সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 30

.
কালকে জেল থেকে রেহাই দেওয়া হবে কামরুলকে। সংবাদটা শোনা মাত্রই এক খুশির ঝলক দেখা গিয়েছিলো তার মধ্যে। তবে তা বেশিক্ষন স্থায়ী ছিল না। মনে তার এক সুক্ষ্ম বেদনা। অনুতপ্ত সে। গভীর ভাবে অনুতপ্ত! নিজের বউ আর সন্তানের সাথে কতটা নির্দয় ছিল সে, এতদিনে বুঝতে পেরেছে কামরুল। তার বউ তাকে কতই না আদর-সোহাগ করে খাবার খাওয়াতো। ভালো ভালো রান্না করত। তার মেয়েটা কত সুন্দর করেই না তাকে “আব্বা” বলে ডাকতো। তারা কতই না ভালবেসেছে তাকে। আর সে? দিনদিন তা তুচ্ছ মনে করেছে। আসলে সেসব তুচ্ছ ছিল না, ছিল একরাশ ভালোবাসা আর সুখ। যা এখন প্রতিক্ষনে টের পাচ্ছে কামরুল। মনে মনে সিধান্ত নিলো সে, জেল থেকে বের হয়েই তার প্রথম কাজ হবে নিজের বউ-সন্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়া।
৩০.
লেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেনি। বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। চোখে তার জল আর মনে এক যন্ত্রণা। দৃষ্টি শূণ্য! হঠাৎ পাশ থেকে চেনা এক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে উঠে…
— “মন খারাপ?”
পাশ ফিরে তাকালো জেনি। দিহান দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার মতোই কষ্টে ভুগছে সে। দিহানকে এখানে দেখে অনেকটা অবাক হয় জেনি। তবে তা প্রকাশ করে না। যেভাবে পাশ ফিরে তাকিয়ে ছিল সেভাবেই আবার সামনে তাকালো জেনি। এবার দিহানের অবাক হওয়ার পালা। তার মস্তিষ্ক একটা কথাই জানতে চাচ্ছে- “চঞ্চল মেয়েটা এত শান্ত কেন আজ?” দিহান পাশে এসে দাঁড়ালো জেনির। লম্বা শ্বাস টেনে বলল…
— “রোদের আলোয় লেকের পানি চিকচিক করছে। সুন্দর লাগছে দেখতে তাই না?”
— “আপনি হঠাৎ এখানে যে?”
— “তুমিই তো এ জায়গা চিনিয়ে দিয়েছো আমায়। মন খারাপ হলেই এখানে আসি।”
থামলো দিহান। আবারও বলল…

— “মন খারাপ?”
— “হ্যাঁ! ”
— “কেন?”
— “এমনি। আমার মন খারাপের কারন লাগে না।”
ঠোঁট কামড়ে হাসলো দিহান। যে মেয়ের মিথ্যা বলা ছাড়া এক মুহুর্তও চলে না সে মেয়ে কিভাবে এত অগোছালো ভাবে মিথ্যা বলছে? যে কেউ বুঝতে পারবে মেয়েটা সত্য বলতে চেয়েও মিথ্যা বলার প্রচেষ্টায় আছে। জেনির দিকে তাকালো দিহান। ওইদিনের মতো আজও মেয়েটা অনেক চুপ-চাপ। কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে তার। মন থেকে এক সুক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। হয়তো দু’জন এক পথের পথিক বলে!
চোখ সরিয়ে লেকের দিকে তাকালো দিহান। শান্ত সরে বলল…
— “নিজের কষ্টের কথা অন্যজনকে বললে কষ্ট কমে।”
দিহান কি ইঙ্গিত করছে তা বুঝতে পেরেছে জেনি। তার কি হলো কে জানে, দিহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। কেঁদে দিলো “হু” “হু” করে। দিহান সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তি লাগছে তার। প্রবল আকারের অস্বস্তি! তার মিরু ছাড়া কখনই সে কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসে নি। অতিরিক্ত উত্তেজনায় একবার হাত ধরেছিল আর রেয়ানের সামনে জড়িয়ে ধরে ছিল মাত্র। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল সে। এক হাত দিয়ে জেনির চুলে হাত বোলাতে লাগলো। এতে জেনি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দিহানকে। যেন দিহানই তার এক মাত্র ভরসা। এদিকে নিজের অজান্তেই বুক থেকে কয়েকটা দীর্ঘ বেড়িয়ে আসে দিহানের। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে চলেছে তার জীবনে। যা সে চায় না!
৩১.
শহরে তেমন আত্মীয়-স্বজন নেই আমাদের। সবাই গ্রামেই থাকেন। গ্রাম থেকে শহরে আসতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগে। আজ দীঘির বৌভাত৷ যার জন্য তারা আসবেন আমাদের বাসায়। প্রায় বিকালের দিকে! তাদের আসার কথা শুনে একগুচ্ছ ভয়াবহ কাজ আমার ওপর চেপে বসে। সকাল থেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত আমি। এদিকে রেয়ান সেই সকাল থেকে বায়না করছেন আমাকে রেডি হতে। নিজের বাবার সাথে দেখা করাতে চান উনি। এমনি বাসায় এত কাজ তারওপর রেয়ানের এমন সব বায়না! তাছাড়া উনি যেই সেই জায়গায় নিয়ে যাবেন না আমাকে, নিজের বাবার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবেন। এক ধরণের ভয় থেকে তার সাথে যেতে চাইছি না আমি। কিন্তু রেয়ান তো রেয়ানই! নাছোড়বান্দার মতো লেগে আছেন উনি। অবশেষে একরাশ অভিমান নিয়ে সোফায় মুখ কালো করে বসে রইলেন। সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। কেমন বাচ্চা বাচ্চা দেখাচ্ছে তাকে। যেন পাঁচ বছরের ছেলে চকলেট খাওয়ার জন্য বায়না করছে। আর তা না দেওয়ায় সে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। হাসলাম আমি। রেয়ান আড়চোখে দেখলেন সেটা। মুহুর্তেই নিজের মুখশ্রী আরও গম্ভীর করে ফেললেন। এবার খারাপ লাগছে আমার। মানুষটা আমার জন্য কত কিছুই না করেছে। আর আমি, আমি সামান্য ভয় সংশয় করে তার বাবার সাথে দেখা করতে যেতে পারছি না? এমন কেন আমি? এতটা স্বার্থপর না হলেও তো হতো।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হাসি হাসি মুখ করে রেয়ানের পাশে বসলাম। উনি অভিমানের পাল্লা ভাড়ি করে পাশ ফিরে বসে পড়লেন। হাসলাম মাত্র। শান্ত সরে বললাম…
— “এদিকে ফিরুন। আপনার অভিমান মাখা মুখ দেখব।”
ফিরলেন না রেয়ান। আমি আবারও বললাম…
— “আমি যাবো রেয়ান। এখন এদিকে ফিরুন।”
চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রেয়ানের। আমার দিকে ফিরে বলে উঠলেন…
— ” আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি। ওয়েট!”
বলেই উনি হাওয়ার গতিতে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। কিছুক্ষন পর ঠিক একই ভাবে এসে আমার পাশে বসে পড়লেন। হাতে থাকা প্যাকেট আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন…

— “এখানে লাল শাড়ি আছে, পড়বে! চুল খোবা করে মাথায় ঘোমটা দিবে। বেশি সাজবে না। কেমন?”
মাথা উপর-নিচ নাড়ালাম আমি। রেয়ান প্রশান্তির এক নিশ্বাস ফেললেন। পরক্ষনেই ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন…
— “এখন যাও। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসো। সময় নেই আমাদের।”
— “কিন্তু প্রমিস করুন বিকালের আগে বাসায় নিয়ে আসবেন।”
— “প্রমিস। এখন যাও। রুমে যাও।”
একপলক তার দিকে তাকালাম আমি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম রুমের দিকে।
____________
রেয়ানের বাবা রাহুল আহমেদের সামনে বসে আছি আমি আর রেয়ান। রাহুল আহমেদের পাশেই বসে আছেন রেয়ানের মা নীলা রাহমান। নীলা রাহমান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও রাহুল আহমেদ আমার দিকে খুবই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এতে যেন ভয়টা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রেয়ান বিরক্তি মাখা চেহারা নিয়ে বসে আছেন। যেন না চাইতেও বাধ্য হয়ে কিছু করছেন উনি। ঠিক হয়ে বসলেন রাহুল আহমেদ। নিজের স্ত্রী নীলা রাহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
— “তোমার ছেলেকে বলে দাও, এসব করে সে কি বোঝাতে চাচ্ছে আমাকে? ডাক্তার হয়েছে নিজ ইচ্ছায়। আমি কিছু বলিনি। তাই বলে এখন বিয়েও নিজের মতামতে করবে? আমার কি কোনো গুরুত্ব নেই? সে জানে না তার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
রেয়ানও বলে উঠলেন…
— “মা তোমার প্রাণ প্রিয় স্বামীকে জিজ্ঞেস করো ডক্টর হওয়ায় কে আমাকে বাড়ি থেকে বের করেছে?”
চটে গেলেন রাহুল আহমেদ। বললেন…
— “নীলা ওকে বলো আমি কি ইচ্ছে করে বলেছিলাম সেটা? রাগের মাথায় বলেছিলাম। তাই বলে কি তাকে সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে?”
দমে গেলেন রেয়ান। তবে পুরোপুরি না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠলেন…
— “মা তোমরা বিয়েতে রাজি কি রাজি না সেটার উত্তর চেয়েছি আমি। যদি উত্তর “না” হয় তাহলে আগেই বলে দাও আমি ওকে নিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলব।”
রেয়ানের কথায় যেন আরও রেগে গেলেন রাহুল আহমেদ। নীলা রাহমানকে রাগী কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “দেখেছো তোমার ছেলে কতটা বেয়াদব হয়ে গেছে? কিভাবে যে এ মেয়ে এমন বেহায়া,অভদ্র ছেলের প্রেমে পড়ল আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
কথাটা শুনে রেয়ান খানিকটা বিরক্ত হলেন। আমি আর নীলা আহমেদ নিরব দর্শকের মতো তাদের কান্ড দেখে যাচ্ছি। রাহুল আহমেদ আমার দিকে আবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন। কণ্ঠে দৃঢ় ভাব এনে বললেন…
— “তোমাকে এই বেহায়া ছেলেটা কি নামে ডাকে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে হঁচকচিয়ে গেলাম। তবুও স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম নিজেকে। স্লান হেসে বললাম…
— “জ্বী মরুভূমি!”
নাকমুখ ছিটকে উঠলেন রাহুল আহমেদ। নীলা আহমেদকে বলে উঠলেন…

— “তোমার ছেলে যেমন ক্ষেত, নামও রেখেছে ক্ষেত।”
থামলেন রাহুল আহমেদ। আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলেন…
— “তো শুনো মেয়ে আমি তোমাকে বউমা বলে ডাকবো। তোমাদের বিয়ের পরে যদি অন্য কোনো সুন্দর নাম পাই তাহলে সেটা পরবর্তিতে রাখবো। আর হ্যাঁ! যাওয়ার আগে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যেও। আমার কয়েকদিন পর একটা কাজে বাইরের দেশে যেতে হবে। সেখান থেকে এসেই তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো।”
উনার এমন কথায় উপস্থিত তিনজন চমকে উঠলাম। পরক্ষনেই হাসি ফুটে উঠল আমার আর রেয়ানের মুখে। তবে সে হাসি রেয়ানের মুখে স্থায়ী ছিল না। উনি এক প্রকার অস্থির হয়েই নীলা রাহমানকে বললেন…
— “তাহলে তো অনেক দেড়িতে বিয়ে হবে মা। আমি আরও তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই।”
রাহুল আহমেদ তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। বললেন…
— “বিয়েতে রাজি হয়েছি এটাই তোমার ছেলের সাত পুরুষের সৌভাগ্য নীলা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিয়েই করতে দিবো না বলে দাও তাকে।”
নীলা রাহমান করুন চোখে তাকালেন নিজের ছেলের দিকে। রেয়ান গম্ভীর হয়ে আছেন। রাহুল আহমেদ আবারও বলে উঠলেন…
— “আর আরেকটা কথা! তোমার ছেলেকে বলে দিও বিয়ের পরে বউমা আমাদের বাসায় থাকবে। আর তোমার ছেলে থাকবে তার সেই বস্তি ফ্ল্যাটে। আমার বাসায় জায়গা নেই তার।”
.
.
#চলবে…