সে কি জানে Season 2 ! Part- 39
৫৩.
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেলো। পার্লার থেকে সাজিয়ে নিজের রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে আমাকে। একটু পরেই হলুদ লাগাতে স্টেজে নিয়ে যাওয়া হবে। আপাতত কাঁটাচামচ দিয়ে মিষ্টি খেতে ব্যস্ত আমি। হঠাৎ বারান্দা থেকে কচরমচর শব্দ পেতেই চমকে উঠলাম। “কে” শব্দাটা উচ্চারণ করেই এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। তবে কাউকে দেখতে পেলাম না। পেছনে ফিরতে নেবো তার আগেই এক জোড়া হাত আমার বাহু চেপে ধরল। আলতো করে নিজের দিকে ঘুরালো আমাকে। আরেক দফা চমকালাম। সামনে থাকা ব্যক্তিকে চিনতে পেরেও যেন চিনলাম না আমি। মুখে মাক্স, মাথায় কেপ! গায়ে কালো রঙের একটা শার্ট। তবে চোখগুলো কোনো আবরণ দ্বারা আবৃত নয়। ফলে চোখ দেখেই বুঝতে পেরে গেলাম মানুষটা আসলে রেয়ান! ধূসর রঙের চোখ তার। তাকালেই এক গভীরতায় আটকে যাই আমি। এবারও তাই! কিন্তু পরক্ষনেই মাথায় আসলো রেয়ান এখানে আসবেন কিভাবে? মনে ভয়-ভীতি কাজ করল এবার। মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলাম আমি। সাথে সাথে রেয়ান নিজের মুখের মাক্স একটানে খুলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠেন…
— “মরুভূমি! এটা আমি। তোমার রেয়ান!”
যা সন্দেহ করলাম তা-ই হলো। রেয়ানের মুখটা দেখে সব ভয়-ভীতি যেন মুহুর্তেই উবে গেল। উনার দিকে তাকালাম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে। একটু কাছে গিয়ে দু’হাত ভাঁজ করে বললাম…
— “আপনি এখানে কেন? আপনাদের বাসায় না আপনার হলুদের অনুষ্ঠান চলছে?”
রেয়ান হাসলেন। পকেট থেকে কিছু একটা বের করতে করতে বলে উঠলেন…
— “বউ তো আমার এখানে। ওখানে থেকে কি করব?”
— “আপনি কি অনুষ্ঠান রেখে এখানে পালিয়ে এসেছেন রেয়ান?”
উনি এবার আগের চেয়ে আরেকটু বিরাট হেসে বলে উঠলেন…
— “হুম।”
— “মানে কি? অনুষ্ঠান ছেড়ে এখানে কি জন্যে এসেছেন?”
আমার প্রশ্নের বিনিময়ে রেয়ান প্যান্টের পকেট থেকে হলুদে ভরা একটা প্যাকেট থেকে একটু খানি হলুদ হাতে নিয়ে গালে লাগয়ে দিলেন আমার। পরক্ষনেই গাল থেকে আবার নাকে একটু লাগিয়ে দিলেন উনি। আমার নাকের সাথে নিজের নাক হালকা ছুঁইয়ে কপালে কপাল ঠেকে মৃদু সরে বলে উঠলেন…
— “আমার বউকে আমার আগে কেউ হলুদ লাগাবে? নো ওয়ে!! তাই চলে আসলাম আমার হলুদপরীকে হলুদ লাগাতে।”
— “কিন্তু…”
— “হুস! এত কথা বলো না তো। হলুদ লাগিয়ে দাও আমাকে।”
তার কথা শুনে সরে আসতে চাইলাম আমি। সরতে দিলেন না উনি। হাতের বাহু চেপে ধরলেন শক্ত করে। আবারও মৃদু সরে বলে উঠলেন…
— “উহু! এভাবে না। তোমার গালে লাগানো হলুদ আমার গালে ছুঁইয়ে লাগাও।”
মৃদুভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। কিছু বলার মতো অবস্থা নেই আমার। গলায় কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে বারংবার। চোখ বন্ধ করে ফেললাম সাথে সাথে। রেয়ান বাঁকা হাসলেন আমার এমন অবস্থা দেখে। নিজ থেকেই আমার গালে গাল ছুঁয়ালেন উনি। সরে গেলেন ততক্ষনাত। আমি এখনও চোখ বন্ধ করা অবস্থায়। জোড়ে কিছু শব্দ হওয়ায় চোখ মেলে তাকালাম। রেয়ান নেই আমার আশেপাশে। কিন্তু কিভাবে? উনি তো এতক্ষন আমার সামনেই ছিলেন। তাড়াতাড়ি বারান্দার রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে রেয়ান বারান্দা থেকে নিচে নেমে গেছেন।চারপাশ খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করে নিজের গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন উনি।গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই বারান্দার দিকে তাকালেন একবার।চারপাশ আরও একবার দেখে মুখের মাক্সটা খুলে ফেললেন। ঠোঁট দু’টো চুমু দেওয়ার ভঙ্গিমা করে গাড়িতে বসলেন দ্রুত গতিতে।গাড়ির জানালা দিয়ে আরও একবার দেখে নিলেন আমায়। তারপর চলে গেলেন নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটু আগে রেয়ানের গাড়ি থাকা ফাঁকা রাস্তায় এখনও তাকিয়ে আছি আমি। কেন যেন অন্যদিকে তাকাতে মন চাইছে না আমার।
একটু পরেই মামী আমাকে রুম থেকে নিতে আসলেন।আমার মুখে হলুদ লাগানো দেখে ভ্রুঁ কুঁচকান উনি। দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠেন…
— “মীরা! তোর গালে আর নাকে হলুদ লাগানো কেন? রুমে কি করছিলি তুই?”
মামীর দিকে চোরের দৃষ্টিয়ে তাকালাম আমি। কি বলব এখন? রেয়ান এসে লাগিয়ে দিয়ে গেছেন এটা? মোটেও না।মামী আস্ত রাখবেন না আমাকে।মস্তিষ্কে বিক্রিয়া ঘটিয়ে কিছু একটা বানিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই।জোড় পূর্বক হেসে বলে উঠলাম,
— “আসলে হয়েছে কি মা আমার না খুব ইচ্ছে করছিল নিজের গালে-নাকে একটু হলুদ লাগাতে।তাই আরকি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে হলুদ লাগিয়েছি!”
মামীর যেন বিশ্বাস হলো না কথাটা। আরও তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।বলে উঠলেন,
— “হলুদ কোই পেলি তুই?”
এবার বিরক্ত লাগছে আমার। এত্ত প্রশ্ন! এগুলোর জবাব দিতে দিতেই আমি বুড়ি হয়ে যাবো। এত প্রশ্ন কেউ করে নাকি? ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও তা মুখে প্রকাশ করলাম না। কথা ঘুড়িয়ে বলে উঠলাম…
— “পেয়েছি এক জায়গায়। এখন এসব বাদ দাও তো! আগে এটা বলো এখানে কেন এসেছো? জরুরি কথা কি?”
— “তোকে নিতে এসেছিলাম। কথায় কথায় তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি চল! সবাই অপেক্ষা করছে তোর জন্য।”
আমি যেন হাফ ছেঁড়ে বাঁচলাম। ধীর পায়ে মামীর পিছু পিছু যেতে লাগলাম।
____________
হলুদ শেষে রুমে এসেই গোসল করে ফেলি আমি।মামী নতুন একটা শাড়ি দিয়েছেন আমায়।সেটা পরেই বের হলাম রুম থেকে। চুল মুছে বিছানায় বসতে না বসতেই মামী এসে হাজির।হাতে তার খাবারের প্লেট। চটফট পুরো এক প্লেট খাবার খাইয়ে দিলেন আমায়। আমি বিনাবাক্যে খেয়ে নিলাম সেগুলো। এরপর হয়তো মামীর হাতের খাবার কপালে খুব কমই জুটবে আমার। খাইয়ে দেওয়া তো পরের ব্যাপার!
মামী যাওয়ার কিছুক্ষন পরই আবার আসলেন রুমে। কয়েকজন মহিলাও এসেছেন সাথে। আমাকে অজু করিয়ে জায়নামাযে বসালেন উনারা। মাথায় একটা বিরাট ঘোমটা পড়িয়ে দিলেন। তখনই মামীকে একজন বলে উঠল- রেয়ানকে নাকি মসজিদে নেওয়া হয়েছে বিয়ে পড়াতে। আমি নির্বাক সেগুলো শুনে গেলাম। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে আমার সাথে। আবদ্ধ আর দীঘির তো অন্য ভাবে বিয়ে হয়েছিল। তারা দুজন বর-কনে সেজে একসাথে কাজী সাহেবের সামনে বসে বিয়ে করেছিল। তাহলে আমাদের বেলায় আলাদা কেন? আস্তে করে মামীকে ডাকলাম। মামী বসে পড়লেন পাশে। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন…
— “কিছু বলবি?”
— “হুম!”
— “বল।”
— “আচ্ছা মা, আবদ্ধ আর দীঘির বিয়ে তো এভাবে হয় নি। তাহলে আমার বিয়ে এভাবে হচ্ছে কেন?”
মামী হেসে বলে উঠলেন…
— “রেয়ানের বাবা বলেছেন তাই।”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। কথা বলার আর কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা তেমন। কিছুক্ষন পরই কাজী রুমে এলেন। আমাকে “কবুল” শব্দটা বলতে বলছেন উনি। তবে মুখ থেকে একটা “টু” শব্দও বের হচ্ছে না আমার। মনে হচ্ছে আমি যেন মুহুর্তেই বোবা বনে গেছি। মনে পরে গেল দীঘির বিয়ের দিনের কথা! মেয়েটাকেও “কবুল” বলতে বললে সে চুপ করে ছিল। প্রায় অনেক্ষন! যা দেখে তখন প্রচুর রকমের বিরক্ত হয়েছিলাম আমি। এত সময় লাগে নাকি এতটুকু শব্দ উচ্চারণ করতে? মনে মনে হাজারবার সে শব্দটা উচ্চারণ করেছিলাম আমি। অথচ এখন? কণ্ঠনালি থেকে সরই বের হচ্ছে না! চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললাম। মুহুর্তেই একটা কথা মস্তিষ্কে এটে গেল। এখন যেমন নিজের ভালোবাসাকে আপন করে সারাজীবনের জন্য পেয়ে যাবো, তেমনি নিজের আপনজনকেও সারাজীবনের জন্য ছেড়ে চলে যেতে হবে আমার! চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম একবার। গড়গড় করে তিনবার “কবুল” শব্দটা বলে ফেললাম। আমার কি হলো কে জানে? পাশে বসে থাকা মামীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কেঁদে দিলাম শব্দ করে। মামীও তাই! মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন উনি।
৫৪.
বউ সেজে স্টেজে বসে আছি আমি। আশপাশের তীব্র লাইটিং চোখে পরছে বারংবার। চোখ মেলে থাকাটা যেন দায় হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। কানে আসছে মানুষের কোলাহলের শব্দ! চোখটা বন্ধ করে আরেকবার খুললাম আমি। ইতিমধ্যে রেয়ান এসে গেছেন এখানে। আমার পাশে এসে ধপ করে বসে পড়লেন উনি। সবার আড়ালে হাত ধরে ফেললেন শক্ত করে। সরাসরি রেয়ানের দিকে তাকাতে পারলাম না আমি। কারন সবাই এদিকেই তাকিয়ে আছেন। কোনোমতে রাগী কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম…
— “হাত ছাড়ুন রেয়ান। কেউ দেখলে কি বলবে?”
— “মগের মুল্লুক নাকি? আমার বউয়ের হাত আমি ধরেছি। কেউ দেখলে কার বাপের কি?”
— “হাত ছাড়ুন!”
— “উহু!”
— “আপনি এমন জেদি কেন?”
— “আমার বাপ জেদি বলে।”
— “আপনি একটা বেহায়া লোক! লাগামহীন!”
— “আর তুমি এই বেহায়া, লাগামহীনের বউ।”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। এ মানুষটার সাথে কথা বলে যে আমি পারবো না এটা অজানা নয় আমার। তাই চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলাম মাত্র! আড়চোখে রেয়ানের দিকে তাকালাম। তার উজ্জ্বল মুখটা এক বিশেষ হাসির প্রেক্ষাপটে আরও উজ্জ্বল হয়ে পড়েছে। বারবার ডান হাত দিয়ে চুলগুলো স্লাইড করছেন উনি। একটু পরপর তাকাচ্ছেন আমার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম তার থেকে। মাথা তুলে চারপাশটা দেখতে লাগলাম কিছুক্ষন। হঠাৎ চোখ গিয়ে থামলো দিহানের দিকে। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত বুকে রেখে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তবে দিহান একা নয়! জেনিও আছে সাথে। ভার্সিটিতে অনেকবারই ওদের একসাথে দেখেছি আমি৷ তাই এখন ওদেরকে একসাথে দেখে মোটেও অবাক হয় নি আমি। কেন যেন মনে হয়, এ এক নতুন গল্পের শুরু! দিহানের দিকে তাকিয়ে এক ফালি হাসলাম আমি। চোখ নামিয়ে ফেললাম ততক্ষনাত। আরও কিছুক্ষন দিহানের দিকে তাকালে হয়তো তার কষ্টেভরা হাসি দেখতে পেতাম।আড়চোখে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম…
— “দিহান এসেছে।”
— “দেখেছি!”
— “সাথে জেনিও আছে।”
— “হুম।”
রেয়ানের এমন একবাক্যে উত্তর দেওয়াটা রাজ্যের বিরক্তিতে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। প্রকট বিরক্তি নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম…
— “ভালোভাবে কথা বলুন রেয়ান। “হুম!, দেখেছি” এগুলো কি ধরণের কথা?”
উনি এবার আমার কানের কাছে কিছুটা ঝুঁকে এলেন। বাঁকা এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন…
— “চলো মরুভূমি। কোথাও পালিয়ে গিয়ে রোমেন্স করি। এখানে ঠিক সুবিধা হচ্ছেনা বুঝলে।”
কথাটা বলে থামলেন রেয়ান। ফিসফিসিয়ে আরও একটা কথা বলে উঠলেন উনি। সাথে সাথে চোখ বড় করে তাকালাম উনার দিকে। উনি যে এতটা নির্লজ্জ আর অভস্য, তা জানা ছিল না আমার!
এদিকে দিহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তা দেখে জেনির মন খারাপ তীব্র থেকে তীব্র ভাবে বাড়ছে। সে তো আসতে চায় নি এখানে। তাকে জোড় করে এনেছে দিহান। অথচ এখন একটা কথাও বলছে না সে। শুধু মনের কষ্টগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে মাত্র! দিহানের দিকে আরও একবার তাকালো জেনি। দিহান থেকে একটু সরে দাঁড়াতেই সে বলে উঠল…
— “মীরুকে অনেক সুন্দর লাগছে তাই না জেনি? একদম পরীর মতো! আচ্ছা আমাদের বিয়েতে তোমাকে বউ সাজলে কেমন দেখাবে? মীরুর মতো?”
দিহানের কথায় চমকালো জেনি। আমাদের বিয়ে মানে? প্রশ্নটার উত্তরটা যেন বারবার জানতে চাইছে সে। ইচ্ছেটাকে দমিয়ে না রেখে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিহান আবারও বলে উঠল…
— “জানো জেনি, মীরুকে এভাবে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব! কত স্বপ্ন ছিল আমার মীরু বউয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে এভাবে পুতুল হয়ে বসে থাকবে। তার পাশে বসে থাকবো আমি। সবার আড়ালে নানা খুনসুটিতে মেতে উঠব আমরা। সব কিন্তু ঠিক স্বপ্নের মতোই হচ্ছে। তবে বেঠিক হলো এটাই যে আমি মীরুর পাশে নেই। ওর পাশে অন্য কেউ।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিহান। জেনির দিকে তাকালো একবার। মেয়েটার চোখে জমা হয়ে আছে অসংখ্য পানিকণা। আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিহান। কথাটা হয়তো বলা উচিত হয় নি তার। আবার হয়তো হয়েছে! জেনির থেকে চোখ সরিয়ে মীরার দিকে তাকালো দিহান। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল…
— “এভাবে কথায় কথায় কাঁদবে না জেনি। বিরক্ত লাগে আমার।”
দিহান থামলো। তারপর আবারও বলল…
— “জানো তো জেনি! মীরা আমার প্রথম ভালোবাসা। আর তুমি আমার মনে দাগ কাঁটা এক নতুন অনুভূতি।”
কথাটা বলেই জেনির হাত চেপে ধরল দিহান। উল্টো ফিরে চলে যেতে লাগলো সে। জেনি হালকা চমকালো। দিহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল…
— “কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?”
— “বাসায়!”
— “কিন্তু আমরা তো এই মাত্র এসেছি এখানে। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবো!”
জেনির কথায় দিহান বিরক্তি প্রকাশ করল। বিরক্তি নিয়ে বলল…
— “তোমার কি মনে হয় জেনি, আমি আমার ভালোবাসার মানুষের বিয়ের দাওয়াত খাবো?”
জেনি দমে গেল। পরক্ষনেই দিহানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো সে…
— “ওই নতুন অনুভূতির নাম কি দিহান?”
দিহান চমকালো না। না দাঁড়ালো। বরং আগের চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো বাইরের দিকে। জেনির দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে স্থীর দৃষ্টি রেখে বলে উঠল…
— “হয়তো ভালোবাসা!”
__________________
ফুলে সাজ্জিত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর রেয়ান। আমাদের ঘিড়ে দাঁড়িয়ে সবাই। আমার ঠিক সামনে মামী আর আবদ্ধ শব্দ করে কাঁদছে। ওদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঠোঁট দিয়ে মুখ চেপে কান্না করছে দীঘি। হয়তো কান্নার শব্দ বের না হওয়ার প্রয়াস! দু’হাত দিয়ে যথা সম্ভব মামী আর আবদ্ধকে শান্ত করার চেষ্টা করছে সে। তাদের দেখে আমিও কাঁদছি। তবে সে কান্নায় নেই কোনো মুখের বিকৃতি, আর না আছে কোনো শব্দ! ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম মামী আর আবদ্ধের দিকে। ওদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম কিছুক্ষন। এর পরপরই দীঘিকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। সরে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলাম…
— “সরি রে দীঘি। বেশি দিন থাকতে পারলাম না তোর সাথে।”
কথাটা শুনে এবার শব্দ করেই কেঁদে দিল দীঘি। আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলে উঠল…
— “তুমি যেও না মীরাপু। আমাদের যে এখনও অনেক গল্প করা বাকি!”
হাসলাম আমি। বললাম…
— “ঠিক বলেছিস। কথায় কথায় ঝগড়া করা তো এখন হয়ই নি।”
এবার দীঘিও হেসে দিলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সবার মুখ আরও একবার দেখে নিলাম আমি। এক মুহুর্তও বিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম দ্রুত গতিতে। চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইলাম জানালার পাশে। একটু পরেই রেয়ান এসে বসলেন পাশে। গাড়ি চলতে শুরু করল তখনই। হয়তো এতক্ষন রেয়ানেরই অপেক্ষা করছিলেন ড্রাইভার চাচা!
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আমার হাত শক্ত করে ধরলেন রেয়ান। বলে উঠলেন…
— “তোমার কি কাঁদতে ইচ্ছে করছে মরুভূমি? কাঁদবে আমার বুকে?”
ব্যাস! এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য। রেয়ানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। কাঁদতে লাগলাম প্রবল ভাবে!
প্রায় অনেক্ষন পর শান্ত হলাম আমি। রেয়ান নিজ থেকে সরে এলেন আমার কাছ থেকে। হাতে টিস্যু নিয়ে চোখের পানিগুলো মুছতে মুছতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার মতো করে বলে উঠলেন…
— “হায়!হায়! মরুভূমি। তোমাকে তো পেত্নি পেত্নি লাগছে। এখন বাসায় যেয়ে কি বলব আমি? একজন পেত্নিকে বিয়ে করেছি এটা?”
চোখ গরম করে তাকালাম আমি। হাসলেন উনি। বললেন…
— “সত্যি বলতে আমার মরুভূমিটাকে এভাবেও পরীর মতো লাগে। কিন্তু এসব আদা-ময়দা লাগানোর ফলে কৃত্রিমতায় ভরে গেছে তোমার মুখ। প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেছে।”
রেয়ানের কথায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। পরক্ষনেই মনে হলো ড্রাইভার চাচা সামনে বসে আছেন।আয়নায় তাকালেই তো আমাদের এভাবে দেখে ফেলবেন উনি। নাকি দেখে ফেলেছেন? তাড়াতাড়ি সরে এলাম রেয়ানের কাছ থেকে। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে রইলাম। হঠাৎ রেয়ান আমার কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে উঠেন…
— “সামনে তাকাও মরুভূমি।”
তাকালাম না আমি। উনি আবারও বলে উঠলেন…
— “তাকাও।”
এবার তাকালাম। অবাক হলাম অনেকটাই। ওইবারের মতো এবারও সামনের আয়নাটি রুমাল দিয়ে ঢাকা।আমার অবাকের পর্ব শেষ হতে না হতেই রেয়ান আবারও বলে উঠলেন…
— “সব ঠিক থাকলেও ড্রাইভার চাচা কিন্তু আমাদের কথা শুনে ফেলেছে মরুভূমি। এখন কি করা উচিত বলো তো? তোমার তো লজ্জা পাওয়ার কথা। লজ্জা পাবে না?”
কথাটা বলেই বাঁকা হাসলেন রেয়ান। আমি আরও একবার লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলাম। মনে মনে হাজারবার আওড়াতে লাগলাম- “অসভ্য লোক! জীবনেও সুধরাবার নয়!”
__________________
রেয়ানের বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখলাম নীলা রাহমান, রাহুল আহমেদ, নুহান আর রেয়ানের বোন মৃধা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মূখ্য দরজার কাছে। সাথে আছে আরও কিছু আত্মীয়-সজন। আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন তারা। গাড়ির দরজা খুলে রেয়ান প্রথমে নেনে আসলেন। আমি নামতে নেবো তার আগেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন উনি। বারবার লজ্জা পাওয়ায় মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে আমার। এদিকে রেয়ানের এহেন কান্ডে সবাই জোড়ে জোড়ে হাসছে। একমাত্র রাহুল আহমেদ ছাড়া। উনি খুব কঠিন কণ্ঠে নীলা রাহমানের কানের কাছে বলে উঠেন…
— “তোমার ছেলেকে যত ইচ্ছে তত আনন্দ করতে বলো। কিন্তু রাতে বউমার ঘরের আশেপাশেও যেন ওকে না দেখতে পাই আমি। দরকার পড়লে বউমার সাথে তুমি ঘুমাবে আর তোমার ছেলে ছাদে! আর হ্যাঁ! সকাল হতেই তাকে তার নোংরা ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলবে। আমার বাড়িতে আর থাকা চলবে না তার।”
নীলা রাহমান লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললেন। এই বাবা-ছেলের শত্রুতা কখনও শেষ হবে কি হবে না, এটা নিয়ে অনেক সন্দেহ তার। এরা যে একই রক্তের গড়া। সাথে সাথে একটা নতুন রক্তের নাম আবিষ্কার করে ফেললেন নীলা আহমেদ। যার নাম- “একরোখা জেদি রক্ত!”
.
.
চলবে….