পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 21

__________________
—” ক্ষমা করা মহান গুন হলেও আপনাকে করা যাচ্ছে না।”
অরিত্রান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ওয়াসেনাত আবার হাঁটে।ভাবখানা এমন যে অরিত্রানকে সে চিনেই না।অরিত্রান পা মিলেয়ে চলতে চলতে বললো,
—” ওটা প্রকাশ করা আমার কাজ ছিলো। এখন করা না করা তোমার কাজ।কোথায় যাওয়া হচ্ছে??”
ওয়াসেনাত তাকালো না।জবাব ও দিলো না।অরিত্রান একুই প্রশ্ন দু’বার করতে পছন্দ করে না।তবুও তাকে ইদানীং এই কাজটা করতে হয়।অরিত্রান পাশাপাশি হাঁটছে।ওয়াসেনাত কিছুটা হেঁটে থেমে যায়।ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
—” পিছনে পিছনে কি করছেন??আমার সাথে যাবেন নাকি??”
অরিত্রান পকেটে হাত গুঁজে বলে,
—” নিতে চাইলে কেনো নয়!!”
ওয়াসেনাত রেগে বলে,
—” এই আপনার আর কাজ নেই?আমার পিছনে পিছনে কি করছেন??আর আপনি আমার বাসা চিনলেন কিভাবে??”
অরিত্রানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়।ভাবে,কি বলবে এখন?বাসার ঠিকানা জোগাড় করা অরিত্রান খানের জন্য কোনো ব্যাপার না হলেও এটা নুহাশের জন্য পসিবল না।ওয়াসেনাত ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বললো,
—” আপনার মতলব কি বলেন তো??যা আপনি দেখান তা আপনি নন!আর যা আপনি দেখান না তাও আপনি না।আসলে আপনি কে বলুন তো??”
অরিত্রান হালকা হাসে।হাসি মুখে রেখে চোখ বাঁকিয়ে ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
—” আমাকে নিয়ে এত গবেষণা চালিয়েছ তুমি?গুড ভেরী গুড। ব্যাট কেনো??”
ওয়াসেনাত চুপসে যায়।সে যে অরিত্রানকে নিয়ে সারাদিন রাত ভাবে এটা তো বলা যাবে না।অরিত্রান আবার হাসে।ওয়াসেনাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলে,
—” আপনি সব সময় এভাবেই হাসবেন।হাসলে আপনাকে মারাত্মক লাগে।আমার দেখা প্রথম পুরুষ যার হাসিতে অদ্ভুত ছোঁয়া আছে।অদৃশ্য সেই ছোঁয়া।”
অরিত্রান হাসলো।বললো,
—” তাই!তাহলে এর বিনিময়ে আমি কি পাবো?”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক গলায় বললো,
—” কি পাবেন মানে কি??হাসলে আমাকে না আপনাকে সুন্দর লাগে।আর আপনার সৌন্দর্যে তো আপনার লাভ।হাজারো মেয়ে ফিদা হবে।”
অরিত্রান গম্ভীর গলায় বললো,
—” সব মেয়েকে ফিদা করে আমার লাভ কি?”
ওয়াসেনাত হাঁটা শুরু করেছিলো।আবার তা থামিয়ে বললো,
—” লাভ কি মানে??অবশ্যই লাভ আছে।ছেলেরা তো অনেক মেয়ের সাথেই প্রেম করতে চায়।হাজার মেয়ে ফিদা হলে সেদিকে আপনার লাভ না!”
অরিত্রান যেন এবার নিজের রূপ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছে।নতুন রূপ নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে ওয়াসেনাতের সামনে।নিজের প্রতি তার নিয়ন্ত্রণ নেই।অভিজ্ঞ গলায় সে বলে,
—” প্রেম বহু বার করা যায়।হাজার বার প্রেমে পড়া যায় সবাইকে ভালোবাসা যায় না।সব ভালোবাসায় প্রেম থাকে কিন্তু সব প্রেমে ভালোবাসা থাকে না।কিছু প্রেমে থাকে মোহ্, কিছুতে থাকে মুগ্ধতা, কিছু প্রেমে থাকে সময় অপচয় করা।আর সেই “কিছু” নামক জিনিস সরে গেলেই ফুরিয়ে যায় প্রেম।তাই প্রেমে পড়লে আমার কোনো লাভ নেই।যা চাই তা হলেই হবে।”
ওয়াসেনাত চমকে,অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।এই লোকের মুখে হঠাৎ এত ভয়ংকর কলিজা কাঁপানো কথা কোথা থেকে এসেছে?ভূতে ধরেছে নাকি?না কি প্রেমে?অরিত্রান নিজেও অবাক।মেয়েটার আশেপাশে থাকলেই সে অদ্ভুত কাজ করে।এই সব ভাষা না সে শুনেছে কখনো আর না বলেছে।তাহলে আজ হলোটা কি?ওয়াসেনাত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,

—” আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে।আপনার আগের কথা “ডাবল ইম্পসিবলে” আমি বিশ্বাস করিনা।”
অরিত্রান হাসলো।সামনে হেঁটে যেতে যেতে বললো,
—” মিথ্যা বলতে যাবো কেনো?গার্লফ্রেন্ড নেই।হয় তো অন্য কিছু আছে।”
ওয়াসেনাত হতবাক হয়ে বললো,
—” আজ আপনার কি হয়েছে বলবেন??”
অরিত্রান চোখ ঘুরিয়ে বললো,
—” কেনো??”
—” অদ্ভুত আচরণ করছেন।এই যেমন, হাসছেন!অনেক কথা বলছেন!আর কেমন একট….”
ওয়াসেনাত থেমে যায়।অরিত্রান বলে,
—” কথাটা সম্পূর্ণ করো।”
—” আর কেমন একটা প্রেমিক প্রেমিক মনে হচ্ছে আপনাকে!অদ্ভুত তো বটেই।তিনদিন আগেও আপনাকে ভয়ংকর লাগতো আর আজ কেমন যেন?”
অরিত্রান জবাব দিলো না।শান্ত পায়ে কিছুদূর হেঁটে বললো,
—” পরিবর্তন ভালো নয় কি??”
ওয়াসেনাত শুধু হা করে তাকিয়ে আছে।এই লোকটাই কি সেই লোক যে তার হাত ভেঙেছে।ফোন ছুঁড়ে দিয়েছে। আরো কত কি?এত পরিবর্তন কেনো??প্রেমে পড়েছে তাই??কার প্রেমে??গার্লফ্রেন্ড আছে??অন্যকিছু মানে কি??ওয়াসেনাত প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছে।আচ্ছা এটা হতে পারে না তাকেই পছন্দ করে??কথাটা মাথায় আসতেই ওয়াসেনাত মিটমিটিয়ে হাসে।অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে সে।অরিত্রান মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে।কিছুসময় নীরবতা ছিলো দু’জনের মাঝে।নীরবতা ভেঙে অরিত্রান বললো,
—” এত ভাবছো কেনো??বেশি ভেবে ছোট মাথায় চাপ দিচ্ছ। তাও শুধু শুধু।”
ওয়াসেনাত নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে দেখে তারা মেইন রাস্তায় চলে এসেছে।অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে বলে,
—” আপনাকে নিয়ে ভাবছি না।”
—” তাহলে কাকে নিয়ে ভাবছো??”
বেশ উৎসুক হয়ে ওয়াসেনাত বলে,
—” ভালোবাসা নিয়ে।”
কথাটা শুনেই অরিত্রানের হৃৎপিন্ডে তীব্র ব্যথা হয়।মনে হচ্ছে সে ব্যথার বেগে ছিদ্র হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে।নির্বিকার গলায় সে বলে,
—” বয়ফ্রেন্ড আছে??”
ওয়াসেনাত হেসে ফেলে।অরিত্রান ভ্রু-জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে দেখে সে হাসি।ভাবে,ও কি অরূপকে ভালোবাসে??তাহলে অরূপকে খুন করে দিবে সে।সে অত মহান প্রেমিক হতে পারবে না।ত্যাগ!না সে ত্যাগী হতে পারবে না।অরিত্রান খান আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে পেয়েছে।এটা তো তার ভালোবাসার ব্যাপার।সত্যি অরূপকে সরিয়ে দিবে সে?ওয়াসেনাত হাসির গতি বাড়িয়ে বলে,
—” কেনো বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে না বুঝি?এই বয়সের সবারই থাকে।এটাই তো স্বাভাবিক। কি বলেন নুহাশ সাহেব??”
অরিত্রান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে।জবাব দেয় না।অরিত্রান অনুভব করে তার মনের সাথে মস্তিষ্কও ঠান্ডা নেই,রাগ হচ্ছে খুব।তীব্র রাগে ঝলসে যাচ্ছে তার ভিতরের সবুজ চোখজোড়া।ওয়াসেনাতের গাল লাল হয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনেক বাজে ভাবে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।হচ্ছে করছে বলতে, আমার বাদে তুমি অন্য কারো নও ওয়াসেনাত!কারো না!কিন্তু বলতে পারছে না।কিছু একটা গলায় আটকে আসছে বার বার।কেনো এমন হচ্ছে জানে না সে।ওয়াসেনাত হাসি থামিয়ে অরিত্রানের হাতে হালকা ধাক্কা দেয়।অরিত্রান একটু হকচকিয়ে যায়।ওয়াসেনাত বলে,
—” কি হলো?নিজের ভালোবাসার কথা মনে পড়ছে বুঝি??আচ্ছা চলেন আজ আপনার প্রেমকাহিনী শুনি।বলেন??”
অরিত্রান হা করে কিছুসময় ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” প্রেমকাহিনী তো শুরুই হলো না।”
ওয়াসেনাত চোখেমুখে হতাশা ফুটিয়ে বললো,
—” শুরু কেনো হলো না??”
—” বলা হলো না তাই।”
—” বলা হলো না কেনো??”
অরিত্রান খক খক করে হালকা কেশে দীর্ঘশ্বাস নেয়।ওয়াসেনাত উৎসাহে উজ্জীবিত হয়ে আছে।সাথে মনে এক রাশ হতাশা। শুরু হয় নি ভেবে হতাশা না। কোনো একটা কাহিনী আছে ভেবে হতাশ হচ্ছে সে। রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতেই একটা ছেলে ওয়াসেনাতের হাতের সাথে ধাক্কা দেয়।অরিত্রান রেগে আগুন হয়ে ওয়াসেনাতকে নিজের বাম পাশে টেনে নিয়ে আসে।আর ওয়াসেনাতের ডান পাশে সে দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাতের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বলে,
—” হাতে লেগেছে??”
ওয়াসেনাত আকর্ষীক কাজে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো।অরিত্রান ওয়াসেনাতের হাতের পাশে হালকা ছুঁয়ে বললো,
—” নিশ্চুয়ই লেগেছে।তুমি সত্যি খুব বোকা মেয়ে।রাস্তায় চলাফেরার সময় চোখ কান খোলা রাখতে হয়। জানো না??”
ওয়াসেনাত তাকিয়ে আছে।তেমন কিছু বলছে না।এত কেয়ার হঠাৎ?? আজব তো??লোকটার হয়েছেটা কি??পরক্ষনেই মনটা খারাপ হয়ে উঠে।ওয়াসেনাত গম্ভীর শব্দে বললো,
—” ছাড়েন।এটা রাস্তা।”
অরিত্রান ওয়াসেনাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারও হাতের বাহুতে হালকা ঘোঁষে বলে উঠে,
—” ছাড়বো না।”
ওয়াসেনাত উদ্বেগ নিয়ে বললো,
—” কেনো??”

অরিত্রান আর একবার চোখ তুলে বলে,
—” একবার যখন ধরেছি।ছাড়ার জন্য না।”
ওয়াসেনাত হা করে তাকিয়ে আছে।অরিত্রান হাত ছেড়ে আবার হাঁটে। ওয়াসেনাত তাল মিলিয়ে হাঁটে।মুখে হাসি।অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে সে হাঁটছে।কলাপাতা রঙের শার্ট গায়ে।ফর্সা হাতের উপরে ভাঁজ করে রেখেছে হাতাটা।লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে নিয়ম মেনে লেপ্টে আছে কপালে,চশমার উপরে।চশমাটা মাঝে মাঝেই নাকের ডগায় চলে আশে।কিছুক্ষণ পর পর অরিত্রান ডান হাতের অঙ্গুল দিয়ে ঠেলে সেটা ঠিক করে দেয়।ব্ল্যাক জিন্স।সাদা হাতে ছাই রঙের ঘড়িটাও চমৎকার সুন্দর মনে হচ্ছে ওয়াসেনাতের কাছে।ঘামে চকচক করছে শরীরের ভিঁজা অংশ গুলো।পিঠ,কাঁধ,বুকের সমনের অংশ।গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলোও মারাত্মক লাগছে।লোকটা সুন্দর!!নিখুঁত!! উনার যে হবে তাকেও নিখুঁত হতে হবে।সে কি নিখুঁত? না তো! সে স্মার্ট না,ফ্যাশেন্যাবল না,রং ঢং পারে না।ওয়াসেনাত হোঁচট খায় সামনের ইটের সাথে।অরিত্রান হাত বাড়িয়ে সামনে থেকে ধরে।তিক্ত মেজাজ দেখিয়ে বলে,
—” বোকা জানতাম।অন্ধ যে সেটা জানতাম না।এক্চুয়েলি তুমি কি এখনো অনেক জানা বাকি।এনিওয়ে কোথায় যাবে তুমি??বলো আমি দিয়ে আসি।”
ওয়াসেনাত ভ্রুকুঁচকে বললো,
—” আপনি কিভাবে দিয়ে আসবেন??”
—” গাড়িতে করে।এত বড় মেয়েকে কোলে নিয়ে দিয়ে আসা যাবে বলে তোমার মনে হয়?”
—” না তা মনে হয় না।তবে আমার ওজন বেশি না।চাইলেও নিতে পারেন।
অরিত্রান বেশ অবাক হয়ে বললো,
—” হোয়াট।”
ওয়াসেনাত দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—” কিছু না।তবে এই কোলে নেওয়া থেকে একটা কথা মনে পড়েছে।আমাকে একজন সবুজ চোখের মানব বাঁচিয়ে ছিলো।সে কিন্তু কোলে নিয়েই বাঁচিয়ে ছিলো।”
অরিত্রান হতবুদ্ধি হয়ে কিছুসময় তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ তাকেই কেনো এই কথা বলছে ওয়াসেনাত সে জানে না।ওয়াসেনাত আবার বললো,
—” তাকে একবার দেখার ইচ্ছে আছে।এত উপকার করেছে। কিন্তু চোখ খুলে আর দেখিনি।কোথায় যেন চলে গেছে।”
—” তাকে খুঁজে পেলে কি করবে??” অরিত্রানের ধীর গলা।
ওয়াসেনাত একটা বিশাল হাসি দিয়ে বলে,
—” ধন্যবাদ দিবো।”
অরিত্রান নাক ছিটকায়।মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,লাগবে না তোমার ধন্যবাদ,ডাফার একটা।ওয়াসেনাত কিছুটা এগিয়ে একটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
—” আপনার আর উপকার করতে হবে না।আমি কুঞ্জবাড়িতে যাবো।এই সেই বাড়ি।আপনি এখন যেতে পারেন।”
অরিত্রানের ইচ্ছে করছে না।বাড়িটার দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে সে।গেটের উপরে সাদা কালি দিয়ে লেখা কুঞ্জবাড়ি।অরিত্রান বললো,
—” এটা কার বাড়ি?”
—” আমাদেরই।”
—” ওহ্।”

ওয়াসেনাত গেটের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
—” বাই!”
অরিত্রান জবাব দিলো না।সামনে তাকিয়ে হাঁটা দিলো।ওয়াসেনাত পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,
—” ও হ্যালো সরিটার আনসার লাগবে না??”
অরিত্রান পিছনে তাকালো।হঠাৎ ফোনটা দেওয়ার কথা মনে পড়লো।কিন্তু কেনো যেনো দিতে ইচ্ছে হলো না।ছবিটা নিতে পারেনি সে।না নিলে দেখবে কিভাবে ওয়াসেনাতকে।নতুন ছবি তুলা পর্যন্ত এটাই তার সম্বল।তাই পিছনে তাকিয়ে কন্ঠে গাম্ভীর্য রেখে বললো,
—” প্রয়োজন নেই এখন। যখন ক্ষমার উপযোগী জিনিস ফিরিয়ে দিবো তখন আনসার জানতে চাইবো।”
ওয়াসেনাত খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।অরিত্রান গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।ওয়াসেনাত আবার হাক লাগিয়ে বলে,
—” আমার আম্মু বলে ক্ষমা মহান গুণ। কেউ ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিঁত। তাই আমিও করে দিলাম।”
অরিত্রান পিছনে মুড়ে তাকালো না।সামনে তাকিয়েই হাসলো।নরম হৃদয়ের মেয়ে।এত কিছু করার পরেও ক্ষমা করে দিলো।অরিত্রানের মনে হচ্ছে মেয়েটার সব কিছুতেই কোমলতা।ওয়াসেনাতের মনে হয়েছে হয় তো শুনেনি।সে ভিতরে ঢুকে পরে।
_____________________
—” বন্ধু হওয়ার জন্য নয় প্রপোজ করার জন্য পাঠিয়ে ছিলাম।আর তুই কি না বন্ধু হতে হাত বাড়িয়ে দিলি।আজব!”
অরিত্রান অফিসে এসেছে।অনেকগুলো কাজ জমে আছে। সেগুলো শেষ করছে।রিমন রুমে ঢুকেই কথাটা বলে উঠে।অরিত্রান তাকাচ্ছে না।নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“এত হাইপার হওয়ার মত কিছু হয়েছে কি?আমি কি একবারো বলেছি তোকে ওর সাথে প্রেম করতে চাই?তাহলে প্রপোজ কেনো করবো?”
—” মানে কি??ওকে তুই ভালোবাসিস এটা এখনো বুঝতে পাড়লি না??হায় আল্লাহ্‌ কি করলে বুঝবি তুই??”
অরিত্রান চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” ভালোবাসলেই যে ঘটা করে প্রপোজাল দিতে হবে এটা কোথাও লেখা নেই।যাকে ভালোবাসি তাকে বুঝাতে পারলেই হবে।দুনিয়া কাঁপিয়ে ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয় না।আমি এই কয়েকদিনে যা বুঝলাম তা হচ্ছে, ভালোবাসা সহজ না রিমন।আর তাছাড়া তুই আমার উপর গোয়েন্দাগিরি করছিস??হুয়াই??”
রিমন থমথমে হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
—” আরে ওটাকে গোয়েন্দাগিরি বলে না।ওটাকে বলে ইয়ে মানে নজর রাখা।তুই তো ডেঞ্জারাস মানুষ।পরে দেখা যাবে তোরে রিফিউজি করার অভিযোগে মেয়েটাকে খুন করে দিবি।আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না।সরি পর্যন্ত ছিলাম।বিশ্বাস কর।”
অরিত্রান একটা ফাইল সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,
—” বিশ্বাস আর তোকে! ও মাই গড!!ইম্পসিবল। ম্যানেজারকে বল এটা ঠিক করে নিয়ে আসতে।”
রিমন তিক্ত বিরক্ত হয়ে ডাকলো,
—” গার্ডস! গার্ডস! ”
দু’জন গার্ডস এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। রিমন ফাইল তাদের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
—” এটা ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যাও।”
গার্ডস বেড়িয়ে যেতেই রিমন অরিত্রানের দিকে চোখ রাখলো।অরিত্রান কাঁচের দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত শহর দেখছে।গাড়ি,ধোঁয়া,জ্যাম, মানুষ,ইত্যাদি ইত্যাদি। রিমন পিঠে হাত রেখে বললো,
—” সত্যি বলছি এবার শুধু সরি পর্যন্ত ছিলাম।”
অরিত্রান হাসলো।আগের মত তাকিয়ে বললো,
—” ওর সামনে দাঁড়ালেই কেমন যেন একটা অদ্ভুত ফিলিংস হয়।হৃৎপিন্ড তুমুল হারে শব্দ করে।মনে হয় বেড়িয়ে আসবে।মাঝে মাঝে হার্ট বিট মিস করে ফেলি।আজ যেটা সবচাইতে বেশি হয়েছে সেটা হচ্ছে ভয়!”
রিমন ভীমড়ি খেয়ে বললো,
—” ভয়!!”

—” হুম।ভয়!যদি মুখের সামনে বলে দেয় আমি আপনাকে না অরূপকে ভালোবাসি!আমি এই কথাটা নিতে পাড়তাম না।তখনই কিছু একটা করে বসতাম। তাই বলতে সাহস পেলাম না।কিসব আজেবাজে বকে চলে এলাম।হার্ট বিট এতো দ্রুত চলছিলো যে আমার মনে হচ্ছিলো দম বন্ধ হয়ে আমি মারা যাবো।রিমন!!”
অরিত্রান কাত হয়ে পিছনে তাকিয়েই অবাক।রিমন তার চেয়ারে চিৎ হয়ে হাত পা মেলে পরে আছে।অরিত্রান চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে টেবিলের গ্লাস ভর্তি পানি রিমনের মুখে ছুঁড়ে মারলো।রিমন লাফিয়ে উঠলো।অরিত্রান বিরক্তি নিয়ে বললো,
—” সেন্সলেস হওয়ার মানে কি রিমন??এখানে কি তোর সাথে মজা করছি আমি?”
রিমন চেয়ার ঘুরিয়ে বললো,
—” আমি জ্ঞান হারাবো,
মরেই যাবো,
বাঁচাতে পাড়বে না কেউ!”
তুইও না দোস্ত!!”
অরিত্রান ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
—” শেটআপ রিমন!!”
রিমন উঠে দাঁড়িয়ে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
—” তুই!আর ভয়!!ভাইরে ভাই প্রেমে পড়ে মাথাটাও গেলো না কি?ভুলে গেলি তুই অরিত্রান খান!!মাশহুর বিজনেস ম্যান অরিত্রান খান তুই!!এটা তো মনে হচ্ছে এখন আমি নিজেও ভুলতে বসেছি।”
রিমন অরিত্রানের হাতের বাহুতে একটা চিমটি কাঁটে। অরিত্রান শব্দ করে আহ্ বলে হাত ঘোঁষতে শুরু করে।চেঁচিয়ে বলে,
—” আ’র ইউ লস্টেট!!”
রিমন দ্রুত বলে,
—” সরি সরি দোস্ত আমি মনে করেছি স্বপ্ন হবে।”
—” রিমন তোর ফালতু বকা এক পাশে রেখে কাজে মন দে।তা না হলে আমি তোকে জব ছাড়া করতেও ভাববো না।
রিমন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
—” যাচ্ছি যাচ্ছি।
—” মিটিং আছে একটু পরে।সব ঠিক কর।আজ প্রেজেন্টেশন আছে তোর।গট ইট ইডিয়েট!!”
—” ইয়েস ইয়েস।
রিমন যেতে যেতে আবার পিছনে তাকিয়ে বলে,
—” প্রেমে তুই উন্মাদ হচ্ছিস দিন দিন।তুই ভয়ংকর প্রেমিক হবি বস।একদম ভয়ংকর বিজনেস টাইকুনের মত।”
অরিত্রান ঠোঁট কামড়ে হাঁসে।
______________________
খুব সকালেই আজ রোদ এসে ঢুকেছে ওয়াসেনাতের রুমে।রোদের প্রথম ঝাপটায় ঘুম ভেঙে গেলো ওয়াসেনাতের। বেশকিছু সময় বালিশটা মুখে চেপে শুয়ে থাকে ওয়াসেনাত।আজ ঘুমটা দারুন হয়েছে।একদম মনের মত।গত তিন দিনের ঘুম একসাথে এসেছে রাতে।কিন্তু মাথারা ঝিমঝিম করছে খুব।অনেক ভালো ঘুম হলেও ঝিমঝিম করে মাথা।ওয়াসেনাত উঠলো না।বালিশ মুখে গুঁজে চেঁচিয়ে ডাকলো,
—” রূপালী আপু!!!ওওও আপু!!”
রূপালী মগ ভর্তি কফি নিয়ে টেবিলে রাখলো।তারপর ওয়াসেনাতের রুমের পর্দাগুলো ঠেলে দিলো।সাদা পর্দা ঠেলে দিতেই রোদ যেন আরো আনন্দ পেলো।তারা হুরহুর করে ঢুকে পরে রুমে।রুম জুড়ে আলোর ছড়াছড়ি। ওয়াসেনাত বালিশ থেকে মুখ তুলে রূপালীর দিকে তাকিয়ে হাঁসে। রূপালীও হাসে।বিনাবাক্যে ওয়াসেনাত উঠে ফ্রেশ হয়ে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
—” বাহ্। দারুণ।”

রূপালী হাসে আর বিছানা ঝাড়ে।ওয়াসেনাত বারান্দা থেকে ঘুরে এসে বলে,
—” বাবা কই গো??”
—” উনার রুমের বারান্দায় বসে বসে খবরের কাগজ পড়ে।”
—” ওহ্ আচ্ছা আমি তাহলে যাই।”
ওয়াসেনাত পা টিপে বাবার বারান্দায় ঢুকে পরে।তৌফিক চমশা গুটিয়ে নিয়ে বললো,
—” লুকিয়ে আসার মানে কি??”
ওয়াসেনাত হেসে বললো,
—” নাথিং বাবা।শুভ সকাল!”
তৌফিক চায়ের কাপ মুখ থেকে সরিয়ে বলে,
—” তোমার সকল সকাল শুভ হোক।”
ওয়াসেনাত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
—” তাহলে তো রাত গুলো অশুভ হয়ে যাবে বাবা!”
তৌফিক হাসলো।বললো,
—” আল্লাহ্‌ আমার মেয়ের দুনিয়াটাই শুভ করুক।”
—” এবার ঠিক আছে।সাথে বাবারটাও।”
তৌফিক মেয়ের কথায় হেসে উঠে।মুখে বলে,
—” তোমার চুলগুলো খুব অগোছালো হয়ে আছে।রূপালী চিরুনি নিয়ে আয়।”
তৌফিক ওয়াসেনাতের চুলে চিরুনি করে।ওয়াসেনাত ফ্লোরে বসে আছে।এত বড় চুলের কেউ কুলকীনারা পায় না।কিন্তু বাবা ঠিকই পায় কিভাবে তা ওয়াসেনাত বুঝে না।তিনি খুব সুন্দর করে চুলগুলো দু’পাশে ভাঁজ করে। একপাশ একপাশ করে আচঁড়ে দেয়।ওয়াসেনাতের চুল ঠিক করতে সবসময় একজনের সাহায্য লাগে।বাড়িতে রূপালী আর হলে রিমি।তবুও অবস্থা খারাপ হয়।ওয়াসেনাতের এই চুল তার মা বাবা দু’জনেরই খুব প্রিয়।কখনো কাঁটতেই দেয় না।এত লম্বা চুল ওয়াসেনাতের।ছেড়ে হাঁটা অসম্ভব।গুটিয়ে রাখলে খোঁপাটা অনেক বড় হয়।এতে তার ভারী কষ্টও হয়।তবুও ক্লান্তি নেই।বাতাসে ভেসে টেবিলের উপরে থাকা কিছু ছবি ওয়াসেনাতের চুলে এসে লাগে।ওয়াসেনাত হাত দিয়ে ছবিগুলো গুটিয়ে নেয়।উপরে তুলে রাখতে যাবে তখনই ছবিগুলোতে চোখ আটকে গেলো তার।ভয়ংকর রক্তাক্ত ছবি গুলোর দৃশ্য।প্রথম ছবিটা দেখেই ওয়াসেনাত ঘাবড়ে যায়।কাঁটা মাথা,কাটা হাত,পা টাও আলাদা করা।ভয়ে আতঙ্কে চুপসে গেছে সে।কাঁটা মাথাটা দেখেই কেঁপে উঠে সে।এই ছেলেকে সে চিনে।কিছুদিন আগেই নুহাশের সাথে চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় যে ছেলেটা তার হাত চেপে ধরেছে এ তো সেই।ওয়াসেনাত মনোযোগ দিয়ে ছবি একটার পর একটা দেখে।সবগুলো ছেলেই সেদিনে।হুম সেদিনেই।চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না তার।ভয়ংকর ভাবে কেঁটে মেরেছে এঁদের। দেখেই কলিজা কাঁপে।অদ্ভুত ভাবে এদের মুখটা অক্ষত রেখেছে।যাতে চিনা যায়। ওয়াসেনাত উত্তেজিত গলায় বললো,

—” বাবা এদের এমন হলো কিভাবে??মানে কে করলো??”
তৌফিক মাথা উঁচিয়ে দেখেনেয় একবার।তারপর বলে,
—” এদের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্বে আমাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।”
—” কিভাবে মারা গেলো বাবা??”
—” কেউ এভাবে কেঁটে ফেলে রেখেছিলো পুলিশ স্টেশনে। কিছুদিন আগে।এঁদের চাপ্টার ক্লোজ করা হয়েছে কাল।”
—” খুনিকে পাওয়া গেছে??”
তৌফিক হাসলো।ওয়াসেনাত থ হয়ে বসে আছে।হাসলো কেনো??মনে হচ্ছে এটা অনেক বড় কৌতুক। ওয়াসেনাত ক্ষিপ্ত সুরে বললো,
—” হাসছ কেনো বাবা?? খুনি কে??খুঁজে পেয়েছ??”
তৌফিক ছবিগুলো নিয়ে বললো,
—” এটা সবাই জানে।শুধু প্রথমে একটু কনফিউজড হয়ে পড়েছিলো।তাই এটা নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছে আমাকে।কিন্তু যে করেছে জানার পরে সব বন্ধ। তবে এদের মৃত্যুতে আমার ভালোই লাগছে।রেপিস্ট এরা।একমাস আগে তিনটা মেয়ের রেপ করেছে।আরো অনেক কাহিনী আছে।তাদের আবার খুনও করেছে।তবে এদের যে মেরেছে সে আমাকে খুব অবাক করেছে।”
ওয়াসেনাত উৎসুক হয়ে বললো,
—” আগে বলো কে মেরেছে??খুনি কে??”
তৌফিক একটু অবাক হয়ে বললো,
—” তোমার এত উত্তেজিত হওয়ার কারন কি??”
ওয়াসেনাত চুপসে গেলো।বাবাকে বলা যাবে না এদের সাথে দেখা হয়েছে।ওয়াসেনাত ঢোক গিলে বললো,
—” তেমন কিছু না বাবা।কত জঘন্য ভাবে টুকরোটুকরো করেছে তাই জিজ্ঞাস করলাম।কে করেছে বাবা?”
তৌফিক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
—” অরিত্রান খান।তবে ওর এই ব্যাপারটা পছন্দ হয়েছে আমার।ও একটু ত্যাড়া মনে হয়। ওর এই ত্যাড়ামু আমার ভালো লাগে।দারুণ পার্সোনালিটি। অন্যায়কারী চোখে পড়লেই ডিটেক্ট খুন।তবে এদের উপরে একটু বেশিই তেজ উড়িয়েছে মনে হয়।পাঙ্গা নিয়েছে হয় তো।ধর্ষকদের প্রকাশ্যে এভাবেই টুকরোটুকরো করা উচিঁত। আ’ই লাইক ইট।ব্রেব বয়।”
তৌফিক হাসলেন।ওয়াসেনাত ছাড়া লম্বা চুলগুলো নিয়েই উঠে দাড়াঁলো।কি মারাত্মক ভয়ংকর লোক!এটাই ভাবছে সে।নুহাশ আর অরিত্রানের পার্সোনালেটির কোথাও যেনো মিল আছে।এই যেমন রহস্য! নুহাশের মাঝেও অনেক রহস্য আছে।আর এই অরিত্রানের কচু গাছের মত মানুষ কাঁটার পিছনেও আছে হয় তো অন্য রহস্যময়ি গল্প।
.
.
#চলবে____