সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 32

রাত ২টা বেজে ৫৫মিনিট। চরম বিরক্তির সাথে বিছানায় শুয়ে আছি আমি। পাশেই আমার চাচাতো বোন মায়মুনা শুয়ে বকবক করছে। এই মেয়ে, শুধু মাত্র এই মেয়ের জন্য আমি রেয়ানের সাথে রাতভর কথা বলতে পারছি না। আজকে মেহমানরা সবাই আমাদের বাসায়ই থাকবেন। কালকে সকালে যাবেন তারা। যার ফল সরুপ মায়মুনা আমার রুমে ঘুমাবে। মায়মুনার একটা খুবই বাজে অভ্যাস আছে। কেউ যদি ফোনে কথা বলে কিংবা মেসেজে চ্যাট করে তবে সে উল্লুকের মতো মোবাইলের দিকে চেয়ে থাকে। যা অত্যন্ত বিরক্তিকর জিনিস। এই পরিস্থিতিতে রেয়ানের সাথে কথা বলা অসম্ভব আমার পক্ষে। যা রেয়ানকে বলতেই উনি প্রথমে রেগে গেলেও পরক্ষনে দমে যান। কেননা নিজের বাবার সাথে আমাকে দেখা করাতে নেওয়ায় হাসপাতালে অনেক কাজ জমে হয়ে গেছে তার। আপাতত রেয়ান সেসব কাজই করছেন হাসপাতালে!
৩৩.
অবশেষে মায়মুনা বকবক করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। চেয়েছিলাম রেয়ানকে একবার কল দিবো, কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো- “সে হয়তো ব্যস্ত এখন।” তাছাড়া আমারও প্রবল আকারে ঘুম পাচ্ছে। তাই আগপাঁচ ভাবতে ভাবতে আমিও ঘুমানোর প্রচেষ্টায় লেগে গেলাম।
চোখ মাত্র লেগেই আসছিলাম এ সময় ফোন বেজে উঠল আমার। বিরক্তি জিনিসটা কি তা এখন বেশ ভালোভাবে টের পাচ্ছি আমি। ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিকে এখন কয়েকটা বাজে কথা শুনেই ছাড়বো। কমনসেন্স ছাড়া মানুষ! এত রাতে কে ফোন দেয় একটা মেয়েকে? তবে তা আর হলো কই? ফোন হাতে নিতেই স্কিনে গোটা গোটা অক্ষরে রেয়ানের নাম ভেসে উঠল। মুহুর্তেই আমার রাগও যেন ভেসে গেল এক অচেনা সাগরে। ফোন রিসিভ করলাম আমি। সাথে সাথে অপর পাশ থেকে ক্লান্তি মাখা কণ্ঠে উনি বলে উঠলেন…
— “তুমি কি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে মরুভূমি? নিচে আসতে পারবে একটু? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।”
— “আসছি।”
তাড়াতাড়ি গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিলাম আমি। খুব সাবধানে রান্নাঘরে গিয়ে বিরিয়ানি গরম করতে লাগলাম। সবশেষে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম রেয়ানের কাছে। উনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। হাতে পানির বোতল! এগিয়ে গেলাম তার দিকে। সে এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন। ডাকলাম তাকে। বিনিময়ে চোখ খুললেন উনি। আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন…
— “এসেছো?”
— “হুম! আপনি কিছু খেয়েছেন রাতে?”
— “না।”
— “জানতাম! আপনার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি খাবেন।”
— “দারুন করেছো। চলো…!”
— “কোথায়?”
প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না রেয়ান। আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন পেছনের সীটে। নিজেও বসে পড়লেন পাশে। আমি প্লেটে থাকা ঢাকনা সরিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলাম তাকে। উনি আবেশে খেয়ে নিচ্ছেন সেটা। যেন ইহা তার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদ খাবার। খাওয়া শেষে আমার হাতে টিস্যু ধরিয়ে দিলেন রেয়ান। আমার দিকে একটু ঝুঁকে বলে উঠলেন….
— “মুখ মুছে দাও।”
আমি বিনা বাক্যে তাই-ই করলাম। কেন যেন তার এসব ছোট ছোট আবদার খুব মূল্যবান মনে হয় আমার কাছে। মুখ মুছে দিতেই রেয়ান আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। এতে চমকে উঠলাম আমি। করুন সরে বললাম…
— “আমার এখন যেতে হবে রেয়ান। বাসায় অনেক মেহমান। কেউ দেখে ফেললে..”
— “কেউ দেখবে না মরুভূমি। প্লিজ একটু ঘুমাবো আমি। মাত্র ২ঘন্টা প্লিজ।”
দমে গেলাম আমি। তার কথা ফেলতে পারছি না কোনো মতেই। উনি চোখ বন্ধ করে কোমড় জড়িয়ে আছেন আমার। তার দিকে তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টিতে৷ উনার চুলে আস্তে আস্তে হাত বুলাতে লাগলাম আমি।

৩৪.
সকাল প্রায় ১১টা। দীঘির বাবা কামরুলকে জেল থেকে মুক্ত করা হয়েছে মাত্রই। দীর্ঘ দিন পর বাইরের মাটিতে পা রেখেছে সে। একটা লম্বা শ্বাস টানলো সে। মনটা জুড়িয়ে গেল কামরুলের। চোখ বন্ধ করতেই নিজের স্ত্রীর মুখের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল সামনে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অপরাধ বোধ কাজ করছে তার মধ্যে। কথায় আছে- কোনো কিছু হারালেই তবে সে জিনিসটার মর্ম মানুষ বুঝে, কাছে থাকলে বুঝে না! কামরুলের ক্ষেত্রে তাই-ই হচ্ছে। খুব মনে পড়ছে নিজের স্ত্রী আর মেয়েটার কথা। তাদের কাছে ক্ষমা চাইবে সে। দরকার হলে পা ধরে ক্ষমা চাইবে। তাও তাদের ক্ষমা তার চা-ই চাই। এভাবে আর থাকতে পারছে না কামরুল। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। কাঁধের ব্যাগটা বাম হাত দিয়ে আরেকটু টেনে নিলো সে। পা বাড়ালো আবদ্ধের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
____________
খুব সকালেই মেহমানরা চলে যান নিজ গন্তব্যে। এখন বাড়িটা কেমন শান্ত শান্ত লাগছে। কোনো কোলাহল নেই। আর না আছে কোনো চিল্লাচিল্লি। মনে এক প্রশান্তি বয়ে গেল আমার। যাক, এবার রাতে শান্তি মতো রেয়ানের সাথে কথা বলতে পারবো আমি!
.
খাবারের টেবিলে বসে আছি আমরা। আমার নজর আবদ্ধ আর দীঘির দিকে৷ আবদ্ধ দীঘির গাল টানছে বারংবার৷ দীঘি আবদ্ধের দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য৷ পরক্ষনেই সে লজ্জায় মিশে যাচ্ছে মাটিতে। তাদের দেখে হাসলাম আমি। মনে যে কথাটি প্রথম এসেছে সেটা হলো- “একজোড়া সুখী দম্পত্যি তারা!”
আরেক দফা হাসলাম আমি। নিজের খাওয়ায় মন দিতেই হঠাৎ দারোয়ান চাচা এসে বললেন…
— “আফা কামরুল নামের এক ব্যটা আইছে। আপনেগোর লগে দেখা কইরবার চায়৷ পাঠামু ভিতরে?”
ভ্রুঁ কুঁচকালো আবদ্ধ। কিছু একটা ভাবছে সে। পরক্ষনেই মনে পড়লো আজ তো তার শ্বশুড়মশায়ের জেল থেকে রেহাই পাওয়ার দিন। মন খারাপ হলো খানিকটা। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল সে…
— “উনাকে ভেতরে পাঠাও চাচা।”
— “জ্বী আইচ্ছা।”
চলে গেলেন দারোয়ান চাচা। এদিকে কামরুল এক বিরাট বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতেও অবাক লাগছে তার দীঘি এ বাড়িতে থাকে। আবদ্ধ এত বড়লোক? প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো সে। তার জানা মতে আবদ্ধ একজন ভদ্র ছেলে। তারওপর তার মেয়েকেও ভালোবাসে। টাকা-পয়সাও অনেক। তার মেয়ে হয়তো অনেক সুখী এখানে। সাথে তার স্ত্রীও! এরমধ্যে দারোয়ান চাচা এসে পড়লেন। বললেন…
— “আপনেরে ভিতরে যাইতে কোইছে।”
সৌজন্যতার খাতিরে কামরুল হাসলো মাত্র। বাড়ির ভেতরে ঢুকছে আর চারপাশে তাকাচ্ছে সে। তার মতে বাড়িটা একটা রাজপ্রসাদ! সুন্দর লাগে তার এমন বাড়ি। ইচ্ছে ছিলো কামরুলের এমন একটা বাড়ি তৈরি করার। কিন্তু কিভাবে? তার যে তেমন সামর্থ্য নেই। আফসোস করল সে৷ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। এতদিন পর নিজের স্ত্রী আর দীঘির এমন হাসজ্জ্বল মুহুর্ত দেখে চোখ ভরে আসলো তার। শারমিন কামরুলের কাছে ছুটে গেলেন ততক্ষনাত। দীঘি যেতে চাইলে আবদ্ধ তার হাত ধরে ফেলে শক্ত করে। যার অর্থ- “যেতে দিবে না আবদ্ধ” সে এখন গম্ভীর মুখ করে আছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম আমি। শান্ত সরে বললাম..
— “দীঘিকে যেতে দেয় আবদ্ধ।”
— “না।”

— “যেমনই হোক দীঘির বাবা সে। মেয়েটার মনটা আর ছোট করিস না। যেতে দেয় ওকে।”
করুন চোখে আমার দিকে তাকালো আবদ্ধ। দীঘির হাত ছেঁড়ে দিলো সে। ছাঁড়া পেয়ে দীঘি ছুটে গেল কামরুলের কাছে৷ ব্যক্তিগত ভাবে নিজের বাবাকে সে পছন্দ না করলেও এখন কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে তার কামিরুলকে একটু জড়িয়ে ধরতে। কতদিন পর তাকে দেখলো সে! কান্না পাচ্ছে তার। প্রচুর কান্না!
এদিকে আবদ্ধ রেগে যাচ্ছে তীব্র থেকে তীব্র ভাবে। কেন রাগছে তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। তবে কামরুলকে তার মোটেও পছন্দ নয়। এই লোকটাই তার দীঘির গায়ে খুব নিকৃষ্টভাবে মেরেছে। আজও দীঘির পিঠে সেই কালচে দাগ আছে। অসংখ্য দাগ আছে শরীরে। এগুলো কি আদও দীঘির শরীর থেকে মিটে যাবে? নাকি আজীবন থেকে যাবে? এসব কিছুর পর কিভাবে মেনে নিবে সে কামরুলকে? ভেবে পায় না আবদ্ধ।
______________
দীঘি, শারমিন আর কামরুল। পরিবারের তিনটি সদস্য কাঁদছে আজ। একজন তার কান্নার কারণ জানে না, একজন এতদিন পর তার স্বামীকে পেয়ে খুশিতে কাঁদছে আর একজন নিজের ভুল বুঝতে পেরে কাঁদছে৷ হঠাৎ শারমিনের পায়ের কাছে বসে পড়ল কামরুল। পা ধরতে নিলে দু’কদম পিছিয়ে যায় শারমিন। কামরুল দমে না। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে…
— “মাফ করে দে আমারে শারমিন।মাফ কর আমারে দীঘি। আমি তোদের অপরাধী। ভুল করছি আমি। মাফ করে দেয়।”
ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো আবদ্ধ। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কামরুলকে পর্যবেক্ষন করতে লাগলো সে। “তাহলে কি কামরুল নিজের ভুলে বুঝতে পেরেছে?” প্রশ্নটা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। উঠে দাঁড়ালো আবদ্ধ। কামরুলের কাছে গিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে কঠিন কণ্ঠে বলল…
— “আপনি কি সত্যি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন? নাকি নাটক করছেন?”
— “না বাবা সত্যি আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। আমারে মাফ কইরা দাও তোমরা।”
রহস্যময় হাসি হাসলো আবদ্ধ। বলল…
— “ভালো। এখন আসুন আমাদের সাথে নাস্তা করবেন।”
প্রশান্তির আভা আরও একবার ছুঁয়ে দিলো কামরুলকে। আবদ্ধকে জড়িয়ে ধরল সে!
৩৫.
মাঠে বসে আছে দিহান৷ হাতে বই তার। তবে মন অন্যদিকে। মিরুকে দেখতে ইচ্ছে করছে তার। খুব করে ইচ্ছে করছে। তবে আদও কি দেখা পাবে সে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিহান। হঠাৎ কোত্থেকে জেনি সে “ধপ” করে বসে পড়ল তার পাশে। সেদিকে একবার তাকালো দিহান। মেয়েটা অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো অশ্লীল জামা পড়ে না, ন্যাকামি করে না, শালীন ভাবে চলে। যা আজকাল দিহানের ভালো লাগছে প্রবল ভাবে। জেনি পাশে থাকলে কষ্ট-টা একটু কম হয় তার। নিজের ভাবনার থেকে বেরিয়ে এলো দিহান। কি ভাবছে সে? এগুলো তো তার ভাবার কথা নয়! বইয়ের পাতায় মন দিলো সে। জেনি হেসে বলল…
— “কি পড়ছেন?”
— “গল্প!”
— “কার লিখা?”

— “হুমায়ুন আহমেদ।”
— “ও! এক সময় আমিও ওনার গল্প পড়তাম।”
ভ্রুঁঁ কুঁচকালো দিহান। সন্দেহের সাথে জেনির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারলো সে…
— “তুমি উনার বই পড়তে?”
দিহানের তাকানোর ধরণ ভালো লাগলো না জেনির। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল…
— “হ্যাঁ। কেন বলুন তো?”
— “না কিছু না। তা কোন বই পড়েছ উনার?”
— “কুটু মিয়া।”
আড়চোখে জেনির দিকে তাকালো দিহান৷ কিছু বলল না আর। জেনিও চুপ হয়ে রইল। খানিকবাদ দিহানের হাত টেনে দাঁড় করালো সে। সময় না নিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো সে। মুখ বলল- “লেকে যাবো চলুন।”
আচমকা এমন হওয়ায় দিহান ভয় পেল খানিকটা। ইচ্ছে করছে জেনিকে কয়েকটা বকা
শুনিয়ে দিতে। তবে তা করল না সে। বাধ্য ছেলের মতো হাঁটতে লাগলো জেনির সাথে। পর্যবেক্ষন করতে লাগলো জেনির হাসি মাখা মুখশ্রী!
.
.
.
#চলবে…