মায়াবিনী

® মায়াবিনী—– পর্ব- ৩

লেখাঃ নিলয় রসূল
অয়নী: ডিভোর্স…..!
টিনা: কিহ্……!
অয়নীর চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে,,মাথাটা ঝিম ঝিম করছে…মনে হচ্ছে যেনো সামনের সবকিছু যেনো নড়ে যাচ্ছে আর ওর বুকের ভিতরটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে…!
বাকী কথা অয়নী বলতেই পারলনা তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। আর হাতে থাকা চায়ের কাপটা মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো। টিনা চমকে উঠে অয়নীর দিকে তাকালো…!দেখলো অয়নী মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো…!
টিনার মাথাটাও কেমন যেনো করছে। কি হচ্ছে, কি চলছে, আর সামনেই বা কি অপেক্ষা করছে কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে যা হচ্ছে আর সামনে হতে চলেছে তা যে খুব ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।
সুপ্ত দূরেই খেলছিলো। হঠাৎ অয়নীকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে “মাম্মা,, মাম্মা “বলে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো..!
টিনা কি করবে বুঝতে পারছেনা একদিকে অয়নী মেঝেতে পড়ে গিয়ে কপাল ফেটে অবিরাম ধারায় রক্ত পড়ছে আর এদিকে সুপ্ত কাঁদছে আর হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে,, ওদের বারান্দাটা খোলা বারান্দা তাই একটু অসতর্ক হলেই সুপ্ত নিচে পড়ে যাবে আবার বেশি দেরি করলে অয়নীর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে….!
টিনা কোনো উপায়ন্তর দেখে ওর বাবা মা কে ডাকতে লাগলো। চিৎকার করে ডাকছিলো কিন্তু কেও এলোনা…! টিনার মাথাও ধরে আসছিলো। কি করবে বুঝতে না পেরে সুপ্তকে দ্রুতো কোলে করে নিয়ে ঘরে রেখে আসলো। আর তারপর অয়নীকে তোলার পালা। কিন্তু টিনা তুলতে পারছেনা। খুব কষ্ট করে টেনে হিচড়ে ঘরে এনেই কিছু ফ্রেন্ডকে ফোন দিলো। সবাই মিলে অয়নীকে হাসপাতালে নিলো। আশ্চর্যের বিষয় অয়নীর শাশুড়ি এতো কিছু জানার পরও তাকালেনও না….!
কিন্তু বিধি বাম টিনার যে স্যার তিনি হাসপাতালে নেই এখন, বাইরে গেছেন থাকলে এতক্ষণে ট্রিটমেন্ট শুরু হতো….!
শেষমেশ ডাক্তার পাওয়া গেলো। অয়নীকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। টিনা সুপ্তকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো প্রায়য় রাত ১০ টার দিকে।
টিনার মা: কিরে এতো দেরি করে বাসায় ফিরলে যে
টিনা: (একবার তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলো)
টিনার মা: আমি কিছু বলছি…
টিনা: মা এতটা খারাপ হইওনা। ওপরঅলা তোমাদের জীবনেও ক্ষমা করবেননা। কোনো কিছুরই বাড়াবাড়ি ভালোনা মা..
বলেই টিনা ঘরে চলে গেলো।
কিছুই ভালো লাগছেনা ওর। সুপ্তকে ফোন দিলো গেইম খেলতে। আর ও বারান্দায় এসে ভাবছে, “কি থেকে যে কি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিনা..! আর ভাবিই বা হঠাৎ…ওহো ভাবি কি যেনো একটা পড়েছিলো খাম থেকে বের করে.. সেইটা দেখলে অনেক কিছুর সমাধান মিলবে..!”
টিনা দ্রুতো ঘরে এসে খোঁজাখুজি করতেই বিছানার নিচে চিঠিটা পেলো।
দ্রুতো খুলে দেখলো রাজীব টিনাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছে….!
এবার টিনা নিজেই শক খেলো। কি দেখছি আমি এগুলো। হায় আল্লাহ্ এবার কি কি হবে। আর সামনেই বা কি অপেক্ষা করছে…!
মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে টিনা। হঠাৎ মনে প্রশ্ন উদয় হলো
” আচ্ছা ওই জানোয়ারটা ডিভোর্স দিবে তো সেটা চিঠি আকারে কেনো..?”
পরে টিনা জানতে পারলো রাজীব ব্যাবসার কাজে বাইরে গেছে..!
পরেরদিন সকালে অয়নীর মুখে প্রাভাতের প্রথম প্রহরের সূর্যের আভা এসে পড়লো। অয়নীর ঘুম ভাঙ্গলো। মাথাটা খুব ব্যাথায় টনটন করছে। তবে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো ও হাসপাতালো। কিন্তু সুপ্ত,, টিনা….?
এমন সময় নার্স এসে বললো
” একি আপনি উঠবেননা। ডাক্তারের নিষেধ আছে। আপনি উঠেননা। আমি টিনা আপাকে ফোন দিচ্ছি।
অয়নী কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে মিষ্টি সকালটা.আর ফিরে গেলো ঠিক পাঁচ বছর আগের এরকমই একটা স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি মুহূর্তে…
: আচ্ছা অরু দেখ আকাশে মেঘমালারা না আজ বড্ড অভিমান করেছে..!
: কি করে বুঝলি…!
: দেখছিসনা আজ ভোরের প্রকৃতিটা বড়ই নিশ্চুপ…!কেমন যেনো অভিমান করে আছে…! আর মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ করে মেঘমালারা তার অভিমানের জানান দিচ্ছে….!
: তাই..!
: হু…
: তারপর…!
: দেখ দেখ অরু মেঘমালারা না কেমন যেনো মুখ ফিরিয়ে আছে….মনে হচ্ছে এই বোধায় কেঁদে দিবে…!
: তাই নাকি..!!
: হু..একদম তোর মতো..বড্ড ছিচকাদুনে..
:কি আমি ছিচকাঁদুনে,,,আমি ছিচকাঁদুনে…!
: তা নয়তো কি…!
: নীল তোর চুল গুলো কিন্তু আর মাথায় থাকবেনা বলে দিলাম। এরকম করলে। দাড়া আজ সাথি আপুর কাছে নালিস করবো তোর বিরুদ্ধে তারপর আপু তোর কানগুলো আদর করে দিবে..হি হি হি..
: এই এরকম করিসনা..আমি আপুকে বড্ড ভয় পায়..
: তাহলে আমাকে ছিচকাঁদুনে বললি কেন..
: আচ্ছা বাবা সরি…সরি.. সরি আর বলবনা…!
: হুহ্ তোর সাথে কথা নেই যা….!
: এই দেখ এই যে কান ধরছি আমি…! প্লিজ প্লিজ এমন করিসনা অরু। আমি তোর সাথে কথা না বলে থাকতে পারবনা…! তুই তে জানিস সেটা….!
: প্রমিস কর..
: আচ্ছা এই যে করলাম। প্রমিস…!
: এইটা দিয়ে কত নাম্বার হলো..
: ইয়ে মানে..
: হা হা হা…অরু(অয়নী) নীলের কাধে মাথা রেখে আকাশ আর মেঘেমালার মান অভিমান দেখতে লাগলো। বৃষ্টি নামা নামা ভাব
: অরু চল অন্য কোথাও গিয়ে বসি। এই জায়গাটা খোলা। বৃষ্ট নামবে মনে হচ্ছে..
: হু…!
: চল ওইখানটা গিয়ে বসি
: না,,
: কিন্তু কেনো…
: আমি ভিজবো বৃষ্টিতে….!
: এই না না,, অরু প্লিজ জেদ করিসনা। জ্বর আসবে..
: না…! আমি বলেছি মানে ভিজবো তো ভিজবোই। আর তুইও ভিজবি..!
: এই না..!
: উহুঁ,..
বৃষ্টি নেমে আসলো আকাশ থেকে..ঝুম বৃষ্টি..।
অয়নি ভিজছে বৃষ্টিতে স্বাধীনভাবে।আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত তুলে। সে ভিজছে আর নীল গাছে হেলান দিয়ে তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে…ভাবছে” মেয়েটা এখনো ছোটোই রয়ে গেলো। মাঝে মাঝে ওর ছেলেমানুসি গুলো এমনভাবে শুরু করে না,,তবে ভালই লাগে ওর ছেলে মানুসিগুলো দেখতে..কিন্তু কেনো যে বুঝতে পারেনা ওই ছেলেটা ভালো না…..!
নীলের ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে অয়নী নীলকে জোর করে নিয়ে গেলো ভিজতে। ওপর থেকে বৃষ্টির পানির ফোটা গুলো এসে ওর ওপর পড়ছে আর ও অদ্ভুৎ শিহরণে শিহরিত হচ্ছে……!
:ভাবি..ভাবি..কি হলো তোমার
অয়নি তার চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসলো। দেখলো টিনা ওর হাত ধরে ডাকছে। পাশে সুপ্ত দাড়িয়ে আছে।
অয়নী: অরু..!
টিনা: কি..! মানে কিসের কি বুজলামনা ভাবি…!
অয়নী: কিছুনা বাদ দে
টিনা: এই নাও তোমার ছেলে কাল থেকে তোমার সাথে কথা বলার জন্য পাগল হয়ে গেছিলো….!
অয়নী: বাবাই এদিকে আসো
সুপ্ত: মাম্মা তোমাল তি হয়েতে..
অয়নী: কই কিছুনাতো বাবাই। কি হবে…!
সুপ্ত: তোমাল মাতায় ব্যান্দিৎ কলা কেনো….
তিনা বছর বয়সের ছোট্ট সুপ্তর আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু তার এ প্রশ্নের উত্তর যে বড্ড গভীর…!
বিকালে অয়নীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়লো। রিকশাতে টিনার কোলে বসে সুপ্ত দুষ্টামি করছে আর পাশে বসে অয়নী অন্যদিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে..
” রাজীব আমার সাথে এটা করতে পারলো…!কি দোষ করেছিলাম আমি। আল্লাহ্‌ আমার কপালে তুমি এতো কষ্ট কেনো দিছো বলতে পারো..!আচ্ছা আজ ভোরে হঠাৎ নীলের কথা মনে হলো কেনো। আমদের সুখের স্মৃতিগুলো। এই পাঁচ বছরে তো একটি বারও ওর কথা মনে হয়নি। শুনেছি মানুষ যখন সব থেকে দুঃখে থাকে তখন তার সবথেকে প্রিয়জনের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো ভেসে উঠে। তাহলে কি নীলই আমার সব থেকে কাছের ছিলো…! আচ্ছা নীল এখন কোথায়…! আমি বড়ই স্বার্থপর নিজেরটুকু ছাড়া মনে হয় কিছুই বুঝিনা। ও বারবার বলতো আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারেনা আর আমিই কিনা….! কেমন আছে এখন ও,,জীবনে করা আমার একটা ভূল এতো বড় শাস্তি দেবে ভাবিনী কখোনো। আজ সব কিছু হারিয়ে আজ আমি নিঃস…সর্বহারা…..!”
টিনা: ভাবি আমরা চলে এসেছি বাসায়। ভাবি…ভাবি…
সুপ্ত: মাম্মা.. বাতায় তলে এতেথি…
টিনা: (অয়নীর হাত নাড়িয়ে) ভাবি….!
অয়নী: হা..!! বল
টিনা: আমরা চলে এসেছি নামবানা….!
অয়নী: ওও,,হ্যা,..
টিনা: আস্তে.।।আস্তে নামো…!

একসপ্তাহ পর অয়নী সুস্থ হয়ে উঠলো। সারাদিন ওর মাথায় একই চিন্তা ঘোরে “রাজীব এমন করলো….!”
কয়েকদিন পর রাজীব ফিরে আসলো। আর শুরু হলো অয়নীর জীবনের ঝড়।
একদিন মাঝ রাতে,
রাজীব অয়নীকে বলছে,
: কিরে সই করেছিস
: কোথায়..
: কোথায় মানে..বুঝতেছিসনা
: না, বুঝতে পারছিনা
: তোকে এখন আবার বুঝিয়ে দিতে হবে নাকি..!
: কি বুঝাবে তুমি আর আমিই বা কি,বুঝবো,,,আর মুখের ভাষা ঠিক করে কথা বলো,,
: একদিন ছিলামনা ভালোই তো বেড়েছিস দেখছি।
: খবরদার বলছি ভাষা ঠিক করে কথা বলবে আমার সাথে…
: তবে রে…
বলেই অয়নীকে আবারও থাপ্পড় মারলো। এমনিতেই অয়নীর শরীর অসুস্থ। তারওপর আবার দূর্বল। মার খাওয়ার পর জীবনটা মনে হচ্ছিলো বেরিয়ে যাচ্ছে আর সহ্য করতে পারলনা। ওই জায়গাতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। রাজীব অয়নীকে আবারও অমানুষিক ভাবে অত্যাচার শুরু করেছিলো আর বলছিলো
: বুঝতে পারছিস না কিসের সই বুঝতেছিস না,, না
: নাহ্…বুঝতে পারছিনা
: কুত্তি আমি তোকে ডিভোর্স এর কথা বলছি রে…!
: আ আমি তোমাকে ডিভোর্স কেনো দেবো…?
: তোর মতো অপয়াকে বোঝানোর দরকার নাই আমার
: রজীব..!! এগুলো কি বলছো…
: কান নাই, শুনতে পাচ্ছিস না। নাকি বেতটা এনে কানটও পরিষ্কার করে দিবো…!
: রাজীব তুমি ভূলে যাচ্ছো তুমি আমাকে ভালবাসতে। আমাদের ভালবেসে বিয়ে হয়েছিলো….! রাজীব তোমার এতো পরিবর্তন কেনো..!
: হা হা হা….! আমি বদলাইনি রে। বরং তোর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
:মানেহ্
: শোন অপয়া আমি তোকে বিয়ে করেছিলাম তোর বাবার কাছ থেকে কিছু পাবার আশায়। তুই তে তার একমাত্র মেয়ে। কিন্তু হলো তো উল্টো। সে তোকে ত্যাজ্য করলো। আবার তোর সন্তানকে মেনে নিলো….! আর: ভালবাসা..হা হা সেটা কতজনকে বেসেছি….!
: ছিঃ রাজীব তুমি এতো নীচ….!
: কি বললি আমি নীচ,,,আমি নীচ….!
আবার মারতে লাগলো। চিল্লাচিল্লি শুনে টিনা দৌড়ে এসে দেখে আবার সেই পুরোণ চিত্র। দ্রুতো অয়নীকে নরপশুটার কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসলো নিজের ঘরে। আসার সময় অয়নী শুনতে পেলো রাজীব ফোনে কাকে বলছে, ” হ্যা সোনা বলো,,,,না না ব্যাস্ত হবো কেনো ওই অফিসের ফাইলগুলো দেখছিলাম”
ঠিক এভাবে অয়নীকে আগে বলতো।
ঘরে এসে টিনা অয়নীকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তারপর বললো
: তুমি কেনো এই নরপশুকে বিয়ে করেছিলে। একটা পিশাচ কোথাকার। জানোয়ার একটা ছিঃ….
:(কাঁদতে কাঁদতে) বাদ দে রে বোন। সবার কপালে সব সয়না। লালাট বলে একটা কথা আছে না। সেখানে আমার সুখ বলে বস্তুটা নেই।
: তাই বলে এভাবে দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করে যাবে….!
: কি করবো তাছাড়া বল। ওই বাড়ির দরজাটাও যে আমার জন্য বন্ধ।
: বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারোনা। যেদিক দুচোখ যায়। এভাবে আর কতো অত্যাচার সহ্য করবে,, কতো নিপীড়নের স্বীকার হবে,,কতো নির্যাতনের মুখোমুখি হবে….কতো,, কতো…
বাড়ি থেকে যেদিকে মন চায় সেদিকে যেতে টিনা রাগ করে বলেছিলো। কিন্তু কথাটা অয়নীর মনের কোনো এক কোণে আটকে গেলো।
আগের বার অয়নী বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বড় ভূল করেছিলো। কিন্তু এবার আগের বারের থেকে অনেক ভয়ংকর আর কঠিণ সিদ্ধান্ত নিলো অয়নী……!
< <<চলবে>>>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *