প্রেমাতাল

#প্রেমাতাল পর্ব ৩৩

লেখা- মৌরি মরিয়ম
তিতিরের শরীর প্রচন্ড গরম। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে। ও বোধহয় জ্বরের ঘোরে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারেনি তাই চলে এসেছে। জ্বর কমলে, ঘোর কাটলে তো চলেই যাবে। শুধু শুধু মায়া বাড়াতে এল মেয়েটা!
-“এই দাওনা। খাবোতো!”
মুগ্ধর ঘোর কাটলো। বলল,
-“কি দেব?”
-“তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েসটা।”
-“ভয়েস কি খাওয়া যায় পাগলী?”
-“হুম খাওয়া যায়, আচ্ছা তোমাকে দিতে হবে না, আমি নিয়ে নিচ্ছি।”
একথা বলেই তিতির মুগ্ধর গলায় একটা গভীর চুমু খেল। মুগ্ধর চোখদুটো আবেশে বুঁজে গেল। বুকের ভেতরটা কাঁপছে। প্রায় এক বছর পর! ভালবাসা এমন কেন হয় আজ এতবছর পরেও মনে হয় যেন প্রথম স্পর্শ!
কিছুক্ষণ পর তিতির টায়ার্ড হয়ে মুগ্ধকে ছেড়ে বালিশে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,
-“একা একা কেন এলে? আমাকে ফোন করতে আমি নিয়ে আসতাম।”
তিতির সেকথার কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,
-“এই আমকে আজকেই বিয়ে করবে?”
-“সে সব পরে হবে, আগে বলো এত জ্বর নিয়ে এলে কেন?”
-“তোমার কাছে না এলে আমার জ্বর কি কোনদিনও ভাল হতো? হতো না, এখন তোমার কাসে এসেছি এক্ষুনি ভাল হয়ে যাব।”
কথাগুলো বেঝে বেঝে যাচ্ছিল। সেই পুরোনো অনুভূতি। বৃষ্টির ফোটাগুলো যেমন একটার উপর একটা পরে লাফালাফি করে তেমনটাই ওর বলা প্রতিটি শব্দ একটার উপর আরেকটা পরে লাফালাফি করছে দুরন্ত বালিকার মত। “র” গুলো শোনাচ্ছে অনেকটা “ল” এর মত। বাচ্চা একটা! মুগ্ধ বলল
-“তুই এত পাগলী কেন রে?”
-“তুমি একটা পাগল যে তাই আমি একটা পাগলী!”
বলেই হিহি করে হেসে দিল তিতির। মুগ্ধর মনে হল এ যেন হাসি নয়, প্রচন্ড গরমের তাপদাহের পর কালবৈশাখীর উন্মাদ হাওয়া! হাসতে হাসতে তিতির পরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুহাতে তিতিরকে আলিঙ্গন করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“চোখমুখ এত শুকিয়ে গিয়েছে কেন? খাওনা ঠিকমতো?”
-“খাওয়া মজ্জা না।”
-“থাপ্পড় দিব একটা ধরে।”
তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ বলল,
-“সকালেও নিশ্চই কিছু খাওনি।”
-“খেয়েছি তো।”
-“কি খেয়েছো?”
-“তোমার ঘুমু ঘুমু ভয়েস! উম্মম্মম্ম! ইয়াম ইয়াম, মজ্জা মজ্জা!”
মুগ্ধর হাসি পেল। বলল,
-“চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”
-“নাহ নাহ নাহ, আমি তোমাক্কে খাবো!”
মুগ্ধ এবার না হেসে পারলো না। বলল,
-“আমাকে তো খালি পেটে খেতে পারবে না। আগে কিছু খেয়ে নাও তারপর আমাকে খেয়ো।”
-“ওহ তাই তো। মিষ্টি তো খাওয়ার পরে খেতে হয়।”
-“হুম। তুমি শুয়ে থাকো, আমি আসছি।”
মুগ্ধ উঠে ফ্রেশ হয়ে একটা টি-শার্ট পড়ে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই দেখলো স্নিগ্ধ ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছে। মুগ্ধকে দেখেই স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাইয়া ভাবীর কি অবস্থা? দেখে খুব অসুস্থ লাগছিল।”
-“ওর মারাত্মক জ্বর।”
-“আমারও দেখে সেটাই মনে হচ্ছিল।”
-“আমি দরজা খুলতেই ভাবী বলে, ‘স্নিগ্ধ আমি একেবারে চলে এসেছি।’ আসল ঘটনা কি ভাইয়া?”
-“আমাকেও তাই বলছে। গড নোজ কি হয়।”
-“বলো কি? ওর ভাই যদি আবার ঝামেলা করে?”
-“করলে করুক, রাস্তার কুকুরদের আমি ভয় পাই না। কিন্তু তিতিরের উপর অত্যাচার করে এটাই আমার ভয়।”
-“সেটাই তো ভাইয়া। আর আম্মুও ঢাকায় নেই এই সময়।”
-“মা যেন কবে আসবে?”
-“পরশু আসার কথা।”
-“আচ্ছা আমি কথা বলে নিচ্ছি মায়ের সাথে। আর পিউ কোথায়?”
-“পরশু আপুর র্যাগ ডে না? এরেঞ্জমেন্ট করছে। কাল রাতে না বলল সকাল সকাল ও বেড়িয়ে যাবে। আমি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ও চলে গেছে।”
-“ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে।”
-“বুয়া এসে নাস্তা বানিয়ে দিয়ে গেছে। তুমি আর ভাবী খেয়ে নাও।”
-“হুম।”
মুগ্ধ দেখলো ডাইনিং টেবিলে কিছুই নেই। স্নিগ্ধ বলল,
-“নাস্তা রান্নাঘরে বোধহয়।”
মুগ্ধ রান্নাঘরে ঢুকলো। হটপটে রুটি রাখা। পাশেই সবজি আর ডিমের অমলেট। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। কে বলেছে বুয়াকে এত আগে আগে অমলেট করতে। সব পান্তা হয়ে গেছে। মুগ্ধ ঠান্ডা অমলেটগুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে দুটো কাঁচা ডিম বের করে পোচ করতে করতেই তিতির চলে এল রান্নাঘরে। পেছন থেকে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরতেই মুগ্ধ চমকে উঠলো। বলল,
-“আরে, তুমি অসুস্থ শরীরে রান্নাঘরে কেন আসলা রে বাবা?”
-“আমি আর তোমাকে ছাড়া আর থাকবো না তাই চলে এসেছি। জানো আমি এতদিন তোমাকে ছাড়া অনেক কষ্টে ছিলাম।”
একথা বলে কেঁদেই ফেলল তিতির। মুগ্ধ চুলা বন্ধ করে পেছনে ফিরে তিতিরের চোখের পানি মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-“আমি জানি।”
-“আর আমিও জানি যে তোমারও কতটা কষ্ট হয়েছে।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“হয়েছে এবার খেয়ে নাও পাখিটা।”
তিতির মুগ্ধর বুকে কামড় দিতে লাগলো। মুগ্ধ বলল,
-“আরে কামড়াচ্ছো কেন?”
-“তুমি যে খেতে বললা?”
-“আমাকে পরে, আগে রুটি খাও। চলো রুমে চলো।”
তিতির কেবিনেটের উপর উঠে বসলো। তারপর পা ঝোলাতে ঝোলাতে বলল,
-“আমি যাব না। এখানে বসে খাব।”
-“এখানে গরম। রুমে চলো।”
-“আজ আমি কোথাও যাব না-হুমায়ুন আহমেদ স্যারের এই বইটা পড়েছো?”
-“পড়েছিবাবা। চলো তো।”
-“আজ আমি কোথাও যাব না। এখানে বসে খাব নাহলে খাব না।”
অবশেষে মুগ্ধ তিতিরের কথাই মেনে নিল। রান্নাঘরে বসেই তিতিরকে খাইয়ে দিল। তিতির বলল,
-“আমাকে ডিম দিবেনা। জানোনা আমি ডিম খাইনা।”
-“আচ্ছা এই দেখো, শুধু সবজি দিয়েছি।”
তিতির মুখে নিয়ে বলল,
-“এহ সবজিটা একদম মজা হয়নি। পচা পচা পচা। আমি খাবো না।”
-“আরে বাবা, পচা না, তোমার জ্বর তাই মজা লাগছে না।”
-“মা রান্না করলে অন্নেক মজা হয়। দ্মন পচা হয়না। মা কোথায়? মাকে দেখছি না কেন? আমি মায়ের কাছে যাব।”
তিতির নেমে গেল। মুগ্ধ হাত ধরে থামিয়ে বলল,
-“এই শোনো, মা বাসায় নেই কুমিল্লা গিয়েছে।”
-“সেকী! তাহলে আমাদের বিয়ে কি করে হবে?”
-“স্নিগ্ধ গিয়ে নিয়ে আসবে।”
-“আচ্ছা।”
হাসি ফুটলো তিতিরের মুখে। তিতির আবার বসলো। তারপর বলল,
-“এই তুমি না আগে পুরোটা ডিম একবারে মুখে নিয়ে খেতে?”
-“হুম।”
-“এখন খাওনা, আমি দেখবো।”
মুগ্ধ তাই করলো। তিতির হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ ধরে ফেলল আর তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে বলল,
-“তোমার বুকটাতে এত শান্তি কেন?”
-“ভালবাসো যে অনেক তাই।”
-“শুধু সেজন্য নয়।”
-“তাহলে?”
-“তোমার বুকে ম্যাজিক আছে।”
-“ওটা তোমার বুকেও আছে।”
তিতির ওড়না সরিয়ে, জামার ভেতরে তাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“কই দেখিনা তো।”
-“আমারটা দেখতে পাও?”
-“নাতো।”
-“হুম, কারন… ম্যাজিক অলওয়েজ ইনভিজিবল হয়।”
-“ওহ।”
-“এবার রুমে চলো। তোমার ঘুম দরকার। চোখগুলো লাল হয়ে আছে, মনে হয় সারারাত একফোঁটা ঘুমাওনি। আমার কাছে আসবে বলে শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা করেছো।”
-“হুম, তুমি মনের কথা বুঝতে পারো। তুমি খুব ভাল।”
-“আচ্ছা, এবার চলো।”
তিতির ওর সেই বিখ্যাত স্টাইলে মুগ্ধর গলা ধরে ঝুলে ঝুলে বলল,
-“তাহলে আমাকে কোলে নাও… কোলে করে নিয়ে চলো রুমে।”
-“আচ্ছা এটুকু কষ্ট করে হেটে চলো। রুমে গিয়ে কোলে নিচ্ছি।”
-“নাহ, আমি হাটতে পারিনা। তোমার কোল মজা।”
-“ওইজন্যই তো রুমে গিয়ে কোলে নিব। ড্রয়িংরুমে স্নিগ্ধ বসে আছে। ওর সামনে কি করে কোলে নেই বলো?”
-“তাহলে কি হয়েছে? ওরও তো শিখতে হবে। ও যদি তোমার মত না হয় তাহলে ওর গার্লফ্রেন্ড কষ্ট পাবে না? ওরও শিখতে হবে কিভাবে গার্লফ্রেন্ড কে কোলে নিতে হয়।”
মুগ্ধ অবাক হয়ে বলল,
-“পাগলামি করেনা বাবা, ও আমার ছোট ভাই না? আমি ওর সামনে এটা করতে পারি?”
-“তাও ঠিক! কিন্তু ওর শিখতে হবে তো।” -“ওর শিখতে হবেনা ও পেকে ঝুনা হয়ে গেছে। আমি এতদিনেও যা করতে পারিনি ও অলরেডি ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে তা করে ফেলেছে।”
-“তুমি কিভাবে জেনেছো? ও তোমাকে বলেছে?”
-“না বলেনি। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি।”
-“ওহ। তাহলে হেটেই যাচ্ছি। কিন্তু প্রমিস করো, রুমে গিয়েই কোলে নিবে।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
-“রুমে চলোই না, কোল থেকে নামাবোই না।”
অবশেষে মুগ্ধ বোঝাতে সক্ষম হলো এবং তিতির হেটেই রুমে গেল। রুমে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েই মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিল। তারপর মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর হাটতে হাটতে বলল,
-“আমার তিতিরপাখিটার যে এখন একটু ঘুম দরকার।”
-“তাহলে আমাকে কোলে নিয়ে বিছানা পর্যন্ত যাও।”
মুগ্ধ তাই করলো। তিতির বিছানায় শুয়ে বলল,
-“তুমিও শোও আমার সাথে।”
-“শুচ্ছি দাঁডাও, আগে তোমাকে একটা অষুধ খাইয়ে নেই।”
-“ই না। আমি ওষুধ খাবো না, ওষুধ খুব বাজে হয়।”
মুগ্ধ তিতিরের পাশে বসে বলল,
-“না খেলে তোমার সাথে শুবো না।”
-“তুমি খুব পচা। দাও ওষুধ দাও।”
মুগ্ধ ওকে একটা প্যারাসিটামল আর পানি দিল। তিতির বলল,
-“এতবড় অষুধ? খেতে গেলে আমি মরে যাব।”
-“ওকে, আমি ব্যবস্থা করছি।”
মুগ্ধ ওষুধটাকে ভেঙে চার টুকরা করে দিল। তিতির সেগুলো একটা একটা করে খেল। তারপর মন খারাপ করে বলল,
-“জানো বাবা সবসময় বড় ওষুধগুলো আমাকে ভেঙে দিত।”
মুগ্ধ বলল,
-“বাবারা তো এমনই হয়।”
-“কিন্তু আমার বাবা সবচেয়ে ভাল বাবা।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
মুগ্ধ উঠে যাচ্ছিল। তিতির বলল,
-“কোথায় যাও?”
-“আসছি।”
মুগ্ধ এক বালতি পানি নিয়ে এল। যখন তিতিরের মাথায় পানি ঢালছিল তখন তিতির বলে উঠলো,
-“এই তুমি আমার চুল ধুয়ে দিচ্ছো?”
-“হুম।”
-“তুমি কি আমাকে গোসলও করিয়ে দেবে?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“প্রয়োজনে দেব।”
-“কবে দিবে?”
-“যেদিন প্রয়োজন পড়বে।”
-“কবে প্রয়োজন পড়বে?”
-“তাতো জানিনা।”
মাথায় পানি দেয়া শেষ করে মুগ্ধ নিজের টাওয়াল দিয়ে ভাল করে তিতিরের মাথাটা মুছে দিল। তিতির তো আহ্লাদে আটখানা। তারপর মুগ্ধ যখন টাওয়াল মেলে দিতে বারান্দায় গেল তিতির তখন বলল,
-“আমি তো ওষুধ খেয়েছি। এখন তো শোও।”
-“বালতিটা রেখে এসেই শুচ্ছিরে বাবা।”
মুগ্ধ যখন তিতিরের ডানপাশে শুয়ে পড়লো। তিতির মুগ্ধর গলা ধরে বলল
-“এই তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? কিছু তো বললে না।”
-“তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো এতকিছু করলাম। অবশ্যই করবো।”
-“আমি তোমার বুকে ঘুমাবো।”
মুগ্ধ তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মুগ্ধর আসলে টেনশন হচ্ছিল। তিতির যখন সুস্থ হবে তখন তো চলে যাবে, কিছুই করতে পারবেনা মুগ্ধ। এতদিন ওকে ছেড়ে থাকার একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল যা আজ ভেঙে দিল। এবার ও যখন চলে যাবে ভেতর থেকে কলিজাটা ছিঁড়ে নিয়ে যাবে। কেন এল ও? কিছুক্ষণ পর তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,
-“শোনো আমরা কখন বিয়ে করবো আজকে সন্ধ্যায় নাকি আজকে রাত্রে?”
-“ঘুমিয়ে ওঠো আগে। ওষুধ খেয়েছো তো জ্বর কমে যাবে, তখন বলবো।”
-“না এক্ষুনি বলতে হবে।”
-“না এখন ঘুমাতে হবে।”
তিতির মুগ্ধকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তুমি আসলে আমাকে বিয়েই করতে চাওনা। আমি বুচ্ছি এবার। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।”
-“আরে পাগলী! না না একথা কে বলল?”
-“আমি সব ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে এলাম আর এখন তুমি বলছো বিয়ে করবে না! এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।”
মুগ্ধ তিতিরকে খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“না বাবা, আমি সত্যি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে বিয়ে করার জন্যই তো কত কষ্ট করলাম, বোঝোনা তুমি? কিন্তু তুমি সুস্থ না হলে বিয়ে কি করে করবো বলো? আর মায়েরও তো আসতে হবে। তুমি একটু ঘুমিয়ে ওঠো তারপর এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।”
-“ওহ, আচ্ছা।”
-“এইতো আমার লক্ষীটা। একটু অবুঝ হলেও বোঝালে সব বোঝে।”
তিতির একটা বিশ্বজয় করার হাসি দিল। তারপর মুগ্ধ তিতিরের মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রইলো। তিতিরের জ্বর মনে হচ্ছে আরো বাড়ছে। মুগ্ধর বুকটা প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে। প্রচন্ড গরম! তবু খুব শান্তি লাগছে মুগ্ধর। পরম শান্তি! অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মুগ্ধ যখন ভাবলো তিতির ঘুমিয়ে পড়েছে তখনই তিতির মাথা উঠিয়ে বলল,
-“এই দেখোনা, আমার ঠোঁট ফেটে কি হয়েছে!”
মুগ্ধ বুঝলো তিতির কি চাইছে। কোন কথা না বলে আস্তে করে তিতিরকে উপরে উঠিয়ে ঠোঁটে আলতো চুমু খেল।
দুপুরবেলা তিতির ঘুম থেকে উঠলো। ওর এখন জ্বর নেই। রুমে একা শুয়ে আছে। যতদূর মনে পড়ে ও মুগ্ধর সাথে শুয়েছিল। মুগ্ধ কোথায় গেল! ঘর থেকে বের হয়ে কাউকে দেখতে পেল না। রান্নাঘরে যেতেই দেখলো মুগ্ধ রান্না করছে, পিউ হেল্প করছে। তিতিরকে দেখতে পেয়েই পিউ এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো।বলল,
-“ভাবী!”
তিতিরও পিউকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কেমন আছো?”
-“যেমন তেমন ছিলাম গো! তোমাকে দেখে খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।”
তিতির পিউয়ের গালে একটা চুমু দিল। পিউ বলল,
-“ভাবী! সত্যি চলে এসেছো? পার্মানেন্টলি?”
-“হ্যা।”
মুগ্ধ তাকালো তিতিরের দিকে। তিতিরও তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিল তিতির। পিউ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে ফিরে বলল,
-“ভাইয়া, ভাবীর কিন্তু এখন জ্বর নেই।”
মুগ্ধ বলল,
-“এখন তাহলে ওর কথা গ্রহণযোগ্যতা পাবে।”
তিতির মিটিমিটি হাসতে লাগলো। পিউ বলল,
-“ভাইয়া তোর আর কিছু লাগবে?”
-“না, রান্না অলমোস্ট কম্পলিট।”
-“আমি তাহলে গোসলে যাই।”
-“আচ্ছা, যা।”
পিউ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যেতেই তিতির মুগ্ধর পাশে এসে দাঁড়ালো। মুগ্ধ তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“বাহ, জ্বর নেই দেখছি। কয়দিন ধরে জ্বর তোমার?”
-“চারদিন।”
-“এতদিনের ওষুধগুলো কি আগের মত ফুলের টবে গিয়েছে?”
-“হ্যা।”
-“ঠিক হয়নি। ওষুধ খেলে আরো আগে সুস্থ হয়ে যেতে।”
-“ওষুধ ভেঙে দেয়ার কেউ ছিলনা।”
-“বাবা?”
-“বাবা ছিল, কিন্তু দেয়নি। হয়তো ভেবেছে আমি বড় হয়েছি, এখন খেতে পারবো।”
মুগ্ধর রান্নাটা ততক্ষণে পুরোপুরি শেষ। চুলা বন্ধ করে হাত থেকে গ্লাভস খুলে রাখলো। তারপর আচমকা তিতিরের হাত ধরে একটানে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তিতিরও ধরলো। এতক্ষণে মুগ্ধর মনে হলো তিতিরকে ও পেয়েছে! কারন, তিতির এখন স্বজ্ঞানে। মুগ্ধ ওই অবস্থাতেই তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কি সত্যি সত্যি চলে এসেছো তিতির?”
-“হ্যা, সত্যি এসেছি।”
-“আর যাবে না তো?”
-“নাহ। মরে গেলেও আর যাব না।”
-“বাসায় কি বলে বেড়িয়েছো?”
-“কিছুনা। শুধু একটা মেসেজ করে দিয়েছি ভাইয়াকে।”
-“কি লিখেছো?”
-“লিখেছি আমি মুগ্ধর কাছে চলে যাচ্ছি। আজ আমরা বিয়ে করবো।”
-“তান্না কি রিপ্লে দিয়েছে?”
-“ভাইয়া লিখেছে, আর কোনদিনও ফিরে আসবি না। আমার বোন একটু আগের মেসেজটা দেয়ার সাথে সাথে মারা গেছে। বাবা-মাও মেসেজটা দেখে বলেছে তাদের মেয়ে মৃত।”
-“তারপর?”
-“আমি আর কোন রিপ্লে দেইনি।”
-“এই মেসেজ কখন দিয়েছো?”
-“সকালে।”
মুগ্ধ এবার তিতিরকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুহাতে ওর মুখটা তুলে চোখে চোখ রেখে বলল,
-“কিকরে আসতে পারলে বলোত? ভয় করেনি?”
-“নাহ, শুধু খারাপ লেগেছে। কি করবো যতকিছুই করিনা কেন এখন আর তাদের খুশি করতে পারিনা। অন্যদিকে তোমাকে ছেড়েও থাকতে আর পারছিলাম না। তাই শেষমেশ তোমার কথাই মেনে নিলাম যে বিয়ের পর একদিন না একদিন মেনে নেবে।”
-“আমি জানতাম তুমি আসবে। আমার ভালবাসার উপর এটুকু বিশ্বাস আমার ছিল। আর এজন্যই আমি তোমার সাথে সেদিন ওরকম নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম। সেদিনের জন্য আমাকে তুমি মাফ করে দিও তিতিরপাখি।”
-“হুম। আমি পরে সেটা বুঝেছিলাম।”
-“সেদিনের ব্যবহারের জন্য রাগ নেই তো?”
-“নাহ। তোমার যদি আদর করার অধিকার থাকে তো রাগ, শাসন এবং খারাপ ব্যবহার করার অধিকারও আছে। সেদিন খুব কষ্ট পেলেও পরে বুঝেছিলাম আমি।”
মুগ্ধ তিতিরের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-“আজ আমার জীবন সার্থক।”
-“এবার বলো কবে বিয়ে করবো?”
-“কাল।”
-“কাল কেন? আজই বিয়ে করবো আমি। কাল হয়ে গেলে আর বিয়ে করবো না।”
-“কেন?”
-“কি থেকে কি হয়ে যায় ঠিক নেই।”
-“তাহলে তো মোটেও তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না। কখনো যেন তোমার মনে না হয় যে তুমি এভাবে চলে এসে হুট করে বিয়ে করে ভুল করেছো। আজ সারারাত চিন্তা করো আর তোমার ফ্যামিলি কি একশন নেয় দেখো। তাছাড়া, মাকে ছাড়া শুধু আমি তুমিই তো বিয়ে করতে পারবো না। আজ স্নিগ্ধকে পাঠাচ্ছি মাকে নিয়ে আসার জন্য। কাল এলেই বিকেলে আমরা বিয়ে করবো। ঠিকাছে?”
-“ওহ, মা কোথায় গিয়েছে?”
মুগ্ধ মনে মনে হাসলো। একবার বলা স্বত্তেও ভুলে গেছে তিতির। জ্বরের ঘোরে ছিল কিনা। নিশ্চই তখনকার অনেক কথাই ভুলে গিয়েছে। বলল,
-“কুমিল্লা গিয়েছে।”
-“ওহ। আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে কালই।”
লাঞ্চের পর পিউ আর তিতির বিয়ে নিয়ে টুকটাক প্ল্যানিং করছিল। বিকেলেই স্নিগ্ধ রওনা দিয়ে দিল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। তারপর পিউ বলল,
-“ভাইয়া আমার একটু বেরোতে হবে।”
-“কোথায় যাবি আবার।”
-“উফ ভাইয়া আমি তো বড় হয়েছি না? আমার অনেক পারসোনাল কাজ থাকতে পারে।”
-“ওহ, আচ্ছা আচ্ছা যাহ।”
পিউ চলে যাওয়ার পর মুগ্ধ তিতিরকে বলল,
-“তোমার ননদ তো আমাদের প্রেম করার সুযোগ করে দিয়ে গেল। কিন্তু অসুস্থ মানুষের সাথে কি প্রেম করবো আমি?”
-“কই এখন তো আর আমি অসুস্থ না।”
-“তাই না?”
মুগ্ধ হঠাৎ তিতিরকে কোলে তুলে হাটা শুরু করলো। প্রায় পুরো ফ্ল্যাট চক্কর দেয়া শেষ। তখন তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হলো তোমার? কোলে নিয়ে ঘুরাঘুরি করছো যে?”
-“সেকি! তুমিইনা সকালবেলা কোলে ওঠার জন্য লাফাচ্ছিলে?”
তিতির তো আকাশ থেকে পড়লো,
-“ইশ! কখন?”
-“হ্যা, এখন তো অস্বীকার করবেই।”
সকালবেলা যা যা হয়েছে সবটা মুগ্ধ ডিটেইলে বলল তিতিরকে। স্নিগ্ধর সামনে কোলে উঠতে চেয়েছে, স্নিগ্ধকে শেখাতে চেয়েছে সেটা শুনে তো তিতির লজ্জায়ই মরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
-“সুন্দরী, এগুলো ঘোরে তোমার মনে, না?”
To be continued…