যদি তুমি জানতে !! Part- 15
-আজ আমার মুড অনেক ভালো!!এজন্য তোকে ছেড়ে দিলাম।। কিন্তু কাল ঠিকই আসবো!!! রেডি থেকো ফিহা।।।
দিপ ভাই খোজ মেজাজে সিড়ি বেয়ে রুমে চলে গেলেন। আমি রুমের দিকে পা বাড়িয়ে হাটা দিলাম। রুমে যেয়ে দরজার নব্ এবং সিটকিনী দুটো আটকে দিলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিলেও চোখে ঘুম নেই। বালিশের নিচ থেকে সাঈদ ভাইয়ের ফোনটা বের করলাম।ফোন অন করে গ্যালারীর ছবি দেখছি। ভাইয়ার ফোনে বেশিরভাগ উনার প্রজেক্টের জিনিসের ছবি তোলা। একটা ফোল্ডারের নাম ছিল “ক্রিয়েশন” দিয়ে। ওটাতে ক্লিক করতেই দেখি উনার বানানো নানা মডেলের ছবি।
বলে রাখি, সাঈদ ভাই খুব হাই লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট পার্সন। পদার্থবিজ্ঞানে সে খুব পারদর্শী।উনার মডেল গুলো যেমন ইউনিক তেমনি উনার চিন্তাভাবনাও।
ফোনটা বুকে নিয়ে কখন যে চোখ লাগিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি খেয়াল নেই। রাতে তেমন খারাপ কিছু আর হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙে দরজা ধাক্কানোতে। ঘুমঘুম চোখে উঠে দরজা খুলব তার আগে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল আটটা বেজে গেছে। সকাল সকাল দরজা ধাক্কানো দেখে ভাবলাম খালামনি বা মা হতে পারে। তাই দরজা খুলে চোখ কচলাতেই দেখি দিপ ভাই খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে। আমি এতো সকালে উনাকে এখানে আশা করিনি। উনি রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে আমার দিকে এসে বললেন-
-সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো ফিহু!! তোমাকে মনিং গিফট দিলাম হটি!!
আমি কোনো জবাব না দিয়ে পিছাচ্ছি। উনিও অগ্রসর হচ্ছে। আসতে আসতে ভাই আমার একহাত দূরে আছেন। আমার দিকে সে যেই না হাত বাড়িয়ে টাচ করতে নেবে তার আগেই দিপ ভাইয়ের ফোন বেজে উঠল। উনি ফোন বের করে কলটা রিসিভ করে কানে নিতেই বললেন-
-হ্যালো, ম্যানেজার। তোমাকে না বলছি আমাকে যখন তখন কল করবে না ! এখন আমি ছুটিতে আছি জানো না!
-…………………………………
-কি! কখন! কিভাবে !বাকি সবাই কোথায় ছিলো!!
-…………………………………
-আচ্ছা আমি এক্ষুনি আসছি! তোমরা যতটুকু পারো জরুরী ফাইল বের করে আনার চেষ্টা কর!
দিপ ভাই কথা বলা শেষ করে দৌড়ে রুম থেকে চলে গেলেন। এমন ভাবে চলে গেলেন যে কোনো ঘোর বিপদ হয়েছে উনার।। আমি ভ্রু কুচকে চিন্তা করতে থাকি হঠাৎ কি হলো, দিপ এভাবে তার অফিসের ম্যানেজারের সাথে কথা কেনো বললেন, কি হলো এতো সকালে!! আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতেই একপ্রকার হৈহৈ চিল্লাচিল্লি শুনছি। নিচে নেমে দেখি মেজো খালামনি, মাথায় হাত দিয়ে “ও খোদা ও খোদা ” বলে পায়চারি করছেন। মা আর ছোট খালামনি মিলে মেজো খালামনিকে শান্ত করানোর চেষ্টায় আছেন। ফিমা আপু,স্নেহা আর দুই ভাবি নতুন ভাবির পাশে বসে এটাওটা নিয়ে কি যেন কথা বলছেন। আমি বড় খালামনিকে জিজ্ঞেস করি-
-খালামনি কি হয়েছে? এতো সকাল সকাল সবাই এমন মুখ কালো করে আছেন কেনো?
-ফিহা তোর দিপ ভাইয়ের অফিস বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। কীভাবে লেগেছে, কখন লেগেছে কেউ জানেনা। দাউদাউ করে পুরো বিল্ডিং আগুনে পুড়ছে!
-কি বলো ? হুটহাট আগুন লাগবে নাকি!
-সেটাই। অফিসের স্টাফরা বলছে শর্টসার্কিটে আগুন লেগেছে!তোর দিপ ভাই ওখানেই গেছে সবকিছু দেখতে !
-ফায়ার সার্ভিস ডেকেছে?
-খবর এখনো পাইনি।। না জানি ছেলেটা আমার কিভাবে সামলাচ্ছে!! এদিক দিয়ে তোর সাঈদ ভাইয়ের কোনো খোজ মিলছে না! কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে!! ফিহা মা আমার তুই এখানটা সামলে নিস। আমি তোর মাকে নিয়ে দিপের অবস্থা দেখতে যাচ্ছি।।
-খালামনি তোমরা এখন যেওনা। আগুন নেভানো সহজ হবেনা। শুধু শুধু ভিড় করে লাভ নেই। ফায়ার ব্রিগেডিয়ারদের কাজ করতে দাও।। তোমরা আপাতত বাসায় থাকো পরে যেও।
-দেখি, তোর খালুকে একটা ফোন করে বলে দেই।।
খালামনির মুখ থেকে দিপ ভাইয়ের এমন অবস্থা শুনে কী যে শান্তি লাগছিল!! বলে বোঝাতে পারবনা!! দিপ ভাইয়ের অফিস পুড়ে যেন ছাড়খার হয়ে যায়, একদম ছাইছাই!! আমাকে দিয়ে সাঈদ ভাইয়ের ক্ষতি করার ফল এখন তুমি শিরায় শিরায় টের পাবে, দিপ ভাই! ভালো ভাবে টের পাবে!
.
.
আমি রুমে চুপচাপ বসে বই পড়ছি। খালামনি একটু আগে জানিয়েছেন আগুন নাকি নিভে এসেছে। প্রায় চার ঘন্টার সাফল্যে আগুন নেভাতে পেরেছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। নতুন ভাবি সহ সবাই ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। বাকি আছি শুধু আমি আর আপু। আপু রুমে বসে প্র্যাক্টিক্যাল করছেন। কিছুক্ষণ পর আপু আমার রুমে এসে বললেন-
-ফিহা ফ্রি আছিস?
-হ্যাঁ আপু। বলো।।
-আমার সাথে একটু বাইরে যেতে পারবি?আমি প্র্যাক্টিক্যাল খাতার পেজ সাথে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনব।
-আপু তুমি এখানেও পড়াশোনা নিয়ে পড়ে আছো??
-আরে সামনে সেমিস্টার পরীক্ষা, চাপের মধ্যে পড়ছি! এখন একটু আয় আমার সাথে। জিনিস ক্যারি করার জন্য আরেকজন লাগবে।
-আচ্ছা চলো।
আপু, আমি সার্ভেন্টকে জানিয়ে বাইরে বেরিয়েছি, কিছু কিনতে হবে। আপু একটা রিক্সা ডাক দিয়ে মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঠিকানা বলে। আমরা দুজন রিক্সায় বসার পর মার্কেটের রাস্তায় যাচ্ছি। কিছু দূর যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল করি একটা বাইক বারবার আমাদের ক্রস করে রিক্সার সামনে- পিছনে ছুটছে। প্রথম প্রথম ইগনোর করলেও পরে আপুকে জানাই। আপু বললেন-
-থাক বাদ দে। কোনো বখাটে হয়তো। মেয়ে দেখছে এখন বাইক চালিয়ে ভাব মারতেছে।
-আমারো তাই মনেহয়।
আমরা পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই মার্কেটে পৌছে গেলাম। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া চুকিয়ে পিছন ফিরে তাকালে দেখি ওই বখাটে আর নেই। মেবি পাত্তা না পেয়ে চলে গেছে। আপু একটা পাইকারি লাইব্রেরিতে ঢুকে তার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনছে। ভেতরে অনেক ভ্যাপসা গরম বলে বাইরে এসে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মোবাইল টিপছি। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে আমার সামনে এসে বলল-
-আপু আপু আপনে এই ফানুসটা কিনবেন? আমি না দুইডা দিন কিছু খাইনাই। দয়াকরে কিনবেন আপু?
-তোমার মতো এতো কিউট একটা ছেলে সামনে এসে ফানুস কিনতে বললে কেন কিনবো না!!! দাম কত?
– পন্ঞাশ টাকা আপু।
-এই নাও। আর কিছু খেয়ে নিও, কেমন।।
-আপু আমার কাছে একশ টাকার ভাঙতি নাই।
-আমিতো ভাঙতি চাইনি!! তুমি পুরোটা রাখো।
-আপনারে ধন্যবাদ আপু।
ছেলেটার কাছ থেকে ফানুসের প্যাকেটটা নিতেই সে চলে গেল। হাতে ফানুসটা দেখছি। খুব সুন্দর। বেশ অন্যরকম।আজ রাতেই এটা উড়াব।। আপু লাইব্রেরি থেকে সবকিছু কিনে কয়েকটা ব্যাগ আমার হাতে দিয়ে নিজেও কয়েকটা নিয়ে বাসায় দিকে রওনা দিলাম। আপু আমার হাতে ফানুসের প্যাকেট দেখে বললেন-
-এটা কখন কিনলি?
-তুমি যখন দোকান থেকে জিনিস কিনছো তখন।
-ওহ্। তাইতো চিন্তা করি কখন কিনলি।।
আপু আর আমি রিক্সা থেকে নেমে বাড়িতেই ঢুকতেই দেখি সবাই চলে এসেছে। কেমন যেন নিরব হয়ে আছে সব। চোখ পড়তেই দেখি মা দিপ ভাইকে মলম পট্টি করছেন। দিপ ভাইয়ের জায়গায় জায়গায় ক্ষত, রক্ত পড়ছে। আমি দিপ ভাইয়ের ওই অবস্থা দেখে বললাম-
-মা দিপ ভাইয়ের এমন অবস্থা কেনো? কি হয়েছে?
-তোর দিপ ভাইকে একদল কালো পোশাকের মুখোশধারী লোক পিটিয়েছে। আমরা সবাই যখন অফিসের ওখানে পৌছাই তখন দেখি প্রায় চার পাচজন লোক লাঠি দিয়ে পিটাচ্ছে। সবাই গাড়ি থেকে দৌড়ে কাছে যেতেই ওরা পালিয়ে যায়।
-শুধু শুধু মেরে পালালো?
-জানি না। আজকাল দেশের যা অবস্থা !! কী থেকে কী হয়ে যায় বলাও যায় না।।
.
.
বিকেলের দিকে সবাই দিপ ভাইয়ের বৌভাতে চলে যায়। দিপ ভাইয়ের চাচার পরিবার মানে স্নেহার পরিবার দিপ ভাইকে বিদায় দিয়ে উনারা চলে যান। বাসায় আছেন শুধু ফিমা আপু। কারন, আমি একা। আজ দিপ ভাই কোনো না কোনো কারনে আমার কাছে বা টাচ করতে পারেননি। সকালের পর থেকে উনি না আমাকে ডেকেছেন না আমার কাছে এসেছেন। বলতে গেলে আজও বেচে গেছি উনার খবল থেকে। জানিনা আর কতক্ষন এভাবে বেচে বেচে চলব।
ছাদে দাড়িয়ে গলায় হাত পড়তেই লকেটের কথা মনে পড়ে গেল।সেদিন দিপভাই বাবাকে বোম টাইপের লকেট চেইন দেওয়ার পাশাপাশি আমাকেও একটা লকেট চেইন গলায় সেট করে দিয়েছেন। আমি যদি এটা খুলার বা ছিড়ার চেষ্টা করি তাহলে রেড এলার্ট দিপ ভাইয়ের ফোনেও বেজে উঠবে।এরপর বাবার বোম ব্লাস্ট এবং আপুর ভিডিও দুটোই সবকিছু বরবাদ করে দিবে। আজ এই লকেটটার জন্যই সাঈদ ভাইকে ইথিলার বাসাতেও কিছু জানাতে পারিনি। না কোনোভাবে আমার পরিস্থিতির কথা মুখ দিয়ে বলতে পেরেছি। আমার গলার লকেটটা, যে পযর্ন্ত ডিএক্টিভেট না হবে সে পযর্ন্ত আমি পুলিশের কাছেও যেতে পারব না। গলার লকেটটায় একটা মাইক্রোফোন সেট করা, আমি যার সাথে কথা বলছি তা সব এতে রেকর্ড হচ্ছে।
আমি নিজেকেও শেষ করতে পারছিনা ! পারছিনা কোনোকিছু সহ্য করতে ! সাঈদ ভাই তোমার নাবিলা তোমাকে মারতে চায়নি।। না ও নিজেকে মারতে পারছে ।।নিজেকে শেষ করার পর দিপ ভাই যে বাবা আর বড় আপুকে শেষ করে দিত!! সাঈদ ভাই ! আমি আর পারছিনা……
সন্ধ্যে নেমে এসেছে। চারপাশ অন্ধকার। ঠান্ডা দুমকা হাওয়া বয়ে চলছে। ছাদে বসে বসে আকাশ দেখছি। খুব সুন্দর দেখতে। প্রকৃতি আজ শান বাজিয়ে বলছে রাতে জোরশোরে বৃষ্টি হবে। আপু রুমে বসে প্র্যাক্টিক্যাল কমপ্লিট করছেন। আমি ছাদে এসেছি ফানুস উড়াব বলে। খুব ইচ্ছে ছিল সাঈদ ভাইয়ের সাথে একদিন ফানুস উড়াব!! উনার মতো ইগোষ্টিক ছফুটের তালগাছ টাইপের পার্সনকে পাশে দাড় করিয়ে ফানুস উড়াব।। আমি যখন ফানুসে আগুন জালিয়ে দিব তখন সে আমাকে আরো উচু করে তুলে ধরবে, আমিও বাতাসের সাথে ফানুস উড়িয়ে দিব।।। কিন্তু জুনায়েদ সাঈদ #যদি_তুমি_জানতে!!
ফানুসে আগুন জালিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলাম। উড়ে চলছে। তাকিয়ে আছি ফানুসটার গতির দিকে। খালি আকাশ। অন্ধকারে আচ্ছন্ন। জলন্ত ফানুসটা আকাশের মাঝে ফুটে উঠেছে। ফানুস খানিকটা উপরে উঠতেই হঠাৎ খেয়াল করি আরো পাচটা ফানুস একত্রে উড়ে চলছে। ব্যাপারটা খটকা লাগলো। কারন, আজ এমন কোনো বিশেষ দিন না যে অন্যরাও ফানুস উড়াবে। তাও আবার একসাথে এতগুলা! আমার ফানুসটা উড়ানোর পর পরই কেনো উড়লো? আগেও তো উড়তে পারতো।। ঘন্টাখানিক পরেই তো উড়তো পারতো!!
আমি পাচটা ফানুসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছি আকাশে একসাথে পাচটা কেনো উড়ালো? দুটা তিনটা এমনকি দশটাও তো উড়াতে পারতো!! পাচটাই কেনো উড়াচ্ছে??পাচ পাচ পাচ পাচ !!! এটা কি কোনো সংকেত?? পাচ মানে ফাইভ। পাচ মানে সংখ্যা নির্দেশক। এক মিনিট! “পাচ ” দিয়ে তো সাঈদ ভাইয়ের ফোন আনলক হয়। পিনকোড ডিজিট। তাহলে কি, SAYEED=5 দ্বারা আমাকে ইঙ্গিত করছে?
জবাবটা জানা নেই।।।।
পাচটা ফানুস আর আমার উড়ানো ফানুস সবগুলো দূর আসমানে চলে গেছে। এখন শুধু হলুদ আভাটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে।আকাশে তাকিয়ে থাকতেই এরপর যা দেখলাম তা দেখে থমকে আছি! ফানুস উড়ছে। কিন্তু একটা না পাচটা না অনেকগুলো ! কয়েকশ ফানুস উড়ার সাথে সাথে যে অক্ষর গুলো ধারন করছে যা ছিলো ” S A Y E E D “। আমি আকাশে ভাইয়ের নাম দেখে দাড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়ি।। চোখের সামনে প্রত্যেকটা অক্ষর ভাসছে। তাহলে…..? দূর থেকে উনি ইন্ডিকেট করছে “আমি জুনায়েদ সাঈদ বেচে আছি “!!……..
কিন্তু তুমি কোথায় সাঈদ ভাই?? তোমার নাবিলা যে দিপ হায়েনার আস্তানায় এখনো পড়ে আছে !! আমি যে তোমাকে সামনে পেয়েও চিৎকার করে ডাকতে পারছি না!!বলতে পারছিনা!!ভাই, তুমি যে আমার কাছে আছো, আমার চারপাশে আছো তা আবার প্রমাণ করে দিলে।
ছাদে অনেকক্ষন বসেছিলাম যে পযর্ন্ত তার নামের ফানুসগুলো উড়ছিলো। ততক্ষণ পযর্ন্ত চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম যতক্ষণ পযর্ন্ত মিলিয়ে না যাচ্ছিলো। সাঈদ ভাই আমার পাশে আছেন, উনি বেচে আছেন!!! উনি সামনে আসবেনই।।শেষ করবে দিপ নামের মুখোশধারিকে!
.
.
রুমে বসে আছি। বাইরে ঝড়ো হাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ঝুম বৃষ্টি হবে। আজ দিপ ভাই তার শ্বশুরবাড়ি থেকে আসতে পারবেননা এটার নিশ্চিত ।। এজন্য বাড়িতে একা থাকা সত্ত্বেও কোনো ভয়ডর কাজ করছেনা। বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। বাতাসের ঝাপটানিতে জানালা দিয়ে পানি আসছে। আমি থাই গ্লাস আটকিয়ে বৃষ্টি দেখছি। আপু হয়তো এখনো কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, এজন্য আমার সঙ্গ দেননি। তাতে কি? আমি একা একাই বৃষ্টি বিলাস করব থাই গ্লাসের ভেতরে। আমার সাঈদ ভাই যে বেচে আছে, এর চেয়ে বড় খুশির সংবাদ আমি আদৌ টের পাইনি।। সাঈদ ভাই তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ভাই!! তোমাকে ওভাবে মেরে ফেলার দৃশ্য থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই ভাই, রেহাই পেতে চাই।।
জানালায় বৃষ্টির ঝাপটা পড়ছে। স্বচ্ছ গ্লাসের ওপাশে তাকিয়ে দেখি দিপ ভাই গাড়ি করে বাড়ি চলে এসেছেন। ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল! দিপ ভাই বৃষ্টির মধ্যেও বাসনা পূরনের জন্য এখানে চলে এসেছে! কী করব কী করব ভাবছি! দরজা লক করলেও উনি কোনোএকভাবে ভেতরে ঢুকে পড়বেন! কি করবো এখন! তাকিয়ে দেখি দিপ ভাই দৌড়ে আমার রুমে এসে হাটু গুজে হাফাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন-
-তোমাকে একা ছাড়া যাবে না ফিহু বেবি।। তোমাকে এই ঠান্ডার দিনে একা রাখা যাবে না!! তাই বৃষ্টি, শ্বশুরবাড়ি, নতুন বউ সব ফেলে তোমাকে পাওয়ার জন্য চলে এসেছি!!!চলো আজ ফিহু!! রাত্রি উদযাপন করি!!
বলেই দিপ ভাই সোজা হয়ে দাড়িয়ে এক ঝটে আমার কাছে চলে এলেন।আমি পিছালেও শেষপ্রান্তে দেয়াল। হঠাৎ খপ করে হাত চেপে ধরলেন। অনেক চেষ্টা করছি ছাড়ানোর কিন্তু আজ উনার জোরের সাথে পেরে উঠতে পারছিনা। উনি কাছে আসতে আসতে আমার মুখের ঠিক চার ইন্ঞি দূরে। যেই আমার মুখের একদম কাছে চলে আসে ওমনেই “থু” করে উনার মুখে থুথু নিক্ষেপ করি। আমার এমন কাজে দিপ ভাই কিছুটা পিছিয়ে তার মুখ থেকে হাত দিয়ে থুথু মুছে নেয়। আমার দিকে উনি রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকে। আমার দিকে তাকিয়েই টেবিলে রাখা পানির গ্লাস হাতে ঢেলে হাত ও মুখ পরিষ্কার করেন। আমি কোনো ভাবেই বাচার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। দিপ ভাই আবার হামলে ধরল। ভাই এতোই ক্ষেপে গিয়েছেন যে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে দেয়ালে আর টেবিলে জোরে আঘাত করতে থাকে। ভারি বস্তুর চোটে আমার কপাল বেয়ে তখন রক্ত পড়তে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করে চুলের মুঠি থেকে ভাইয়ের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলে আমাকে জোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। আর বলতে থাকে-
-তোর মেয়েকে আমি আমার বাড়ির চাকরও বানাই না ! আর তুই আমার মুখে থুথু দিচ্ছিস! দেখ কী করি ! তোর সাহস!! দেখ এখন এই বৃষ্টির মধ্যে কেমন তান্ডব রটাই !
আমি ফ্লোরে মাথা ধরে বসে আছি। পরপর দুবার ওভাবে আঘাত করাতে চোখেমুখে বারবার ঝাপসা দেখছি। দিপ ভাইকে স্পষ্ট দেখতে পারছিনা। উনি আবার আমার কাছে এসে হাত ধরে টেনে হিচড়ে রুম থেকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছেন। একহাত দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত কপাল ধরে আছি আরেকহাত ধরে টেনে ছেচড়ে দিপ ভাই নিয়ে চলছেন। উনি টানতে টানতে আমাকে ছাদে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন। বৃষ্টির ঝনঝনাট প্রচুর হচ্ছে। ছাদের ফ্লোরেই লুটিয়ে পড়লাম। আস্তে করে ছাদের ফ্লোর থেকে মাথা উঠিয়ে বসলাম। পুরো শরীর ভিজে, ঠান্ডা বসে যাচ্ছে। দিপ ভাই ছাদে ফেলে দিয়েই সেখান থেকে চলে গেছেন।
বৃষ্টির মধ্যেই কেদে চলছি। ফুপিয়ে, চিৎকারে যেভাবে পারছি কান্না করে যাচ্ছি। কপাল থেকে রক্ত এখনো টপটপ করে পড়ে বৃষ্টির পানির সাথে মিশছে। আমার চারপাশে জমা বৃষ্টির পানি লাল বর্ন ধারন করেছে।ব্যাথায় শেষ হচ্ছি!! সাঈদ ভাই তুমি আমার এরুপ অবস্থা দেখছো? দেখো সাঈদ ভাই, দিপ কী সুন্দর যন্ত্রণা দিচ্ছে!! খুব সুন্দর যন্ত্রণা !!
.
.
আকাশ থেকে বৃষ্টির বড় বড় ফোটা পড়ছে। বাইরের নিয়নবাতির জ্বলজ্বল আলো দূরত্ব ভেদ করে এখানেও কিছুটা আসছে। বৃষ্টির মধ্যে মাথা নুয়িয়ে বসে আছি। হঠাৎ কেউ “নাবিলা”- বলে উঠল। আমি কন্ঠ শুনে মাথা উঠালে দেখি ছয়ফিট ডেশিংম্যান বৃষ্টির মধ্যে দুহাত দুপাশে মেলে দাড়িয়ে আছে!!
আমি একহাত মাথায় দিয়ে আরেকহাতে চোখ মুছে দেখার চেষ্টা করছি। বৃষ্টির পানির জন্য চোখ ধাধিয়ে আসছে। পুনরায় দেকার জন্য চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে দেখি, “সাঈদ” ! সত্যি সত্যি উনি দাড়িয়ে আছেন! বৃষ্টির পানির মধ্যে দু বাহু প্রসারিত করে মেলে রেখেছেন নাবিলাকে জড়িয়ে আবদ্ধ করার জন্য!
আমি উঠে দাড়াতেই সাঈদ ভাই বলে উঠলেন-
-ওই বেক্কল ! তাড়াতাড়ি আয়। আর কতো এইভাবে বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে থাকব! জলদি কর!
সাঈদ ভাই-ই! উনি এসেছেন!! ব্যথা উপেক্ষা করে উনার দিকে দৌড়ে যাচ্ছি। দৌড়ে যেয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলে সাঈদ ভাই আমাকে দুবাহুডোরে শক্ত করে আবদ্ধ করে ধরলেন। সাঈদ ভাই আমাকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরেকহাত মাথায় রেখে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। মাথায় অজস্র শত ঠৌট ছুয়িয়ে দিচ্ছেন। ছুয়িয়ে দিতেই বললেন-
– নাবিলা, এই জুনায়েদ সাঈদের আসতে আবারো দেরি হয়ে গেল ! ফরগিভ মি প্লিজ নাবিলা! ওই জানোয়ার তোকে আবার আঘাত করে ফেলল!আমি দ্বিতীয়বারের মতো আবারো দেরি করে ফেললাম…
-চলবে