প্রেমে পড়া বারণ

প্রেমে পড়া বারণ ( সিজন-2 ) Part- 21

আমি চিৎকার করে কাঁদলাম।
অনেক কাঁদলাম। এ আমার মন ভাঙার গল্প। এ কষ্ট কেবল আমার। কান্নাটাও আমার, একান্ত নিজের।
এই কষ্ট, এই কান্না হয়তো কোনো দিন রেহানকে ছুঁতে পারবে না।
এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষন। রেহানের উপর ভীষণ অভিমান হলো। ভীষণ।
– তুই জিতে যা রেহান। আমিই হেরে গেলাম।
যত দুঃখ আসুক, কষ্ট আসুক একটা মানুষ সারাক্ষণ কাঁদতে পারে না।
একটা সময় কান্নাও থেমে যায়। অসহনীয় কষ্ট ও সহ্য করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন। কান্নাও থেমে যায়, কিন্তু ভেতরে??
চোখ বারবার মুছতে মুছতে আমার কান্নাও একটা সময় থেমে গেলো। কিন্তু ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
নিজেকে সামলে নিলাম।
রুমে ফিরে এসে বিছানায় লুটিয়ে পড়তেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখের পাতায়।
রাতে দিয়ার ডাকে ঘুম ভাঙলো।
– কি হয়েছে?
– তোকে খেতে ডাকছে।
– আমি খাবো না, তোরা খেয়ে নে।
দিয়া চলে যায়। কিছু সময় পরে আব্বু এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। আব্বুকে না করতে পারলাম।
ডাইনিং এ বসেছি ঠিকই কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছে না।
শুধু নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি।
– আপু,তুই তো কিছুই খাচ্ছিস না!
দিয়ার দিকে তাকাতেই আম্মুর উপর চোখ গেলো। আম্মু চোখের ইশারায় দিয়াকে কিছু বলতে নিষেধ করলেন।
দিয়া চুপ হয়ে গেছে।
রাতে সবাই যখন শুয়ে পড়লো তখন আম্মু আমার রুমে আসলেন।
– হিয়া?
– আম্মু..! এসো।
আম্মু আমার ঠিক পাশে বসলেন।
– কিছু বলবে?
– ঘুমাসনি?
– না আম্মু।অনেকক্ষন ঘুমিয়েছি তো এখন ঘুম আসছে না।
প্রচুর মাথা ব্যথা করছিলো। বাইরে যা গরম। মনে হয় ভেতরে গরম আটকে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো!
– হুম। ঠিক আছে। ঘুমাতে চেষ্টা কর।
– আচ্ছা।
আম্মু উঠতে গিয়েও উঠলো না। একটু সময় চুপচাপ বসে রইলেন।
– আমি ভাবতাম আমার মেয়ে যেকোনো পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে!
এই সব সুখ,দুঃখ, কষ্ট কোনোটাই মানুষের জীবনে স্থানী নয়। সুখের সময় অতি উচ্ছ্বাস, আর দুঃখের সময় অতি কাতর হয়ে পড়া একেবারেই মানসিক দুর্বলতার লক্ষ্মণ। আমি আমার মেয়েকে কখনো দুর্বল হৃদয়ের দেখতে চাইনি।
– আম্মু… তুমি এসব কেন বলছো?
– হিয়া… তুই আর বাচ্চা মেয়েটি নেই।
তুই নিজেও জানিস কেন কথাগুলো বললাম। আমি জানি না তোর কি হয়েছে। জানতেও চাইনা।
একটু দম নিয়ে বললেন – তোর এই বয়সটা আমিও পাড় করে এসেছি।
জীবনে সব অঙ্কের হিসাব কষতে নেই হিয়া।
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে কখনো তুলনা করতে নেই।
তুলনা করতে গেলেই মনের অসুখ হয়। এই অসুখ মানুষকে কখনো সুখী হতে দেয়না।
তাই প্রত্যাশা একপাশে রেখে যা প্রাপ্তি জীবনে সেটা নিয়েই ভালো থাকতে হয়।
– জীবন এতো অদ্ভুত কেন আম্মু??
– জীবন অদ্ভুত আর জটিল বলেই সুন্দর। একদম সরল রেখায় চললে জীবনের মানে খুঁজে পেতাম না। বড্ড একঘেয়ে লাগতো!
আর জীবনে টিকতে গেলে অনেক শক্ত হতে হয়।
একটা কথা বলছি তোকে, হয়তো দশ বছর পর কিংবা আরও পরে কখনো আমার এই কথাটা তোর মনে পড়বে।
– কি কথা আম্মু??
– আজকে যে যায়গায় দাঁড়িয়ে তুই যে কারণে কষ্ট পাচ্ছিস,দশ বছর পরে এই কথাটাই মনে পড়লে তোর হাসি পাবে।নিজের ছেলেমানুষী মনে করে আনমনে হাসবি।
তোর যায়গায় হয়তো তুই ঠিক,কিন্তু তখন এই ঠিকটাই ছেলে মানুষী মনে হবে।
তোর এখনো সংসার হয়নি। সংসার হলে এই কথাটা বলতাম না।
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলাম। আম্মু একহাতে আগলে ধরলেন আমাকে।
– নিজের মনের উপর সবাই কন্ট্রোল রাখতে পারে না হিয়া। যারা পারে তারা দৃঢ় মানসিকতার মানুষ। কখনো নিজের ইমোশন অন্যকে দেখাবি না।
তোর ছোট দুইটা ভাইবোন আছে। ওরা সেটাই শিখছে যেটা তুই করছিস।
তাই আর কখনো যেন তোকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় না দেখি।
– আচ্ছা আম্মু।
– নে এবার ঘুমা।
আম্মু চলে গেলেন। আমি আর কিছু বললাম না। মা বুঝি এমনই হয়। না জেনেও উনারা অনেক কিছু বুঝতে পারেন!
আম্মু ঘুমাতে বললেও আমার চোখে ঘুম নেই। তবে আগের মতো কান্না পাচ্ছে না এখন। আম্মুর কথাগুলো অনেক ভাবলাম।
এটা তো সত্যি – আমি প্রত্যাশা করেছিলাম রেহান অন্য কিছু বলুক।কিন্তু আমার প্রত্যাশা আর পাওয়া এক হয়নি বলে কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রেহানের কি দোষ?
ওর কাছে বন্ধুত্ব অনেক দামি,তেমনি কখনো এর বাইরে কিছু ভাবেনি বলে তাকে দোষারোপ করেতে পারি না।
হয়তো একদিন ওর মনেও আসতে পারে।
কিন্তু আমি কখনো রেহানকে বলতে যাবো না। আমার অনুভূতি গুলো আমার কাছেই থাকুক।
রেহানের সাথে যেমন বন্ধুত্ব ছিলো, তেমনই থাকবে। কোনো দিন ওর সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়াবো না। নিশ্চয়ই একদিন ও বুঝতে পারবে আর নিজেই আসবে আমার কাছে।
সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
দেখতে দেখতে মাসটা কেটে গেলো।
রেহান ওর চাকরিতে জয়েন করেছে। এর মধ্যে রেহানের ব্যস্ততায় খুব একটা কথা হয়নি আমার সঙ্গে। মাঝেমধ্যে কথা হয়।কিন্তু আগের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা অপ্রয়োজনীয় কথা হয় না!
সময় তো আর আগের মতো নেই।
এখনো রেহান আগের মতোই আমার সঙ্গে ঘুরবে আড্ডা দিবে, এসব ভাবা বোকামি ছাড়া কিছু না।
রেহানের চাকরির যখন তিন মাস চলে, তখন একদিন আমাকে ফোন দিয়ে বললো
– হিয়া, বাসায় আছিস?
– হে.. বাসায়ই। তুই কই?
– আজতো ছুটির দিন। বাসায় আছি।শোন আমি আসছি এখন তোর বাসায়।
– তো?
– তো আবার কি?
– তো মানে তো! আসবি তো আমাকে কি করতে হবে? ধানদূর্বা দিয়ে, ফুল ছিটিয়ে বরণ করার আয়োজন করবো?
– তাতো করতেই হবে!
– কেন??
– এমনি।
– এমনি না… বল কেন করতে হবে?
– বাহরে কতদিন পরে তোদের বাসায় যাবো! বরণ করা উচিত না?
– আচ্ছা আয়। বরণডালা রেডি করছি!
– হাহাহা….
রেহান হাসতে ফোন রাখলো।
বিকেলবেলা ছাদে এসেছি।তখনই রেহান ফোন করেছিলো। ফোন রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি।
এ রাস্তা দিয়ে রেহান আসবে।
তুই অনেক বদলে গেছিস রেহান। আগে আমার বাসায় আসতে ফোন করে বলার প্রয়োজন হতো না। এমনকি ফোন করে জানতেও হতো না বাসায় আছি কিনা।কারণ তুই জানতিস কখন কোথায় থাকি!
একটা দীর্ঘশ্বাস অনেক গভীর থেকে আসলো।
অইতো রেহানকে দেখা যাচ্ছে।
আজকাল অনেক চেঞ্জ ওর মধ্যে। আগের মতো এলোমেলো, স্টাইলিশ ভাবটা নেই। অনেক ফরমাল আর ভদ্রলোক বনে গেছে। চাকরিতে জয়েন করে এতো চেঞ্জ। আনমনে হাসলাম।
একটা সময়ে কত চায়ের টংয়ের সামনে, ক্যাম্পাসে,ক্যান্টিনে…. ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলেছে।চাইলে সবাইকে পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন!
সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে। এমনি করে সময় বদলায় আর দূরত্ব বেড়ে যায়।
রেহান অনেকক্ষন আগেই আমাদের বাসায় ঢুকেছে। কিন্তু এখনো ছাদে এলো না। নিশ্চয়ই আম্মুর সঙ্গে গল্প শুরু করেছে! আম্মুর সাথে রেহানের গল্প জমে ভালো।
আরও কিছু সময় পরে রেহান ছাদে এলো।
– কিরে? একা একা ছাদ বিলাস করছিস?
– না, তোকে বরণ করার অপেক্ষা করছি।
– কই করলি না তো বরণ! কোনো আয়োজন ও দেখতে পাচ্ছি না।
– উহহহ… শখ কত! তোরে বরণ করতে আমার কি ঠেকা পড়ছে!
– যা বাবা! আমি কি বলেছিলাম কিছু? তুই নিজেই বলেছিস।
– তোকে তো আজকাল দেখাই যায় না!
– আর বলিস না, কত ব্যস্ততার মধ্যে থাকি।চাইলে সম্ভব হয় নারে।
– হুমম।
– তোর কি খবর বল।
– এইতো ভালো।
– একটা সাজেশন দে তো আমাকে।
– কি সাজেশন?
– কাউকে প্রপোজ করতে হলে কিভাবে করতে হবে? একটু ডিফারেন্ট ভাবে।
আমি জানি রেহান তুই তানিশাকে প্রপোজ করবি। ভেতরে একটা চাপা আর্তনাদ হচ্ছে আমার।
মুখে বললাম – তুই আর প্রপোজ?!
দুটো দুই মেরুতে। তার চেয়ে ভালো বিয়ে করে ফেল।
– এটা একটা ভালো আইডিয়া দিয়েছিস।
– তো কবে প্রপোজ করবি তানিশাকে?
– তানিশাকে?!!
রেহান একটু অবাক হয়ে তাকালো!
তারপর হেসে বললো – তুই তো অনেক কিছু বুঝিস দেখা যায়! ভালো তো!
রেহানের কথার মানে বুঝতে পারছি না, ও ঠাট্টা করলো, নাকি সিরিয়াসলি বললো।
– কেন ভুল কিছু বললাম?
– তুই কখনো ভুল বলতে পারিস?
আচ্ছা বাদ দে এসব। আমাকে আইডিয়া দে।
রেহান আমার হবে না তাতে কি? ও যদি ওর ভালোবাসার মানুষকে পায় আর সুখে থাকে তাহলে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো আমি!
আমার বন্ধুত্বের সবটুকু ফরজ আমি করে যাবো শুধু তোর জন্য রেহান।
– কিছু বল??
– এই বয়সে এসে প্রেম করবি? তোর তো জব হয়ে গেছে। চাইলে বিয়েটা করতে পারিস।
– কিন্তু… কিভাবে কি করবো?
– আমার মাথায় কিছু আসছে না। তবে এ ব্যাপারে তোকে সবচেয়ে ভালো আইডিয়া দিতে পারবে খুশবু।
– ওকে এখন কই পাবো?
– দাঁড়া তোর সমস্যার সমাধান এখনি হয়ে যাবে।
খুশবুকে ফোন করলাম। স্পিকার লাউডে দিয়ে বললাম সব।
খুশবু বললো – উহহহফ দুস্ত! তুই প্রপোজ করবি! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
কাকে করবি রে?
– বলা যাবে না এখন।সিক্রেট! ( রেহান)
– ধুর শালা… আমার কাছে কোনো আইডিয়া নেই তাহলে! যা ভাগ!
– আচ্ছা আচ্ছা.. তোকেই করলাম প্রপোজ। ( রেহান)
– হাউ ফানি! ঝেড়ে কাশো বাবু…( খুশবু)
– উফফ.. মনে কর হিয়াকেই প্রপোজ করবো!!
এবার আইডিয়া দে ভাই!( রেহান)
রেহানের কথা শুনে একটু কেঁপে উঠলাম।
সেটা হয়তো রেহানের চোখে পড়েনি।
চলবে…