সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 29

২৭.
বিয়ে শেষ হওয়ার পর পরই রাত ৩টা কি ৪টার দিকে তুমুল বৃষ্টি হয়। চারপাশে বিরাজ করে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। এমন ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে ঘুমানোর এক আলাদা মজা আছে। একবার ঘুমালে সহজে ঘুম ভাঙ্গা দায়। তারওপর রাতভর রেয়ানের সাথে ফোনে কথা বলেছি আমি। ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশিই দেড়ি হয়ে যায়। সকাল তখন ১১টা ১০ মিনিট। বিছানা থেকে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গলাম আমি। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে রেয়ানকে মেসেজ দিলাম- “শুভ সকাল!” এটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। দীঘির অপরেসন হয়েছে আজ ৪মাস। এই ৪মাসে অনেক কিছু ঘটে গেছে। রেয়ানের সাথের দূরত্বটা কমিয়ে ফেলেছি আমি। তার সাথে মিশতে শুরু করেছি আস্তে আস্তে। এখন আর হাড়ানোর ভয় কাজ করে না। অনুভূতির পাতা হৃদয়ে এক আলাদা শিহরণ জাগিয়ে দেয়। যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। অনতত আমার পক্ষে না! আর এ অনুভূতি আরও প্রবল আকার ধারণ করে তন্ময়ের সুস্থতা থেকে। সে সুস্থ হওয়ার পরপরই মনে হয় এসব হাড়ানোর ভয় নিত্যান্তই একটা বোকামো। বিধাতা চাইলে কেউ আটকাতে পারবে না একজোড়া আত্তাকে। তাদের মিলন ঘটবেই। তারা যে একে অপরের জন্য তৈরি। ব্যস! ওইদিন থেকেই সারারাত ভরে কথা বলা, ঘুম থেকে উঠে একে অপরকে “শুভ সকাল” জানানো, হুটহাট দেখা করা যেন আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রেয়ানের পাগলামো গুলোও প্রকট আকার ধারণ করেছে। কখনও তো রাত ২টা-৩টার দিকে ফোন দিয়ে বলে উঠেন- “ক্ষুধা লেগেছে মরুভূমি। কিছু নিয়ে আসো তো নিচে। আমি অপেক্ষা করছি।” তখন যেন আমার মাথায় আকাশ পরার মতো অবস্থা। না চাইতেও ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘর থেকে কিছু না কিছু নিয়ে যেতাম। নিচে গিয়ে দেখতাম উনি পকেটে হাত রেখে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। একটা পায়ের ওপর অন্য পা রেখে! সাদা সার্ট, প্রথম তিনটে বোতাম খোলা, লাল টাই ঝুলানো, হাতা কনুই পর্যন্ত বটা, এলোমেলো চুল। সবমিলিয়ে তার ক্লান্তি মাখা সৌন্দর্য!
আর আমি! কোনো ভাবে গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে ঘুমু ঘুমু ভাব নিয়ে যেতাম তার সামনে। সে হাসতো। গাড়ির সামনে পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিতো আমায়। নিজেও বসে পড়তো পাশে। মুখে “হা” করে অস্পষ্ট ভাবে বলে উঠতেন…
— “খাইয়ে দাও। ক্ষুধায় ইঁদুরগুলো লুজ্ঞিডান্স করছে। কুইক।”
আমার আর কি? বাধ্য মেয়ের মতো খাইয়ে দিতাম তাকে। আর সে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন!

.
হাসলাম আমি। ভাবতেও অবাক লাগছে তার মায়ায় জড়িয়ে গেছি আমি। খুব বাজে ভাবে জড়িয়ে গেছি!
২৮.
দীঘির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আবদ্ধ। এসবে দীঘি বেজায় বিরক্ত। সেই সকাল ৮টার দিকে তার কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল আবদ্ধ। এখন ক’টা বাজে? ১১টা! একই ভাবে বসে থাকতে যতটা বিরক্তি লাগছে দীঘির তারচেয়েও বেশি বিরক্ত লাগছে আবদ্ধের কান্ডগুলো। মোটেও সে ঘুমায় নি বরং দীঘিকে নানাভাবে কাতুকুতু দিচ্ছে। দীঘির আবার এ জিনিটা অনেক বেশি। হাত ছাড়া শরীরের সব জায়গায় দীঘির কাতুকুতু। যার ফায়দা এখন আবদ্ধ নিচ্ছে। একবার মাথা এপাশ-ওপাশ করছে তো একবার হাত দিয়ে দীঘির পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে। খুব হাসি পাচ্ছে দীঘির। কিন্তু কোন জিনিসই অতিরিক্ত ভালো নয়। এখন তার কাতুকুতু মোটেও লাগছে না। বিরক্তির শেষ প্রান্তে সে। বিরক্তি নিয়ে এবার বলেই ফেলল…
— “সমস্যা কি আপনার হ্যাঁ? কাতুকুতু কেন দিচ্ছেন।”
আবদ্ধ পাল্টা রেগে বলল…
— “তোর সমস্যা কি? আমি আমার বউকে দিচ্ছি।”
— “আপনার বউটাকে শুনি?”
— “তুই।”
— “তাহলে আমার সমস্যা হবে না তো কার সমস্যা হবে?”
— “পেত্নির। তাল গাছের পেত্নির।”
মুখ ভেঙ্গচালো দীঘি। আবদ্ধ আবার বলল…
— “কালকে বিয়েতে তোকে যে পেত্নি লাগছিল না পিচ্ছি,পুরাই কালা চান্দ।”
দীঘি চটে গেল। বলল…
— “কি বললেন আপনি? আমি কালা চান্দ? সরুন, সরুন আমার কোল থেকে। আমি আর থাকবো না আপনার কাছে।”
— “কোই যাবি শুনি? আমি ছাড়া তোর গতি নেই। আর না আমার আছে তুই ছাড়া। সো কোথাও যেতে পারবি না তুই।”
— “বললেই হলো? সরুন আমি মামনির কাছে যাবো।”
আবদ্ধ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। দীঘিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দীঘির গলায় মুখ রেখে বলল…
— “তা তো আর হচ্ছে না পেত্নি। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে আমাদের। কিভাবে এত তাড়াতাড়ি ছেঁড়ে দি?
এখন সত্যি সত্যি ঘুমাবো আমি। তোকে জড়িয়ে ধরে। সো নো নড়াচড়া। নাহলে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবো তোকে।”
দীঘিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবদ্ধ। দীঘি হাসলো মাত্র। আবদ্ধের পাগলামো গুলো এখন তার অনেক ভালো লাগে।

২৯.
সকাল হতে রাত পেরিয়ে গেছে। টেন্সনে আমার সারাশরীর অসার হয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত রেয়ানের কোনো খবরাখবর নেই আমার কাছে। না কোনো মেসেজ দিয়েছেন উনি না কল। এমনি তো দিনে ৫-৬বার ফোন করেন আমায়। তবে আজ একটি বারও না। আমার ফোনও ধরছেন না। ফোন বন্ধ তার! বুকে এক সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব হচ্ছে আমার। রেয়ানকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। তার কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে! ফোন হাতে নিলাম আমি। আরেকবার ফোন করব তাকে। তবে তা আর হওয়ার? ফোন দিতেই অপাশ থেকে একটা মহিলার কণ্ঠ ভেসে উঠল- “দুঃখীত আপনার কাক্ষিত নম্বরটি এ মুহুর্তে বন্ধ আছে।” কথাটা শোনার সাথে সাথে মেজাজ চটে গেল আমার। এখনের জন্য মহিলাটির কণ্ঠটা সবচেয়ে বাজে আমার কাছে। এমন সময় মামী এলেন আমার রুমে। বললেন…
— “মিরা রাত হয়ে গেছে তো। খাবি না? নিচে আয় তাড়াতাড়ি সবাই অপেক্ষা করছে তো।”
— “আসছি মা!”
মামী চলে গেলেন নিচে। তার পিছু পিছু আমিও গেলাম। চেয়ারে বসতেই কোত্থেকে রেয়ান এসে হাত টেনে ধরলেন আমার। কিছু না বলেই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে নিয়ে যাচ্ছেন উনি। তার এহেন কান্ডে আমিসহ উপস্থিত সবাই অবাক। রেয়ান কখনই এমন করেন না। প্রথমে সবার সাথে কুশল বিনিময় করেন। তারপর নাহয় আমার সাথে যা বলার বলেন। মামীও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তবে কিছু বলছেন না। মামীর এক অন্ধবিশ্বাস আছে তার ওপর। যা থেকে রেয়ান যা-ই করুক না কেন মামীর কাছে মনে হয় এর নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট কারন আছে। নাহলে রেয়ান এমন করবেন কেন?
_____________
ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছেন রেয়ান। আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে আছেন উনি। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার জবাব শূণ্য! আচমকা জড়িয়ে ধরলেন আমায়। করুন কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “আমাকে বিয়ে করবে মরুভূমি? কালকে বাবার সাথে দেখা করাবো তোমায়।”
আজকে যেন অবাক হওয়ার দিন আমার। অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি। কোনোমতে তাকে বললাম…
— “কিছু কি হয়েছে রেয়ান? হঠাৎ এমন কথা কেন?”
আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন রেয়ান। এবার কিছুটা কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “জেনির বাবা আমার বাবাকে বলেছে- জেনি আমাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা জেনির বাবার বেগগ্রাউন্ড দেখে হ্যাঁ করে দিয়েছে। বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে জেনির বাসায়। এক মাস পর বিয়ে।”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এমনটাও কি হওয়ার কথা ছিল? সব কিছু কেমন যেন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গলেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু এটা যে স্বপ্ন নয়। বাস্তবতা! রেয়ানের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে এলাম আমি। দৃঢ়ভাবে বললাম…
— “এখন আপনি কি চাচ্ছেন?”
— “আমি আমার উত্তর জানিয়ে দিয়েছি মরুভূমি। কালকে তোমাকে বাবার সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাবো। বাবা তোমাকে পছন্দ করলে করল না করলে…কাল-পরশু আমি কাজী অফিসে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করে ফেলব।”
— “মানে?”
— “আরেকবার বলল? ঠিক করে শুনো নি?”
রেয়ানের চোখ বরাবর তাকালাম আমি। অনেক কিছু বলছে ঐ চোখ দু’টি। তবে কি বলছে তা বোঝার ক্ষমতা এখনও হয় নি আমার। চোখ নামিয়ে ফেললাম। বললাম…
— “এটা সম্ভব না ডক্টর!”
— “তোমাকে জিজ্ঞেস করে নি আমি।”
আমার হাত দু’টো টেনে নিজের কাছে নিলেন রেয়ান। একের পর এক চুমু দিচ্ছেন হাতে। আর বলছেন- “ভালোবাসি প্রিয়তা!”
____________
আমাদের বাসা থেকে বের হয়েই রেয়ান রওনা হোন জেনির বাসার উদ্দেশ্যে। রাগ লাগছে তার। ভীষণ রাগ! মেয়েটাকে এত কিছু বলার পরও বেহায়ার মতো এমন কাজ কিভাবে করল? কিছু একটা করতে হবে এ মেয়ের। বেশি বাড়া বেড়ে গেছে সে।
.
সোফায় বসে টিভি দেখছে জেনি। এই মাত্রই তার মা-বাবা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছেন। ইন্ডিয়া যাবেন তারা। জেনি বুঝতে পারছে না মাত্র তিন দিন হলো তারা বাড়ি থেকে এসেছে আবার এখনই কেন ইন্ডিয়া যেতে হনে উনাদের? নিজের মেয়ের জন্য কি একটুও সময় নেই তাদের? দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেনি। হাতে থাকা চিপস খেতে লাগলো সে।
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলে রেয়ানকে দেখতেই জেনি অবাক হয়। দীর্ঘ ৪মাস পর রেয়ানকে দেখছে সে। আগে থেকেও সুন্দর হয়ে গেছে রেয়ান। প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে করছে জেনির। কিন্তু রেয়ানের কথায় দমে গেল সে।
— “কিভাবে পারো তুমি জেনি? এত অপমানের পরেও এমন নিচু কাজ করতে তোমার বিবেকে বাঁধে নি?”
জেনি অবাক হয়। সে কি করেছে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রেয়ানের দিকে তাকালো সে।বলল…
— “আমি কি করেছি রেয়ান?”
রাগ যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল রেয়ানের। নিজেকে আটকে রাখতে পারছেন না। রাগী কণ্ঠে বলে উঠেন…
— “চালাক সাজছিস আমার সামনে? কি করেছিস জানিস না? কোন সাহসে নিজের বাবাকে দিয়ে আমার বাবাকে বললি তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস। এতটা বেহায়া কেন তুই। ইচ্ছে করছে তোকে মাটিতে পুতে ফেলি।”
চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল জেনির। সে তো কিছু করে নি। যা করার তার বাবা করেছে। চোখ মুছলো জেনি। শান্ত সরে বলল…
— “আমি কিছু করি নি রেয়ান। আজ থেকে প্রায় ৫মাস আগে ড্যাডকে বলেছিলাম তোমাকে বিয়ে করতে চাই। ড্যাড কেন যে এখন এমনটা করল আমি জানি না। সত্যি জানি না।”

রক্তচক্ষু নিয়ে জেনির দিকে তাকিয়ে আছেন রেয়ান। রাগ কমছে না রেয়ানের। কিছুতেই না! জেনি যে সত্য বলছে তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মন মানছে না। খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে এ মেয়েকে রেয়ানের। অসহ্য লাগছে। রাগ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। নিজেকে শান্ত করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। তাও অনেকটা শান্ত সরেই বললেন…
— “কিভাবে বিশ্বাস করব তুমি সত্যি বলছ? শুনে রাখো জেনি এরপর যদি তুমি কোনো বাজে কাজ করো আই সোয়ের মেরে ফেলবো একদম। সাথে তোমার বাবা মার সম্মানও ছিনিয়ে নিবো। এন্ড আই থিংক তোমার বাবা-মার মানসম্মান শেষ হয়ে যাক এটা তুমি চাও।”
.
চলে গেলেন রেয়ান। জেনি দরজা লাগিয়ে সেখানেই বসে পড়ল। কষ্ট লাগছে তার। সে সত্যিই কিছু করে নি। রেয়ানের স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে মুছে ফেলেছে সে। নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছে। তবুও কেন সবাই তাকে এখনও খারাপ ভাবে? দরজার সাথে মাথা ঠেকালো জেনি। চোখ থেকে পানি পড়ছে তার। নিজেকে শান্ত করে চোখের পানি মুছল সে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল- “আর কখনও রেয়ানের সামনে যাবে না আমি। কখনওই না!”
.
.
.
#চলবে…