সে কি জানে Season 2 ! Part- 38
৫০.
রাতে বিছানায় বসে বই পড়ছিলাম আমি। হঠাৎ মামী এলেন রুমে। নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসলেন। শান্ত সরে বললেন…
— “রেয়ানের বাবা আজকে সকালে ফোন করেছিলেন আমাকে।”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালাম মামীর দিকে। হাতের বইটা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসে বললাম…
— “নিশ্চয়ই বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্য ফোন করেছিলেন তাই না?”
— “হুম। আর এটাও বলেছেন যে উনি তিন দিন পর তোদের বিয়ে দিতে চান।”
অবাক হলাম আমি। মামীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলাম…
— “এত তাড়াতাড়ি? কেন?”
— “রেয়ান নাকি তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায়। আমি চিন্তা করেছি কালকে তোদের এঙ্গেজমেন্ট করিয়ে ফেলবো ঘরোয়া ভাবে। এর একদিন পর হদুল আর বিয়ে একসাথে করানো হবে। রাহুল আহমেদকে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। উনি কালকে সন্ধ্যা করে চলে আসবেন।”
আরেক দফা অবাক হলাম আমি। কালকে আমার এঙ্গেজমেন্ট, দুইদিন পর আমার বিয়ে অথচ আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। সব কিছু কেমন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠল মুখে। মামীর দিকে তাকিয়ে বললাম…
— “এসব তোমরা কখন সিধান্ত নিলে? আবদ্ধ জানে?”
— “হ্যাঁ! আবদ্ধ, দীঘি আর আমি মিলেই সবকিছু প্লেন করে ফেলেছি।”
— “এত তাড়াতাড়ি?”
— “অবশ্যই। এসব বিষয়ে আমরা অনেক ফাস্ট বুঝলি।”
— “বুঝলাম।”
কথাটা বলে চুপ হয়ে গেলাম ক্ষাণিক্ষন। আরেকটু ভালোভাবে বসে মামীর হাত ধরলাম শক্ত করে। বললাম…
— “এত তাড়াতাড়ি কেন বিয়ে করতে বলছ আমাকে মা? তাছাড়া টাকারও তো ব্যাপার আছে তাই না?”
মামী এবার একটু গম্ভীর হলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন..
— “একদিন না একদিন সবার বিয়ে করতে হয় মা। সেটা আজ হোক কিংবা কাল। সত্যি বলতে আমিও চাই নি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে। তবে রেয়ানের বাবা জেদ করলেন। উনিও চান যেন তুই উনার ঘরের বউমা হয়ে খুব শীগ্রই আসিস। আমি তখন আর কিছু বলতে পারি নি জানিস। তাছাড়া তুই কি আমার কাছ থেকে একেবারে চলে যাচ্ছিস নাকি? যখন ইচ্ছে রেয়ানকে নিয়ে চলে আসবি বাসায়। কে মানা করেছে?”
মামী থামলেন। তার চোখে পানি টলমল করছে। তবে তা নিচে গড়িয়ে পড়ল না। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মামী আবারও বলে উঠলেন…
— “শুন টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোর। আমরা গরিব নাকি? তোদের তো নিজস্ব কোম্পানি আছে তাই না? এটা থাকা সত্ত্বেও কি আমাদের টাকার অভাব হবে কিংবা কখনও হয়েছে? ভুলে যাস না তোরা খান ইন্ডাস্ট্রির মালিক।”
মামীর কথায় হাসলাম আমি। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম…
— “সব ঠিক আছে। কিন্তু একটা জিনিস ভুল বলে ফেলেছো তুমি।”
মামী ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠলেন…
— ” কি? ”
— ” কোম্পানিটা শুধু আমাদের না। তোমারও! তাই আগে যে বললে “তোরা খান ইন্ডাস্ট্রির মালিক।” সেখানে তোরা শব্দটার জায়গায় আমরা শব্দটা বসবে।”
মামীর মুখের হাসি প্রসারিত হয়ে গেল মুহুর্তেই। গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরলেন আমায়। আমিও যেন ছোট শিশুর মতো মিশে গেলাম মামীর শরীরে!
__________________
টেবিলে বসে নিশ্চিন্তে খাবার খাচ্ছেন রেয়ান। পাশেই রেয়ানের ছোট ভাই নুহান বসে খাবার খাচ্ছে আর ফোন চালাচ্ছে। এবার সবে মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছে সে। বয়সে তাকে আবদ্ধের কয়েক মাসের ছোট বলা যায়। তার এই খাবার খেতে খেতে ফোন চালানো দেখে চরম বিরক্তিতে নিয়ে যাচ্ছে রাহুল আহমেদকে। উনি এবার বেশ বিরক্ত হয়েই বলে উঠেন…
— “এখন তো ফোনটা একটু রাখ। খাবার সময়ও এত কিসের ফোন হ্যাঁ?”
নুহান বিরক্তি প্রকাশ করল। হাতের ফোনটা পাশে রেখে দিলো ততক্ষনাত। তখনই রেয়ান নীলা রাহমানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন…
— “বুঝলে মা, তোমাদের ছোট ছেলে সারাদিন ফোন নিয়ে বাসায় পড়ে থাকলেও তোমার প্রিয়ধর বর তাকে কিচ্ছুটি বলে না। বিজনেস সামলাতে তো ভুলেও বলবে না। আর আমাকে? উঠতে-বসতে কথা শোনায়। কেন? কারন তার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি ডাক্তার হয়েছি। ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি বিজনেস সামলাতে পারছি না। তোমার বর কি এই বেরোজগাড় ছেলেটাকে কিছু বলতে পারে না। আমার সাথেই লাগে কেন সবসময়?”
এটা শুনে রাহুল আহমেদ চটে গেলেন। রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “তোমার ছেলেকে বলে দাও নীলা, ছোট ছেলে আমার অনেক ছোট। ওর এখন পড়াশোনার বয়স। বিজনেস সামলানোর না।”
রেয়ান এবার তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠেন…
— “মা তোমার ছেলে পড়ালেখা করে নাকি সারাদিন ফোন চালায় তা দেখে নিতে বলো তাকে। আর তাছাড়া সে কোন দুনিয়ায় বাস করে? এখনকার জেনারেশনে ইন্টারপাস করা ছেলেরাও বিজনেস করে।”
রাহুল আহমেদ বিড়বিড় করে বলে উঠেন…
— “আমি কোন দুনিয়াতে বাস করি এটা তুমি বিয়ের পড়েই জানবা মাই ডিয়ার সান। তখন বুঝবে আমি তোমার কে!”
এদিকে নুহান বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে রেয়ান আর রাহুল আহমেদের দিকে। এ মানুষগুলো জীবনেও সুধরাবে না। সারাটা দিন ঝগড়া আর ঝগড়া। রেয়ান আর রাহুল আহমেদ থেকে চোখ সরিয়ে নুহান এবার খাবার খেতে মনোযোগী হলো। খাবার খেতে খেতে নীলা রাহমানকে বলে উঠল সে…
— “রেয়ান ভাইয়ার বিয়ে কবে দিচ্ছো মা? আর আপুই-বা শ্বশুড় বাড়ি থেকে কখন আসবে?”
— “বলল তো হলুদের দিন আসবে।”
ভ্রুঁ কুঁচকান রেয়ান। নীলা রাহমানকে প্রশ্ন করার সুরে বলে উঠেন…
— “হলুদের দিন মানে? বিয়ে কখন আমার?”
সাথে সাথে রাহুল আহমেদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ান। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নীলা আহমেদকে বলে উঠেন…
— “তোমার ছেলেকে বলে দাও নীলা। কাল তার এঙ্গেজমেন্ট। এর একদিন পর বিয়ে আর হলুদ দোনো’টা হবে।”
বলেই রাহুল আহমেদ চলে যান নিজ রুমে। রেয়ান স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। গলা দিয়ে খাবার নামছে না তার। এক ধরণের আলাদ অনুভূতি আর উত্তেজনা অনুভব হচ্ছে তার। এখন এ আনন্দটা কিভাবে প্রকাশ করবেন উনি সেটাই বুঝতে পারছেন না রেয়ান। তার এ অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে নুহান আর নীলা আহমেদ। সেদিকে একবার আড়চোখে তাকালেন রেয়ান। কোনো রুপ ভঙ্গিমা না করে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ান উনি। ধীর পায়ে এগিয়ে যান রুমের দিকে।
__________________
রুমে ঢুকতেই রেয়ান “ইয়াহু” বলে জোড়ে শব্দ করে লাফিয়ে উঠেন। এক বিশেষ ধরণের আনন্দ কাজ করছে তার মধ্যে। আর মাত্র কয়েকদিন। তারপরই তার মরুভূমি সারাজীবনের জন্য শুধু তারই হয়ে যাবে।তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নিলেন রেয়ান। নিজের প্রেয়সীর নাম্বারে ফোন দিতেই দুই-তিনবার রিং হতেই ফোন ধরে ফেলি আমি। সাথে সাথে রেয়ান চরম উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠেন…
— “মরুভূমি! কালকে নাকি আমাদের এঙ্গেজমেন্ট। তুমি জানো এ বিষয়ে?”
আমি ধীর কণ্ঠে বলে উঠলাম…
— “হু! মা এই মাত্র বলে গেলো। কালকে সন্ধ্যায় তো আপনারা আসবেন তাই না?”
— “এসব জানি না আমি। বাবা শুধু বলল কালকে এঙ্গেজমেন্ট। সকালে হয়তো বিস্তারিত বলবে। যাই হোক, এসব বাদ দাও। এটা বলো, কেমন ফিলিং হচ্ছে তোমার?”
— “একরাশ আনন্দ আর একরাশ বেদনা। আপনার?”
আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না রেয়ান। উল্টো বলে উঠলেন…
— “বেদনা কেন?”
— “জানি না।”
— “এটা আবার কেমন কথা?”
— “কোনো কথা না! আপনার কেমন লাগছে সেটা বলুন।”
রেয়ান ফোনের অপাশ থেকেই মুখের হাসি প্রসারিত করে বলে উঠলেন…
— “আমার তো লুঙ্গিডান্স দিতে মন চাইছে মরুভূমি। ইচ্ছে করছে পুরো এলাকার মানুষদের নিয়ে নাচি।”
তার কথা শুনে মুচকি হাসলাম আমি। উনি কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “এই মরুভূমি, আমি তোমার কাছে আসি। দু’জনে মিলে সেলিব্রেট করব!”
— “না, একদমই না! ঘুমিয়ে যান তাড়াতাড়ি। কালকে অনেক কাজ আছে।”
— “আসি না।”
— “না মানে না। একদম না। ঘুমান চুপচাপ। রাখি।”
রেয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম আমি। মনে মনে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একদিক দিয়ে যেমন আনন্দ লাগছে, অন্যদিক দিয়ে ঠিক তেমনই কষ্ট হচ্ছে আমার। বুঝতে পারছি না এ কষ্ট কিসের! মামী আর আবদ্ধকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট নয়তো?
৫১.
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই একদল মেয়ে এসে হামলে পড়ে আমার ওপর। কোনোমতে ফ্রেশ হতে দেওয়ার সময়টুকু দেয় মাত্র! তারপর আবার আটকে ধরে আমাকে। দু’হাতে মেহেদী লাগাতে শুরু করে তারা। আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় অনেক-কেই দাওয়াত দিয়েছে মামী। কালকে রাতেই নাকি তারা রওনা হয়েছিলেন আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে। তাই সকাল হতে হতে আমাদের বাসায় এসে হাজির তারা। দিহানকেও সকালের দিকে ফোন দিয়ে বলা হয়েছিল আমার এঙ্গেজমেন্টে আসতে। আমার রুমে এসে আমারই সামনে আবদ্ধ লাউড স্পিকার দিয়ে ফোন করেছিল দিহানকে। যখন আবদ্ধ দিহানকে আমার আর রেয়ানের বিয়ের কথা বলে, তখন ফোনের অপাশ থেকে দিহানের মৃদু হাসার শব্দ এসেছিল। সে কিছু বলে নি তখন। আবদ্ধ তখন আবার বলে উঠেছিল যেন আজকের দিনটা আর বিয়ের দিনটায় দিহান আসে। দিহান কিছুক্ষন চুপ করে ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল সে…
— “আমি একটু ব্যস্ত আবদ্ধ। ইদানিং অনেক ব্যস্ততায় কাটে আমার। তবুও চেষ্টা করব মীরুর বিয়ের সময় আসতে। কেমন?”
চোখের ইশারায় আবদ্ধকে জোড়াজোড়ি করতে মানা করলাম আমি। আবদ্ধ তা-ই করল। বিদায় জানিয়ে ফোনটা কেটে দিলো সে। রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো নানা কাজের অযুহাতে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এই বিয়ে নিয়ে কত আজগুবি সব চিন্তা ছিল আমার। অথচ এখন কিছুই করছি না। কত ভেবেছিলাম আবদ্ধের পাশাপাশি দিহানও ভাইয়ের মতো আমার বিয়ের নানা কাজ করবে। কিন্তু আফসোস! দিহান যে আমাকে বোন হিসেবে দেখতো না। কিভাবে ভাই হিসেবে আমার বিয়ের কাজগুলো করবে সে?
__________________
রাত প্রায় ৮টা। রেয়ানসহ তার পরিবার আমাদের বাসায় এসেছে বহুক্ষন। এখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রেয়ানের কাছে। নিচে গিয়ে প্রথমেই আমার চোখ যায় রেয়ানের দিকে। ব্লেক স্যুট পড়েছেন উনি। ভেতরে ব্লু শার্ট। কোট-সহ শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত বটা তার। চুলগুলো খাড়া করানো। সাইনিং স্যু আর হাতে বড় ব্লেক ওয়াচ। মুখে অমায়িক হাসি। সব মিলিয়ে চোখ ফিরানো দায় হয়ে যাচ্ছে আমার। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে। উনি সেটা খেয়াল করলেন। মুখে দুষ্টো হাসির রেখার ফুটিয়ে ভ্রুঁ নাচিয়ে- “কি” বললেন। সাথে সাথে একরাশ লজ্জা এসে ভর করল আমার ওপর। চোখ নামিয়ে নিলাম। কিন্তু আমার দিক থেকে রেয়ান চোখ সরালেন না। বরং বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলেন। তীর্থ ভাইয়া আর রওনক ভাইয়া এ নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করে দিলেন। এতেও যেন রেয়ানের কোনো ভ্রুঁক্ষেপ নেই। উনি উনার মতোই তাকিয়ে আছেন। এদিকে আমি লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। তা যেন রেয়ানকে আনন্দ দিচ্ছে বেশ ভাবে। আমাকে উনার পাশে দাঁড় করাতেই উনি বাঁকা হেসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেন…
— “মরুভূমি! এসব এঙ্গেজমেন্ট, ফেঙ্গেজমেন্ট বাদ দিয়ে চলো একেবারে বিয়ে করে ফেলি। তোমার এমন পরীর মতো রুপ দেখে আমার তো ইচ্ছে…”
তার কথা শেষ না হতেই আমি মৃদু কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলাম…
— “অসভ্য! অসভ্য! অসভ্য!”
রেয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলেন মাত্র। দূর থেকে আমার আর রেয়ানের কান্ড দেখছে আবদ্ধ। দীঘি তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে৷ দীঘিকে একটু জ্বালাতে আবদ্ধ তার দিকে একটু ঝুঁকে বাঁকা হেসে বলে উঠল…
— “দীঘি চল আমরাও আবার বিয়ে করি।”
দীঘি ভ্রুঁ কুঁচকিয়ে বলে…
— “একবার বিয়ে করে সখ মিটেনি?”
— “না! তোর চকলেট ওয়ালা পেত্নী মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে আবার। যদিও এখন তোকে পেত্নীর থেকে কম লাগছে না। একদম পারফেক্ট পেত্নীই লাগছে। কিন্তু বিয়ের সময় একটু বেশিই লাগছিল বুঝলি। তাই আরকি!”
আবদ্ধ দাঁত কেলিয়ে হাসে। দীঘি রেগে যায়। হাতের কুনুই দিয়ে আবদ্ধের পেটে গুতা মারে জোড়েসড়ে। আবদ্ধ পেটে হাত দিয়ে নিচের দিকে একটু ঝুঁকে “আহ” শব্দ করে উঠে। তা দেখে দীঘি হেসে দেয়। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় ব্যথা পাওয়া স্থানে।
এদিকে সবার নজর আমাদের দিকে। কেননা দু’জন দু’জনকে আংটি পড়াবো এখন। প্রথমে আংটি আমার পড়াতে হয় রেয়ানকে। প্রায় অনেকটা সময় নিয়েই তাকে আংটি পড়িয়েছি আমি। কেন যেন তখন হাতটা অনেক কাঁপছিল আমার। যার রেশ এখনও রয়ে গেছে শরীরে। আমার কাঁপাকাঁপি দেখে রেয়ান মুচকি হাসেন। আমার হাতে আংটি পড়াতে নিবেন তখনই খেয়াল করেন তার দেওয়া সাদা পাথরের আংটিটা এখনও অনামিকা আঙ্গুল থেকে খুলিনি আমি। হাসি আরও প্রসারিত হলো রেয়ানের। সাদা পাথরের আংটিটা অনামিকা আঙ্গুলের পাশের আঙ্গুলটায় পড়িয়ে সেখানে তার হাতের আংটিটা পড়িয়ে দেন আমায়। পড়ানো শেষে আবার সটান হয়ে দাঁড়িয়ে যান উনি। কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেন…
— “আংটির মতো আমাকেও আগলে রেখো মরুভূমি। অযত্নে যে আমিও ক্ষুদ্র আংটিটার মতো একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবো।”
তার কথার মানে বুঝলাম না আমি। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম রেয়ানের দিকে।
৫২.
রাত এগারোটার দিকে সবাই চলে যান যার যার বাসায়। তবে আমাদের কিছু আত্মীয় রয়ে গেছেন এখানে। একেবারে বিয়ে শেষ করে যাবেন তারা। এদিকে আমি মাত্র ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। শরীর ক্লান্তু যুক্ত থাকলেও চোখে ঘুম নেই মোটেও। বুক চিড়ে কান্না আসছে বারংবার। একজন ঠিকই বলেছেন- “শত কষ্ট-বেদনা বুকে থাকলেও দিনে তা প্রকাশ পায় না। তবে রাতে! রাতে সে শত চেষ্টা করলেও ভেতরের কষ্টটা আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তা প্রকাশ পাবেই।” আর সাথে এখন ঠিক তেমনটাই ঘটছে।মাত্র আর একদিন থাকবো এখানে আমি।তারপর অন্যের বাসায় চলে যেতে হবে আমার। মামী আর কখনও সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠাতে আসবেন না আমাকে।খাবার খাওয়ায় অনিয়ম করলে মামী আর বকবেন না আমাকে। সবসময় মামী আর আবদ্ধকে চোখের সামনে দেখতে পারবো না আমি। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সাথে সাথে কল এলো ফোনে। রেয়ানের কল! কল রিসিভ করে রেয়ানকে কিছু না বলতে দিয়েই আমি কান্না ভেঁজা কণ্ঠে বলে উঠলাম…
— “আমি আপনাকে বিয়ে করব না রেয়ান।”
এক মুহুর্তের জন্য থমকে যান রেয়ান। পরক্ষনেই হেসে হেসে বলে উঠেন…
— “তুমি আমার সাথে মজা করছ মরুভূমি তাই না?”
এবার আমি কেঁদেই দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম…
— “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রেয়ান। মামী আর আবদ্ধকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। ওদের ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো রেয়ান। প্লিজ আমাকে ওদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন না। প্লিজ!”
আমার কথা শুনে রেয়ানের উত্তেজনা নিমিশেষেই শান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষন চুপ থেকে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে উনি বলে উঠেন…
— “আমার ওপর কি তোমার বিশ্বাস নেই মরুভূমি? আমাকে এতটাই পর মনে হয় তোমার? এখনও ভরসা করতে পারলে না আমায়? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে আম্মু (মামী) আর আবদ্ধ থেকে কেড়ে নিবো?মোটেও না! আই সোয়ের মরুভূমি বিয়ের পর তোমাকে একটু কষ্টও পেতে দিবো না আমি। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব তোমাকে খুশি রাখার। তারপরও যদি আম্মুর কথা মনে পড়ে তোমার, যতদিন ইচ্ছে আম্মুর সাথে থাকতে দিবো তোমায়। বিন্দু মাত্র আপত্যি করবো না। যখন মন চায় আম্মুর সাথে দেখা করাতে তোমাকে নিয়ে যাবো কিন্তু প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না মরুভূমি। শূণ্যে ভেসে যাবো আমি। একদম নিঃশেষ হয়ে যাবো।”
একটু শান্ত হলাম আমি। তার কথাগুলো অনেকটাই ভরসা মূলক আমার জন্য। তবে পুরোপুরি ভাবে শান্ত হতে পারলাম না। নিঃশব্দে কাঁদছি মাত্র! আর রেয়ান! উনি নানাভাবে শান্ত করার চেষ্টা করছেন আমায়।
এদিকে আবদ্ধ দীঘিকে শক্ত করে জড়িয়ে আছে। সবকিছু অসহ্য লাগছে তার। মনে এক সুক্ষ্ম কষ্ট দানা বেঁধে আছে। আর মাত্র একিদিন। তারপর তার মিরাপু চলে যাবে অন্য এক জায়গায়। আর কখনও সে মিরাপুর হাত ধরে বলতে পারবে না “চলো মিরাপু আজকে ঘুড়তে বের হবো।” আর কখনও খাবারের টেবিলে নানা মজার বিষয়ে হাসাবে না কেউ তাকে। কোনো ভুল করলে কেউ তাকে শাসণ করবে না। আরও শক্ত করে দীঘিকে জড়িয়ে ধরল আবদ্ধ। দীঘিও তাই। তারও যে কষ্ট হচ্ছে। মিরাপু যে তারও প্রিয় একজন মানুষ। সবার পাশাপাশি মামীও কাঁদছেন নিজ রুমে। সবার মনেই হাজারটা প্রশ্ন! হাজারটা কষ্টের রোল!
.
.
চলবে…