পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 20
__________________
দুপুর ২টা বাজে প্রায়।সূর্যের প্রকাণ্ড রোদ একদম মাথার উপরে।আকাশটা সূর্যের তেজে ঝকঝক করছে।চারপাশেই মাথা ফাঁটা রোদ দৌড়ে বেড়াচ্ছে।অদ্ভুত ভাবে সে রোদের তেজ নিজের গায়ে মাখিয়ে দাড়িয়ে আছে অরিত্রান।সারাটা রাত নির্ঘুমে পার করে ভার্সিটিতে পা রেখেছিলো সে।কিন্তু ভাগ্য খুবই খারাপ ছিলো।যার জন্য ভার্সিটিতে যাওয়া সে ভার্সিটিতে নেই।খোঁজ লাগিয়ে যানতে পেরেছে সে তার বাড়িতে।তাই সেই সকাল দশটা থেকে নিজের কামধাম ফেলে সে দাঁড়িয়ে আছে পিছঢালা রাস্তায়।ঘামে ভিজে আছে গায়ের চকলেট রঙের শার্ট।গলার পিছনে, লম্বা হাতা,বুকের সামনের দিকে।এতটা কষ্ট সে জীবনে তেমন করেছে কি না মনে নেই।এই কয়েক বছরে তো সে কখনোই করেনি।রোদে প্রচণ্ড এ্যালার্জি তার।গালের দু’পাশ রৌদের তীব্র তেজে জ্বলছে তার।কিন্তু প্রকাণ্ড সূর্যের তার প্রতি কোনো দয়া নেই।সে নিজের তেজ দেখাতে ব্যস্ত। ঠিক তারই মত।সে যেমন দয়া দেখায় না।ঠিক একটুই ভাবে আজ তাকেও দয়া দেখাচ্ছেনা সূর্য।গাড়ি নিয়ে এসেছিলো।কিন্তু তা রাস্তার মোড়ের গলিতে রেখে এসেছে।এদিকে নিয়ে আসেনি। আসলে এত বড় গাড়ি এদিকে তেমন ডুকে কি না তার সন্দেহ ছিলো তাই নিয়ে আসেনি।এখন তার মনে হচ্ছে কেনো যে নিয়ে এলো না!এত রোদে তার মাথা ধপধপ করছে।শ্যামলা কপালের দু’পাশের নীল রগ লাফাচ্ছে। পানির তৃষ্ণাটা প্রচন্ড বেশি। কপাল বেয়ে চুয়ে চুয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।তবুও দাঁতমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে।চার ঘন্টা একটানা দাঁড়িয়ে তার পাগুলোও ব্যথা হয়ে উঠছে।এত সব যন্ত্রণার মাঝেও তার একটা ভালো লাগা কাজ করছে।অপেক্ষা! সে আজ পর্যন্ত কারো জন্য করেনি।এতে যে কত বিরক্তি! সে জানে ও না।তবে উপলব্ধি করতে পেরে আজ পর্যন্ত সে একটা মিনিটও তেমন কারো জন্য অপেক্ষা করে নি।কিন্তু আজ করছে।অপেক্ষার মাঝেও যে ভালো লাগা থাকতে পারে এটা আজকের এই ভয়ংকর রোদে পোড়া দিনটা না আসলে হয় তো সে বুঝতেই পারতো না।ওয়াসেনাত নামক মেয়েটা তাকে উম্মাদ করে তুলছে।তার চিন্তায় তার ঘুম হচ্ছে না।অরিত্রান নিজেকে প্রশ্ন করে,সত্যি কি আমি প্রেমে পড়েছি??আচ্ছা প্রেমে পড়লে ক্ষতি কি!অরিত্রান হাসে।এত কষ্টেও তার হাসি পাচ্ছে।রাস্তার পাশের উঁচু জায়গায় অরিত্রান নিজের প্যান্ট হালকা উঁচিয়ে বসে পরে।পিছনে দু’হাত দিয়ে সে তাকিয়ে আছে কালো গেটের দিকে।মাঝে মাঝে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।আজ তার মনে হচ্ছে সারা দিন রাত বসে থাকলেও অপেক্ষমান ব্যক্তি আসবে না।সত্যি কি আজ দেখা হবে না?অরিত্রানের মন চঞ্চল হয়ে উঠে।একবার দেখার আগ্রহ তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।পথটা নির্জন।এক দু’জন মানুষের আনাগোনা চলছে।তারা ভ্রু-জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে থাকে অরিত্রানের দিকে।দু’জন হলে আবার ফিসফিস করে কিসব বলা বলি করে।অরিত্রানের সে দিনে চিন্তা নেই।সে আছে তার অপেক্ষা নিয়ে।মেয়েটাকে নিজের সব কিছু থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেয়েও সে পারে না।সব ব্যস্ততার ভীরেও সে গুটিশুটি মেরে তার মনে কড়া নাড়ে।হাজারো ভাবনা তাকে নিয়ে বুনে ফেলে তার গম্ভীর মন।
অরিত্রানের অপেক্ষার শেষ হলো না।ওয়াসেনাতকে দেখা গেলো না।কিন্তু রাতটা গভীর হয়ে উঠেছে।অরিত্রান আর বসে থাকতে পারলো না।উঠে দাড়াতেই হলো।মনে এক ঝাঁক চাপা দীর্ঘশ্বাস তার সঙ্গী হলো।যেন কষ্টে বুকটা ভার হয়ে আসছে।মেয়েটা একটি বারো এলো না?কেনো?সে কি অরূপকে নিয়ে খুব ব্যস্ত? অরিত্রানের গুমোট মন আজ অভিমান করতে শিখেছে।শিখেছে দুঃখী হতে।আজ মনটা কেনো যেনো বড্ড দুঃখী হয়ে উঠেছে।অরিত্রান কোলম ভাবে পা ফেলে।পিছন ফিরে বার বার তাকায়।কিন্তু তাকে দেখেনা।যেতে ইচ্ছে করছে না তার।একবার জোড় করে ভিতরে ডুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে “কেনো আমার ঘুম,নাওয়া খাওয়া,মনের ব্যস্ততা সব কেঁড়ে নিয়েছ?কেনো?”অরিত্রান চেয়েও যেতে পারে না।হুট করে কারো বাড়িতে সে কি হিসেবে ডুকবে তাই ভাবে।প্রকাণ্ড এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।নিঃশ্বাস ফেলে সামনে হাঁটা দেয়।কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে তাকায়।মনটা বার বার বলছে একবার, শুধু একবার দেখা হলেই হবে।”
_________________
আজ সারাদিন ওয়াসেনাত বাড়ির বাহিরে পা রাখেনি।আজ সে নিজের হাতে রান্না করেছে।বাবার জন্য।একসাথে খেয়েছে গল্প করেছে,টিভি দেখেছে আরো কত কি।এভাবেই দিনটা পার করে দিয়েছে।রাত ১০টার দিকে তারা সবাই খাবার খেতে বসেছে।মাজিদ আর রূপালীও ছিলো।মজিদ খেতে খেতেই বললো,
—” মামা সাহেব আপনারে একটা কথা বলার ছিলো?”
তৌফিক খেতে খেতে বললো,
—” এখন না। তুমি জানো খাবার সময় কথা বলা আমি পছন্দ করি না।”
মজিদ নিচু গলায় বললো,
—” মাফ করবেন মামা।”
—” কথায় কথায় মাফ চাওয়াও আমি পছন্দ করি না।”
মজিদ নিজের সাদা সাদা দাঁত দেখিয়ে হেসে উঠে।সবাই হাসে।ওয়াসেনাত গলাটা হালকা ঝুঁকিয়ে রূপালীর কানে কানে বললো,
—” দেখো তোমার মুক্তরাজার মুক্তর মত দাঁত ঝকঝক করছে।”
রূপালী লাজুক হাসে।সে যে মজিদকে মুক্তরাজা ডাকে তা ওয়াসেনাত একদিন রুমের বাহিরে হেটে যাওয়ার সময় শুনেছে।তারপর থেকেই রূপালীর সামনে কখনো ওয়াসেনাত মজিদ ভাই ডাকে না।সবসময় মুক্তরাজা ভাই বলেই ডাকে।রূপালী বেশ লজ্জা পায় আর শুধু হাসে।
খাওয়াদাওয়া শেষে সোফায় বসেছে সবাই।রূপালী খাবার গুলো রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছিলো।ওয়াসেনাত তাকে সাহায্য করছিলো।তৌফিক খবরের কাগজ উল্টাতে উল্টাতে বললো,
—” বলো মজিদ?”
মজিদ ভাষণ দেওয়ার ভঙিতে বললো,
—” আজ একজন লোকরে বাড়ির বাহিরে ঘুরাঘুরি করতে দেখছি।দেখে ভদ্রলোকই মনে হয়।কিন্তু বাড়ির বাহিরে কি করে সেটাই বুঝলাম না মামা সাহেব?”
তৌফিকের মাথার চামড়ায় কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে।সে চিন্তায় পরে ভাবে তার জন্য কি কোনো বিপদ বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।ওয়াসেনাত টেবিল পরিষ্কার থামিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
—” কেমন দেখতে বলো তো?”
মজিদ আবার নড়েচড়ে বললো,
—” শ্যামলা হবে মুখ,তবে হাত সাদা।সূর্যের কিরনে তো মুখটা পুরা লাল হয়ে উঠেছিলো।আমি আবার কখনো শ্যামলা মানুষরে লাল হতে দেখি নাই।ওও চোখে আবার চশমাও আছে।হাতে একটা কালো ঘড়ি।চকলেট রঙ্গা শার্ট ছিলো গায়ে।মুখে চাপা দাঁড়ি।ঠোঁটজোড়া আবার লাল।”
ওয়াসেনাতের বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠে।কম্পিত হয়ে সে হালকা কেঁপে উঠে।বুকের ভিতরে হাতুরি পিটা শুরু হয়।আচ্ছা উনি কি এসেছে?”প্রশ্ন করতে গিয়েই থেমে যায় সে।কিসব বলতে বসেছে।তাও বাবার সামনে।তৌফিক মেয়ের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—” তুমি চিনো না কি??”
ওয়াসেনাত হকচকিয়ে যায়।আমতা আমতা করে বললো,
—” আ আরে না বাবা আমি কেনো চিনবো।আসলে চোর ডাকাতের চেহারার বণর্না শুনলেইত তাদের চিনা যায়।তাই জিজ্ঞেস করেছি।এই আর কি।”
কথাটা বলেই ওয়াসেনাত একপ্রকার দৌড়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরে সে।মনে হঠাৎ বাতাস লাগে।ভালো লাগার বাতাস।যদি নুহাশ আসে?ইশশ্ কেনো যে বাহিরে গেলো না আজ?কথাটা ভেবেই ওয়াসেনাতের খারাপ লাগছে।খুব খারাপ।সাথে নিজের প্রতি রাগ আর বিরক্ত তাকে ঝেঁকে ধরেছে।দুঃখটা তো ফ্রিতে আছেই।
____________________
অরিত্রান হোটেলে না ঢুকে তার সামনে থাকা সুইমিংপুলের সামনে থ মেরে দাঁড়িয়ে পরে।কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে সচ্ছ নীল পানির দিকে তাকিয়ে থাকে।অরিত্রানের নিজের এক বুক কষ্টকে এক পৃথিবী সমান কষ্ট মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব কষ্ট তার একারই।ওয়াসেনাত কি অরূপের সাথে আছে?হয় তো অরূপকে সে ভালোবাসে?সত্যি কি ওয়াসেনাতের সেই সৌভাগ্য ভালোবাসা অরূপ পাবে?অরিত্রানের মাথাটাও ভার হয়ে আসে।পায়ে হাত দিয়ে কনভার্স খুলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইমিংপুলে। পানির ঝাঁপাং শব্দে আশেপাশের হোটেল কর্মচারী,অরিত্রানের গার্ডস সহ আশেপাশের সবাই চমকে সুইমিংপুলের দিকে তাকায়।এই প্রথম তারা অরিত্রানকে এই পুলে নামতে দেখেছে।অরিত্রানের কিছুই ভালো লাগছে না।সে সুইমিং করে নিজের রাগ কমাতে চাচ্ছে। আজ সারা দিন সে অপেক্ষা করেছে।অথচ মেয়ে একটা বারও বাহিরে এলো না??ওই ছেলের জন্য এয়ারপোর্টে যেতে পেরেছে, কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে পেরেছে, আর তার জন্য সামান্য বাহিরে পা রাখতে পারলো না?ব্যাপারটা যেনো তাকে আরো ক্ষেপীয়ে তুলছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীটা থমকে গেছে।কিছুই মাথায় আসছে না।কিন্তু সে নিজেইত ওয়াসেনাতকে দূরে ঠেলতে চেয়েছে।কাল পর্যন্ত সে দেশটাই ছাড়তে চেয়েছে।আর আজ?আজ তার কেনো এত খারাপ লাগছে?কেনো? কেনো?অরিত্রান সুইমিংপুলের পানি দু’হাতে উড়িয়ে দিচ্ছে।আশেপাশের সবাই ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।রিমনকে খবর দেওয়া হয়েছে।অরিত্রানকে সবারই খুব ভয় লাগে।ঠুস ঠাস সে মানুষকে মেরে ফেলে।যেন পানি গিলার মত সহজ একটা ব্যাপার।অরিত্রান একের পর এক থাবা দিয়েই চলেছে।তার কেমন যেনো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা।তার মনে হচ্ছে ওয়াসেনাত তাকে ইগ্নোর করছে।সে কি এখনো রেগে আছে?হয় তো!অরিত্রানের বিশাল দুনিয়া হঠাৎ নিমিষে ছোট হয়েগেছে।সেই দুনিয়ার চারদিকে শুধু ওয়াসেনাত ঘুরছে!শুধু ওয়াসেনাত!অরিত্রান দ্রুতগতিতে কয়েকবার ডুব দেয়।রিমন সুইমিংপুলে পা ভিজিয়ে বসে পরে।সবাইকে ইশারায় যেতে বলে।পাশে চশমাটা ভাসছে।রিমন হাত বাড়িয়ে সেটা নেয়।অরিত্রান নিজের তর্কি স্টাইলের চুলগুলো পিছনে টেনে ধরে।কব্জির কাছের বুতাম খুলে হাতা গুটিয়ে উপরে তুলে নেয়।চোখ বন্ধ করে পুলের পাশে ঠেসে দাড়ায়।নিঃশ্বাস ফেলে কিছু।সবই দীর্ঘশ্বাস। রিমন তাকিয়ে সব কিছু নিখুঁত ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।চশমাটা চোখে লাগিয়ে হাসছে।আবার খুলে ফেলছে।অরিত্রান আবার একবার সম্পর্ন সুইমিংপুলে সাঁতার কেঁটে হাঁপিয়ে উঠে।চোখ তুলে তাকাতেই রিমনকে দেখে।দ্রুত উপরে উঠে ভিঁজা শরীরে হাঁটা শুরু করে।রিমন দৌড়ে অরিত্রানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
—” তোয়ালে নিয়ে যা।”
অরিত্রান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে টেনে তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে হোটেলের ভিতরে ঢুকে।
সোফায় বসে আছে মাদৌলি।সুইমিং করতে করতেই লন্স খুলে ফেলেছে অরিত্রান।সিঁড়ির দিকে যেতেই একজন দৌড়ে এসে বললো,
—” স্যার একটা মেয়ে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
মুহূর্তেই অরিত্রানের কপাল কুচঁকে আসে।পিছনে ঘুরে তাকিয়ে মাদৌলির দিকে তাকায়।কালো একটা শর্ট স্কার্ট পড়ে মেয়েটা বসে আছে।কাঁধ,গলা দৃশ্যমান। স্মার্ট, মডার্ন মেয়ে।অরিত্রান ভিজা গায়ে এগিয়ে যায়।মাথা মুছায় তার পূর্ন মনোযোগ। মাদৌলি হা করে তাকিয়ে দেখছে।চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে সে ডুবে যাচ্ছে।অরিত্রান খান কাছ থেকে এতটা সুন্দর তার জানা ছিলো না।আর ভিজা অবস্থায় তাকে যে আরো ভয়ংকর লাগছে সে কি জানে?অরিত্রান সামনের সোফায় বসে। নিজের বুকের উপরের দু’টো বুতাম খুলে দেয়।খুব গরম লাগছে।এভাবে না থেমে সুইমিং করায় তার এত গরম লাগছে।এসির পাওয়ার বাড়িয়ে অরিত্রান আবার নিজের মাথা মুছতে শুরু করে।রিমন এগিয়ে এসে থেমে যায়।মেয়েটাকে সে চিনি।এখানে কেনো এসেছে সেটা জানে না।উল্টাপাল্টা কিছু হলে এখনি মেরে ফেলে দিবে।অরিত্রান এই সম্পূর্ন পৃথিবীতে রিমনের সাথেই ভালো এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে।তা ছাড়া আর কাউকে সে নিজের সেই রূপের সন্ধান দেয় না।নতুন আর এক রূপ শুধু ওয়াসেনাতের নামে বরাদ্দ। সেটা তো রিমন নিজেও জানতো না।রিমন কৌতুহলী হয়ে পিছিয়ে আসে।অরিত্রান নিজের কাজের সময় কাউকে এলাউ করে না।প্রয়োজন হলে নিজেই ডেকে নিবে।মাদৌলির চোখ অরিত্রানের দিকে গোল গোল করে চেয়ে আছে।অরিত্রানের সব কিছুই তাকে ঘায়েল করে।কত ছেলেকে দেখেছে,কত ছেলের সাথে ঘুরেছে,প্রেম করেছে,কিন্তু অরিত্রান সবার উর্ধ্বে। আলাদা এর পার্সোনালিটি,এ্যাটেটিড,স্টাইল।সবই পাগল করে তুলেছে মাদৌলিকে।অরিত্রান চুল মুছতে মুছতে বললো,
—” হু আ’র ইউ??কি চাই আপনার আর কেনো এসেছেন?”
মাদৌলি যেন আরো ঘোড়ে চলে গেছে।কন্ঠটা এত সুন্দর? মিডিয়ায় সে অনেক ভিডিও দেখেছে অরিত্রানের। সেখানে অরিত্রান বক্তব্য দিয়েছে।নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।কিন্তু ইংলিশে।বাংলায় কথা বলতে এই প্রথম দেখছে।সেই কন্ঠের চাইতেও মারাত্মক বাস্তবের এই বাংলা ভাষার গলা।অরিত্রান তোয়ালে ছুঁড়ে দিয়ে সটাং হয়ে চোখ সরু করে।কঠিন একটা চাহনি দিয়ে স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করে,
—” আ’র ইউ ডুমবস/Dumbs.”
মাদৌলি হকচকিয়ে বলে,
—” না না আমি বলতে পারি।এই যে বললাম।”
অরিত্রান তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
—” কি চাই??”
মাদৌলি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বললো,
—” তোমাকে!”
অরিত্রান শান্ত ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে পরে।সোজা হাঁটা শুরু করে মাদৌলি জিভ কেঁটে পিছনে দৌড় লাগিয়ে অরিত্রানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
—” সরি সরি।আসলে আমার তোমার কাছে একটা কাজ চাই।চাকরি টাইপের।”
অরিত্রান কপাল কুঁচকে সামনে তাকিয়ে বলে,
—” নাম কি?”
মাদৌলি আবার অন্যমনস্ক হয়ে পরে।অরিত্রান শান্ত, খুবই শান্ত গলায় আবার বললো,
—” নাম কি??”
মাদৌলি দ্রুত বললো,
—” মাদৌলি।”
অরিত্রান হালকা হেসে বললো,
—” অরিত্রান খানের সম্পর্নে সম্পূর্ণ জ্ঞান না থাকলে এমন টাই হয় মিস শিকদার।”
মাদৌলি চমকে উঠে।তার বাবা যে শিকদার এটা জানলো কিভাবে।অরিত্রান সিঁড়ি বাইতে বাইতে পকেটে হাত ডুকিয়ে বললো,
—” ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ভুল।আর যাতে অরিত্রান খানের আশেপাশে না দেখি।অরিত্রান খান সবার হয় না।স্বপ্ন দেখা বোকামি।আর অরিত্রান খানকে তুমি বলার অধিকার সবাইকে দেয় না সে।সো মাইন্ড ইট মিস মাদৌলি শিকদার।আগুন নিয়ে খেলা সবাইকে মানায় না।আপনার মত মেয়ের তো আরো মানায় না।এমন আজেবাজে টাইপের অনেক মেয়ে অরিত্রানের আশেপাশে থাকে।তাকে ধারণ করতে হলে মোম হতে হবে!মোম!দেন গেটলস্ট।”
মাদৌলি রাগে ফুঁসছে।অরিত্রান কিভাবে তাকে চিনে নিলো?এটাই মাথায় আসছে না।আজেবাজে মেয়ে বলেছে তাকে?অরিত্রান খান ডেঞ্জারাস সে জানে।তবুও তার অরিত্রান খানকেই চাই।অরিত্রান খান যানে না সেও আগুন।
রিমন বিছানায় গড়াগড়ি করে হাসছে।অরিত্রানের সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সে জামা চেঞ্জ করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। রিমন এগিয় এসে বললো,
—” মাইয়াটারে ভাগাই দিলি কেন?চাকরি চাইলো আর তুই ভাগাইয়া দিলি??কি হট মাইয়া ছিলো দোস্ত!!ফিদা হওয়ার মতো।আমার যদি একজন না থাকতো পটাই নিতাম।”
অরিত্রান রাগী গলায় বললো,
—” শেটআপ রিমন। এগুলো কেমন ভাষা?মাইয়াটা,ভাগাইয়া,!একদম এসব ভাষায় কথা বলবি না।”
—” ওকে সরি দোস্ত। তার আগে বল মেয়েটাকে চিনলি কিভাবে?”
—” ওসব মেয়েদের এমনেই চিনা যায়।শিকদার গ্রুপের ট্যাগ গলায় ঝুঁলিয়ে ঘুরলে তো বাপের নামটাও চিনা যায়।আর ড্রেস দেখেই বুঝা যায় কাজের প্রয়োজন আছে কি না।যার গায়ে ৪৭হাজার টাকার ড্রেস থাকে তার চাকরির প্রয়োজন হয় না।মাদৌলি নামের একটা মেয়ের নামে গার্ডস অনেক আগেই রির্পোট করেছে।কোন মেয়ে নাকি আমাকে নিয়ে খুব খোঁজ লাগাচ্ছে।এটাই সেই মাদৌলি।”
রিমন মুগ্ধ গলায় বললো,
—” বাহ্ ভাই বাহ্ এত বুদ্ধি কই রাখছ?তুই যা খাওয়াদাওয়া করছ আমিও তো তাই খাই তাহলে এত বুদ্ধি তোর একার কেনো??আমার গুলা কই যায়??”
অরিত্রান স্বাভাবিক গলায় বলে,
—” ফালতু বকবকে।”
রিমন হাসে।রয়ে সরে অরিত্রানের কাঁধ চাপড়ে প্রশ্ন করে,
—” ওয়াসেনাতের সাথে দেখা হয়েছে?
অরিত্রান কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যায়।এরপর কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে,
—” প্রয়োজনটা কি?সে হয় তো দেখা করতে চায় না বা ভাগ্য চায় না।”
কথাটায় বড্ড কষ্ট লুকিয়ে ছিলো।রিমন ফিল করতে পেরেছে।একটা বিশাল হাসি দিয়ে সে বললো,
—” মাঝে মাঝে জোড় করে চাওয়াটা আদায় করে নিতে হয়।”
অরিত্রান থমকায়।সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বললো,
—” জোড় করবো!!”
রিমন হেসে বললো,
—” দরকার হলে তাই করবি।আল্লাহ্ সে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না যতক্ষণ সে নিজে চেষ্টা করে।তুইও চেষ্টা কর।হয় তো সফল হবি।”
রিমন রুম থেকে চলে যায়।অরিত্রান দাঁড়িয়ে থাকে নিস্তব্ধ হয়ে।কাপটা পাশে রেখে অরিত্রান রুমের কোণা কোণা খোঁজা শুরু করে।নিজের বিছানার একদম পিছনে পরে আছে “বাবলি” নামের উপন্যাসটা।ছিঁড়ে দুই খন্ড হয়ে আছে।অরিত্রান নিচে ঢুকে বইটা বের করে।দু’টি অংশ জোড়া লাগিয়ে অরিত্রান একধ্যানে তাকিয়ে থাকে বইয়ের দিকে।তারপর ফোনটার নিয়ে আবার বসে পরে।তার নতুন জীবন এই মেয়েটি।
___________________________
তিন নাম্বারটা অরিত্রানের কাছে লাকি প্রমাণিত হয়েছে।আজ তিনদিন সে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওয়াসেনাতের অপেক্ষা করেছে অধীর আগ্রহে।আজ যেন অপেক্ষার সময় ফুরিয়ে সে সফল।ওয়াসেনাতকে গেটের বাহিরে আসতে দেখে অরিত্রানের হৃৎপিন্ড দ্রুত চলাচল করেছে।আজ পর্যন্ত তার বড় বড় সফলতায়ও তার এতটা খুশি লাগে নি যতটা খুশি এখন লাগছে।ওয়াসেনাত অরিত্রানকে দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে বুঝতেই পারছে না এটা সত্য না কি?ওয়াসেনাত দু’হাতে চোখ কচকায়।দেখে সত্যি!নুহাশ সাহেব এখানে এসেছে?ভাবতেই বুকটা ধাকধাক করে শব্দ করা শুরু করে।ঠোঁট কাঁপে।আসলে এই তিন’দিন সে বাড়ির কাজে আর বাবার সাথে সময় কাটাতে এতটাই ব্যস্ত ছিলো যে গুমোট অন্ধকার, গভীর রাত বাদে এই লোকটির কথা তার তেমন মনেই পরতো না।একদম মনে পরতো না বললে ভুল হবে।মাঝে মাঝেই মনে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নড়াদিতো।ওয়াসেনাত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।যার মনে দয়ামায়া নেই, যে তার মায়ের দেওয়া ফোনটা ফেলে দিয়েছে তার জন্য এত ফিলিংস আসে কোথা থেকে সে জানে না?কেনো তাকে নিয়ে এত চিন্তা এতো ভাবনা?ধ্যৎ আর ভাববে না।ওয়াসেনাত হেঁটে যেতেই অরিত্রান নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে দৌড়ে পিছে হাটা শুরু করে।শীতল গলায় ডাকে,
—” ওয়াসেনাত বিনতে তৌফিক!! আরে দাড়াও এত দ্রুত কিভাবে হাটছো ওয়াসেনাত বিনতে তৌফিক!!”
ওয়াসেনাত থেমে পিছনে ফিরে রাগি গলায় বললো,
—” আমার সম্পূর্ণ নাম আমি জানি।বার বার ডেকে প্রমাণ করতে হবে না আমি ওয়াসেনাত বিনতে তৌফিক।”
ওয়াসেনাত আবার হাঁটা শুরু করে।অরিত্রান ও তাল মিলায়।মুখে বলে,
—” সেটা আমিও জানি।তোমাকে দেখলেই চিনা যায় প্রমাণের কি প্রয়োজন। আসলে বুঝাতে চাচ্ছি তোমার নাম কত বড়।”
রাগি চোখে পাশ ফিরে তাকায় ওয়াসেনাত।কিছু বলে না।চোখ রাঙিয়ে হাটে।অরিত্রান হালকা হাসে।জীবনে কখনো ভাবে নি এভাবে রাস্তায় দৌড়ে কারো রাগ ভাঙাবে,অভিমান কমাতে চাইবে।সবই কপাল।অরিত্রান অবাক হয়ে ভাবে,মেয়েটা বড্ড অবুঝ আর অভিমানী।অরিত্রান আবার বললো,
—” রেগে আছো?”
এবার ওয়াসেনাত থামলো।পাশে তাকিয়ে অরিত্রানের দিকে তাকালো।অরিত্রানের চোখ গভীর। ওয়াসেনাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
—” আপনি এখানে কি করছেন?”
অরিত্রান শান্ত গলায় বললো,
—” অপেক্ষা!”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক গলায় বললো,
—” কার জন্য?”
অরিত্রান চোখ সামনে নেয়।সেদিকে তাকিয়ে বলে,
—” তুমি ছাড়া আমাকে অপেক্ষা করাতে পারে এমন কেউ নেই আপাতত।”
ওয়াসেনাত চমকালো।দারুন ভাবে সে চমক মুখে ধরে রেখে বললো,
—” আমার জন্য! অপেক্ষা!”
অরিত্রান তাকালো না।কিছু বললো নাও না।সামনে তাকিয়ে আছে সে।ওয়াসেনাত উত্তর পেলো না।সে চুপ করে থাকে কিছুসময়। মৌনতা কাটিয়ে ওয়াসেনাত বলে,
—” তা কেনো??আবার কিছু একটা করে কষ্ট দেওয়ার ধান্ধা আছে নাকি?”
অরিত্রান চট করে ওয়াসেনাতের দিকে তাকালো।সাদা একটা থ্রি-পিজ পরেছে। মাথায় সাদা হিজাব।হাতে প্লাস্টার।অরিত্রানের চোখের দৃষ্টি করুন হয়ে উঠে।”সত্যি তো কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়নি সে।”ওয়াসেনাত হাঁটতে হাঁটতে বললো,
—” আপনি একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে শুধু শুধু কাঁদিয়ে ছেড়েছেন।একদম বিনা কারনে।”
অরিত্রানের বুকটা ভার হয়।ওয়াসেনাতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।কেনো যেন ফ্যাকাসে মনে হচ্ছে। সত্যি সে খারাপ।আজ বেশি বেশি সেটা উপলব্ধি হচ্ছে। অরিত্রান অনুশোচনা ভরা গলায় আস্তে বললো,
—” তুমি প্রথম মেয়ে যার কষ্টে আমি অনুতপ্ত।”
ওয়াসেনাতের কানে কথাটা হালকা এলো।সে চমকে তাকিয়ে আবার শুনার জন্য বললো,
—” কিছু একটা বলছিলেন আপনি?ভালো করে শুনি নি।আবার বলবেন?”
অরিত্রান বিব্রতবোধ করে।ওয়াসেনাত শুনতে চায় আবার।অরিত্রান কথা ঘুরিয়ে বললো,
—” কিছু বলার ছিলো।এখনো বলিনি।”
ওয়াসেনাত হতাশ গলায় বললো,
—” বলার হলে বলে চলে যান।আমার কাজ আছে।”
—” কোথাও যাচ্ছ??”
—” হুম”
অরিত্রানের মনটা খঁচখঁচ করে।ইতস্তত গলায় বলে,
—” অরূপ নামের ছেলেটার কাছে?”
ওয়াসেনাত পা চলানো বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে,অরূপকে নিয়ে এতো মাথা ব্যথা কেনো উনার?সাথে রাগও হয়।এইসব ফাউল কথা বলতে এসেছে বুঝি!জেদ দেখিয়ে বলে,
—” যার কাছে ইচ্ছে তার কাছে।এতে আপনার কি?”
অরিত্রান কিছু বললো না।কথা যেনো খুঁজেই পাচ্ছে না। ওয়াসেনাত হাঁটছে আর বিরক্তি নিয়ে পায়ে শব্দ করছে।অরিত্রান এত ভণিতা না করে বললো,
—” কিছু বলতে চাই দাড়াও।”
ওয়াসেনাত দাঁড়ালো না।অরিত্রান রেগে বাম হাত টেনে ধরে।ওয়াসেনাত চমকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।আলতো হাতে ধরেছে হাতটা।খন সময় মৌন থেকে বলে,
—” এটা আমার এলাকা মানুষ দেখলে নেগেটিভ কিছু ভাবতে পারে।”
অরিত্রান মাথা নিচু করে বলে,
—” মাঝে মাঝে নেগেটিভিটি ভালো।বলুক না কিছু নেগেটিভ কথা।কি আর বলবে!আচ্ছা বলতো কি বলতে পারে?”
ওয়াসেনাত কিছু না ভেবে বললো,
—” প্রেমিক প্রমিকা ছাড়া আর কি বলবে।”
অরিত্রানের যেন পছন্দ হলো কথাটা।হেসে বললো,
—” বলুক।”
—” কি???”
—” চেঁচাচ্ছ কেনো?বললেই হয়ে যাবে! এমন তো নয়।বন্ধুও ভাবতে পারে।”
ওয়াসেনাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
—” আপনি আমার বন্ধু??”
অরিত্রান হাত ধরে রেখেই বললো,
—” হতে চাইলে সমস্যা?”
আজ কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ডুকলো না ওয়াসেনাতের। হাত ঝাঁকিয়ে হাঁটা দিতেই অরিত্রান নিজের চুল ঠিক করতে করতে বললো,
—” সরি।”
ওয়াসেনাত পিছনে ফিরে তাকায়।চোখ বড় করে বলে,
—” হোয়াট?”
.
.
#চলবে____