
সাঈদ ভাইয়ের কথাগুলো শুনে আরো শক্ত করে জাপটে ধরি। এতকিছুর পরও উনি আমাকে দূরে ঠেলে দেননি, আঘাত করেননি, কষ্ট দেননি, ভুল বুঝেননি।আমার কান্নাকাটি বেড়ে গেলে গেলে ভাই আমাকে ছেড়ে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিলেন।বিছানায় বসতেই ভাই আমার কোলে মাথা রেখে বললেন-
-নে, এখন কান্না করতে থাক। দেখি কতক্ষণ ভ্যা ভ্যা করতে পারিস!
-ভাই তুমি এমন কেনো!!!
-হুম অনেক খারাপ। আই নো।
-নাহ্। ভালোর চেয়েও ভালো। আমি তোমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলাম কিন্তু তুমি সব জেনেও আমাকে কাছে টেনে নিচ্ছো!!
-প্রয়োজন প্রিয়জন দুটোই অভ্যেসে আমার। অজান্তেই নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলেছি তোকে। ইটস ইম্পসিবল ফর মি টু লিভ ইউ!
-ধোকাবাজ আমি ভাই। এমন একটা মেয়েকে সাথে রাখতে চাও, যে কিনা তোমার যোগ্য না!
-জানিস আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড ফিহা, যে আমার যোগ্যতা দেখে পছন্দ করছিল। অবশ্য ওকে কখনো ভালোবাসি নজরে দেখতে পাইনি। সবার দেখাদেখি জাষ্ট সো কল্ড রিলেশনে ছিলাম। ও আমার হাইপার নেচার সহ্য করতে পারতো না। ওকে আমি ছেড়েছি, ও আমাকে ছাড়েনি।যদিও এটা কেউ জানেনা। আমাকে নিয়ে অনেক মেয়ে পাগল হলেও আমার রাগের কাছে কেউ টিকতে পারেনি। প্রথম দিন যখন তোকে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মেরেছিলাম, আমার মনে হয়না অন্য কোনো মেয়ে দ্বিতীয়বার আমাকে সহ্য করে নিতো। কিন্তু তুই! যা বলতাম যেভাবে বলতাম চুপচাপ মেনে নিতি। তোর মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি ছিল, যেটা আমার খুব পছন্দ। আমি তোর ছোটছোট করা প্রশ্ন, বাচালের মতো করা বকবকানির মধ্যে আনন্দ খুজে পেতাম।তুই কাছে না থাকলে তোর বাচ্চামোগুলো মনে করে নিজে নিজেই হাসতাম। আর এখন যদি বলিস তুই ধোকা দিয়েছিস, আমি তাও বিলিভ করব না।
-কারন?
-হাত ছেড়ে দেয়ার আগে কি বলেছিলাম মনে আছে?
-তুমি নিজের উপর যে বিশ্বাস রাখতে পারোনি তার চেয়ে বেশি বিশ্বাস আমাকে করো..
-কারেক্ট! আই হোপ জবাব পেয়ে গিয়েছিস।
-ভাই একটা প্রশ্ন করি?
-হুম।
-তুমি বেচে আছো কীভাবে? আমি তো ভেবেছি আমি তোমাকে খুন করে ফেলেছি।
-আমি জানতাম এমন কিছু হবে।
-মানে!
-মানে আমি দিপের প্ল্যান আগেই বুঝে ফেলেছি।
-ভাই! আমার গলায় লকেট…!
-গলায় হাত দিয়ে দেখ ওটা নেই।
-এ কি করলে সাঈদ ভাই! দিপ তো..
-আমি কাচা কাজ করিনা। চিন্তা করিস না।সব কন্টোলে আছে। আমি মাইক্রোফোনের চিপ হ্যাক হয়ে আমার মোতাবেক চালাচ্ছি।ঘুমাতে দে।
-ভাই শান্তি মতো ঘুম দিয়ো, না করবো না কিন্তু দিপ যদি কিছু করে ফেলে….ভাই আমার অনেক ভয় করছে ভাই। কি বলতে চাইছোতুমি খুলে বলো!! প্লিজ!!
-ওয়ান কন্ডিশন! আমি সব বলব!
-বলো!!
-আমি তোর কোলে যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ ঘুমাব। ডাক দিবি না!
-মন্জুর!!
-শোন তাহলে। আমরা সব ভাইবোন একত্র দেখে দিপ জমকালো পার্টির আয়োজন করল। সবার জন্য ড্রেস,এটা ওটা সব রেডি করল। সবার সবকিছু ঠিক ছিল, কাহিনিটা ঘটালো তোর ড্রেসে। তোর ড্রেসটা ছিল হাটাকাটা, বড়গলার টপস। বাজে মেয়েরা যেসব ড্রেস পড়ে। আমি ওটা দেখে দিপকে জিজ্ঞেস করলে বলে “ফিহা ছোটমানুষ, এমন ড্রেস পড়লে কিছু হবেনা, আমরা আমরাই”। আমার সামনে এমন লজিক ছাড়া কথার এ্যান্সার ছিল না। কজ, তুই সবার ছোট হলেও এখন আর ওই ছোট নেই যে এমনসব পোশাক পড়তে পারবি।ওর আচরন আমার সন্দেহজনক লাগলো। দিপের না জানাতেই আমি ওর কাজিন স্নেহার মতো অন্য কালার ড্রেস এনে বড় ভাবির কাছে তোর ড্রেস বদলে দেই। সারা পার্টিতে আমি দিপের দিকে নজর রাখছিলাম, ও কি করে, না করে। তোকে অন্য ড্রেসে দেখে ওর মুখ যে আলুর চপের মতো চুপসে যায়, সেটাও দেখি। পার্টি শেষে ওর রুমে যাই। ওর যেয়ে পাশ ঘেঁষে ঘুমাই।ঘুমানোর পর সবার আগে ওর ফোনটা চেক করি, দেখি ডুয়েল সিমে আরেকটা সিম কানেক্ট করা। ওই সিমের নাম্বার থেকে তোকে ওই থ্রেট মেসেজগুলো করেছে। এরপর আমার সন্দেহ একদম ক্লিয়ার হয়ে যায় তোর “অজ্ঞাত” ব্যক্তি আর কেউ না আমাদের “দিপ”।
-তুমি সব জানতে তাহলে আমাকে জানাওনি কেন?
-হ্যাঁ! তোর মতো বাচালকে বলি! যে পেটের কথা মুখে আনতে সময় নেয় না! দিপের এই চিপ ডিভাইস না থাকলে তুই যে সবাইকে ঢোল পিটিয়ে বলে দিতি ওটাও জানতাম!!
-ভাই তুমি অনেক খারাপ! আমি বাচালের মতো কি করছি বলতো! সবসময় ইজ্জত দাও!
-চোরের মন পুলিশ পুলিশ!! নিজের ইজ্জত দিপের কাছে তুলে দিয়ে ইজ্জতের গান গাচ্ছে! চুপ। একটা কথা বলবি না। আগে শোন। দিপের ফোন রেখে আস্তে করে উঠে ক্লু খুজতে থাকি। অনেক রাত পযর্ন্ত পার্টি করে সবাই ক্লান্ত হয়ে বেঘোরে ঘুম! আমিও খুজতে খুজতে টেবিলের নিচে ভেতরের দিকে দেখি একটা প্যাকেট রাখা। ওই প্যাকেট খুলে তোর বলা কালো হুডি, সাদা গ্লাভস সাথে শুকিয়ে যাওয়া রক্তমাখা ছুড়ি পাই। সব কালেক্ট করতে থাকি। হলুদের দিন সকালে তোর পাশে বসে ওর ফোন হ্যাক করার ট্রায় করছিলাম, বাট প্রতিবারেই ফলাফল শূন্য। একপর্যায়ে ফোন হ্যাক হলে ফিমার ব্যাপারটা জানতে পারি, ওটা ডিলিট করলেও এমন ফরমেটে সাজানো হয়েছে যে পযর্ন্ত দিপ পাসকোড দিবে না সেপর্যন্ত ভিডিও কোনোভাবেই ডিলিট হবেনা। হলুদের অনুষ্ঠানে তোকে স্টোররুম থেকে বের করলে একমাত্র দিপই ছিল যে আম্মুকে ফুসলিয়ে তোকে আমার থেকে দূরে পাঠায়। ইথিলার বাড়িতে তোকে রাখার ঘটনায় বাড়ির সবাই ওর কথামত চলে। আব্বু ঘটনাটা পুরো বলে দিয়েছিল, সাথে হেল্প করেছিল, ফলে আমি তোর কাছে যাই। তোকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছিল, কিন্তু তুই যখন তোর সাঈদ ভাইকে মিথ্যে বললি তখন আমি ডেম সিউর হয়ে গিয়েছিলাম, ওই বদমাইশ তোকেও বন্ধ করে দিয়েছে।তোর গলার চেইন আর ছোট খালুর চেইন যে সেম, বুঝে গিয়েছিলাম ও কীসের হুমকি দিয়েছে। তোর কথাবার্তা দেখে বুঝে যাচ্ছিলাম দিপ তোকে দিয়ে আমাকে শেষ করার ফন্দি করেছে। আমি আব্বুকে জানিয়ে একটা প্ল্যান করি।মেইনরোডে যাওয়ার আগে আব্বুকে বলে দেই। আব্বু তার কয়েকজন ফোর্স মেম্বার আমার পিছনে পাঠিয়ে দেয়।আমি ফোনে তাদের কল আমাদের গাড়িতে রেখেছিলাম। গ্রিন পয়েন্ট নাম শুনার পর তারা পাহাড়টা টার্গেট করে দিপের লোকের আগেই ঘটনাস্থলে পৌছে যিয়। আর সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখে। তুই ধাক্কা দেয়ার পর তারা আমাকে উচু থেকে পড়ার কয়েকমিটার দূরে নেট পেতে বাচিয়ে ফেলে। এতে লাঠিও ভাঙেনা, সাপও মরেনা। দিপের লোকজন দূর থেকে তোর হাতে আমাকে ধাক্কা মারতে দেখলেও বাকিটা ইতিহাস জানতে পারেনি।
-সাঈদ ভাই তাহলে তুমি আমার সামনে আসোনি কেন? কেন তুমি দূরে দূরে ছিলে?খালুতো জানতেন তবুও দিপকে কিছু করলেন না!
-আব্বু বলেছে দিপের মামলা আমাকে রফাদফা করতে। তার বিশ্বাস আমি একাই দিপকে জন্মের শিক্ষা দিতে পারব। আড়াল থেকে আমি এ দুদিন দিপের বিষয়ে অনেক কিছু কালেক্ট করেছি যেটা আমার কাছে প্রমাণসাধ্য, ও যে তোর মতো অনেকগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তোর মত অনেকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে লুটে খেয়েছে!!
-ভাই কাল যে একটা বখাটে বাইকার ভাঙচুর করল সে কে ছিলো?
-হায়রে গদর্ভ রে! ওকে বখাটে আখ্যা দিলি! ও আমার বন্ধু লাবিব। এট নাও লাবিব আমাকে প্ল্যানে হেল্প করছে। ও কালকে প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু দিপের বাচ্চা তোকে জখম করে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলবে, জানতাম না! বায় চান্স যদি গাড়িটা থামাত ! একখাবলে ওর কলিজা টেনে হাতে নিয়ে আসতাম! আমি ভেবেছি ও ভাঙচুরের ভয়ে গাড়ি কয়েক মিনিটের জন্য থামাবে ! তা না করে করল আরেকটা!
-সাঈদ ভাই আমাকে মাফ করে দিও।
-আগে লাল মরিচের মশলা মাখা আদরটা দরকার !! তিনদিন ধরে পাইনি!!!
সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে দুজনেই হেসে দিলাম। উনার ইচ্ছানুযায়ী “লাল মরিচের মশলা মাখা আদর” টা ঠোটে ঠোট ছুয়িয়ে দিয়ে দিলাম। ভাই চোখ বন্ধ করে বললেন-
-নাবিলা ছাদে চল। সেদিনের মতো করে ফানুস উড়াব!!
-সাঈদ ভাই একটা প্রশ্ন করি????
-আমি জানি! আগেই জবাব দিয়ে দেই। ওই বাচ্চা ছেলেকে আমি তোর কাছে পাঠিয়ে ছিলাম। ওটা উড়নোর পর তোকে ইঙ্গিত দেয়ার জন্য। চল এখন। ফানুস উড়াব!!
-চলো!!!
সাঈদ ভাই আমাকে নিয়ে ছাদে গেলেন। ছাদে এসে দেখি একটা টিবিল রাখা, তার উপর অনেকগুলো ফানুস । আমি দৌড়ে গিয়ে ফানুস গুলো একটা একটা করে দেখছি। সাঈদ ভাই আমাকে বললেন-
-নাবিলা এখন উড়াবি নাকি রাতে?
-এখন উড়াই। রাতে আবার যেতে হবেনা!
-না, যেতে হবেনা। আজ তুই আমার সাথে থাকবি। আপাতত ওখানকার সবাই তোকে আর আমাকে নিয়ে একটু টেনশন করুক!! তবেই জমবে দিপের খেলা।।
-ভাই তুমিও না!!
সন্ধ্যায় আকাশে লাল গোলাপি লালিমা ছেয়ে আছে। যেন আকাশের বুকে কেউ রঙতুলি দিয়ে হালকা লালের মাঝে গোলাপি মিশিয়ে দিয়েছে। ছাদের চারপাশ কী সুন্দর মনোরম ঠান্ডা !! ছাদের একপাশে আমি আর সাঈদ ভাই একসাথে। সাঈদ ভাইয়ের কাধে মাথা রেখে বসে আছি। ভাইও মাথা এলিয়ে বসে আছেন। নিরবতা ভেঙে ভাই বললেন-
-নাবিলা একটা কথা বলি?
-সাঈদ ভাই, তুমি না আমার মতো কথা বলছো!! তোমার কথায় কি অনুমতি লাগে নাকি।।বলো..
-রিকুয়েস্ট করবো রাখবি?
-অবশ্যই।
-আমার নামের পাশে “ভাই” ওয়ার্ডটা বলবিনা।
-সাঈদ ভাই ডাকতে কী সুন্দর লাগে!! মজাটা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি ইচ্ছোমতো ডাকব !!সাঈদ ভাই সাঈদ ভাই সাঈদ ভাই!!!
-জুনায়েদ সাঈদকে ইনসাল্ট করার অপশন আর ছাড়লিনা!! একটা রিকুয়েস্টই করেছিলাম!
-আগে গান শুনাও তারপর!
-আমার টেকনিক আমার উপরেই?
-ইয়েসসস!!
-গিটার নেই কিন্তু !
-কেনো?…..ইশশ! ওটা তো ওখানেই রয়ে গেছে!!
-হ্যাঁ, গিটারের মধ্যে ক্যামেরা সেট করা।
-মানে??
-চলবে