#প্রেমাতাল পর্ব ৩৪
লেখা- মৌরি মরিয়ম
পুরোটা বিকেল ওরা বারান্দায় কফির মগ হাতে গল্প করে কাটিয়ে দিল। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে গল্প। খুব সিরিয়াস টাইপের গল্প। প্রায় এক বছর কে কিভাবে কাটিয়েছে, কার জীবনে কি হয়েছে সেসব গল্প। তিতির মুগ্ধকে সুহাসের কথাটা সব খুলে বলততেই মুগ্ধ খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
-“তার মানে তো বিয়ে পুরো ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। তুমি যেভাবে চলে এসেছো, ছেলেটা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা কে জানে।”
-“যেভাবে মন চায় সেভাবে নিক। আমি তো আর ওর সাথে প্রেম করিনি। ফ্যামিলি ঠিক করেছে।”
-“এলেই যখন বিয়েটা ঠিক হওয়ার আগেই আসতে।”
-“কেন তোমার কি কোন প্রব্লেম হচ্ছে? হলে বলো আমি এক্ষুনি চলে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরের ডানপাশে বসে ছিল। ডানহাতটা দিয়ে তিতিরকে টেনে বুকে নিয়ে বলল,
-“আরে পাগলী, তা বললাম কখন? জাস্ট এটাই বলতে চাচ্ছি এখন তোমার ফ্যামিলি বলবে তুমি তাদের মুখ পুড়িয়েছো।”
-“যা মন চায় বলুক, এখন আর আমি কিছুতেই কেয়ার করি না। বিয়েটা দু’মাস আগে ঠিক হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর আমি আরো ভাল করে বুঝলাম যে তুমি ছাড়া অন্য কাউকেই আমার ভাল লাগবে না। মন বসবেনা কারো প্রতি।অন্যকারো হয়ে থাকার চেয়ে সারাজীবন একা থাকাটা অনেক সহজ।”
-“আচ্ছা, আচ্ছা বাদ দাও। যা হয়েছে হয়েছে। তুমি যে ফাইনালি এসেছো এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রাখলো। মুগ্ধ বলল,
-“তোমার জ্বরটা আবার আস্তে আস্তে আসছে মনে হচ্ছে।”
-“আসুক।”
-“ডাক্তার দেখিছিলে?”
-“না।”
-“৪/৫ দিন ধরে এত জ্বর আর তুমি ডাক্তার দেখাওনি?”
-“না।”
-“অফিসে গিয়েছো?”
-“যেদিন জ্বর এসেছিল সেদিন গিয়েছিলাম, পরে আর যেতে পারিনি।”
-“ও।”
-“আচ্ছা তিতির এখন যদি তোমার ফ্যামিলির কেউ তোমাকে নিতে আসে?”
-“আমি যাব না।”
-“সত্যি তো?”
-“১০০%।”
-“তিতির, কষ্ট পেও না। দেখো আমাদের বিয়ের পর তোমার বাবা-মা একদিন না একদিন মেনে নেবে।”
-“সত্যি মানবে তো?”
-“হুম মানবে, যখন আমাদের একটা বেবি হবে, তখন বেবিটাকে দেখলেই গলে যাবে।”
-“যদি না মানে?”
-“আরে মানবে মানবে। প্রত্যেকেরই নাতি-নাতনীর প্রতি অন্যরকম ভালবাসা থাকে। মুখ দেখলে দুনিয়া ভুলে যায়। আর কাজটা খুব দ্রুত করে ফেলবো বুঝলে। তান্নার বেবি হওয়ার আগে আমাদের টা হলে ভাল হয়।”
-“যদি ভাইয়ার আগে হয়?”
-“প্রব্লেম নেই তো। আমাদের আগে হলে ভাল, পরে হলেও ক্ষতি নেই। কেন তোমার ভাবী কি প্রেগন্যান্ট নাকি?”
-“নাহ।”
-“তাহলে তো হলোই, কাল আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। একদম নগদ নগদ আমি তোমাকে প্রেগন্যান্ট করে দেব। ওনলি আদর আর আদর। নো প্রটেকশন!”
-“ধ্যাত!”
লজ্জা পেয়ে তিতির উঠে দৌড় দিল। মুগ্ধ গেল পেছন পেছন। মুগ্ধ তিতিরকে ধরে ফেলতেই তিতির নিজেকে ছোটাতে চাইছিল। দুজনেই হাসছে, ধস্তাধস্তি তুমুল পর্যায়ে এমন সময় কলিং বেল বাজলো। মুগ্ধ ছেড়ে দিল ওকে। বলল,
-“যাও তোমার ননদ চলে এসেছে। বেঁচে গেলে।”
তিতির দরজা খুলেই হা হয়ে গেল। ইকরা দাঁড়িয়ে আছে। ইকরার সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল মুগ্ধর এক জন্মদিনে। তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে মুগ্ধদের বাসায়, অনেক আগে যখন ওদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। এমনিতে ইকরা যেমনই হোক, খুব মিশুক। যতবার ওদের দেখা হয়েছে ততবারই হাত ধরে ‘তুমি খুব লাকি’ ‘জাদু জানো নাকি? নাহলে মুগ্ধ ভাইয়ার মত মানুষ গলে যায়!’ এই টাইপের কথাবার্তা বলেছে ইকরা। আর প্রতিবারই তিতির ওকে অবাক চোখে দেখেছে আর ভেবেছে একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে!
ইকরা বলল,
-“ভেতরে ঢুকতে দেবে না?”
তিতির হেসে বলল,
-“হ্যা হ্যা এসো।”
ইকরা আর তিতির ড্রইংরুমে বসলো। ততক্ষণে মুগ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ইকরাকে দেখেই ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলল না। তিতির বলল,
-“ইকরা আপু তোমাকে কফি দেই?”
ইকরা হেসে বলল,
-“না না, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি কখন এলে?”
তিতির বলল,
-“আজ সকালে এসেছি।”
-“তিতির তুমি কি অসুস্থ? তোমাকে কেমন যেন লাগছে।”
-“হ্যা আপু, একটু জ্বর ছিল।”
ইকরা তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“জ্বর তো এখনো আছে। ওষুধ খেয়েছো?”
-“হ্যা খেয়েছি।”
এতক্ষণে মুগ্ধ কথা বলল,
-“তুই হঠাৎ এখানে?”
ইকরা বলল,
-“এমনি তোদের খোঁজ নিতে এলাম, মামী নেই তার মধ্যে তোরা কেমন আছিস সেটা জানার জন্যই।”
-“তোর মামী তো আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নেই, খোঁজ নেয়ার কথা আজ মনে পড়লো?”
-“আমি প্রতিদিনই বাসায় এসে খোঁজ নিই। তুই থাকিস অফিসে জানবি কি করে?”
-“ওহ, ভেরিগুড!”
-“আর কাউকে দেখছিনা। বাসায় কি তোরা দুজনই?”
-“হ্যা, আমরা দুজনই। কোন প্রব্লেম?”
-“নাহ, আমার কি প্রব্লেম।”
-“দেন ইউ ক্যান গো নাও, আমরা একটু বিজি ছিলাম।”
ইকরা চোখমুখ শক্ত করে উঠে চলে গেল। মুগ্ধ গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। এতক্ষণ তিতির কথা বলছিল না। এবার বলল,
-“এভাবে না বললেও পারতে।”
-“প্লিজ তুমি এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলো না তো। আমি শিওর ও কোন না কোন ভাবে জেনেছে যে স্নিগ্ধ, পিউ কেউ বাসায় নেই আর তুমিও এসেছো। তাই স্পাইগিরি করতে এসেছে আমরা কি করছি না করছি সেটা নিয়ে।”
-“কিন্তু ও কিভাবে জানবে?”
-“জানার ইচ্ছে থাকলে অনেকভাবে জানা যায়। ও যদি না জেনে আসতো তাহলে তোমাকে দেখে অবাক হতো। কিন্তু ও অবাক হয়নি।”
-“ওহ, তাই তো।”
মুগ্ধ এবার তিতিরের কপালে হাত দিয়ে বলল,
-“তোমার জ্বর একটু একটু করে বাড়ছে। আমার মনে হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ।”
-“ধুর, আমি যাবনা। তোমার কাছে এসেছি এখন আমার জ্বর এমনিতেই চলে যাবে।”
-“তুমি জেদ করছো কেন?”
তিতির কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,
-“তোমার চেয়ে বড় ওষুধ দুনিয়ায় আর নেই। আমি বাসায় বিছানা থেকেও নামতে পারছিলাম না আর তোমার কাছে এসে আমি দৌড়াদৌড়ি করছি। তুমি পাশে থাকলে আমার কোন ডাক্তার লাগবে না। আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর ওর মাথার কাছে বসে বলল,
-“রেস্ট নাও তাহলে।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তিতির বলল,
-“ইকরাকে দেখলে আমার কি মনে হয় জানো?”
-“কি?”
-“মনে হয় একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? আমি চোখ ফেরাতে পারিনা জানো?”
-“তিতির, তুমি ওর থেকে অনেক বেশী সুন্দরী ছিলে। আমাদের আলাদা হওয়ার পর থেকে তোমার উপর দিয়ে যেসব ঝড় গিয়েছে তার প্রভাবে তোমার চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের বিয়ের পর দেখবে আবার ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
-“আমি আগে সুন্দর ছিলাম একথা ঠিক কিন্তু ওর মত সুন্দর তো ছিলাম না। ওর চোখ, চুল, স্কিন, ঠোঁট সবকিছু এত সুন্দর! আর কি স্লিম ফিগার মাশাল্লাহ।”
-“কি যে বলো তুমি! ওর চোখগুলো তো মাছের মত ছোট ছোট। আর চুল! ডেইলি চুলের মধ্যে কত কি লাগিয়ে বসে থাকে জানো? আর দুদিন পরপর বিউটি পার্লারে যায়। আর স্কিন? স্কিন কোত্থেকে দেখলে বুঝলাম না সব তো আধ ইঞ্চি মেকাপে ঢাকা থাকে অলওয়েজ। আর ঠোঁট! জঘন্য টেস্ট, খালি দেখতে ভাল হলে তো হবে না। আর ফিগার! কি বলবো তিতির, ওই পিচ্চি পিচ্চি.. না মানে এলসিডি টাইপ ফিগার আমার ভাল লাগে না। আমার তোমার মত ফিগার ভাল লাগে। আর শুধু আমি কেন বাংলাদেশের সব ছেলেরাই জানে মেয়েদের 32 ফিগারের চেয়ে 36 কতটা বেটার। কেন সেটা আর নাইবা বলি।”
তিতির লজ্জা পেয়ে মুগ্ধকে মারতে লাগলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-“আরে আমাকে কেন মারছো?”
-“মুখে লাগাম নেই কেন?”
-“এটা তো আমার জন্মগত স্বভাব।”
তিতির থেমে গেল। তারপর সিরিয়াস হয়ে বলল,
-“একটা কথা জিজ্ঞেস করি? রাগ করবে না তো?”
-“না না বলো না?”
-“তুমি যে বললে ইকরার ঠোঁটের টেস্ট খারাপ! তুমি কি টেস্ট করেছো নাকি?”
মুগ্ধ একথা শুনে একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে বলল,
-“আমার লাইফের ফার্স্ট লিপকিস ওর সাথেই।”
ম্যাজিকের মত এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই তিতিরের চোখ জলে ভরে যায়। ও ইকরার সাথে যত ভাল ব্যবহারই করুক না কেন ও মনে মনে তো ইকরা কে অপছন্দই করে। ব্যাপারটা খেয়াল করে মুগ্ধ একটা হাত তিতিরের গালে রেখে বলল,
-“কষ্ট পেওনা তিতির।”
-“নাহ, কষ্ট পাচ্ছি না তুমি বলো?”
-“ছোটবেলায় ওর সাথে আমার সম্পর্কটা খুব ভাল ছিল। ওরা তো ঢাকাতেই থাকতো। ছুটিতে কুমিল্লা যাওয়ার আগে চিটাগাং যেত ওরা। তখন আমরা অনেক মজা করতাম। একসাথে খেলতাম, ঘুরতাম আরো কত যে মজা করতাম। কাজিনরা যেমন হয় আরকি! তখন আমি ছোট, এসএসসি দিব। ও বোধহয় সিক্সে পড়ে এক্সাক্টলি মনে নেই। তখন একদিন বিকালে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, ও এসে আমাকে কিস করে। ঘুমের ভেতর ছিলাম তো, আমিও করেছি। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম ভেঙে যায় এবং কতক্ষণ সময় লাগে বুঝতে যে কি হচ্ছে! যখন বুঝলাম তখন আমি ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই। আমার লাইফের জঘন্যতম এক্সপেরিয়েন্স। তারপর থেকে আমি কাউকে কিস করার কথা ভাবতেই পারতাম না। পরে তো বড় হতে হতে আসল ব্যাপারটা বুঝেছি।”
তিতির নীরবে কাঁদছে। মুগ্ধ ওকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই টের পেল তিতিরের জ্বর বেড়েই চলেছে। পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“কেঁদোনা প্লিজ। আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। ওর প্রতি আমার কোন ফিলিংসই নেই। ভার্সিটির ট্যুরে কক্সবাজারে গিয়ে কি হয়েছিল তা তো তুমি জানো! ওকে ওভাবে দেখেও আমার মধ্যে কিছুই হয়নি।”
তিতির এতক্ষণ চুপচাপ কাঁদছিল। এবার ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিল। মুগ্ধ থামানোর চেষ্টা করছিল। ওদিকে তিতির ওকে আঁকড়ে ধরে বলছে,
-“তোমাকে আমি কাউকে দেবনা। তুমি শুধু আমার। তোমার দিকে কাউকে তাকাতেও দেবনা আমি। খুন করে ফেলবো।”
-“আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছে হয় করো।”
তিতির ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ইকরার কত বড় সাহস ও তোমাকে টাচ করে! ওর হাত কেটে টুকরো টুকরো করে মালা বানিয়ে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেব। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার।”
-“সেজন্যই তো সহ্য করতে পারিনা ওকে। দেখোনা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।”
তিতিরের কান্না থামছেই না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
-“শয়তান মেয়েটার এতবড় সাহস ও তোমার ঠোঁটে কিস করেছে? ওর ঠোঁট কেটে কুচিকুচি করে দোপেঁয়াজা করে আমি কুকুরকে খাওয়াবো।”
তিতিরের এধরণের কথায় মুগ্ধর হাসার কথা। কিন্তু হাসতে পারলো না। উল্টো খুব খারাপ লাগতে লাগলো তিতিরের এমন কান্না দেখে। কতটা ভালবাসে তিতির ওকে। অথচ তিতির এভাবে চলে না এলে তো সারাজীবন আলাদাই থাকতে হতো। ওর চোখ মুছে দিয়ে মুগ্ধ বলল,
-“কেঁদোনা, প্লিজ এমনিতেই তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছো। আমার অনেক খারাপ লাগছে। দেখো, আমি তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। তোমাকে আনেক অনেক সুখে রাখবো।”
তিতির হঠাৎ মুগ্ধর বুক থেকে উঠে সোজা হয়ে বসলো। তখনও কাঁদছিল। তারপর নিজের হাত দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছে দিতে দিতে বলল,
-“ইকরা আমার সম্পত্তিতে কেন হাত দিল? কেন কিস করলো এই ঠোঁটে? ওকে মেরে ফেলবো আমি।”
তারপর ওর ওড়না দিয়ে মুগ্ধর ঠোঁট মুছতে লাগলো। মুছতে মুছতে বলছিল,
-“ইকরাকে আমি মেরে ফেলবো, মেরে ফেলবো।”
তিতিরের চোখে তখন অঝর শ্রাবন! মুগ্ধর বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
To be continued…