সে কি জানে Season 2 ! Part- 48
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জেনির কান্না বেড়েই চলেছে। থামার কোনো নাম-গন্ধ আদৌ পাচ্ছে না দিহান। একদিকে যেমন তার বিরক্ত লাগছে, তেমনি অন্যদিকে কষ্টও হচ্ছে। মেয়েটার সাথে ভুল করে ফেলছে সে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে! এখন এ নিয়েই সারাক্ষন পরে থেকে লাভ কি? এতে শুধু আশান্তি বাড়বে। সুখ তো আদৌ মিলবে না। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল দিহান। জেনির কাছে গিয়ে বসতেই জেনি ক্ষাণিকটা দূরে সরে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিহান। কোলে তুলে নিলো তাকে। জেনি বিচলিত হলো। তবে দিহানকে ধরল না মোটেও। কিংবা নিজেকে ছাড়ানোর কোনো প্রয়াসও করল না। নির্বাক সে। ভয়ংকর রকমের নির্বাক! তার নির্বাক থাকার পেছনে যে কতটা অভিমান আর রাগ মেশানো তা টের পাচ্ছে দিহান। জেনিকে ওয়াশরুমে রেখে আলমারি থেকে নিজের কিছু জামা বের করে ড্রইংরুমের বাথরুমে চলে যায় সে। সাথে সাথে জেনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না সে। বেহায়া কান্না চোখ থেকে বরাবরই পানি হিসেবে বিরতিহীন ভাবে পড়ছে। যেন পানিগুলো একরাশ অভিমান।
________________
ড্রইংরুমের এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করছে দিহান। রুমে যাবে কি যাবে না, সে ভাবনায় শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। অপরাধবোধে জেনির সাথে কিভাবে কথা বলবে সে? লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল সে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রুমের দিকে। রুমে ঢুকতেই থমকে গেল দিহান। বিছানার এক কোণে হাঁটুতে মাথা গুঁজে কান্না করছে জেনি। বুকটা কেমন করে উঠল দিহানের। “জেনি” বলে মৃদু আওয়াজ করতেই মাথা তুলে তাকালো সে। সাথে সাথে বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হতে লাগলো দিহানের। চোখ-মুখ লাল হয়ে ফুলে গেছে জেনির। দিহান এগিয়ে গেল জেনির দিকে। হুট করে জড়িয়ে ধরল তাকে। জেনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। দিহান থেকে নিজেকে ছাড়াতে নিলেই দিহানের করুন কণ্ঠ কানে এলো তার।
— “সরি মাই ল্যাডি! সরি ফর এভ্রিথিং! আমি আসলে এত রিয়েক্ট করতে চাই নি। আবার খুশিও হই নি। সব অপ্রত্যাশিত ছিল। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে তোমার পরিবারের সম্মতিতে, পুরো সমাজের সামনে একজন রেস্পেক্টেবল পারসন হিসেবে বিয়ে করব। আর তারপরই তোমাকে আপন করে নিবো। কিন্তু তার আগে এমন কিছু ঘটে গেল!”
একটু থেমে দিহান আবারও বলে উঠল,
— ” তোমার বাবা যদি আমাকে মেনে না নেয়? আমার থেকে যদি তোমাকে কেড়ে নেয়? আমার এই ভুলটার জন্য তখন তোমার কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো?”
জেনি কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে উঠল,
— “চাই না তোমাকে। চাই না কিছু ভেবে দেখতে। থাকবো না আমি তোমার সাথে। তুমি চরম ফালতু একটা ছেলে। ভালোবাসি না তোমাকে। দূরে সরো আমার থেকে। চলে যাও আমার সামনে থেকে।”
দিহান হাসলো। জেনিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
— “চলে যাবো?”
জেনি জবাব দিলো না। কান্না বেগ আরও বাড়িয়ে দিলো। দিহান তখন আদূরে কণ্ঠে বলে উঠল,
— “এত কেঁদো না প্লিজ বউ। আমার তো কষ্ট হয়। আমার কান্না থামানোর জন্য তোমাকে আনলাম আর সেই তুমিই কিনা এখন আমার সামনে কাঁদছো? কাঁদবে না একদম! আই প্রমিস আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে তোমার বাবাকে খুশি করার চেষ্টা করব। পরিবারকে সাক্ষী নিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। তারপর সারাজীবনের জন্য টোনাটুনির সংসার করব। যেখানে শুধু থাকবে অবিরাম সুখ!”
জেনি কান্না থামালো না একদমই। বরং দিহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অবিরাম কেঁদে চলল। এ যে বড্ড সুখের কান্না।
৬৬.
দুপুরে খাবার খেয়ে অজানা কারনে তিনবার বমি হলো আমার। এর পরপরই মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাই আমি। ভাগ্য ভালো নীলা রাহমান পাশে ছিলেন আমার। ফ্লোরে পড়ে যাওয়ার আগেই আমাকে ধরে ফেলেন উনি। কোনোমতে রুমে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন। রেয়ান তখন হাসপাতালে ছিলেন। আমার মাথা ঘুড়িয়ে পড়ার কথা উনার কানে যেতেই হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে চলে আসেন উনি। আমি বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলাম। উনি আমার কাছে এসেই প্রথমে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমি একটা ‘টু’ শব্দটিও করিনি। শরীরে শক্তি না থাকায় তাকে জড়িয়ে ধরতে পারলাম না। তবে তাকে অনুভব করছি প্রবল ভাবে। কিছুক্ষন পর আমার থেকে সরে আসেন উনি। মুখে অবিরাম চুমু খেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন আমার সামনে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে গলা ধরানো কণ্ঠে বলে উঠেন,
— “মন তো চাচ্ছে তোমাকে গিলে ফেলি মরুভূমি। এত কেয়ারলেস কেন তুমি? কালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম না তোমাকে? কিছু হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করেছিলাম তো! তাহলে মিথ্যা বললে কেন? আমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে? আমাকে মেরে ফেলতে চাও? শ্বাস আটকে মরে গেলে খুশি হবে তো? তুই বঝিস না! কষ্ট হয় তো আমার! শ্বাস নিতে পারি না ঠিকমতো। এতটা অবুঝ কেন তুই?”
গলা থেকে স্বর আর বের হতে চাইলো না রেয়ানের। কয়েকটা ঢোক গিলে আবারও কিছু বলবেন, তার সে বলাটাকে বাঁধা দিয়ে আমি শান্ত স্বরে বলে উঠলাম,
— “শান্ত হোন! জগ থেকে পানি ঢেলে তারপর কথা বলুন। কষ্ট হচ্ছে আপনার।”
— “তুমি তো সেটাই চাও।”
— “হুম চাই। এবার পানিটা খান।”
রেয়ান খেলেন না পানি। উল্টো রেগে গিয়ে বললেন,
— “হ্যাঁ! এখন তো এটাই বলবি। আমাকে কষ্ট দিলে তো তোর পৈশাচিক আনন্দ হয়। তুই তো এটাই চাস যে তোর টেন্সনে টেন্সনে আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাই।”
তীব্র থেকে তীব্র ভাবে ক্ষেপে উঠছেন রেয়ান। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাকে কাছে ডাকলাম আমি। উনি মুখ ফিড়িয়ে নিলেন। বেশ কয়েকবার ডাকার পরও যখন উনি শুনলেন না, এবার আমি তার কাছে যাইতে চাইলে রেয়ান সাথে সাথে আমাকে বাঁধা দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি মাথা উঁচু করে তার কপালে চুমু দিলাম। নিমিষেই সব অভিমান মিটে গেল তার। অভিমানের বদলে মুখে ফুটে উঠল একরাশ হাসি। আমার গালে দু’হাত রেখে মুখ উঁচু করলেন উনি। শান্ত স্বরে বললেন,
— “কি হয়েছে এখন ঠিক করে বলো।”
আমি ক্ষাণিকটা সময় চুপ থেকে বললাম,
— “বেশ কয়েকদিন ধরে মাথা ব্যথা করে আমার, খাবার দেখলেই বমি বমি পায়। ডিমের গন্ধ তো সজ্জই করতে পারি না আমি। তার উপর পেটের ভেতর কেমন যেন করে। মাঝে মাঝে ভীষণ টক খেতে মন চায়।”
আমার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন রেয়ান। ক্ষীন স্বরে বললেন,
— “এসব লক্ষণ তো__!”
কথা শেষ করলেন না রেয়ান। হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এমন করলেন কেন হঠাৎ?
প্রায় ২০ কি ২৫মিনিট পর আবারও আমার কাছে এলেন রেয়ান। হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে অস্থির হয়ে বলে উঠলেন,
— “আমার নিজেকে অনেক মুর্খ মনে হচ্ছে মরুভূমি। তোমার লক্ষণগুলো কিসের তা বুঝেও বুঝতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে ডাক্তার হওয়ার জন্য এতগুলো বছর যা যা পড়েছি সব নিমিষেই ভুলে গেছি আমি। তুমি প্লিজ একবার টেস্ট করো। প্লিজ!”
আমি কিছুক্ষন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। পরক্ষনেই নির্বাক চলে গেলাম ওয়াশরুমে।
ক্ষাণিকবাদ বেড়িয়ে এলাম আমি। রেয়ান সারা রুমময় পায়চারী করছিলেন৷ আমাকে বের হতে দেখেই থমকে দাঁড়ান উনি। আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। কিছু বলতে চেয়েও বলছেন না। তবে ব্যগ্র হয়ে উঠছেন প্রবল ভাবে৷ অপেক্ষার অবশন ঘটিয়ে মুখ খুললেন এবার। বললেন,
— “রেজাল্ট কি পজেটিফ মরুভূমি?”
আমি কিছু বললাম না। মাথা উপর-নিচ নাড়ালাম মাত্র। রেয়ান মাথা নিচু করে শুধু এতটুকুই বললেন,
— “তুমি মোর ভালোবাসা,
তুমিই মোর সর্বোসুখ!
বলো তো! এত সুখ
দিয়ে আমায় পাগল করিয়ে
লাভ কি তোমার?”
.
.
চলবে…