সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 33

৩৬.
দুপুরে একেবারে খাবার খেয়েই কামরুল আর শারমিন রওনা হয় নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে। অনেকদিন তো হলো নিজের স্ত্রী আবদ্ধের বাসায় থাকছে। তাছাড়া কামরুল নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চায়। নিজের কাপড়ের ব্যবসা আরও মনোযোগ দিয়ে চালাবে, সংসারটাকে নতুন ভাবে নতুন রুপে সাজাবে। বৌটাকে ভালোবাসবে। মারবে না একদম! নিজের ভুল যে খুব গভীর থেকে গভীর ভাবে বুঝতে পেরেছে সে। মারাত্তক অপরাধ বোধে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রতিজ্ঞা বদ্ধ সে। সবকিছু সুন্দর ভাবে ঠিক করার প্রতিজ্ঞা!
________________
এদিকে আবদ্ধ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কামরুলের যাওয়ার দিকে। এ লোককে কেন যে এখনও পছন্দ নয় তার, সে উত্তরটা বেশ ভাবে জানতে চায় আবদ্ধ। কামরুলকে মেনে নিলেও কোথায় যেন একটা ফাঁকা জায়গা রয়েই যায়। ঘৃণা হয় প্রবল ভাবে! তবুও সে চেষ্টা করছে। ভীষণ ভাবে চেষ্টা করছে! যেন কামরুলকে নিজের বাবার আসনে বসাতে পারে সে। অনতত শ্বশুড় হিসেবে হলেও যেন শ্রদ্ধাটুকু মন থেকে আসুক তার। তবে সে ব্যর্থ। মারাত্তক ভাবে ব্যর্থ! দেখতে দেখতে কামরুল গেট পেরিয়ে চলে যায়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবদ্ধ। চেয়ে রয় আকাশের দিকে। দৃষ্টি শূণ্য তার! আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ এসে ভীড় করে। অনেক কাজ বাকি তার। অফিসে যাওয়া হয় না আজ এক সপ্তাহ। যাওয়া দরকার একবার। তাছাড়া ভার্সিটিতেও অনেক দিন যাওয়া হয় না। তারওপর দীঘিকে ১০ম শ্রেণীতে ভর্তি করানোর এখনও চান্স আছে।ভর্তি করাতে হবে! ভাবতেই বিরক্ত হলো আবদ্ধ। বিয়ে করেছে আজ ক’দিন? তিন কি চারদিন হবে। এর মধ্যে এত এত কাজ মাথায় চেপে বসেছে। এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করা আসলেই উচিত হয় নি। কিন্তু সে আর কি করত? এখন বিয়ে না করলে হয়তো এ ইহো কালে আর বিয়ে করা হতো না তার। চেয়েছিলো তো আরও আগে বিয়ে করতে। কিন্তু রেয়ানের কড়া নিষেধ। তার উক্তি এরুপ ছিল- “মাত্র তো দীঘির অপরেসন হয়েছে আবদ্ধ। এখনই বিয়ে কেন? ওকে সুস্থ হতে দাও। অনতত চার মাস পর বিয়ের কথা ভাবলে ভাববে কিন্তু এখন আপাতত এগুলোর চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফেলো।”
আবদ্ধ তাই-ই করল। দীঘির অপরেসনের চার মাস পড়েই দীঘিকে বিয়ে করেছে সে। এর আগে একটা “টু” শব্দও করে নি।

৩৭.
দুপুরের দিকে আমি, দীঘি আর মামী জমবেশ আড্ডা দিলাম। তারপর চলে এলাম রুমে। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর! ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমানোর আগে ফোনটা একবার হাতে নিলাম আমি। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত এক’ফোটাও কথা হয় নি রেয়ানের সাথে আমার। ফোন দিলে ধরছেন না উনি। তবে মেসেজ দিয়েছেন রেয়ান। হাসপাতালের কাজে অনেক ব্যস্ত উনি। কথা বলতে পারবেন না। এতে অভিমানের পাল্লা ভাড়ী হয়ে যায় আমার। আমিও আগ বাড়িয়ে ফোন করিনি তাকে। হয়তো আমার অভিমান বুঝতে পেরেছেন রেয়ান। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটা মেসেজ দিয়েছেন উনি। যেমন-
“হাসপাতালে অনেক কাজ বুঝলে মরুভূমি। তবুও তুমি যেন আমার ব্যস্ততার মাঝেও বিরাজ করেছো। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করলেই চোখ বন্ধ করে ফেলি। সাথে সাথে ভেসে ওঠে তোমার হাসি মাখা মুখশ্রী!”
“রোগীর অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল মরুভূমি। ইমার্জেন্সি ওটিতে নিতে হবে।”
“ভদ্র লোককে ওটিতে নেওয়া হয়েছে মরুভূমি। আমরা ডাক্তাররা একটু পরই যাবো সেখানে।”
“আমি ওটিতে যাচ্ছি মরুভূমি”
ব্যস এতটুকুই মেসেজ দিয়েছেন উনি। তবে আমি একটা মেসেজেরও রিপ্লাই দেই নি। মোটেও দেই নি! আর দিবোই বা কেন? রেয়ান আমাকে মেসেজ করার সময় পেয়েছেন অথচ একটু সময়ের জন্য ফোনে কথা বলতে চাচ্ছেন না উনি। তার কণ্ঠ সর যে খুব করে শুনতে ইচ্ছে করছে আমার। সেটা কি উনি বুঝেন না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন?

৩৮.
জেনি দিহানকে লেকে যাওয়ার নাম করে পুরো শহর ঘুরিয়েছে। একবার এ জায়গায় নিয়ে গেছে তো একবার ওই জায়গায়। এতে দিহান প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে ভালো লাগতে শুরু করে তার। জেনির চঞ্চলতা কেন যেন ভালো লাগছে তার। পাশাপাশি একটা দ্বিধাও কাজ করছে। পরক্ষনেই ইচ্ছে করছে জেনির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তবে তা কি সে করবে? মোটেও না।
জোড় করে দিহানকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় জেনি। সবশেষে দিহানকে নিয়ে যায় সেই চিরচেনা লেকে। লেকের আশপাশটা অনেক প্রাকৃতিক। প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিতেই দিহানের মন ভরে যায় একরাশ মুগ্ধতায়! এদিকে জেনি প্রস্তুত হচ্ছে দিহানকে নিজের মনের কথা বলতে। লম্বা শ্বাস টেনে দিহানের সামনাসামনি দাঁড়ালো সে। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলল…
— “আমি আপনাকে ভালোবাসি দিহান।”
দিহানের স্বাভাবিক চোখ মুহুর্তেই তীক্ষ্ম হয়ে গেল। কপালও কুঁচকে গেল তার। জেনির পা থেকে মাথা অব্ধি দেখলো একবার। এতে যেন জেনির কাঁপাকাপি আরও বেড়ে গেল। কোনোমতে বলল…
— “আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি দিহান।”
জেনির কথায় হো হো করে হেসে দিলো দিহান। ক্ষাণিকবাদ থামলো সে। মুখে বাঁকা হাসি রেখে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল…
— “রেয়ানের পর আমি কত নাম্বার জেনি?”
— “মানে?”
— “এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ভালোবেসে ফেললে আমায় জেনি? এটা তোমার নতুন নাটক নয়তো?”
এহেন কথায় জেনি স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় বেরিয়ে এলো জল! ঠিক এই ভয় টাই পাচ্ছিলো সে। ভেবেছিলো নিজের মনের কথা বলার পর হয়তো দিহান তাকে অপমান করবে। যেমনটা রেয়ান করেছিল। আশ্চর্য ভাবে সেটাই হলো। জেনি নিজেকে শক্ত করল। বাম হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানিগুলো মুছে কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠল…
— “এত তাড়াতাড়ি নয় দিহান। আমি আপনাকে ৪মাস থেকে পছন্দ করতাম। কখন যে এটা ভালোবাসাতে পরিণত হলো…আপনার মনে আছে প্রথম বার লেকে আসার ঘটনা। তার আরও আগে থেকে আপনাকে আমি পছন্দ করতাম। লেকে আসার পর থেকে সেটা আরও তীব্র হয়। আমি জানি আমাদের তেমন ভাবে দেখা হয় নি এ কয়দিনে। তবে আপনার সাথে দেখা হওয়ার এক একটা মুহুর্ত আমার জন্য হাজার হাজারটা বছর। আমার প্রতিটা রাতের সঙ্গি আপনি। আমার প্রতিটা স্বপ্নের সঙ্গি। বিশ্বাস করুন আমি কোন নাটক করছি না। সত্যিই ভালোবাসি আপনাকে।”
দিহান জেনির চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ চোখ যে মিথ্যা বলছে না। তবে এটা মানতে দিহান নারাজ। দু’টানায় পরে যাচ্ছে সে। কি করা উচিত তা বোধগম্য নয় দিহানের। তার মনে হলো এখন এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়! তাই-ই করল দিহান। জেনির পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। এদিকে জেনি দাঁড়িয়ে আছে আগের নেয়। বুক চিঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে বারংবার। তবে কি দিহান তার কখনই হবে না? কিন্তু সে যে দিহানকে ছাঁড়া বাঁচতে পারবে না। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো জেনি। যে করেই হোক নিজের ভালোবাসা আদায় করবে সে। দিহানকে ভালোবাসতে বাধ্য করবে!

৩৯.
দুপুরে ঘুমানোর পর একেবারে রাতে ঘুম থেকে উঠেছি আমি। তাও মামীর ডাকে! বুঝতে পারছি না ইদানিং এত ঘুমকাতুরে হয়ে গেছি কেন আমি? ইচ্ছে করে সারাদিন ঘুমিয়েই থাকতে। ঘুমের কারনে সবকিছু ঘোলাঘোলা লাগছে আমার। কোনোমতে মুখে পানি দিয়ে চলে গেলাম নিচে খেতে।
খাওয়া শেষে রুমে আসতেই আমি অবাক। আমার স্পষ্ট মনে আছে নিচে যাওয়ার সময় আমার রুমের লাইট অন ছিল অথচ এখন অফ! হঠাৎ ভয় লাগতে শুরু করল আমার। আল্লাহর নাম নিয়ে লাইট-টা জ্বালিয়ে দিলাম আমি। সাথে সাথে আরেক দফা অবাক হলাম। রেয়ান হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। কিভাবে আসলেন উনি? বারান্দা দিয়ে? আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে৷ সে এক হাত কপালে রেখে চোখ বন্ধ করে আছেন। ঘুমিয়ে নয়তো? আমার ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে রেয়ান হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন..
— “কিস মি…ক্লোজ ইউর আইস এন্ড মিস মি!”
.
.
চলবে…