পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 37

সামনে পানি থাকায় বাতাসের ভাপ বেশি আসছে।সেই বাতাস গাছপালা ছাড়িয়ে পানিতে ভেসে দু’জনের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে।পরিবেশ নীরব নিস্তব্ধ।কেউ কথা বলছে না।আবার দু’জনেই বলছে।নিজের সাথে।আরো কয়েক মুহূ্র্ত নীরব থেকে অরিত্রান গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
—-“ আমাকে বেছে না নেওয়ার কারন কি??”
ওয়াসেনাত জবাব দিলো না।নীল পানি থৈথৈ করে নাচ্ছে।বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে।চাঁদের উপরে মেঘ ভর করছে।অরিত্রান কঠিন চোখে তাকায় ওয়াসেনাতের দিকে ।ওয়াসেনাতের চোখ সামনের দিকে।সে তাকাচ্ছে না।অরিত্রানের রাগ হয়।ইচ্ছে করে আবার একবার পানিতে ঝাপিঁয়ে পড়তে।কিন্তু একা না।ওয়াসেনাতকে নিয়েই ঝাপিঁয়ে পরবে এবার।ওয়াসেনাত অরিত্রানের মুখের দিকে ঘুরে তাকায়।কিছু সময় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে।কয়েক মুহূর্ত পরে অপরাধীর সুরে বলে,
—-“ আমি বাবাকেই বেছে নিবো।এতে আমি অপরাধী হবো।তবুও আমি বাবাকে নিবো।”
—-“ কেন??আমি তোমাকে তোমার বাবার চাইতে কম ভালোবাসি??ওয়াসেনাতের চোখে চোখ রেখে বললো অরিত্রান।
অরিত্রানের কাটা হাত টেনে ওয়াসেনাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,
—-“ ১৯ বড় না কি ১!!”

ওয়াসেনাতের এমন বেহুদা কথা শুনে অরিত্রান কপাল কুঁচকে তাকায়।মুখের ভাবভঙ্গি পাল্টে সে বললো,
—-“ আমি কি তোমার সাথে মজা করছি বলে তোমার মনে হয়??”
—-“ ও মা তা হবে কেন??আমি কি একবারো এমন কথা বলেছি।”ওয়াসেনাত মুখ টিপে হাসলো।
অরিত্রান কঠিন চোখে তাকায়।দাঁতে দাঁত চাপে।ওয়াসেনাত হাসে।অরিত্রান রেগে বললো,
—-“ এসব ভালো লাগছে না আমার।”
—-“ আরে উত্তর বললেই হয়।”
—-“ তুমি কি বোকা??১৯ যে বড় সংখ্যা সেটা তুমি জানো না??”
ওয়াসেনাত হাসলো।দু’পাশে হাত দিয়ে পা নাচাতে লাগলো।অরিত্রান উঠে যেতে চায়।ওয়াসেনাত হাত টেনে বসিয়ে দেয়।বলে,
—-“ এত তাড়া কিসের বসেন না একটু।”
অরিত্রান বসলো।চুপ করে বসেছে।ওয়াসেনাত সামনে চোখ রেখে বললো,
—-“ আপনাকে চিনি প্রায় ১বছরের কাছা কাছি সময় নিয়ে।কিন্তু ১৯ বছর আমার বাবা আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছে।তার বিনিময়ে আমি কিছুই দিতে পারিনি।বাবা যদি সত্যি আপনার আর তার মাঝে কাউকে বেছে নিতে বলে আমি বাবাকেই নিবো।আমার মন বলে যে একবার জন্ম দেয় তার একবার মারারও অধিকার থাকে।অনৈতিক অধিকার।কিন্তু অধিকার থাকেই।সেই হিসেবে আপনার হাত ধরা মানে আমি নিজে অপরাধি।আপনার হাত ছাড়লেও আমি অপরাধি।কি করবো বলেন ১৯বছরের ভালোবাসার কাছে আমি ঋণী।পৃথিবীতে বাবা মা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে।আমরা তাদের কিছুই দিতে পারিনা।এই যে আমার শরীর ,রক্ত সবই বাবার পরিশ্রমে তৈরি।বাবা শুধু টাকাই রোজগার করে না।আরো অনেক কিছুই করে।বাবা মার ভালোবাসা কি তা আমার চাইতে আপনি ভালো বুঝবেন।কারন আপনি হারিয়েছেন।হারানো জিনিস যে কত মূল্যবান হয় ,তা হারিয়ে বুঝা যায়।আমি মাকে হারিয়েছি বাবাকে হারাতে চাই না।তাই বাবাকে ছাড়তে পারবো না।বাবার ভালোবাসা আমার কাছে খুবই মূল্যবান।”
অরিত্রান ঘাড় কাত করে বললো,

—-“ আর আমার ভালোবাসা???”
ওয়াসেনাত আর একটু ঘেঁষে অরিত্রানের কাঁধে মাথা রাখে।অরিত্রান চমকে উঠে।কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে পরে সে।ওয়াসেনাতের চোখে পানি ।সেই পানি অরিত্রানের লাল শার্টে পরে কালো আকাড় ধারন করছে।ওয়াসেনাত নিজের হাত দিয়ে পেচিঁয়ে ধরে অরিত্রানের বাহু।কম্পিত গলায় বলে,
—-“ আপনি আমার কাছে আমার মায়ের মত।যানেন মাকে আমি কখনো বলিনি মাকে আমি কতটা ভালোবাসতাম।কতটা কাছে পেতে চাইতাম।মা যখন অফিসের কাজে বাহিরে যেত অনেক দিনের জন্য,মা আমাকে জড়িয়ে কান্না করতো।আমি হেসে তাকে বিদায় দিতাম।কখনো তার সামনে আমি কাঁদিনি।এটা নিয়ে মা ভারি আফসোস করতো।বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে বলতো আমার মেয়ে আমাকে একটুও ভালোবাসে না।একটুও না।তখন আমি মিটমিটিয়ে হাসতাম।মাকে ভালোবাসি বলাই হয়ে উঠলো না।তার আগেই তিনি আকাশের তারা হয়েগেছে।কিন্তু মায়ের নিথর দেহকে আমি বলেছিলাম আই লাভ ইউ মা।তুমি পৃথিবীর বেষ্ট মা।মা কি শুনেছে??আচ্ছা মারা গেলে মানুষ আমাদের কথা শুনে???যদি শুনে যদি দেখে মা যানবে আমি তাকে কত ভালোবাসতাম।বাবার থেকেও একটু বেশি।”
ওয়াসেনাত কান্না মাখা চোখে হাসে।অরিত্রান সেই হাসির শব্দ শুনতে পায়।কিন্তু চেহারা দেখতে পাচ্ছে না।ওয়াসেনাত থেমে বললো,
—-“ আমিও চাই আপনি আমাকে আপনার মা বাবার মত ভালোবাসেন।”
অরিত্রান অবাক হয়ে বললো,
—-“ আমি আমার বাবা মাকে কতটুকু ভালোবাসি তুমি কিভাবে যানলে???”
ওয়াসেনাত হাসলো।বললো,
—-“ সেটা বলা যাবে না।তবে আমি চাই আপনি ঠিক একুই ভাবে আমাকে ভালোবাসেন।ভালোবাসি বলে নয় বুকে ধারন করেন।যদি সত্যি এমন কোনো সময় আসে আমার দু’জনে দুই প্রান্তে থাকি।তবুও যাতে আপনি তাদের মত করেই আমাকে অনুভব করেন।আমি এই ভালোবাসা চাই।”
কিছু সময় অরিত্রান চুপ থেকে বললো,
—-“ভালোবাস মানে ভয়।
রাশি রাশি ভয় যেনো হু হু করে বুকের বাঁ পাশের পাজরে এসে আটকা পড়ছে।
মনে হচ্ছে কোথাও যেনো নিজেকে খুজেঁ পাই না
সব জায়গায় তোমার প্রতিচ্ছবি ভাসে।
মনে হয় তুমি হীনা সব ব্যর্থ।
হ্যা আমি ভয় পাই।
বড্ড ভয় পাই।
ভয় পেয়ে চাতক পাখির মত আনছান আনছার করে মন।ভালোবাসা আমাকে কবি সাহিত্যিক গড়ে না তুললেও আমি ভয়ের কবিতা নিজের মনে আঁকি।বিড়বিড় করে শুধু তোমাকে হারানোর ভয় পাই।মন আউড়াতে থাকে।তোমার হৃদয়ে একটু জায়গা পাওয়ার লোভে আমি লুভি হয়ে ঘুরে বেরায়।কি থেকে যেনো কি হয়েগেলো।পাথরের বুকে তুমি ফুল হয়ে এলে।কেনো এলো?? ভয় জাগানোর জন্য??”
ওয়াসেনাত কিছুই বললো না।হাতে মুখ ঘঁষে নিয়ে আবার মাথা রাখলো।অরিত্রান ওয়াসেনাতের কোমড় পেচিঁয়ে বললো,
—-“ আমার সাথে একবার এক লোকের দেখা হয়েছিলো।নাম আযমান।অসম্ভব সাহসি বুঝলে??প্রথমে তো আমি নিজেই খানিকটা ভড়কে গেলাম।শত হোক অরিত্রান খানের একটা নামডাক আছে।সেই লোক তো আমার নাম ডাক সব ডুবিয়ে বুক উঁচিয়ে দাড়িঁয়ে পরলো।মাথায় রিভলবার ধরেও লাভ হলো না।সে তো পুরাই সটাং হয়ে দাড়িঁয়ে ছিলো।না পারতে আমি শুট করেই দিচ্ছিলাম।তখনই একটা বাচ্চা এসে হাজির।হাতে তার আম।ডুলে ডুলে হাঁটছিলো।ঠিক তখনই আযমান শেখের অবস্থা দেখার মত ছিলো।ভয়ে চুপসে গেছে একদম।তারপর পরই তার বউ এসে হাজির।শেষ তার তো প্রান উড়ে যায় যায় অবস্থা।এতো ভয় দেখে আমি আবার ভড়কে গেলাম।কিন্তু সেই ভয়টা আমি আজ নিজে ফিল করতে পারছি।ভয়ংকর অনুভুতি পরীজা।একদম ভয়ংকর!!!নিজের জীবন যাওয়ার চাইতেও মারাত্নক এই অনুভুতি।”
ওয়াসেনাত মাথা তুলে বললো,
—-“ এতো ভয় পাচ্ছেন কেন বলেন তো??আমার বাবা খুবই ভালো মানুষ।হ্যাঁ আপনাকে তিনি পছন্দ করে না।কিন্তু আমাকে খুবই ভালোবাসে।”
অরিত্রান ওয়াসেনাতের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
—-“ তোমার হিটলার বাবার চোখ দেখেই আমি অবাক হই।এতো বয়স হয়েছে তবুও তেজ কমেনি।ভয়ংকর মানুষ তিনি।সমস্যা কিন্তু সেটা না।তোমার বাবা !!এই কথাটায় সমস্যা।যাই হোক রাজি না থাকলে তুলে নিয়ে আসবো।এমনেও আমি ভিলেন।কাজটা আমার সাথে মানান সই।”
ওয়াসেনাত অরিত্রানের বাহুতে হাতের নুখ দিয়ে খাঁমছি দেয়।চোখ রাঙিয়ে তাকায়।বলে,
—-“ বাবাকে নিয়ে নো উল্টাপাল্টা কথা।যদি বলেন এভাবেই খাঁমছি দিবো।
অরিত্রান চোখ উঁচিয়ে বললো,

—-“ তোমার কি মনে হয় এই হালকা খামঁছিতে আমার কিছু হবে??মোটে ও না বুঝলা।পুঁচকি একটা মেয়ে আসছে আমারে খাঁমছি দিতে!!”
ওয়াসেনাত চোখমুখ লাল করে অরিত্রানের আরো কাছে চলে আসে।আচমকা দাঁত বসিয়ে দেয় অরিত্রানের বাহুতে।অরিত্রান চমকের উপরে চমকিত হয়ে পাশ ফিরে তাকায়।ওয়াসেনাত কামড়ে ধরে রাখে।অরিত্রান প্রথমে অবাক হলেও পরে আর অবাক হলো না।চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকায় সে।ওয়াসেনাত পর পর তিনটা কামড় বসিয়ে অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায়।অরিত্রানের কোন রিয়েক্সান নেই।সে স্বাভাবিক।খুবই সহজ হয়ে সে বসে আছে।ওয়াসেনাত বিরক্ত হয়ে হাত ছেড়ে দেয়।মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
—-“ আপনি কি একটুও ব্যাথা পাচ্ছেন না???”
অরিত্রান চোখ ছোট করে ওয়াসেনাতের দিকে তাকায়।হাত দিয়ে নাক টেনে বললো,
—-“ আমি সকাল বিকাল জিম করি এই কামড়ে কিছু হবে না।তবে তুমি যে আমাকে এতোগুলো কামড় দিয়েছ এতে আমারও কামড়াতে ইচ্ছে করছে।”
ওয়াসেনাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
—-“ আপনি কাকে কামড়াবেন??”
অরিত্রান একটু কাছে ঘেঁষে ওয়াসেনাত সরে বসে।অরিত্রার আর একটু কাছ ঘেঁষে বসে।ওয়াসেনাত আরো পিছিয়ে যায়।অরিত্রান দু’হাতে ওয়াসেনাতের মাথা টেনে কপালের মাঝ রবাবর চুমু বসিয়ে দেয়।লাফিয়ে উঠে দাড়ায় সাথে সাথে।হাসতে হাসতে বলে,
—-“ আজকের জন্য খাঁমছি ,কান্না,কামড়ানো এনাফ।চলো বাসায় পৌছে দিয়ে আসি।”
ওয়াসেনাত থ বনে বসে আছে।অরিত্রানের ফোন বেজে উঠে।রিসিভ করে কানে দেয় সে।উত্তেজিত হয়ে বলে,
—-“ stephen ,have you done the job you were given??”
ও পাশ থেকে কি কথা হয়েছে তা ওয়াসেনাতের কানে এলো না।অরিত্রানের মুখ চকচক করে উঠেছে।সে বেশ শব্দ করেই বললো,
—-“ Today’s party is successful.I’m telling you today what I never told anyone.Thank you stephen.you don’t know what you have done for me.Especially for my life.”
অরিত্রান ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে একটা অনুভুতি মিশানো হাসি দেয়।ওয়াসেনাত ও হাসে কিন্তু কেন সে নিজেও জানে না।স্টেফেন হেসে অরিত্রানকে বললো,
—-“ It’s a matter of luck for me to be able to do something for you. Well, what should I do now ?? What will Ihan and Iman do ??”
অরিত্রান বিরক্ত হলো।তার পরের কাহিনী সে কাউকে যানতে দেয় না।তাই কঠিন গলায় বললো,
—-“ You don’t need to know that. You will get the money. Go back to your own country. You have no more work here. I hope you understand.”
স্টেফেন হাসলো।বিদায়ের সুরে বললো,
—-“ I understand too much. Anyway, I’m leaving tomorrow. Goodbye.
অরিত্রান আর কিছু বললো না।ফোন পকেটে নিয়ে ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-“ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।কালকে দেওয়া হবে।এখন আমি আসি।আমার খুবই গুরুত্বপূর্ন্য কাজ আছে।আমি যাচ্ছি।তুমি রিমির সাথে চলে যাবে ওকে??”
ওয়াসেনাত মাথা দুই দিকে দুলালো।যার অর্থ হ্যাঁ।

_____________________
রাতের কালো আকাশের নিচে হলুদ,সবুজ বাতি জ্বলছে।বাতির পাশ ঘেঁষে হেসে চলেছে ওয়াসেনাত।এক হাতে তার হালকা গোলাপি হিল।আর এক হাতে তার নিজের লম্বা গাউন উচিঁয়ে হাঁটছে সে।মুখে বিড়বিড় করে বকা ঝকা করছে নিজের ভাগ্যকে।আজকে কপালটা এতো খারাপ হবে সে জানতো না।বিরক্তিতে তার মুখ যতটা না কুঁচকে আছে কষ্টে তার পা এর চেয়েও বেশি ব্যথা হচ্ছে।অরিত্রান যাওয়ার পরে সে ভিতরে ডুকে দেখলো রিমিরা সবাই চলে গেছে।তাদেরও দোষ নেই।ভেবেছে ওয়াসেনাত হয় তো অরিত্রানের সাথে যাবে।কিন্তু ওয়াসেনাত যে এখানেই রয়ে গেছে কিভাবে যানবে।ওয়াসেনাত গেট থেকে একটা সিএনজি নিয়ে চলে আসতে চেয়েছে।কিন্তু অরিত্রানের কড়া নিষেধ তাকে একা যেতে যাতে না দেয়।ব্যস বাড়ি থেকে গাড়ি নিতে হয়েছে।সেই গাড়ি কিছুটা এসে থেমে গেলো।ওয়াসেনাত আর কি করবে সিএনজি খুজতে খুঁজতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।হিল পরে পিছঢালা রাস্তায় ঘুরা মোটেও সহজ না।তাই হিল হাতে নিয়েছে সে।তার উপরে এই জামা।ওয়াসেনাত বেশ ঝামেলায় আছে।এভাবে সে এতো রাতে রাস্তায় আগে কখনো ঘুরে বেড়ায় নি।রাস্তা একদম শান্ত।ভয় ভয় লাগছে তার।ঠিক সেই সময় ওয়াসেনাতের ভয় হাজার গুন বাড়িয়ে দেয় রাস্তার কোনায় বসে বসে মদে বুদ হওয়া কিছু ছেলে।ওয়াসেনাতের বুক ভয়ে ধক্ ধক্ করে শব্দ করছে।দু’হাত বুকে চেপে ওয়াসেনাত কিছুটা পাশ কাটিয়ে যেতে চায়।ছেলেগুলোর চোখ তখনো ওয়াসেনাতের উপর পরেনি।ওয়াসেনাত পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ই একটা ছেলে তাকে দেখে ফেলে।চেঁচিয়ে বলে,
—-“ আরে লাল পরী যে??কই যাও লাল সন্দরী??”
ওয়াসেনাত জবাব দেয় না।পা দ্রুত চালানো শুরু করে।
ছেলে গুলো একে একে বসা থেকে উঠে দাড়ায় ।ওয়াসেনাত ভয়ে ভয়ে চোখ বুজেই দ্রুত হাঁটে।ছেলে গুলোও দ্রুত হাটেঁ।ওয়াসেনাত মনে মনে দোয়া করে আল্লাহ্ এই যাত্রায় বাচিঁয়ে দেও আই প্রমিস একা একা কাবিলতি দেখিয়ে রাস্তায় আসবো না।প্লিজজজ আজ বাচিঁয়ে দেও।ওয়াসেনাত জামা আরো উঠিয়ে নেয়।ছেলে গুলো দ্রুত এসে পাশে পাশে হাটেঁ।ওয়াসেনাত না তাকিয়ে দ্রুত হাটঁতে চায়।একটা ছেলে এগিয়ে এসে পথ আগলে দাড়াঁয়।ওয়াসেনাত ভয়ে আড়ষ্ট মুখে তাকায়।ছেলেটা নিজের ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে ওয়াসেনাতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয়।ওয়াসেনাত নিজের জামা ছেড়ে দাড়ায়ঁ।জামা উঁচিয়ে রাখার জন্য তার পায়ের অনেক অংশ দেখা যাচ্ছে।শুষ্ক ঠোঁটে ওয়াসেনাত বিড়বিড় করে আল্লাকে ডাকছে।ছেলেটা বিশ্রী করে হেসে বললো,
—-“ ভাইরে ভাই মাইয়া তো না একখান খাঁসা জিনিস।”
তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে বাকি ছেলেরা।ওয়াসেনাতের কান্না কান্না অবস্থা।সে ভুলেই গেছে তাকে এখান থেকে পালাতে হবে।ভয়ে হাত পা কাপঁছে তার।থরথর করে সেই কাঁপনি বাড়ছে।আর একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো,
—-“ এরে তো আমারই আগে লাগবো।ও সুন্দরি তোমার নাম কি??”
ওয়াসেনাত কিছু বললোনা।ভয়ে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।ছেলে গুলো একে অপরের দিকে চাওয়া চায়ি করে বললো,
—-“ কান্দো কা মাইয়া।আমরা কি তোমারে কিছু করছি??না কি হাত লাগাইছি।এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্দো ক্যান??”
ওয়াসেনাত আরো জোড়ে কেঁদে উঠলো।ফুঁফিয়ে বললো,
—-“ আমাকে যেতে দিচ্ছেন না কেন??রাস্তা ছাড়েন!”
সবাই আবার হাসতে লাগলো।একজন বললো,
—-“ মাইয়া মানুষ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবা আবার আমাগো কইবা ছাইড়া দিতে??হ্যাডা তো হইবো না।রাস্তায় আইছো কা!!এবার আমগো লগে চলো সুন্দরি।”
ওয়াসেনাত ভীতু গলায় বললো,
—-“ আমি আপনাদের সাথে কেন যাবো আমি বাসায় যাবো।”
—-“ পরে যাইয়ো।আগে আমগো লগে চলো।চলো!”
একটা ছেলে ওয়াসেনাতের দিকে এগিয়ে আসতেই ওয়াসেনাত হিল গালে বসিয়ে দেয়।ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠে পাশে সরে যায়।ওয়াসেনাত আবার জামা উঁচিয়ে দেয় এক দৌড়।পিছনে তাকিয়ে তাকিয়ে দৌড়াচ্ছে সে।সামনে একটা বাইক এসে সাই করে তার সামনে থামে আর একটুর জন্য ওয়াসেনাতের গায়ে উঠে যেত বাইক।ঠিক সময়ে থামানো হয়েছে তবুও ওয়াসেনাত ধপ করে নিচে বসে পরে।পায়ে ব্যথা পায় সে।ওয়াসেনাত শব্দ করে হাত পা ছুঁড়ে কেঁদে উঠে।অরিত্রান দ্রুত বাইক পাশে ফেলে ছুটে আসে।ওয়াসেনাতে কেঁদে কেঁদে বলছে,
—-“ আজকে দিনটাই খারাপ গেলো।কেন যে আজ বাসার বাহিরে আসতে গেলাম।আমার পা!!!”
অরিত্রান উত্তেজিত হয়ে বললো,
—-“ কোথায় ব্যথা পেয়েছো??দেখি তো??”
ওয়াসেনাতের কানে অরিত্রানের গলার শব্দ আসতেই কান্না বন্ধ করে সে উপরের দিকে মুখ তুলে তাকায়।অরিত্রানের গায়ে কালো জ্যাকেট।হাতে বাইক হ্যান্ড গ্লাভস।এক হাতে কালো হেলমেট।বাইক রাইডার লাগছে তাকে দেখতে।ওয়াসেনাতের সামনে এক হাঁটু ভাঁজকরে বসে আছে সে।চোখে মুখে আতঁক।ছেলে গুলো হাপাতে হাপাতে এসে অরিত্রানের পাশ ঘেঁষে দাড়াঁয়।ওয়াসেনাত আশেপাশে না তাকিয়ে অরিত্রানের গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।ফুপিঁয়ে কেঁদে উঠে সে।অরিত্রান একহাতে জড়িয়ে নেয় ওয়াসেনাতকে।হাত বুলিয়ে বলে,

—-“ তুমি এখানে কি করছো??তাও এতো রাতে??ড্রাইভার তো ওই দিকে।তুমি এখানে কি করছো??”
ওয়াসেনাত কেঁদেই চলেছে।ছেলেগুলোর থেকে একজন বললো,
—-“ ও ভাই এইডা আমগো জিনিস তুই কই থেকে নামলি??সে যাই হোক ছেড়ে দে তো।দে দে।এই সব ঝাঁমেলায় না পরাই ভালো তাোর জন্য।যা তো।”
কথাটা বলে ওয়াসেনাতের দিকে হাতবাড়িয়ে দেয়ে।অরিত্রান হাত মোছড়ে ধরে।কঠিন চোখে তাকায় ছেলেগুলোর দিকে।আলো তেমন নেই এদিকে।ছেলেটার হাত পেচিঁয়ে নিতেই সে চিৎকার করে উঠে।পাশ থেকে একটা ছেলে ফোন বের করে অরিত্রানের মুখের দিকে লাইট দেয়।অরিত্রানের রক্ত লাল সবুজ চোখ দেখেই চেঁচিয়ে বলে,
—-“ আরে এতো অরিত্রান খান।স্যরি বস আমরা ভুল করে ভুল মাইয়াই হাত দিছি।স্যরি বস।”
অরিত্রান ওয়াসেনাতকে আর এক পাশে নিয়ে আবার হাত মোছড়ে নেয়।ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠে।কুইয়ে উঠে বলে,
—-“ স্যরি বস মাফ চাই।মাফ করেন।”
অরিত্রান হাত পিছনের দিকে নিয়ে বললো,
—-“ তোর জিনিস না???”
ছেলেটা ছুঁটতে চাচ্ছে।অরিত্রান এমন ভাবে ধরে আছে হাত ছিঁড়ে যাবে যাবে।বাকি সবাই দৌড়ে পালালো।ওয়াসেনাত এমন বাঁকা হাত দেখেই অরিত্রানের জ্যাকেট খাঁমছে ধরে।অরিত্রান ছুড়েঁ দিয়ে বললো,
—-“ তোদের পরে দেখছি।”
ছেলেটা খুড়িঁয়ে খুঁড়িয়ে দেয় এক দৌড়।অরিত্রান ওয়াসেনাতের পা নিজের হাতে নেয়।ওয়াসেনাত চেঁচিয়ে বললো,
—-“ আমার ব্যথা লাগে!!”
অরিত্রান চোখ রাঙিয়ে বললো,
—-“ তুমি রাস্তায় একা একা কি করছো পরীজা??”
ওয়াসেনাত আমতা আমতা করে বললো,
—-“ ও ইয়ে মানে কি আর করবো হাঁটছিলাম!!”
—-“ শেট আপ।একটু দেরি হলে কি হতো তুমি জানো??রাস্তায় এতো রাতে ঘুরা কি উঁচিত??আর গাড়ি নিয়ে এসেছো না তুমি??তাহলে রাস্তায় কেন হাটঁছো??হোয়াই??আনসার মি??”
—-“ আমার কি দোষ গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।”
—-“ আর একটা তো আনিয়ে নেওয়া যায় না কি??ড্রাইভারকে রাস্তায় না দেখলে আমি কি আদো তোমাকে খুঁজতে আসতাম??তখন কি হতো??”
অরিত্রান ওয়াসেনাতের পা দু’পাশে মোছড়ে দেয়।ওয়াসেনাত আর্তনাদ করে উঠে।চেঁচিয়ে বলে,
—-“ এতো জোড়ে দেন কেন??ব্যথা লাগে তো।””
অরিত্রান রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত হেসে বললো,
—-“ আমি জানতাম আমাকে কেউ না কেউ হেল্প করতে আসবেই।”
অরিত্রান বাইক উঠাতে উঠাতে বললো,
—-“ তুমি কি ভবিষ্যৎ জানো??”
ওয়াসেনার জামায় হাত মুছে নেয়।জুতো খুঁজে নিয়ে বললো,
—-“ আরে না।আমার আল্লাহর উপরে অনেক বিশ্বাস ছিলো।মন থেকে ডাকলে তিনি সব শুনে।আর আমি একদম মন থেকে ডেকেছি তাই তো আপনাকে পাঠিয়েছে।”
অরিত্রান চোখ মুখ কঠিন করে রেখেছে।এই শয়তান গুলো থেকে হিসাব নিতে হবে আজই নিবে সে।ওয়াসেনাত ভীতু হয়ে বললো,
—-“ আমি যাবো কিভাবে??”
অরিত্রান বাইকের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
—-“ কিভাবে যাবে মানে???”
—-“ আপনি তো বাইক দিয়ে চলে যাবেন আর আমি??”
অরিত্রান হাসলো।ওয়াসেনাত উল্টানো ঠোঁট দেখে এই মাঝ রাস্তায় তার মাথায় নিষিদ্ধ চিন্তা আসছে।অরিত্রান মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
—-“ বাইকে উঠে বসো??”
ওয়াসেনাত চোখ বড় করে বললো,
—-“ না না আমার ভয় করে।”
—-“ আমি আছি তো কিসের এতো ভয়।আমি থাকতেও ভয় লাগছে তোমার??”
আমি আছি শব্দে ওয়াসেনাত নিজের নিরাপত্তা খুঁজে পাচ্ছে।খুব নিরাপদ লাগছে নিজেকে।অরিত্রানের বাহুতে হাত রেখে ওয়াসেনাত উঠে বসে।তার কম্পিত হাত নিজের বাহুতে চেপে নেয় অরিত্রান।কম্পন গতি দেখে নিজে নিজে হাসে সে।

_______________________________
বাইক চলছে ধীর গতিতে।এতো অল্প গতিতে অরিত্রান তার জীবনে কখনো বাইক চালিয়েছে কি না তার জানা নেই।ওয়াসেনাতের কড়া নিষেধ জোড়ে চালানো যাবে না।আস্তে চালাতে হবে।অরিত্রান সেই হুকুম পালন করছে।ওয়াসেনাত অরিত্রানের পেট জড়িয়ে পিঠে মাথা ঠেকিয়ে আছে।বাতাস হচ্ছে আস্তে।তবুও ওয়াসেনাতের মনে হচ্ছে তার গা জুড়ানো বাতাস হচ্ছে।চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে।বাতাসে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ ভাসছে।চাঁদটা লুকিয়ে লুকিয়ে উঁকি দিচ্ছে।ঝিরিঝিরি বাতাসে ওয়াসেনাতের হেজাবের খোলা অংশ উড়ছে।অরিত্রানের গায়ে কালো পাতলা টি-শার্ট।ওয়াসেনাতের কোমড় পেঁচিয়ে আছে তার কালো জ্যাকেট।খুলে রেখেছে অরিত্রান।ওয়াসেনাত যে তার গায়ের সাথে এত সহজে লেপ্টে যাবে এটা ভাবেনি সে।দারুন একটা হৃদয় কাঁপানো অনুভুতি হচ্ছে তার।মনে হচ্ছে বাতাসের সাথে মিশে শরীরে একটা উষ্ণ ভাব প্রবেশ করছে।উত্তপ্ত একটা হাওয়া পিঠে আছড়ে পরছে।পিনপিনের নীরব পরিবেশকে ঝাপিয়ে দু’জনেই নিজেদের উষ্ণ নিঃশ্বাসের টের পাচ্ছে।উপভোগ করছে উত্তাপ।ওয়াসেনাতের ভারি নিঃশ্বাসের তাপ পেয়ে অরিত্রান চমকালো।নীরবতা ভেঙে মৃদু কন্ঠে ডাকলো,
—-“ পরীজা???”
ওয়াসেনাতের তেমন শব্দ নেই।সাড়াও নেই।অরিত্রার বাইক থামাতেই ওয়াসেনাত ঝুঁলে পরতে থাকে।অরিত্রান হাত পিছনে নিয়ে আকঁড়ে ধরে।সে স্তব্ধিত!!ওয়াসেনাত ঘুমিয়ে পরেছে??অরিত্রান শিহরিত,বিমোহিত,চমকিত,অবাকিত।সে ভাবতে পারছে না এই অদ্ভুত একটা সময়ে ওয়াসেনাত ঘুমিয়ে পরলো কিভাবে??ওয়াসেনাতকে কয়েক বার মৃদু গলায় ডেকে অরিত্রান আরো অবাক??এখনো উঠছে না?একটু ঝাকিঁয়ে দিতেই ওয়াসেনাত হকচকিয়ে উঠে বললো,
—-“ কি হয়েছ??”
ওয়াসেনাতের ঘুম ঘুম কন্ঠ শুনে অরিত্রানের মায়া হলো।বাইক নিয়ে কেন বের হয়েছে সেটাতেও রাগ হলো।গাড়ি হলে তো সে কখনোই ওয়াসেনাতকে উঠাতো না।বাইক থেকে পরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই তো সে ডেকেছে।ওয়াসেনাত চোখ কচলায়।অরিত্রান সেই দৃশ্য দেখে হাসলো।ওয়াসেনাত একটু অবাক হয়ে বললো,
—-“ হাসছেন কেন??”
—-“ ভুলে গেছি!” হাসি রেখেই বললো অরিত্রান।
—-“ কি ভুলে গেছেন??”
অরিত্রান হাসলো।ওয়াসেনাত চোখ ছোট ছোট করে তাকালো।অরিত্রান আবার বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
—-“ কেন হাসছি তাই ভুলে গেছি।তোমার সাথে থাকলে আমি নিজের নামও ভুলে যাই।কি যাদু করেছ বলো তো??”
ওয়াসেনাত অরিত্রানের পেট জড়িয়ে আবার পিঠে মাথা রেখে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
—-“ কে জানে?আমিও ভুলে গেছি।”
অরিত্রান হাসলো।দু’হাত আরো টেনে বললো,
—-“ আমি জানি।এর নাম ভালোবাসার জাদু।”
#চলবে__________
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
@হাফসা_____